১৫
রমা মারা যাওয়ার পর থেকেই মাল্যবান মাঝে-মাঝে কেমন সব মৃত্যু ও দাহের স্বপ্ন দেখত রাতের বেলা। একদিন সে দেখল, নিজে মরে গেছে, তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল: সেখানে সে খুব অমায়িক ভাবে সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, সকলকে নমস্কার জানাচ্ছে, বিদায় নিচ্ছে, বলছে; আপনাদের সঙ্গে আর তো দেখা হবে না, কোথায় যাই, কে জানে।
জেগে উঠে তার মনে হল; এ কী অদ্ভুতঃ। হলই বা স্বপ্ন, কিন্তু স্বপ্নের ভেতরেও মরে তো গিয়েছিল সে; মরে গিয়ে মানুষ আবার বসে-বসে জীবিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলে কী করে! বাস্তবিক, স্বপ্ন এমন হিজিবিজি-মানুষের বুদ্ধি বিচার চেতনার দুকান কেটে ছেড়ে দেয়। অনেকে বলে স্বপ্ন সত্য হয়। বাস্তবিক, মরে যাবে কি সে? শীতের গভীর রাতে অন্ধকারকে মিশকালো করে দিয়ে বেশি অন্ধকারের প্রবাহের ভেতর —ভাবতে-ভাবতে-ভাবতে গিয়ে কেমন যেন ন্যাতা জোবড়ার মতো হয়ে পড়ল সে। নিজের জন্যে ততটা নয়—কিন্তু সে মরে গেলে উৎপলার উপায় হবে কী? মনু আর উৎপলার জন্যে মনটা তার নিজের চেয়ে ঢের বুড়ো মানুষের মতো গুইগাঁই করে উঠল। বিছানায় উঠে বসল; চটি পায়ে দিয়ে কম্বল জড়িয়ে আস্তে-আস্তে ওপরের ঘরে গেল সে। গিয়ে দেখল, উৎপলা ঘুমিয়ে আছে—পাশে মনু—সেও ঘুমিয়ে। বেশ শান্ত নিরাময় নিঃশ্বাস তাদের। ওরা অন্তত কোনো দুষ্ট স্বপ্ন দেখেনি। বেশ। এদের দিকে তাকালে আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু তবুও এর স্বামী আর ওর বাবা যদি মরে যায়, তাহলে এ-রকম করে এরা দুজনে ঘুমোতে পারবে কি আর? জেগেও উঠতে পারবে না আর জাগরীতে ঘুরে-ফিরে বেড়াতে পারবে না আর সহজ সফল ভাবে।
কিন্তু, তবুও শেষ পর্যন্ত সত্যিই মরে সে তো যায়নি, বেশ সুস্থ হয়ে বেঁচে আছে। আছে। আমাদের জীবনের নদীর নাম অনুত্তরণ, মাল্যবান ভাবছিল, কোথাও কেউ উত্তীর্ণ হতে পারে না, কোনোদিন এ-নদীর পথে; কিন্তু, তবুও, কতো লোক ব্যথা বিপদ বিফলতা মৃত্যুর বলে প্রতিদিন ওড়াচ্ছে; উৎপলা, মনু পারবে না কেন? মানুষ হয়ে জন্মালে নানারকম দুর্নিবার শাস্তি ভোগ করতে হয়—করতেই হয়; মনু উৎপলা বাদ যাবে না; মাল্যবান মরে গেলে মানুষের সে-পাওনা বুঝে নিতে হবে স্ত্রী-সন্তানকে; কিন্তু বেশি দিনের জন্যে নয়; চুপ হয়ে যায় সব, শান্ত নিশ্ৰুপতা রয়েছে। প্রথমে মাল্যবানের মৃত্যু—তারপরে অনেকদিন পরে হয়তো তার স্ত্রী আর সন্তানের মৃত্যু; এই ত্ৰিমৃত্যুতে নিস্তব্ধ হয়ে যাবে সব। সময়ের কাছে মাল্যবানের দায়িত্ব ফুরিয়ে যাবে। ভাবতে-ভাবতে এখনই যেন ফুরিয়ে যাচ্ছিল সব—এই রকম একটা অনুভাব ঘিরে রাখছিল মাল্যবানকে।
কিন্তু, আরেক দিনের স্বপ্ন সবচেয়ে ব্যথা দিল তাকে। দেখল, উৎপলা মরে গেছে। স্বপ্নের ভেতর মনে হল, উৎপলা সত্যেনবাবুর স্ত্রী—সমস্ত পৃথিবীই তা জানে—মাল্যবান নিজেও খুব ভালো করেই জানে যে, দশ-বারো বছর ধরে এরা পরস্পরের বৈধ স্ত্রী স্বামী; এদের এ-রকম সম্পর্ক নিয়ে কোনো খটকার বাষ্প নেই মাল্যবানের মনে। কিন্তু, তবুও, সেই সঙ্গে সেই স্বপ্নেই উৎপলা মাল্যবানের স্ত্রী-ই—আর কারু কিছু নয়; এ-রকম সব খাপছাড়া জিনিস স্বপের ভেতরে খুব সত্য ও স্বাভাবিক বোধ হচ্ছিল। দেখল গেল, উৎপলা মরে কাঠ হয়ে পড়ে রয়েছে—সমস্তু চুল এলোমেলো, কপালে মাথায় সিঁদুর ধ্যাবড়া, পরনে—আশ্চর্য!—বিধবার থান। মড়ার খাটিয়ার ওপর শুয়ে মড়া নারী মনের, মাংসপেশীর নানা রকম নম্র, উদ্দাম আক্ষেপে নিজের মৃত্যুর বেদনা সত্যেনকে জানাচ্ছে, কিন্তু শুন্যতা ও হাহাকার বিঁধছে মাল্যবানকে, মরমস্নায়ুতে।
ঘুম ভেঙে গেল তার।
তখন শেষ রাত।
কম্বলের নিচে সমস্ত শরীর ঘেমে গেছে মাল্যবানের। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে খালি পায়ে ওপরে ঘরে চলে গেল। গিয়ে দেখল, মনু বিছানায় উঠে বসে আছে—উৎপলা নেই। নেই, থাকবে না বলে দিয়েছে তো স্বপ্ন। তার সঙ্গে গাঁথা এই নাস্তিত্বটা বুঝি। নেই।
তোর মা কোথায়, মনু?
বাথরুমে গেছে।
আছে তাহলে; কিংবা হয়তো নেই; কী মানে আছে এত বেশি শীতে শূন্যতায় প্ৰপন্ন রাতে দূর বাথরুমের অন্ধকারে মানুষের অস্তিত্বের মনুর মুখের বাথরুমে গেছে নির্দেশের।
কখন গেল?
এই তো, এখুনি।
এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল?
হ্যাঁ।
কোনো অসুখ-টসুখ করেনি তো?
কার? মার? মনু মাথা নেড়ে বললে, না তো।
কোনো অসুবিধে হয়েছিল? কাঁদাকাটি করেছিল?
চোখের ওপর থেকে চুলের গোছা সরিয়ে নিয়ে মনু বললে, না তো। আমি দেখছি, কাদেনি। কে বললে মাকে—তুমি বলেছ কাঁদতে?
না রে। মাল্যবান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, চেয়ারে বসল এবার।
মাল্যবান সদ্য স্বপ্নছুট বির্তকাসক্ত মনকে বলছিল, সত্যেনবাবুর কাছে খিচে-দুমড়ে দীনতায় দাবনা কাপিয়ে সে কী আক্ষেপ, কান্না;—নিজে মরে গেছে বলে। বাস্তবিক, স্বপ্ন বড় ফিচেল—নিরেট জিনিস; খাট মেরে বদহজম হলে ও-সব বিলকি ছিলকি স্বপ্ন দেখা যায়, এই যারা ভাবে, তারা কি কিছু জানে? স্বপ্ন হচ্ছে অন্তিম জিনিস—এরপর আর কিছু নেই; ছোট অন্ধকার আর বড় অন্ধকারের টানা পোডেনে রাতের আলোয় অন্তিম ঘনিয়ে উঠলে স্বপ্ন দেখা যায়—দুঃস্বপ্ন; ভালো স্বপ্নও, আশ্চর্য রকমের স্নিগ্ধ স্বপ্ন সব—
এখন, কটা, বাবা? ভোর হয়ে গেছে? না?
না। ঘুমবে না-কি? ঘুমোও, ঘুমোও।
ময়লার গাড়িগুলো ঘিনঘিন করছে; ওগুলো ময়লার গাড়ি, না? কাক ডাকছে তো। এখন কটা রাত, বাবা?
কটা রাত? বলছি তোমাকে। মাল্যবান বললে। কিন্তু ধারাপাত প্রথম ভাগ নিয়ে মন তার বসে পড়তে যাচ্ছিল না। অমেয় অব্যয় স্বপ্নকুটও জ্ঞাননিজ্ঞানগ্রন্থি নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে ছিল তার মন—বৃহত্তর উৎপলা গ্রন্থির পরিধির ভেতর। সব রকম গ্রন্থিকে অতিক্রম করে একটা স্বাভাবিক তার মহত্বে পৌঁছুবার জন্যে।
উৎপলা বাথরুম থেকে ফিরে এসে বললে, তুমি এখানে বসে যে—
তুমি এখন ঘুমুবে?
মতলবটা কী তোমার?
না, কিছু না। মনে হলে, কোনো অসুখ-টসুখ করল না-কি?
কার? আমার?
সারারাত বেশ ঘুম হল?
মাল্যবানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার তাকিয়ে নিয়ে উৎপলা বললে, এখানে এখন কীসের জন্যে?
এমিই এসেছিলাম। রাতে অনেকক্ষণ বই-টই পড় বুঝি? অনেক কাজ করি—
তুমি মনে কর, আমি বুঝি তোমার কাজের ফর্দ চাইতে এসেছি। না, তা নয়, এম্নি কথাবার্তা বলতে এলুম।
এখন আমার সময় নেই, উৎপলা বললে, ভালো মানুষের মতো নিচে গিয়ে ঘুমোও তো।
তুমি এখন আর-এক দমক ঘুমিয়ে নেবে বুঝি?
আমার আজ উঠতে দেরি হবে। নিজে চা করে নিয়ো।
নেব। দোকানেও খেয়ে আসতে পারি। আজ রাতে তোমার ঘুম হয়েছিল ভালো? আমি কেমন বিদকুটে স্বপ্ন দেখেছিলুম সারাটা রাত।
উৎপলা লেপের ভেতর চলে গিয়েছিল; শেষ রাতে আর-একটা ঘুম জড়িমার আশ্চর্য ঢেউ এসে পড়েছিল ঠিক বাথরুমে যাবার আগে; এখনও আবেশটা কেটে যায়নি; কিন্তু নিচের থেকে মানুষটা ঠিক এই সময়েই উঠে এল বাদ সাধবার জন্যে।
তুমি যাও।
আজকে রাতে স্বপ্ন দেখেছিলুম, তুমি মরে গেছ।
তুমি নিচে যাবে?
নিচে আমি যাব বটে, মাল্যবান কম্বলটা আঁট করে জড়িয়ে নিয়ে বললে, নিচে যেতে হবে। কিন্তু বিচ্ছিরি সব স্বপ্ন দেখছিলুম সারারাত। পোষ মাসের রাত; পোলা বলে পাড়াগাঁয়—ধূম পড়ে গেছে সব। পোষলার গাঁজলা বলেন স্বপ্নকে ফ্রয়েড। কিন্তু কী জানেন স্বপ্নের ফ্রয়েড? জ্বিয়েনার যত মৃগী রুগী আসত তো তার কাছে; তাদের কফিসেদ্ধর গরম-গরম সুরুয়া বানিয়ে তো আর মানবজীবনের তত্ত্ব বেরোয় না।
মনু বললে, মা মরে গেছে, এই স্বপ্ন দেখেছিলে রাত্রে?
আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, তোর বাবা উল্টোপাধায় চড়ে সিধে নিয়ে চলেছে-বাজেশিপুরের ব্রহ্মমোহনবাবুকে দেবে। চলেছে—চলেছে—চলার আর শেষ নেই—উল্টোগাধায় চড়ে চলেছে কোথায়? বাজেশিবপুরের নকড়ি খোসাল বটব্যালের কাছে
মনু ফিক-ফিক করে হেসে উঠল, বললে, ভোম্বা! বাজেশিবপুর—বা-জে-শি-ব ন-ক-ড়ি খো-সা-ল—
অন্ধকারের ভেতর একটা বিড়ি জ্বালিয়ে নিয়ে মাল্যবান ঠোঁট ভেঙে হাসছিল। বেশ ভালো লাগছিল তার; চারদিক অন্ধকার—হয়তো একটু পাতলা হয়ে এসেছে; তবুও বেশ ভালো, নিশ্রুপ, উচ্ছিষ্ট অন্ধকারে ভরে আছে ঘরটা; খুব শীত; গায়ে গরম পন্টুর ওপর বেশ চৌখুপ্পী কম্বল জড়িয়ে বসেছে সে শীতের ভেতর। ডিমপাড়া নীচের দুটো কোলঘেঁষা পাখির মতন উষ্ণ হয়ে রয়েছে যেন তার একামানুষের শরীর। বাইরে জীবনের সাড়া চলালচল আরম্ভ হয়ে গেছে—তবুও মুখের নিস্তব্ধ অমরতাও অনেকখানি। ঘরের ভেতর লেপমুড়ি দিয়ে ভারি আরামেই শুয়ে আছে উৎপলা আর মনু; মরেনি পলা, মনু বেশ ভালোই আছে; উল্টোগাধার পিঠে চড়ে বাজে-শিবপুরে যাওয়ার কথাটা পলা যা বলেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে—এই-ই তো বোঝা যাচ্ছে যে, স্থির ঠাণ্ডা তার মাথা। যাক, ভালো আছে ওরা। রাত পোহাতে বাকি আছে খানিকটা সময়। ঘুমোক। মাল্যবান উঠবে, ভাবছিল, বিড়িটাও ফুরিয়ে এল। নিচে গিয়ে চুরুট জ্বালিয়ে বসবে এবার।