এয়ারপোর্টে সিদ্ধার্থ, স্নিগ্ধা, রিনি
এয়ারপোর্টে যে সিদ্ধার্থ, স্নিগ্ধা, রিনি সবাই উপস্থিত থাকবে এটা অবশ্য সন্তুও জানত না। কাকাবাবু তো আশাই করেননি। এটা নরেন ভার্মার কীর্তি, তিনি কায়রোর ইণ্ডিয়ান এমব্যাসিতে টেলেক্স পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেটা দেখে সিদ্ধার্থ নিজেই এসেছে।
কায়রোতে প্লেনটা এক ঘণ্টা থামে। বিমানও নেমে এসে একবার ওদের সকলের সঙ্গে দেখা করে চলে গেল।
রিনি সন্তুকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রে, সন্তু, কলকাতায় যখন দেখা হল, তখন তো একবারও বললি না যে, তোরা এখানে আসবি?
সন্তু গম্ভীরভাবে বলল, আমরা কখন যে কোথায় যাব, তার তো কোনও ঠিক থাকে না। আজ কায়রোতে এসেছি, পরশুই হয়তো আবার মস্কো চলে যাব।
রিনি ঠোঁট উল্টে বলল, ইশ, আর চাল মারিস না! আমরা আমরা করছিস কেন রে? তুই তো কাকাবাবুর বাহন! উনি ভাল করে হাঁটতে পারেন না, তাই তোকে সঙ্গে আনেন।
কলকাতায় থাকতে রিনি কায়রো বেড়াতে আসছে শুনে সন্তুর ঈষা হয়েছিল। এখন তার মনে হল, এইসব অবোধ মেয়ের সঙ্গে কথা বলার কোনও মানেই হয় না! সে মুখটা ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে।
সন্তুকে আরও রাগাবার জন্য রিনি বলল, তুই সেই গল্পটা জনিস না? চাষের খেতে একটা গোরুর শিং-এ একটা মশা বসেছিল। একজন লোক সেই মশাটাকে জিজ্ঞেস করল, ওহে মশা, তুমি এখানে কী করছ? মশা বলল, আমরা হাল চাষ করছি! তুই হচ্ছিস সেই মশা! হিহিহিহি।
বেশ রাগ হয়ে গেলেও সন্তুর মনে হল, রিনি এই ধরনের কথা বলছে কেন? ও কি তিলজলার সেই কেলেঙ্কারির ব্যাপারটা জেনে গেছে?
সন্তু রিনির কাছ থেকে সরে গিয়ে কাকাবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
সিদ্ধার্থদা কাকাবাবুর সুটকেসটা তুলে নিয়ে বললেন, চলুন কাকাবাবু বাড়িতে গিয়ে সব গল্প শুনব। আমার বাড়িটা খুব সুন্দর জায়গায়, আপনার পছন্দ হবে।
কাকাবাবু বললেন, তোমার বাড়ি? না, সেখানে তো আমরা যাচ্ছি না?
সিদ্ধাৰ্থদা নিরাশ হয়ে বললেন, সে কী? আমার বাড়িতে যাবেন না? কেন?
কাকাবাবু বললেন, কিছু মনে কোরো না। আমি হোটেল বুক করেই এসেছি। আমি যে ব্যাপারে এসেছি, তাতে তোমার জড়িয়ে না পড়াই ভাল। তুমি তো সরকারি কাজ করো!
