Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মিশর রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 3

মিশর রহস্য || Sunil Gangopadhyay

প্লেনে চড়া সন্তুর পক্ষে নতুন কিছু নয়, তবে আগে কখনও সে একা কোথাও যায়নি। এয়ারবাস-ভর্তি লোক, একজনও সন্তুর চেনা নয়। বেশ কয়েকজন বিদেশিও রয়েছে।

সময় কাটাবার জন্য সন্তু একটা বই এনেছে সঙ্গে, কিন্তু বই পড়ায় মন বসছে না। সে যাত্রীদের লক্ষ করছে। বিমানটা আকাশে ওড়ার খানিক পরেই অনেকে সিট বেল্ট খুলে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। কারুর কারুর ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয় প্লেনে চড়া তাঁদের কাছে একেবারে জলভাত। মিনিবাসে চেপে রোজ অফিসে যাবার মতন প্লেনে চেপে রোজ দিল্লি বা বোম্বে যান।

কয়েকদিন আগেই শ্ৰীনগরে একটা প্লেন হাইজ্যাকিং হয়েছে। এয়ারপোর্টে বাবা এ সন্তুকে পৌঁছে দিতে, তিনি বারবার ঐ কথা বলছিলেন। বাবা ভয় পাচ্ছিলেন, হঠাৎ যদি প্লেনটা হাইজ্যাকিং হয়ে কোনও বিদেশে চলে যায়, তাহলে সন্তু এক-একা কী করবে!

সন্তুর কিন্তু হাইজ্যাকিং সম্পর্কে মোটেই ভয় নেই। বরং মনে-মনে একটু ইচ্ছে আছে, সেরকম একটা কিছু হলে মন্দ হয় না! এখন সে যাত্রীদের মুখ দেখে বোঝবার চেষ্টা করছে, এদের মধ্যে কেউ কেউ কি হাইজ্যাকার হতে পারে? বাথরুমের কাছে তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, ওদের মধ্যে দুজনের মুখে দাড়ি, একজন পরে আছে একটা চামড়ার কোট। ওরা যে-কোনও মুহূর্তে রিভলভার বার করতে পারে। চোখের দৃষ্টিও বেশ সন্দেহজনক!

আধঘণ্টার মধ্যেও কিছুই হল না। সন্তু জানলা দিয়ে বাইরে দেখতে লাগল। পাতলা-পাতলা মেঘ ছাড়া আর কিছুই দেখবার নেই। মেঘের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছি ভাবলেই মনটা কী রকম যেন হালকা লাগে।

সন্তু একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ মাইক্রোফোনে কিছু একটা ঘোষণা হতেই সে দারুণ চমকে উঠল। তাহলে কি এবারে শুরু হল নাটক?

না, সেসব কিছু না। যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে সবাইকে সিটবেল্ট বেঁধে নিজের নিজের জায়গায় বসতে। বাইরে ঝড় হচ্ছে।

সন্তু মুখ ফিরিয়ে সেই সন্দেহজনক চরিত্রের তিনটি ছেলেকে দেখতে পেল না! জানলা দিয়ে তাকালেও বাইরে ঝড় বোঝা যায় না।

শেষ পর্যন্ত প্লেন হাইজ্যাকিংও হল না, ঝড়ের জন্য কিছু বিপদও ঘটল না। বিমানটি নিরাপদে এসে পৌঁছল দিল্লিতে।

প্লেন থেকে নেমে সন্তু লাউঞ্জে এসে দাঁড়াবার একটু পরেই পাইলটের মতন পোশাক-পরা একজন লোক এসে বলল, এসো আমার সঙ্গে।

সন্তু একটু অবাক হল। লোকটিকে সে চেনে না। লোকটি তার নামও জিজ্ঞেস করল না। কিন্তু লোকটি এমন জোর দিয়ে বলল কথাটা যে, অমান্য করা যায় না। সন্তু চলল তার পিছু-পিছু।

লোকটি একেবারে এয়ারপোর্টের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সন্তু বলল, আমার সুটকেস? সেটা নিতে হবে যে!

লোকটি বলল, হবে। সব ব্যবস্থা হবে।

বাইরে আর-একজন লোককে আঙুলের ইশারায় ডেকে সেই পাইলটের মতন পোশাক-পরা লোকটি বলল, একে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসাও, আমি ওর সুটকেসটা পাঠিয়ে দিচ্ছি!

সন্তু এবারে বলল, দাঁড়ান। আপনারা কার কাছ থেকে এসেছেন? আমার নাম কি আপনারা জানেন?

