Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

বড় বাড়াবাড়িতে অনরেবল মুচিরাম রায়ের রুধির শুকাইয়া আসিল। ভজগোবিন্দ ফিকিরফন্দিতে অল্প দামে অধিক লাভের বিষয়গুলি কিনিয়া দিয়াছিলেন-তাঁহার কার্য্যদক্ষতায় ক্রীত সম্পত্তির আয় বাড়িয়াছিল-কিন্তু এখন তাহাতেও অনাটন হইয়া আসিল। দুই একখানি তালুক বাঁধা পড়িল-রামচন্দ্রবাবুর কাছে। রামচন্দ্রবাবুর সঙ্কল্প এতদিনে সিদ্ধ হইয়া আসিতেছিল-এই জন্য তিনি আত্মীয়তা করিয়া মুচিরামকে এত বড় বাবু করিয়া তুলিয়াছিলেন। রামচন্দ্র অর্দ্ধেক মূল্যে তালুকগুলি বাঁধা রাখিলেন-জানেন যে, মুচিরাম কখনও শুধরাইতে পারিবে না- অর্দ্ধেক মূল্যে বিষয়গুলি তাঁহার হইবে। আরও তালুক বাঁধা পড়ে, এমন গতিক হইয়া আসিল। এই সময়ে ভজগোবিন্দ আসিয়া উপস্থিত হইল। সে শুনিয়াছিল যে, গবর্ণর প্রভৃতি বড় বড় সাহেব তাহার ভগিনীপতির হাতধরা-এই সুযোগে একটা বড় চাকরি যোটাইয়া লইতে হইবে-এই ভরসায় ছুটি লইয়া কলিকাতায় আসিলেন। আসিয়া শুনিলেন, মুচিরামের গতিক ভাল নহে। তাহার উদ্ধারের উপায় বলিয়া দিলেন।

বলিলেন, “মহাশয়, আপনি কখন তালুকে যান নাই। গেলেই কিছু পাওয়া যাইবে। তালুকে যান |”

মুচিরাম আনন্দিত হইল, ভাবিল, “তাই ত! এমন সোজা কথাটা আমার মনে আসিল না |” মুচিরাম খুশী হইয়া, ভজগোবিন্দের কথায় স্বীকৃত হইল।

চন্দনপুর নামে তালুক-সেইখানে বাবু গেলেন। প্রজাদিগের অবস্থা বড় ভাল। সে বৎসর নিকটবর্ত্তী স্থান সকলে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত-কিন্তু সে মহালে কিছু না। কখন মুচিরাম প্রজাদিগের নিকট মাঙ্গন মাথট লয়েন নাই। মুচিরাম নির্ব্বিরোধী লোক-তাহাদের উপর কোন অত্যাচার করিতেন না। আজ ভজগোবিন্দের পরামর্শে সশরীরে তথায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “আমার কন্যার বিবাহ উপস্থিত-বড় দায়গ্রস্ত হইয়াছি, কিছু ভিক্ষা দাও |” প্রজারা দয়া করিল-প্রজা সুখে থাকিলে জমীদারকে সকল সময়ে দয়া করিতে প্রস্তুত। জমীদার আসিয়াছে সম্বাদ পাইয়া, পালে পালে প্রজা টেঁকে টাকা লইয়া মুচিরাম-দর্শনে আসিতে আরম্ভ করিল। মুচিরামের চেষ্ট টাকায় পরিপূর্ণ হইতে লাগিল, কিন্তু ইহাতে আর একদিকে তাঁহার আর একপ্রকার সৌভাগ্যের উদয় হইল।

প্রজারা দলে দলে মুচিরাম দর্শনে আসে-কোন দিন পঞ্চাশ, কোন দিন ষাট, কোন দিন আশী, কোন দিন একশত এইরূপ। যাহাদের বাড়ী নিকট, তাহারা দর্শন করিয়া ফিরিয়া যায়, যাহাদের বাড়ী দূর, তাহারা দোকান হইতে খাদ্যসামগ্রী কিনিয়া একটা বাগানের ভিতর রাঁধিয়া বাড়িয়া খায়। মহালটি একে খুব বড়-মুচিরামের এত বড় জমীদারী আর নাই-তাহাতে গ্রামগুলির মধ্যে বিল খাল অনেক থাকায়, দুই চারিজন প্রজাকে প্রায় রাঁধিয়া খাইয়া যাইতে হইত। একদিন অনেক দূর হইতে প্রায় একশত প্রজা আসিয়াছে–তাহাদের বাড়ী একটা ভারি জলা পার; নিকাশ প্রকাশে তাহাদের বেলা গেল; তাহারা বাড়ী ফিরিতে পারিল না। বাগানে রাঁধাবাড়া করিতে লাগিল। রাত্রি থাকিয়া প্রাতে যাত্রা করিবে। তাহারা যখন খাইতে বসিল, সেই সময়ে নিকটস্থ মাঠ পার হইয়া অশ্বযানে, একটি সাহেব যাইতেছিলেন।

সাহেবটির নাম মীন্‌ওয়েল্। তিনি ঐ জেলার প্রধান রাজপুরুষ-ম্যাজিষ্ট্রেট কালেক্টর। সাহেবটি ভাল লোক-ন্যায়বান্-হিতৈষী এবং পরিশ্রমী। কিসে এ দেশের লোকের মঙ্গল সাধন করিবেন, সেই জন্য সর্ব্বদা চিন্তিত। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সে বৎসর ঐ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল; সাহেব দুর্ভিক্ষের তদারকে বাহির হইয়াছিলেন। নিকটস্থ কোন গ্রামে তাঁহার তাম্বু পড়িয়াছিল-তিনি এখন অশ্বারোহণে তাম্বুতে যাইতেছিলেন। যাইতে যাইতে দেখিতে পাইলেন, একটা বাগানের ভিতর কতকগুলা লোক ভোজন করিতেছে।

দেখিয়াই সহজেই সিদ্ধান্ত করিলেন, ইহারা সকলে দুর্ভিক্ষপীড়িত উপবাসী দরিদ্র লোক, কোন বদান্য ব্যক্তি ইহাদের ভোজন করাইতেছে। সবিশেষে তত্ত্ব জানিবার জন্য, নিকটে একজন চাষাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন।

চাষা অবশ্য ইংরেজি জানে না। সাহেব উত্তম বাঙ্গালা জানেন, পরীক্ষা দিয়া পুরস্কার পাইয়াছেন; সুতরাং চাষার সঙ্গে বাঙ্গালায় কথোপকথন আরম্ভ করিলেন।

সাহেব চাষাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাডিগের গ্‌ড়ামে1 ডুড়্‌বেক্কা2 কেমন আছে?” চাষা তো জানে না ডুড়্‌বেক্কা কাহাকে বলে। সে ফাঁফরে পড়িল। ডুড়্‌বেক্কা কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম হইবে, ইহা একপ্রকার স্থির হইল। কিন্তু “কেমন আছে?” ইহার উত্তর কি দিবে? যদি বলে যে, সে ব্যক্তিকে আমি চিনি না, তাহা হইলে সাহেব হয়ত এক ঘা চাবুক দিবে, যদি বলে যে, ভাল আছে, তাহা হইলে সাহেব হয়ত ডুড়্‌বেক্কাকে ডাকিয়া আনিতে বলিবে; তাহা হইলে কি করিবে? চাষা ভাবিয়া চিন্তিয়া উত্তর করিল, “বেমার আছে |”

“বেমার-Sick?” সাহেব ভাবিতে লাগিলেন, “Well, there may be much sickness without there being any scarcity-the fellow does not understand perhaps; these people are so dull-I say ডুড়্‌বেক্কা কেমন আছে-অঢিক আছে কিংবা অল্প আছে?”

এখন চাষা কিছু ভাব পাইল। স্থির করিল যে, এ যখন সাহেব, তবে অবশ্য হাকিম। (সে দেশের নীলকর নাই) হাকিম যখন জিজ্ঞাসা করিতেছে যে, ডুড়্‌বেক্কা অধিক আছে, কি অল্প আছে-তখন ডুড়্‌বেক্কা একটা টেক্সের নাম না হইয়া যায় না। ভাবিল, কই, আমরা ত ডুড়্‌বেক্কার টেক্স দিই না; কিন্তু যদি বলি, আমাদের গ্রামে সে টেক্স নাই-তবে বেটা এখনই টেক্স বসাইয়া যাইবে। অতএব মিছা কথা বলাই ভাল। সাহেব পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাডের গ্‌ড়ামে ডুড়্‌বেক্কা অঢিক কিম্বা অল্প আছে?”