তারপর তিনি সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, সন্তু, তুই গিয়ে ওদের সঙ্গে থাকতে পারিস। বিদেশে এসে কোনও চেনা লোকের কাছে তোর থাকতে ভাল লাগবে।
সন্তু মুখের এমন ভাব করল যেন সে প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষত রিনি ওরকম কথা বলার পর সে আর রিনির সঙ্গে একটা মিনিটও কাটাতে চায় না।
স্নিগ্ধাদি অনুযোগের সুরে বলল, কাকাবাবু, আপনি যাবেন না? আমি আপনাদের জন্য চিংড়ির মালাইকারি রান্না করে রেখেছি। কত কষ্টে জোগাড় করলুম চিংড়ি…
কাকাবাবু এবারে হালকা গলায় বললেন, তুমি কী করে জানলে ঐ জিনিসটা আমার সবচেয়ে ফেভারিট? ঠিক আছে, সন্ধেবেলা গিয়ে খেয়ে আসব! কিন্তু উঠতে হবে হোটেলেই।
ওয়েসিস হোটেলটি বিশেষ বড় নয়। শহর ছড়িয়ে একটু বাইরের দিকে। গরমকাল বলে এই সময়ে টুরিস্টদের ভিড় নেই, হোটেল প্রায় ফাঁকা। সিদ্ধার্থ স্নিগ্ধা আর রিনি সন্তুদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে একটু পরে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কথা হল যে, সন্ধেবোলা সিদ্ধার্থ আবার এসে ওদের নিয়ে যাবে বাড়িতে।
কাকাবাবু ঘর থেকেই দুতিনটে টেলিফোন করলেন। তারপর তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সন্তুকে বললেন, তুই চান-টান করে নে। আজ দুপুরে আমরা ঘরেই খেয়ে নেব। দুপুরে যা চড়া রোদ ওঠে, বাইরে বেরুনোই যায় না।
গরমে সন্তুর গা চ্যাটচ্যাট করছিল, সে ঢুকে গেল বাথরুমে। সেখানকার জানলা দিয়ে দেখল, রাস্তা দিয়ে ট্রলি বাস চলছে। ঐটাই যা নতুনত্ব, নইলে কায়রো শহরটাকে বিদেশ বিদেশ মনে হয় না, ভারতবর্ষের যে-কোনও বড় শহরেরই মতন। ইজিপ্ট দেশটা যদিও আফ্রিকার মধ্যে, কিন্তু এখানে কোনও মানুষ নেই। বর্তমান ইজিপ্টের অধিবাসীরা জাতিতে আরব।
স্নান সেরে বেরিয়ে এসে সন্তু দেখল, কাকাবাবু তাঁর নোটবুকে কী সব লিখছেন। সন্তু চুল আচড়াতে শুরু করতেই জরজায় ঠক ঠক শব্দ হল। কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকালেন।
সন্তু দরজা খুলতেই একজন মাঝারি চেহারার লোক জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ রাজজা রায়চৌধারি হিয়ার?
কাকাবাবু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, মান্টো? কাম ইন! কাম ইন?
লম্বা লোকটি প্রায় ছুটে এসে কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরলেন। একেবারে দৃঢ় আলিঙ্গন। তারপর কোলাকুলির ভঙ্গি করে তিনি সরে দাঁড়ালেন।
এই গরমেও ভদ্রলোক একটা আলখাল্লার মতন পোশাক পরে আছেন। মাথায় ফেজ টুপি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। দাড়ি-গোঁপ কামানো।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন আলি সাদাত মান্টো, কায়রো মিউজিয়ামের কিউরেটর, আমার পুরনো বন্ধু।
মান্টো ইংরিজিতে বললেন, রায়চৌধারি, তুমি যে এই সময় কায়রোতে এসেছ, তা শুনে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। প্রথমে। তুমি কী কাণ্ড করেছ? জানো, এখানকার সব কাগজে তোমার কথা বেরিয়েছে?
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? তা হলে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছি বলো! কী লিখেছে কাগজে আমার সম্পর্কে?
মান্টো একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে বললেন, খুব গুরুতর অভিযোগ। এখানকার এক বিখ্যাত নেতা মুফতি মহম্মদ চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। সেখানে তিনি কয়েকদিন আগে হঠাৎ মারা যান। শেষ মুহূর্তে তিনি যে উইল করে যান, তুমি নাকি সেটা চুরি করেছ।
কাকাবাবু অট্টহাসি করে উঠে বললেন, ওরে বাবা রে, একেবারে চোর বানিয়ে দিয়েছে?
মান্টোর মুখ গভীর। তিনি বললেন, হাসির ব্যাপার নয়, রায়চৌধারি! এখানে হানি আলকাদি নামে একজন জঙ্গি নেতা আছে। সে দাবি জানিয়েছে। যে, ভারত সরকারের ওপর চাপ দিয়ে তোমাকে এখানে ধরে আনাতে হবে। আর তুমি নিজেই এখানে চলে এসেছ? তোমার কতটা বিপদ তা বুঝতে পারছ না?
কাকাবাবু তবু হালকা চালে বললেন, উইল যদি আমি চুরি করেই থাকি, তা হলে ভারতবর্ষে বসে থেকে লাভ কী? মুফতি মহম্মদের বিষয়-সম্পত্তি সব কিছু তো। এদেশেই। তাই না?
রায়চৌধারি, তুমি গুরুত্ব বুঝতে পারছি না। হানি আলকাদি অতি সাঙ্ঘাতিক লোক। তার দলের ছেলেরা খুব গোঁড়া, নেতার হুকুমে তারা যা খুশি করতে পারে।
মান্টো, তুমি বিশ্বাস করো যে, আমি কারুর উইল চুরি করতে পারি?
না, না, না, আমি সে-কথা ভাবব কেন? তোমাকে তো আমি চিনি! তা ছাড়া মুফতি মহম্মদের উইল নিয়ে তুমি কী করবে? আসলে কী হয়েছে বলো তো?
তার আগে তুমি আমার দুএকটা প্রশ্নের উত্তর দাও! মুফতি মহম্মদ লেখাপড়া জানতেন না, একথা ঠিক তো?
হ্যাঁ, তা ঠিক। উনি কোনওদিন স্কুল-কলেজে যাননি, পড়তে বা লিখতে জানতেন না। তবে জ্ঞানী লোক ছিলেন।
উইল লেখার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। অনেকদিন ধরে ওঁর গলার আওয়াজও একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাহলে উইল তৈরি হল কী করে?
তাও তো বটে?
এ সম্পর্কে তোমাদের কাগজে কিছু লেখেনি?
না, কিছু লেখেনি। তবে হানি আলকাদি অভিযোগ করেছে যে, আল মামুন নামে এক ব্যবসায়ী তোমার সঙ্গে মুফতি মহম্মদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তারপর তুমি ঐ কাণ্ডটা করেছ!
মান্টো, তোমাকে আমি আসল ঘটনোটা পরে বলব। তার আগে তুমি মৃত্যুঃ মুহম্মদ সম্পর্কে কী জানো আমাদের বলে তো। তুমি কি ওঁকে চিনতে?
হ্যাঁ, ইজিপ্টে তাঁকে কে না চেনে। ওঁর বয়েস হয়েছিল একশো বছর।
আমি শুনেছি সাতানব্বই।
তা হতে পারে। ওঁর জীবনটা বড় বিচিত্র। খুব গরিবঘরের সন্তান ছিলেন। ওঁর যখন সাত বছর বয়েস, তখন ওঁর বাবা আর মা দুজনেই মারা যান। সাত বছর বয়েস থেকে উনি রাস্তায় ভিক্ষে করতেন। একটু বড় হয়ে ওঠার পর শুরু করেন কুলিগিরি। তারপর তিনি হলেন বিদেশি ভ্ৰমণকারীদের গাইড। ইংরেজ আর ফরাসিরা যখন বিভিন্ন পিরামিডো ঢুকে ভেতরের জিনিসপত্র আবিষ্কার করতে শুরু করেন, সেই সময়ে তিনি অনেক অভিযানে ওদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। লেখাপড়া না শিখলেও উনি ভাঙা ভাঙা ইংরিজি আর ফরাসি বলতে পারতেন। আর ওঁর গানের গলাও নাকি ছিল খুব সুন্দর। এই সময় ওঁর অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। কিন্তু উনি ওখানেই থেমে থাকলেন না। গাইডের কাজ ছেড়ে দিয়ে উনি যোগ দিলেন একটা বিপ্লবী দলে। তখন ইজিপ্টের রাজা ছিলেন ফারুক। তুমি তো জানো, রাজা ফারুককে সরিয়ে দেবার জন্য এখানকার বিপ্লবীরা কত মরিয়া হয়ে উঠেছিল। মুফতি মহম্মদ হয়ে উঠলেন একটা প্রধান বিপ্লবী দলের নেতা।
কাকাবাবু সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, সন্তু, তুই রাজা ফারুকের নাম শুনেছিস? রাজত্ব হারাবার পর এই ফারুক বলেছিলেন, এরপর পৃথিবীতে আর মোটে পাঁচজন রাজা থাকবে। তাসের চারটে রাজা আর ইংল্যাণ্ডের রাজা! হ্যাঁ, মান্টো তারপর বলে?
মান্টো বললেন, রাজা ফারুককে যে রাজত্ব ছেড়ে পালাতে হয়, তার পেছনে মুফতি মহম্মদের দলের অনেকটা হাত ছিল। রাজা ফারুকের পর এলেন জেনারেল নেগুইব। অনেকে তখন দাবি তুলেছিল যে, মুফতি মহম্মদেরই উচিত এ দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া। মুফতি মহম্মদ নিজে তা কিছুতেই হতে চাননি, তিনি বলতেন যে, তিনি এক সময় রাস্তায় ভিক্ষে করতেন, রাস্তাতেই তাঁর স্থান। এর পর জেনারেল নাসের যখন প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন মুফতি মহম্মদ ঘোষণা করলেন যে, নাসেরই সুযোগ্য ব্যক্তি, আর বিপ্লব আন্দোলন চালাবার দরকার নেই। রাতারাতি তিনি সব কিছু ছেড়ে ফকিরের পোশাক পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। তারপর আর কোনওদিন তিনি বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। মানুষকে সৎপথে চলার উপদেশ দিতেন, নিজেও খুব সাধারণভাবে দিন কাটাতেন। দেশের মানুষ তাঁকে একজন সর্বত্যাগী মহাপুরুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করত।
কাকাবাবু বললেন, আমাদের দেশের শ্ৰীঅরবিন্দের মতন। উনিও আগে বিপ্লবী ছিলেন, পরে সাধক হয়ে যান। মুফতি মহম্মদ কি কোনও আশ্রম করেছিলেন বা ওঁর অনেক বিষয়সম্পত্তি ছিল?
মান্টো বললেন, না, না, সেসব কিছু না। ওঁর অনেক ভক্তশিষ্য ছিল বটে। কিন্তু উনি নিজেকে বলতেন ফকির। ওঁর নিজস্ব কোনও সম্পত্তিই ছিল না।
তা হলে একজন ফকিরের উইল নিয়ে এত মাথা-ফাটাফাটি কেন? ফকিরের আবার উইল কী? অথচ আল মামুন সেই উইলের জন্যই আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল। হানি আলকাদি আমার মুণ্ডু চাইছে। এটা তো বড় আশ্চর্য ব্যাপার
তার কারণ আছে, রায়চৌধারি! মুফতি মহম্মদ এক সময় একটা বড় বিপ্লবী দলের নেতা ছিলেন। হঠাৎ সেই দল ভেঙে দেন। একটা বিপ্লবী দল চালাতে গেলে প্রচুর টাকা আর অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডার রাখতে হয়। মুফতি মহম্মদের দলেও সেরকম টাকা আর অস্ত্র ছিল। অনেকেরই প্রশ্ন, সেগুলো কোথায় গেল? তিনি নিজে কিছুই ভোগ করেননি। এখনও কয়েকটা বিপ্লবী দল এদেশে আছে, তুমি জানো নিশ্চয়ই। এই তো সেদিন এই রকম একটা দলের লোকেরা প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে খুন করেছে। আমি তোমাকে চুপিচুপি বলছি, আমার ধারণা, ঐ হানি আলকাদির দলের লোকেরাই এই খুনটা করেছে। তাহলেই বুঝতে পারছি, ওরা কত সাঙ্ঘাতিক!
তুমি চিন্তা কোরো না, মান্টো। হানি আলকাদি আমাকে এখন খুন করবে না, যদি তার একটুও বুদ্ধি থাকে।
তুমি এত নিশ্চিত হতে পারছি কী করে জানি না। আচ্ছা, এবার বলো তো, মুফতি মহম্মদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী? তুমি তাঁর উইল চুরি করেছ, এরকম কথা উঠছে কেন?
তুমি বললে, মুফতি মহম্মদ লেখাপড়া জানতেন না। তুমি কি জানো, তিনি হিয়েরোগ্লিফিকস ভাষা জানতেন?
মান্টে যেন হতবাক হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কাকাবাবুর দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, আমি নিজেই তো ঐ ছবির ভাষার পাঠোদ্ধার করতে পারি না। তবে, আমি তোমার কথা একেবারে অবিশ্বাস করতে পারছি না। মনে পড়ছে যেন, বছর চল্লিশেক আগে মুফতি মহম্মদ একটা পিরামিডের ভেতরের লিপির মানে এক সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়ে অবাক করে দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য অনেকে ভেবেছিল, উনি আন্দাজে বলেছেন। উনি তা হলে ঐ ভাষায় উইল রচনা করে গেছেন?
না। মুফতি মহম্মদ কোনও উইল করে যাননি। অন্তত আমি সে রকম কিছু জানি না। মৃত্যুর আগে উনি ওঁর শেষ একটা ইচ্ছে কাগজে ছবি একে বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন। সেটা আমি খানিকটা ধরতে পারি। ওঁর সেই শেষ ইচ্ছেটা এতই অদ্ভুত যে, আমি বেশ অবাক হয়েছিলুম। তাতে টাকা পয়সার কোনও ব্যাপারই নেই। আমি ছবি এঁকে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, আমি যা বুঝেছি তা সঠিক কি না। উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীবাদ করলেন, তারপর ছবি
একে জানালেন যে, আমি আগে নিজে যাচাই না করে যেন কারুকে না বলি!
যাচাই করা মানে? কী যাচাই করবে?
সেটা যাচাই না করে তো বলা যাবে না। যাক, সে-সব পরে জানতে পারবে। এখন অন্য কথা বলা যাক। তোমার বাড়ির খবর কী? বৌদি কেমন আছেন! তোমার ছেলে-মেয়ে কাটি হল?
দুএকটা সাধারণ কথার পর মান্টো আবার বললেন, রাজুজ রায়চৌধারি, আমি তোমার সম্পর্কে সত্যি চিন্তিত। হানি আলকাদি তোমার ওপর রেগে আছে, আর তুমি এরই মধ্যে কায়রো এসে পড়েছ! যদি টের পেয়ে যায়…
কাকাবাবু বললেন, আবার ওই কথা! ছাড়ো তো! শোনো, তোমাকে আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলুম…রানি হেটেফেরিস-এর মমি কি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে?
মান্টো চমকে উঠলেন। তারপর তাঁর চোখে শ্ৰদ্ধার ভাব ফুটে উঠল। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, তুমি এটাও জানো! রানি হেটেফেরিসের মমি তার সারকোফেগাসের মধ্যে এক-একবার দেখা গেছে, আবার উধাও হয়ে গেছে। সবাই বলত সেটা অলৌকিক ব্যাপার। বছর তিরিশেক ধরে অবশ্য সেই মমি আর দেখতে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ তুমি এই প্রশ্ন করলে?
কাকাবাবু হেসে বললেন, এমনিই। প্লেনে আসবার সময় সন্তুকে ঐ গল্পটা বলছিলুম কি না। তাই ভাবলুম, ও নিশ্চয়ই শেষটা শুনতে চাইবে। তিরিশ বছর ধরে রানির মমি আর দেখতে পাওয়া যায়নি?
মান্টো কিছু উত্তর দেবার আগেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হল। একজন কেউ বলল, রুম সার্ভিস। ইয়োর লাঞ্চ ইজ রেডি স্যার
সন্তু দরজা খুলতেই হোটেলের বেয়ারার বদলে তিনজন সশস্ত্ৰ লোক তাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এল। একজন দাঁড়াল দরজায় পিঠ দিয়ে। অন্য দুজন লম্বাটে ধরনের রিভলভার তুলে ধরল। ওদের দিকে।
মিউজিয়ামের কিউরেটার মান্টোর মুখখানা ভয়ে একেবারে বিবৰ্ণ হয়ে গেল। দিনদুপুরে হোটেলের কামরার মধ্যে যে এরকম গুণ্ডামি চলতে পারে, তা তিনি যেন কল্পনাই করেননি কোনওদিন। এরা এসেছে। যখন, নিশ্চয়ই খুন করে ফেলবে! এদের তিনজনেরই গায়ে খাকি জামা, একজনের গলায় একটা স্কার্ফ বাঁধা।
দরজায় ঠেস দেওয়া দলপতি ধরনের চেহারার লোকটি মান্টেকে বলল, ইউ কিপ কোয়ায়েট। উই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ!
কাকাবাবু একটুও বিচলিত না হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি হানি আলকাদির লোক? সে কোথায়?
গলায় স্কার্য্য-বাঁধা লোকটি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমরা এখানে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে আসিনি। হুকুম করতে এসেছি। প্রফেসার, পায়ে জুতো পরে নাও, আমরা তোমাকে নিয়ে যাব।
কাকাবাবু বললেন, প্রফেসার? কে প্রফেসার? আমি তো প্রফেসার নই। তোমরা ভুল জায়গায় এসেছি।
লোকটি পকেট থেকে একটা ফোটো বার করে দেখিয়ে বলল, না। আমাদের ভুল হয়নি। নাউ, গেট গোয়িং!
কাকাবাবু বললেন, ই, পাকা কাজ! শোনো, আমাকে ওরকমভাবে হুকুম দেওয়া যায় না। আমার এখন এখান থেকে যাবার ইচ্ছে নেই। হানি আলকাদির সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই, তাকে এখানে ডেকে নিয়ে এসো, আমরা একটা জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব?
একজন লোক রুক্ষভাবে কাকাবাবুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, আরে ল্যাংড়া, চলশিগগির
কাকাবাবুর চোয়াল কঠিন হয়ে গেল। চোখে জ্বলে উঠল আগুন। তিনি মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন লোক তিনটিকে। তারপর তীব্র গলায় বললেন, দিল্লিতে আমার ওপর তিনবার অ্যাটেমাট হয়েছিল, এখানেও দিনের বেলা গুণ্ডামি করতে এসেছি। তোমরা ভেবেছ কী? আমাকে চেনো না তোমরা
দুহাতের ক্রাচ দুটো তুলে তিনি বিদ্যুৎ-গতিতে মারলেন দুজন লোকের হাতে। তাদের হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল, দুজনেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। মান্টে ভয়ের চোটে মাটিতে বসে পড়লেন। সন্তু একটা রিভলভার তুলে নেবার চেষ্টা করতেই দরজায় ঠেস-দেওয়া তৃতীয় লোকটি শান্ত গলায় বলল, স্টপ দ্যাট ফানি বিজনেস। আই উইল শুটি টু কিল!
কাকাবাবু সেই লোকটির একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, করো তো গুলি, দেখি তোমার কত সাহস! আমায় গুলি করলে তোমার নিজের মাথা বাঁচবে? হানি আলকাদি আমাকে জ্যান্ত অবস্থায় চায়। আমাকে মেরে ফেললে সে কিছুই আর জানতে পারবে না।
তৃতীয় লোকটি বলল, হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, তোমাকে জ্যান্ত অবস্থাতেই নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তুমি যদি যেতে অস্বীকার করে তা হলে তোমার পায়ে গুলি করে তোমার আর একটা পাও খোঁড়া করে দিতে কোনও অসুবিধে নেই। তুমি তাই চাও?
মাটিতে বসে থাকা অবস্থায় মান্টো বললেন, রায়চৌধারি, প্লিজ মাথা গরম কোরো না! ওরা যা বলে তাই-ই করো। ওদের কথা মেনে নাও
তৃতীয় লোকটি বলল, প্রফেসার, তুমি ভালভাবে চলে এসো আমাদের সঙ্গে। তোমার কোনও ক্ষতি করা হবে না।
কাকাবাবু বললেন, সেটা ভদ্রভাবে আমাকে আগে অনুরোধ করলেই পারতে। ঘরে ঢুকে গুণ্ডার মতন রিভলভার ওঁচালে কেন? তোমরা গুণ্ডা না বিপ্লবী? তোমাদের দেশে আমি অতিথি হয়ে এসেছি, হানি আলকাদির উচিত ছিল নিজে এসে আমার সঙ্গে দেখা করা।
তৃতীয় লোকটি অনুচ্চ গলায় হেসে উঠে বলল, তুমি সত্যি একজন অদ্ভুত লোক, তা স্বীকার করছি। হানি আলকাদির নাম শুনলেই সবাই ভয় পায়, আর তুমি তাকে ধমকাচ্ছ!
কাকাবাবু বললেন, তাকে আমার ভয় পাবার কোনও কারণ নেই। আমি একজন ভারতীয় নাগরিক, আমার গায়ে হাত তুললে এ-দেশের সরকার হানি আলকাদিকে ছাড়বে না। .
এখন কথা কাটাকাটি করার সময় নেই। তুমি এক্ষুনি চলে আমাদের সঙ্গে।
কাকাবাবু সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, কোনও ভয় নেই, সন্তু। আমি আজ রাত্তিরের মধ্যে যদি না ফিরি, তা হলে তোকে খবর পাঠাব। যদি কোনও খবর না পাস, তা হলে সিদ্ধার্থকে বলবি এখানকার হোম ডিপার্টমেন্টে খবর দিতে।
মান্টেকে বললেন, আমার জন্য কিছু চিন্তা কোরো না, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
তৃতীয় লোকটি সন্তুদের বলল, আমরা এখান থেকে চলে যাবার দশ মিনিটের মধ্যে ঘর থেকে বেরুবে না। পুলিশে খবর দিয়ে কোনও লাভ নেই। তোমার আংকেলের খবর আমরা যথাসময়ে জানিয়ে দেব!
ওরা বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজায় হুড়কে লাগিয়ে দিল।
মান্টে উঠে এসে সন্তুকে ধরে বললেন, বাপ রে বাপ! তিন তিনটে রিভলভার। আমি আগে কক্ষনো এরকম দেখিনি। যদি একটা থেকে গুলি ফশকে-ৰেরিয়ে আসত! তোমার আংকল কী সাংঘাতিক লোক! আমার এখনও পা কাঁপছে?
কাকাবাবু যে ক্রাচ দিয়ে দুটো রিভলভারধারীকে হঠাৎ অমন মারতে শুরু করবেন, তা সন্তু এক মুহূর্ত আগেও বুঝতে পারেনি। কাকাবাবুর অমন রুদ্র মূর্তি সে দেখেনি কখনও আগে। এখনও তার বুক ধড়াস ধড়াস করছে।
এরই মধ্যে সন্তু ভাবল, এখন কী করা যায়? কাকাবাবুকে নিয়ে ওরা সিঁড়ি দিয়ে নামছে, টেলিফোন তুলে হোটেলের রিসেপশনিস্টকে সে-কথাটা জানিয়ে দিলে হয় না?
সন্তু সে-কথা মান্টোসাহেবকে বলতেই তিনি সন্তুর হাত চেপে ধরে বললেন, খবদার, ওরকম কিছু করতে যেও না। ওরা যা বলে গেল, তা-ই শুনতে হবে। তুমি জানো না। ওরা কত নিষ্ঠুর। ঘরে ঢুকেই কেন যে ওরা গুলি চালাতে শুরু করল না, তাতেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। সেটাই ওদের স্টাইল। ওরা কারুকে কোনও কথা বলার সুযোগ দেয় না।
সঙ্গুর গলা শুকিয়ে গেছে। সে জলের বোতল নিয়ে ঢকঢ়ক করে অনেকটা छलcथहश निब्न।
তারপর খানিকটা চাঙ্গা হয়ে নিয়ে বলল, কাকাবাবু জানতেন, ওরা গুলি করবে না। বুঝলেন না, সব জিনিসটাই রয়েছে কাকাবাবুর মাথার মধ্যে। উনি নিজে থেকে না বললে কেউ ওঁর কাছ থেকে জোর করে কথা বার করতে পারবে না?
মান্টো বিরক্তভাবে বললেন, আিৰ্হঃ! কী যে ঝঞ্ঝাট! এসো, বিছানায় বসে থাকি, দশ মিনিট কাটুক। দিনের বেলা হোটেলের ঘর থেকে একজনকে ধরে নিয়ে গেল? ছি, ছি, ছি, কী যে হয়ে গেল দেশটা। দশ মিনিট বাদে আমাদের এই ঘর থেকে কে বার করবে? যদি কেউ এসে দরজা খুলে না দেয়?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মিঃ মান্টো, আপনি হানি আলকাদিকে নিজের চোখে দেখেছেন কখনও?
না। দেখিনি, দেখতেও চাইনা! তবে কাগজে ছবি দেখেছি অবশ্য!
আমার ভয় হচ্ছে। কাকাবাবুকে কেউ হুকুমের সুরে কথা বললে উনি কিছুতেই তা শুনতে চান না। সেইজন্য। ওরা রাগের মাথায় যদি কাকাবাবুকে কিছু করে বসে।
তোমার কাকাবাবুর উচিত ছিল এরকম কাজের ভার না নেওয়া! মুফতি মহম্মদের শেষ ইচ্ছে কী ছিল, তা যাচাই করে দেখা ওঁর কী দরকার। আচ্ছা, ইয়ংম্যান, তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জানো মুফতি মহম্মদের শেষ ইচ্ছে কী ছিল? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
সন্তু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ককাবাবু আমাকে কিছু বলেননি। তবে আমি অনেকটা আন্দাজ করেছি। কিন্তু মাফ করবেন, আমার আন্দাজটাও আমি আপনাকে এখন জানাতে পারব না।