প্রথম লোকটি এবারে মুখ ঘুরিয়ে চার দিকটা দেখে নিয়ে বলল, নাম-টাম বলার দরকার নেই। তোমাকে তোমার কাকাবাবুর কথামতন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। চট করে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে।

কাকাবাবুর কথা শুনে সন্তু আর আপত্তি করল না। দ্বিতীয় লোকটির সঙ্গে গিয়ে একটা ফিয়াট গাড়িতে উঠে বসল। একটুক্ষণের মধ্যেই সুটকেসটা দিয়ে গেল একজন, গাড়িটা স্টার্ট নিল।

অনেকদিন আগে কাশ্মীর যাওয়ার পথে সন্তুরা দিল্লিতে নেমেছিল একদিনের জন্য। সেবারে দিল্লি ভাল করে দেখা হয়নি। দিল্লিতে কত কী দেখার আছে। কিন্তু এখন রাত হয়ে গেছে, রাস্তার দুপাশে বিশেষ কিছু চোখে পড়ছে।

গাড়িতে যে লোকটি সঙ্গে চলেছে, সে একটাও কথা বলেনি সন্তুর সঙ্গে। বাঙালি কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না।

সন্তু নিজে থেকে যেচে কথা বলতে পারে না অপরিচিত লোকের সঙ্গে। সে-ও চুপ করে রইল। কিন্তু একটু যেন অস্বাভাবিক লাগছে। সে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে না পৌঁছতেই যেন তাড়াহুড়া করে নিয়ে আসা হল তাকে। পাইলটের মতন পোশাক পরা লোকটা কী করে চিনল সন্তুকে? সে কেন বলল, কোনও নাম বলার দরকার নেই?

অনেক রাস্তা ঘুরে, একটা আলো-ঝলমলে পাড়ার মধ্যে একটা পাঁচতলা বাড়ির সামনে থামল গাড়িটা। গাড়ির চালক নিজে না নেমে বলল, আপ উতরিয়ে!

সন্তু গাড়ি থেকে নামতেই গাড়িটা ভোঁ করে চলে গেল। সন্তু চেঁচিয়ে উঠল, আরে, আমার সুটকেস!

বাড়ির ভেতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে বলল, আপ অন্দর আইয়ে?

সন্তু বলল, হামারা সুটকেস লেকে ভাগ গিয়া।

লোকটি হেসে বলল, ফিকার মাত কিজিয়ে, সুটকেস পৌঁছে জায়গা!

লোকটির হাসির মধ্যে যথেষ্ট ভরসা আছে। তাই সন্তু আর কিছু না বলে চলে এল ওর সঙ্গে। লিফটে পাঁচতলায় পৌঁছে লোকটি একটা ঘরের বন্ধ দরজায় টোকা মারাল।

দরজা যিনি খুললেন, তাঁকে দেখে সন্তুর মুখটা খুশিতে ভরে গেল। যাক, তা হলে ঠিক জায়গাতেই আনা হয়েছে। আর সুটকেসের জন্য চিন্তা করতে হবে না।

ছিপছিপে লম্বা লোকটির নাম নরেন্দ্ৰ ভামা। দিল্লিতে সি. বি. আই-এর একজন বড়কতা। কাকাবাবুর অনেক দিনের বন্ধু। সন্তুকেও ইনি ভালই চেনেন। এই তো গত বছরেই ত্রিপুরায় ইনি এসেছিলেন কাকাবাবুকে সাহায্য করতে। নরেন্দ্ৰ ভার্মা কলকাতায় লেখাপড়া করেছেন বলে বাংলা মোটামুটি ভালই জানেন।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, এসো, সনটু! কেমুন আছ? রাস্তায় গোলমাল হয়নি তো কিছু? টায়ার্ড?

সন্তু মাথা নেড়ে বলল, না, একটুও টায়ার্ড নই। আপনি ভাল আছেন তো?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা ভুরু কুঁচকে বললেন, ভাল কী করে থাকব? তোমার আংকল দিল্লিতে এসে এমুন ঝোনঝাট বাধাল, অথচ আমি কিছুই জানি না! আমাকে আগে কোনও খবরই দেয়নি! এসব কী বেপার বলে তো? সন্তু আকাশ থেকে পড়ল। সে তো কিছুই জানে না। ঘরের চার দিকে চোখ ঝুলিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু কোথায়? নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, এখানে নেই। সেইফ জায়গায় আছে। আচ্ছা! সনটু, তুমি বলো তো, আ ক্যাট হাজ নাইন লাইভস। তোমার এই কাকাবাবুর কখানা জীবন?

কেন, কী হয়েছে আবার?