চাষা উত্তর করিল, “হুঁজুর, আমাদের গাঁয়ে ভারি ডুড়্‌বেক্কা আছে |”

সাহেব ভাবিলেন, “Hump! I thought as much___” পরে বাগানে যে সকল লোক খাইতেছিল, তৎপ্রতি অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে বোজন করিল?” (উদ্দেশ্য “ভোজন করাইল”)

চাষা। প্রজারা ভোজন কোচ্ছে।

সাহেব চটিয়া, “টাহা আমি জানে-They eat, that I see-but who pays?-টাকা কাহাড়?”

এখন সে চাষা জানে যে, যত টাকা আসিতেছে, সকলই জমীদারের সিন্ধুকে যাইতেছে; সে নিজেও কিছু দিয়া আসিয়াছিল-অতএব এবার বিনা বিলম্বে উত্তর করিল, “টাকা জমীদারের |”

সাহেব। Ah! there it is; they do their duty-how it is that some people find pleasure in maligning them? জমীদারের নাম কি?

চাষা। মুচিরাম রায়।

সাহেব। কট ডিবস বোজন কড়িয়াছে?

চাষা। তা ধর্ম্মাবতার, প্রজারা, রোজ রোজ আসে, খাওয়া দাওয়া করে।

সাহেব। এ গ্‌ড়ামের নাম কি?

চাষা। চন্ননপুর।

সাহেব নোটবুক বাহির করিয়া তাহাতে পেন্সিলে লিখিলেন,

For Famine Report

“Babu Muchiram Ray, Zemindar of Chinnapur-feeds every day a large number of his ryots.”

সাহেব তখন ঘোড়ায় চাবুক মারিয়া টাপে চলিলেন। চাষা আসিয়া গ্রামে রটাইল, একটা সাহেব টাকায় আট আনা হিসাবে টেক্স বসাইতে আসিয়াছিল, চাষা মহাশয়ের বুদ্ধিকৌশলে বিমুখ হইয়াছে।

ঐ দিকে মীন্‌ওয়েল্ সাহেব যথাকালে ফেমিন্ রিপোর্টে লিখিলেন। একটা প্যারাগ্রাফ শুধু মুচিরাম রায় সম্বন্ধে। তাহাতে প্রতিপন্ন হইল যে, মুচিরাম জমীদারদিগের আদর্শস্থল। এই দুঃসময়ে অন্নদান করিয়া সকল প্রজাগুলির প্রাণরক্ষা করিয়াছে।

রিপোর্ট কমিশ্যনরীতে গেল। কমিশ্যনরের হস্ত হইতে কিছু উজ্জ্বলতর বর্ণে রঞ্জিত হইয়া-কমিশ্যনর সাহেব লেখক ভাল-গবর্ণমেণ্টে গেল। গবর্ণমেণটের এই বিবেচনা-যে যার প্রজা, সেই যদি দুর্ভিক্ষের সময়ে তাহাদের আহার যোগায়, তাহা হইলেই “দুর্ভিক্ষ প্রশ্নের” উত্তম মীমাংসা হয়। অতএব মুচিরামের ন্যায় বদান্য জমীদারদিগের সম্মানিত ও উৎসাহিত করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। তজ্জন্য বাঙ্গালা গবর্ণমেণ্ট ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেণ্টের নিকট অনুরোধ করিলেন যে, বাবু মুচিরাম রায় মহাশয়কে-পাঠক একবার হরি হরি বল-রাজাবাহাদুর উপাধি দেওয়া যায়।

ইণ্ডিয়ান গবর্ণমেণ্ট বলিলেন, তথাস্তু। গেজেট হইল, রাজা মুচিরাম রায় বাহাদুর। তোমরা সবাই আর একবার হরি বল।

————–
1 গ্রামে।
2 দুর্ভিক্ষ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
Pages ( 14 of 14 ): « পূর্ববর্তী1 ... 1213 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress