মুক্তি
পুর্নিমার রাত, দুধ সাদা জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। সমুদ্রের পাড়ে অনন্ত জলরাশি। চাঁদের কিরণে সোনালী মায়া বিছিয়ে চিকচিক করছে ঢেউয়ের তালে দুলে ওঠা জল। সোহাগী আকাশ মিশেছে সমুদ্রের কোলে। চারিদিকে কেমন নিঝুম।শুনশান। এক হাঁটু নোনা জলে সুজাতা দাঁড়িয়ে। তারও দু চোখে ভর্তি টলটলে নোনা জলরাশি গড়িয়ে পড়ছে, গাল বেয়ে চিবুক ছুঁয়ে।
পড়ন্ত গোধূলি বেলার বয়সে, সুজাতার আজ মনে পড়ছে তার একমাত্র মেয়ে স্নেহা ও স্বামী সন্দীপনের কথা। বিয়ের পর থেকেই অশান্তি, এমন কি গায়ে হাত তোলাও।
জীবনটাকে সে কতো রকম ভাবে সাজানো গোছানোর চেষ্টা করলো! কিন্তু ভাবনার মতো হলো কই? সবকিছু হয়তো ভাবনার মতো হয় না বলেই জীবন এতো রহস্যময়!একমাত্র মেয়ের স্নেহার কথা ভেবেই সে সব কিছু নিরবে সহ্য করেছে, যাতে মেয়ের পায়ের তলার জমি শক্ত হয়! সন্দীপন প্রায় বলতো, “তোমাকে কোনদিন সে ডির্ভোস দেবে না, মুক্তি দেবে না। স্বামীর নাম নিয়েই তোমাকে মরতে হবে।” আর এই ভাবেই তিল তিল করে কষ্ট দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। সুজাতার নিজেকে বড় অসহায় মনে হতো। অনন্ত আকাশের পানে চেয়ে তার মনে হতো, এতো বড় পৃথিবীতে কেই কি নেই, যে তাকে কেউ একটু বুঝবে! একটু কেউ সহমর্মি হবে! পাশে থাকবে! নাহ্ শ্বশুর বাড়ির লোকজন, আপনজন, এই দুঃসময়ে কেউ কে সে সাথে পায় নি।
সুজাতা খুব ভালো রান্না করতো আর সবাই কে রেঁধে খাওয়াতে খুব ভালো বাসতো। কিন্তু সেই রান্না তার স্বামী দিনের পর দিন ইচ্ছে করেই খেতেন না। চরম অবহেলা মুখ বুজে সহ্য করতো। সবাই যেন নীরব দর্শক চুপ করে সবাই মজা নিচ্ছে! এমন সময় সুজাতার জীবনে মেয়ে বেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর হঠাৎ আর্বিভাব! খুব অবাক হয় সুজাতা আকাশ কে দেখে। আকাশ এখন বিবাহিত,ছোট্টো তার সুখী সংসার।এই আকাশের প্রেরণায় সুজাতা রান্না হোম ডেলিভারি করে, বিভিন্ন জায়গায় খাবার পৌঁছে দিত। ফলে তার নাম পরিচিতি বাড়তে লাগলো। অনেক খাবারের অর্ডার আসতো। আজ সুজাতার আন্ডারে ২০ জন মানুষ কাজ করে, তারা তাদের সংসারে সাহায্য করে। দুমুঠো ভাত পেট পুরে খেতে পায়। এই পেশায় এসে সুজাতা বেশ কিছু টাকা রোজাগার করে আজ তার নিজের পায়ের জমি শক্ত। আজ সে স্বাধীন। কারও অধীনে নয়।
একাই সে বেরিয়ে পড়েছে, মুক্তির স্বাদ নিতে অজানা দেশ বিদেশে ঘুরবে বলে। আজ বহু বছর পর, তার স্বপ্নে দেখা কন্যাকুমারীর সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে তার অশান্ত ঢেউ এর আনাগোনা। সত্যিই কি সে মুক্তি আদৌ পেয়েছে? আজীবন সে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই তো চায় নি। পেল শধুই অবঞ্জা অবহেলা আর যন্ত্রণা। হঠাৎ সে দেখলো ঢেউ গুলো সমুদ্রের বুকে জন্ম নিয়ে বেলাভূমিতে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই ভাবে নতুন ঢেউ ক্রমশ আসছে আর হারিয়ে যাচ্ছে। সুজাতার মনে হলো এটাও একটা জার্নি। এইভাবেই মানুষের শুধু যাওয়া আর আসা,আর ভেসে চলা। হয়তো এই ভাবেই মুক্তি!
মন তার শান্ত হলো। তার দুচোখে উজ্জ্বলতা ও মুখে হাসি ফুটলো।