আরে ভাই, ডেলহিতে আসবার আগে আমাকে একটা চিটুঠি দিল না, এখানে এসে ভি খবর দিল না। আমি খবর পেলাম মাডার অ্যাটেমাট হবার পর?

অ্যাঁ? মাডার অ্যাটেমাট? কার ওপর? তোমার কাকাবাবুর ওপর! আবার কার ওপর? কেন, তোমাকে চিটুঠি লেখেননি?

চিঠিতে তো লিখেছেন, ওঁর জ্বর হয়েছে!

হাঁ হ্যাঁ, তা তো লিখবেনই। আসল কথা লিখলে তোমার মা-বাবা বহোত দুশ্চিন্তা করতেন তো! এবারে বড় রকম ইনজুরি হয়েছে, খুব জোর বেঁচে গেছেন।

আমি কাকাবাবুর সঙ্গে এক্ষুনি দেখা করতে চাই। তা হবে না।

তোমার কাকাবাবুই বলেছেন, তোমাকে সাবধানে রাখতে। কারা মোরল তা তো বোঝা গেল না। তোমার কাকাবাবুর অনেক এনিমি, তবে কে হঠাৎ দিল্লিতে এসে মারতে যাবে? রায়চৌধুরী আমাকে বলল, তোমাকেও সাবধানে রাখতে। তোমার ওপর অ্যাটেমটি হতে পারে। রায়চৌধুরীর ওপর

সন্তুর কাঁধে হাত রেখে নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, বেশি চিন্তা কোরো না। এখন ভাল আছেন কাকাবাবু। এবারে বলো তো, কী কেস নিয়ে এসেছেন দিল্লিতে?

সন্তু বলল, আপনি জানেন না, আমি জানব কী করে? আমায় তো কিছুই বলেননি।

গভর্নমেন্টের কোনও কেস হলে আমি ঠিকই জানতুম। সে সব কিছু না। শুনলাম কী, একজন আরবের সঙ্গে তোমার কাকাবাবুর খুব দোস্তি হয়েছে।

আরব?

হ্যাঁ। মিডল ইস্টের কোনও দেশের লোক। লোকটাকে আমি দেখিনি এখনও। রায়চৌধুরীও কিছু ভাঙছে না। আমার কাছে। বলছে, ই সব তোমাদের গভর্নমেন্টের কিছু বেপার নয়।

কলকাতাতেও কাকাবাবুর কাছে একজন লোককে আসতে দেখেছি। যাকে দেখে সাহেবও মনে হয় না। ভারতীয়ও মনে হয় না।

প্রোবাবলি দ্যাট ইজ আওয়ার ম্যান। লোকটাকে ধরতে হবে। কোন চক্করে ফাঁসিয়ে দিয়েছে তোমার কাকাবাবুকে।

সন্তুর ভুরু কুঁচকে গেছে। দিল্লিতে এসে কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা হবে না, এটা সে চিন্তাই করতে পারেনি।

সে জিজ্ঞাসা করল, নরেন্দ্ৰককা, আমি কি এখানেই থাকব নাকি?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, না, একঘণ্টা বাদ তোমাকে আর এক গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হবে। দেখতে হবে কি, তোমায় কেউ ফলো করছে কি না। অন্য গেস্টহাউসে তোমার সুটকেস পেয়ে যাবে।

কাকাবাবুর সঙ্গে একবার টেলিফোনে কথা বলা যায় না?

আজ অসুবিধে আছে। কাল হবে। আজ রাতটা ঘুমোও। ঘণ্টাখানেক বাদে সন্তুকে আবার আর একটি গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হল অন্য একটি বাড়িতে। এটা একটা মস্ত বড় গেস্টহাউস। অনেক লোকজন। নরেন্দ্র ভার্মা নিজে সন্তুকে দিয়ে গেলে একটি ঘরে। সেখানে আগে থেকেই তার সুটকেস রাখা আছে।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, তোমার রাতের খাবার এই ঘরেই এসে যাবে। আর কিছু লাগলে বেল বাজিয়ে ডাকবে বেয়ারাকে। পয়সার চিন্তা কোরো না। আর, আজ রাতটা একলা বাইরে যেও না।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা চলে যাবার পর সন্তু বিছানার ওপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। একটা অচেনা জায়গায় সে একদম একা। কাকাবাবু চিঠি পাঠিয়ে তাকে ডেকে আনলেন, অথচ কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা হল না।

গতকাল প্রায় এই সময় সন্তু তিলজলার কাছে একটা থানায় বসেছিল, আর আজ সে দিল্লিতে একটা গেস্টহাউসে। আগামীকাল আবার কী হবে কেউ বলতে পারে না।

রাত্তিরটা এমনিই কেটে গেল। ভাল ঘুম হয়নি সন্তুর, সারা রাত প্রায় বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে। ভোরের আলো ফুটতেই সে বেরিয়ে এল বাইরে।

এখনও অনেকেই জাগেনি। বাড়িটার সামনের বাগানে অনেক রকম ফুল। গেটের বাইরে খুব চওড়া একটা রাস্তা। খুব সুন্দর একটা সকাল, কিন্তু সন্তুর মনটা খারাপ হয়ে আছে।

সন্তু বড় রাস্তাটায় খানিকটা হেঁটে বেড়াল। বেশি দূর গেল না। দিল্লির রাস্তা সে কিছুই চেনে না।

নরেন্দ্র ভার্মা এলেন নটা বাজার খানিকটা পরে। সন্তু তখন নিজের ঘরে বসে ব্রেকফার্স্ট খাচ্ছে। এখানে ব্রেকফাস্টে অনেক কিছু দেয়, ফলের রস, কর্নফ্লকস, দুধ আর কলা, টোস্ট আর ওমলেট, আর একটা সন্দেশ।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কী সন্তু, ইউ আর ইন ওয়ান পিস? কেউ তোমাকে গুলি করেনি। কিংবা কিডন্যাপ করার চেষ্টাও করেনি?

সন্তু বলল, কেউ আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, চলো, তৈয়ার হয়ে নাও। রাজা তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।

সন্তুর তৈরি হয়ে নিতে পাঁচ মিনিটও লাগল না।

দিনের আলোয় দিল্লি শহরটাকে ভালভাবে দেখল। সন্তু। রাস্তাগুলো যেমন বড় বড়, তেমনি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। দুপাশে বড়-বড় বাড়ি। দিল্লির নাম শুনলেই সন্তুর মনে পড়ে লালকেল্লা আর কুতুব মিনারের কথা। কিন্তু সে-দুটো দেখা যাচ্ছে না। তবে একটা প্ৰকাণ্ড, গোলমতন বাড়ি দেখে সন্তু চিনতে পারল। ছবিতে অনেকবার দেখেছে, ওটাই পালামেন্ট ভবন।

নরেন্দ্ৰ ভার্মার গাড়ি এসে থামল একটা নার্সিং হোমের সামনে। তিনতলার একটা ক্যাবিনের দরজা খুলতেই কাকাবাবুর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

সন্তু দেখল, কাকাবাবুর পেট আর বাঁ হাত জড়িয়ে মস্ত বড় ব্যাণ্ডেজ। মুখে কিন্তু বেশ হাশিখুশি ভাব। ক্যাবিনটা বেশ বড়, হোটেলের সুইটের মতন। সামনের দিকে বসবার জায়গা, দুটি সোফা ও দুটি চেয়ার রয়েছে, পেছন দিকে খাট আর একটা ছোট টেবিল। কাকাবাবু বসে আছেন একটা সোফায়, অন্যটিতে বসে আছেন। একজন লম্বামতন লোক। সন্তু চিনতে পারল, এই লোকটিকেই কলকাতায় তাদের বাড়িতে কয়েকদিন আসতে দেখেছে। এরা দুজনে মনোযোগ দিয়ে কী যেন আলোচনা করছিলেন। সন্তুদের দেখে থেমে গেলেন।

কাকাবাবু সন্তুকে ডেকে বললেন, আয় সন্তু, কাল রাত্তিরে তোর একা থাকতে খারাপ লাগেনি তো?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, দুজন গার্ড পোস্টেড ছিল ওর ঘরের দিকে নজর রাখার জন্য, সন্তু তা টেরই পায়নি।

সন্তু বেশ অবাক হল। সত্যি সে কিছু বুঝতে পারেনি তো!

কাকাবাবু বললেন, আর কিছু হবে না। আমাকে কোনও উটকো ডাকাত মারতে এসেছিল বোঝা যাচ্ছে। এটা কোনও দলের কাজ নয়।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, উট্ৰকো? উটুকো কথাটার মানে কী আছে?

কাকাবাবু বললেন, এই সাধারণ একটা কেউ। নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, তোমাকে গুলি করে পালাল, ঘর থেকে কিছু জিনিসপত্র নিল না, এ কি সাধারণ ডাকাত?

অপরিচিত লোকটি মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। এবারে মুখ তুলে বললেন, আই ফিল গিলটি

কাকাবাবু ইংরেজিতে বললেন, না, না, আপনার কোনও দায়িত্ব নেই। আমি তো নিজের ইচ্ছেতেই এসেছি।

তারপর সন্তুদের দিকে ফিরে বললেন, তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন. এর নামটা মস্ত বড়, সবটা বললে মনে থাকবে না, সবাই এঁকে আল মামুন বলে ডাকে। ইনি একজন ব্যবসায়ী।

ভদ্রলোক সন্তুর দিকে মাথা নাড়িয়ে বললেন, গুড মর্নিং, হাউ ড়ু ইউ ড়ু?

তারপরই হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আই মাস্ট গো! মিস্টার রায়চৌধুরী, আই উইল গেট ইন টাচ উইথ ইউ

বেশ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। স্পষ্ট মনে হল, ওঁর মুখে যেন একটা ভয়ের ছাপ।

গেলেন। ঘর থেকে।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই আমনভাবে তাকাচ্ছিস কেন? এই ব্যাণ্ডেজটা দেখতেই এত বড়, আসলে বিশেষ কিছু হয়নি। পাঁজরা ঘেঁষে একটা গুলি চলে গেছে, কিন্তু পাঁজরা-টাজরা ভাঙেনি কিছু। ব্যাটারা কেন যে এরকম এলোপাথাড়ি গুলি চালায়! টিপ করতেই শেখেনি!

সন্তু একদৃষ্টিতে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে। পেটে গুলি লেগেছে, তা নিয়েও কাকাবাবু ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে পারেন।

তোমার পাখি কোন বাসায় থাকে তা ঠিক জেনে আসবে।

কাকাবাবু হাসলেন।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, এবারে সব খুলে বলে তো রাজা! তুমি আমার ওপরেও ধোঁকা চালাচ্ছ? আমাদের না জানিয়ে ও লোকটার সঙ্গে তোমার কিসের মামলা?

কাকাবাবু সে-রকমই হাসতে হাসতে বললেন, আরে সেরকম কিছু না। এর মধ্যে কোনও ক্রাইম বা ষড়যন্ত্র বা বড় ধরনের রহস্যের ব্যাপার নেই। ওই লোকটা একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল, তাই আমি কৌতূহলী হয়ে এসেছি দিল্লিতে।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বলল, ক্রাইম কিছু নেই? তবে গুলিটা চালাল কে?

কাকাবাবু বললেন, সেটা অবশ্য আলাদা ব্যাপার। আমি যেজন্য দিল্লিতে এসেছি তার সঙ্গে এর হয়তো কোনও সম্পর্ক নেই। আবার থাকতেও পারে। আচ্ছা, আমি সব বুঝিয়ে বলছি, সুস্থির হয়ে বোসো।

সন্তুর দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুই জানিস, হিয়েরোগ্লিফিক্‌স কাকে বলে?

সন্তু বলল, হ্যাঁ।

কাকাবাবু আর নরেন্দ্র ভার্মা দুজনেই অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকালেন।

কাকাবাবু বললেন, অ্যাঁ? তুই জানিস? বল তো কাকে বলে?

সন্তু বলল, হিয়েরোগ্লিফিক্স হচ্ছে এরকম ছবির ভাষা। মিশরের পিরামিডে কিংবা অন্য-সব স্মৃতিস্তম্ভে ছবি এঁকে একে অনেক কথা লেখা হত।

অনেকটাই ঠিক বলেছিস। এ তুই কোথা থেকে শিখলি?

একটা কমিকসে পড়েছি।

তা হলে তো কমিকসগুলো যত খারাপ ভাবতুম তত খারাপ নয়।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, তুমি যে শব্দটা বললে, আমি নিজেই তো তার মানে জানতুম না।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তুমিও কমিকস পড়তে শুরু করে দাও! আচ্ছা, এবার তাহলে ঘটনাটা গোড়া থেকে বলি। এই যে আল মামুন নামে ভদ্রলোককে দেখলে, ইনি কলকাতায় গিয়ে আমার সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছিলেন। একটা ব্যাপারে আমার সাহায্য চান। উনি কয়েকটা লম্বা-লম্বা হলদে কাগজ নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে লাল রঙের অনেক ছোট-ছোট ছবি আঁকা। দেখলে মনে হয়, যে এঁকেছে, তার আঁকার হাত খুবই কাঁচা, এবং খুব সম্ভবত একজন বুড়ো লোক। আল মামুন বলেছেন, ঐ ছবিগুলো এঁকেছেন তাঁর এক আত্মীয়।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, সেই ছবিগুলো, ঐ যে কী নাম বললে, সেই ভাষায় লেখা?

সন্তি বলল। হিয়েরোগ্লিফিক্‌স!

কাকাবাবু হাহা করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, কয়েক হাজার বছর আগে লুপ্ত হয়ে গেছে এই ভাষা। এখন কি আর এই ভাষায় কেউ লেখে? লিখলেও বুঝতে হবে সে-লোকটি পাগল।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, ছবিগুলো তোমার কাছে নিয়ে যাবার মানে কী? তুমি কি ঐ ভাষার একজন এক্সপার্ট?

কাকাবাবু বললেন, তা বলতে পারো। এক সময় আমি ঐ নিয়ে চৰ্চা করেছি। তোমার মনে নেই, নরেন্দ্ৰ, বছর দশেক আগে আমি টানা ছা মাস ইজিপ্টে ছিলাম? মিশরের সব হিয়েরোগ্লিফিকসের পাঠ আজও উদ্ধার করা যায়নি। অনেকেই চেষ্টা করছেন। আমি কিছু কিছু পড়তে পারি। এ সম্পর্কে আমার লেখা কয়েকটা প্ৰবন্ধও বিদেশি কাগজে বেরিয়েছে।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা জানতে চাইলেন, ঐ আল মামুন কোন দেশের লোক?

ইজিপশিয়ান। ব্যবসা সূত্রে প্রায়ই আসতে হয় এদেশে। এখান থেকে উনি চা, সেলাইকেল, সাইকেল, এইসব জিনিস নিয়ে যান নিজের দেশে।

তা একজন ব্যবসায়ীর এরকম ইতিহাসে উৎসাহ?

সেটাও একটা মজার ব্যাপার। ঐ ভদ্রলোক প্রাচীন মিশরের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানেন না। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ছবিগুলো বোধহয় ইজিপ্টের কোনও পিরামিডের দেয়াল থেকে কপি করা। কিন্তু তা-ও নয়। আল মামুন কোনও দিন পিরামিড চোখেও দেখেননি।

অ্যাঁ? ইজিপ্টের লোক অথচ পিরামিড দেখেনি!

এতে আশ্চর্য হবার কী আছে? ভারতবর্ষে সব লোক কি তাজমহল দেখেছে? হিমালয়ই বা দেখেছে কজন? আল মামুন দূর থেকে হয়তো একটা দুটো পিরামিড দেখে থাকতে পারেন। কিন্তু ভেতরে কখনও যাননি। উনি বলছেন যে, এই দিল্লিতেই ওঁর এক আত্মীয় থাকেন, ছবিগুলো তিনি এঁকেছেন।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বিরক্ত হয়ে বললেন, ধেত্ব! কী তুমি সব ছবি-টবির কথা বলছি, কোন বুড়ো কী এঁকেছে, তাতে আমি কোনও আগ্রহ পাচ্ছি না?

কাকাবাবু বললেন, সেইজন্যই তো তোমাকে আগে এসব বলতে চাইনি।

কিন্তু এর সঙ্গে তোমাকে মাডার করার সম্পর্ক কী? মানে বলছি কী, তোমাকে হঠাৎ কেউ মারতে এল কেন?

সম্পর্ক একটাই থাকতে পারে। আল মামুন ঐ ছবিগুলোর অর্থ করে দেওয়ার জন্য আমাকে এক লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছিলেন।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা হুই-ই করে শিস দিয়ে উঠে বললেন, এক লাখ টাকা? কয়েকটা ছবি পড়ে দেবার জন্য? কী আছে। ঐ ছবির মধ্যে? তুমি মানে বুঝেছিলে?

আগে আর-একটা ব্যাপার শোনো। আল মামুনের ওই যে আত্মীয়, তাঁর নাম মুফতি মহম্মদ। তিনি খুব ধাৰ্মিক ব্যক্তি, তাঁর অনেক শিষ্য আছে। তাঁর বয়েস নাকি সাতানব্বই, শরীর বেশ শক্তসমর্থ। শুধু গত বছর থেকে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেন না। তাঁকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে দিল্লিতে।

সাতানব্বই বছর বয়েস? তার আবার চিকিৎসা?

এটা দেখা যায় যে, সন্ন্যাসী-ফকিররা অনেক বাঁচেন। তাঁদের স্বাস্থ্যুও ভাল থাকে। সাধক মুফতি মহম্মদের শুধু কথা বন্ধ হয়ে গেছে।

সাতানব্বই বছর বয়সে তিনি ছবি আঁকছেন?

আল মামুনের মুখে যা শুনেছি, উনি লিখতে জানেন না। আগে কখনও ছবিও আঁকেননি। মুসলমান সাধকেরা কেউ ছবি আঁকেন না। ইনি ছবি এঁকেছেন ঘুমের ঘোরে।

অ্যাঁ? কী গাঁজাখুরি গল্প শুরু করলে রাজা?

আর-একটু ধৈর্য ধরে শোনো, নরেন্দ্র। আমি যা শুনেছি, তা-ই বলছি। ধর্মীয় গুরু বলে মুফতি মহম্মদকে হাসপাতালে রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে আলাদা একটা বাড়িতে। এক-একদিন মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে উঠে বসে ঐ ছবিগুলো আঁকছেন।

হলদে কাগজে, লাল কালিতে? ঘুমের মধ্যে তিনি সে-সব পেলেন কোথায়?

লাল কালি নয়, লাল পেন্সিল। উনি যে ঘরে থাকেন, তার পাশের ঘরের টেবিলে অনেক রকম কাগজ আর পেন্সিল থাকে। সেটা আল মামুনের অফিস-ঘর। মুফতি মহম্মদ সাহেব ঘুমের মধ্যেই পাশের ঘরে উঠে এসে, বেছে বেছে হলদে কাগজ আর লাল পেন্সিলে ছবিগুলো আঁকছেন। ছবিগুলো যে হিয়েরোগ্লিফিকসেরই মতন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিছু কিছু পরিষ্কার অর্থ পাওয়া যায়।

কী মানে বুঝলে?

সেটা এখন বলা যাবে না। খুব গোপন ব্যাপার। সাধক মুফতি মহম্মদের অনেক শিষ্য এই দিল্লিতেই আছেন। আল মামুন তাঁদের কিছু জানাতে চান না। গুরুদেব কী লিখছেন সেটা তিনি নিজে আগে জেনে নিতে চান।

সেইজন্য দিতে চান এক লাখ টাকা? উনি কি ভাবছেন, এটাই গুরুর বিষয়-সম্পত্তির উইল?

গুরুর উপদেশও অনেকের কাছে খুব মূল্যবান।

তুমি তবে এক লাখ টাকা পেয়ে গেছ, আর টাকার লোভেই দুশমন তোমাকে গুলি করতে এসেছিল?

সেই টাকা পাওয়ার তো প্ৰশ্নই ওঠে না। ঐ কাগজে কী লেখা হয়েছে, তা আমি আল মামুনকে বলিনি এখনও!

বলোনি? ওকেও বলোনি কেন?

কাকাবাবু মুচকি-মুচকি হাসতে লাগলেন।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, এক লাখ টাকা দিতে চায়, তবুওকে তুমি দুচারটা ছবির মানে বলে দাওনি?

কাকাবাবু বললেন, না। ওকে কিছু বলিনি, তার কারণ আমি আল মামুনের কোনও কথা বিশ্বাস করিনি।

সন্তু এতক্ষণ প্রায় দম বন্ধ করে শুনছিল, এবারে সে একটা বড় নিশ্বাস ফেলল। টাকার লোভে কাকাবাবু কোনও কাজ করবেন, তা সে বিশ্বাসই করতে পারে না।

কাকাবাবু আবার বললেন, ওই ছবির ভাষা থেকে আমি বুঝেছি, তা এখনকার কোনও ব্যাপারই নয়। অন্তত সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার একটা ঘটনার কথা বলা হচ্ছে। তাও শেষ হয়নি। আমি পেয়েছি মাত্র চারখানা হলদে কাগজ। এর পরে যেন আরও আছে। সেইজন্য আমি আল মামুনকে বলেছিলুম, আমি গুরু মুফতি মহম্মদকে নিজের চোখে দেখতে চাই। সেইজন্যই আমার দিল্লি আসা।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, দেখা হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, না। সেইটাই তো বুঝতে পারছি না। এতদিন দিল্লি এসে বসে রইলুম, তবু আল মামুন সেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন না। কখনও বলেন যে, ওঁর গুরুর মেজাজ ভাল না থাকলে বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করতে চান না। আবার কখনও বলেন যে, অন্য শিষ্যরা সব সময় ঘিরে থাকে, সেইজন্য সুযোগ হচ্ছে না।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, তোমার ঐ আল মামুন কোথায় থাকে। আমি আজই জেনে যাচ্ছি। আমি ওকে ফলো করার জন্য লোক লাগিয়ে দিয়েছি। এবারে বলো, তোমার ওপর যে-লোকটা গুলি চালাতে এসেছিল, সে লোকটা কেমন? সেও কি পরদেশি? তার মুখ তুমি নজর করেছিলে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, মুখ দেখেছি, কিন্তু একপাশ থেকে। আমার ধারণা সে একটা ভাড়াটে খুনি। কেউ তাকে টাকা দিয়ে বলেছে আমাকে সাবাড় করে দিতে। দ্যাখো, আমার ওপর অনেকের রাগ আছে। কত পুরনো শত্ৰু আছে। তাদেরই কেউ দিল্লিতে আমায় চিনতে পেরে খতম করে দিতে চেয়েছে। ও ঘটনায় গুরত্ব দেবার কিছু নেই!

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, তুমি কী বলছি, রাজা? একটা লোক তোমাকে খতম করে দিতে এসেছিল, আর তাতে কোনও গুরুত্ব নেই? তাজব! লোকটা যদি আবার আসে? শুনেছ সনটু, তোমার কাকাবাবু কেমুন ছেলেমানুষের মতন কথা বলেন?

কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, আরে, ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে তো কোনও কাজই করা যায় না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, লোকটা কি রাত্তিরবেলা ঘরের মধ্যে এসে গুলি করেছিল?

কাকাবাবু বললেন, তখন রাত বেশি না, এগারোটা হবে বড়জোর। হোটেলের ঘরে বসে আমি পড়াশুনো করছিলাম। ঘরের পাশেই একটা ছোট বারান্দা, তার দরজাটা খোলা। একটা শব্দ হতেই চোখ তুলে দেখি যে, বাইরে থেকে বারান্দায় একটা লোক লাফিয়ে উঠে এল। তার হাতে রিভলভার। আমারও বালিশের তলায় রিভলভার থাকে, তুই জানিস। কিন্তু আমি বসে ছিলাম বালিশটা থেকে বেশ দূরে। হাত বাড়িয়ে সেটা নেবার সময় পেলাম না। লোকটা এসেই কোনওরকম কথাবার্তা না বলে রিভলভার তুলল আমার কপাল লক্ষ করে। যদি টিপ করে গুলি চালাত, তা হলে আমি সেই মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতম। তখন বাঁচার একটাই উপায়। আমি প্ৰচণ্ড জোরে চিৎকার করে বললুম, ব্লাড ফুল! লুক বিহাইণ্ড।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, কপালের সামনে রিভলভারের নল দেখেও তুমি চিৎকার করতে পারলে? তোমার নার্ভ আছে বটে।

কাকাবাবু বললেন, আমি আগেও অনেকবার এই রকম চেঁচিয়ে সুফল পেয়েছি। হঠাৎ খুব জোরে শব্দ হলে পাকা-পাকা শিকারিদেরও টিপ নষ্ট হয়ে যায়। এখানেও তাই হল। আমার ধমক শুনে লোকটার হাত কেঁপে গোল একটু, তার গুলি লাগল আমার পাঁজরায়। আমি সাঙ্ঘাতিক আহত হবার ভান করে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। বিছানায়। সঙ্গে-সঙ্গে বালিশের তলা থেকে রিভলভার বার করে এনেছি। লোকটাকে আমি তখন গুলি করতে পারতুম। কিন্তু আমি দেখতে চাইলুম লোকটা এর পর কী করে! কোনও জিনিসপত্তর নিতে চায় কি না। লোকটা কিন্তু আর কিছু করল না। সে ভাবল বোধহয় যে, একটা গুলি চালিয়েই তার কাজ শেষ হয়ে গেছে। আবার টপ করে বারান্দা ডিঙিয়ে পালিয়ে গেল।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, ভাড়াটে খুনি বলেই মালুম হচ্ছে। দিল্লিতে এরকম অনেক আছে।

কাকাবাবু বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে, যে ওকে ভাড়া করেছিল, সে ওকে পুরো টাকা দেয়নি। এত কাঁচা কাজের জন্য। ওর পাঁচ টাকার বেশি পাওয়া উচিত নয়।

হচ্ছে মনে হচ্ছে!

কাকাবাবু আবার জোরে হেসে উঠলেন। নরেন্দ্ৰ ভামাও হাসতে লাগলেন।

এই সময় বাইরের রাস্তায় একটা হৈচৈ আর দুমদাম শব্দ হতে লাগল। সন্তু চলে এল জানলার কাছে।

কী যেন একটা কাণ্ড হয়েছে রাস্তায়। লোকজন ছোটাছুটি করছে। একটা বাসে আগুন লেগে গেছে।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা উঠে এসে উঁকি দিয়ে বললেন, ওঃ! এমন কিছু নয়। বাস বোধহয় একটা লোক চাপা দিয়েছে, তাই পাবলিক রেগে গিয়ে বাসটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! এসব তোমাদের ক্যালকাটাতে আগে হত, এখন আমদানি হয়ে গেছে দিল্লিতেও।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress