তৃতীয় পরিচ্ছেদ : যদুনাথ গোস্বামী
যখন বলাই মণ্ডল অপর দুইজনকে সঙ্গে লইয়া সেই অনাশ্ৰিতা বালিকার সন্ধানে বাহির হইল, তখন আকাশ অনেক পরিষ্কার; ঝড়ের বেগ অপেক্ষাকৃত ভূতমন্দী, এবং বৃষ্টি অল্প অল্প পড়িতেছিল। হলধর যে দীঘির ধার দিয়া বালিকাকে গোস্বামী পাড়ার পথ দেখাইয়া দিয়াছিল, সেই পথ ধরিয়া সকলে দক্ষিণ মুখে চলিতে লাগিল। অনতিবিলম্বে তাহারা সেই দীঘির ধারে আসিয়া পড়িল। তথায় কাহাকেও দেখিতে পাইল না; দীঘির চারিধারে তাহারা সন্ধান করিতে লাগিল। প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টাব্যাপী অনবসর পরিশ্রমের কোন ফলই ফলিল না, দেখিয়াও কেহ নিশ্চেষ্ট হইল না, তথাপি অনুসন্ধান করিতে লাগিল হয় সেই বালিকাকে, নয় তার মৃতদেহ তাহারা যেমন করিয়াই হউক খুঁজিয়া বাহির করিবে।
এইরূপে আরও অৰ্দ্ধ ঘণ্টা অতিবাহিত হইল। তাহারা দেখিল, দীঘিটার অপর পার্শ্ব দিয়া কে একটি লোক সত্বরপদে চলিয়া যাইতেছে, তখন সকলে মিলিয়া সেইদিকে ছুটিল। নিকটে গিয়া লণ্ঠনের আলো ধরিয়া চিনিল, সে লোক তাহাদেরই পাড়ার যদুনাথ গোস্বামী। তখন সকলে তাঁহাকে এক একটা প্রণাম করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
গোস্বামী মহাশয় তাহাদিগকে তদবস্থা দেখিয়া বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “কি রে বলা, এত রাত্রে এখানে যে লাঠি হাতে ক’রে ঘুরছিস্?”
বলাইচাঁদ তখন তাঁহাকে একে একে সকল কথাই বলিল। শুনিয়া গোস্বামী বলিলেন, “তবেই ঠিক হয়েছে, আমিও আসিতে আসিতে পথে একখানা রক্তমাখা কাপড় পড়িয়া থাকিতে দেখিলাম।” তখনই বলাই বলিল, “চলুন, সে কাপড়খানা যেখানে প’ড়ে আছে, সেখানে আমাদের নিয়ে চলুন; সে কাপড়খানা দেখিলেই আমরা চিনিতে পারিব।”
যদুনাথ গোস্বামী প্রথমে দুই একবার অস্বীকার করিলেন; শেষে, বলাইচাদের একান্ত পীড়াপীড়িতে যাইতে সম্মত হইলেন।
যদুনাথ গোস্বামী, বলাইচাঁদ ও বলাইচাঁদের সঙ্গী দুইজনকে সঙ্গে লইয়া চলিলেন। কিছুদূর আসিয়া যদুনাথ গোস্বামী সকলকে লইয়া নিকটস্থ এক জঙ্গলমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বেশী দূর আর যাইতে হইল না, দুই চারিপদ অগ্রসর হইয়া তাহারা লণ্ঠনের আলোকে সেই রক্তমাখা কাপড় দেখিতে পাইল। কেবল রক্তমাখা কাপড় নহে, সেখানে আরও একখানা প্রকাণ্ড ছুরি, দুই তিনটা রৌপ্যনির্ম্মিত মাথার কাঁটা পড়িয়া থাকিতে দেখিল।
বলাই মণ্ডল কাপড়খানা দেখিয়াই চিনিতে পারিল, সেই নিরাশ্রিতা বালিকার। যদুনাথ গোস্বামী ছাড়া আর সকলে ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। সে সকল রক্তমাখা কাপড় ছুরি ইত্যাদি যাহা একটা ভয়ানক খুনের সাক্ষ্যস্বরূপ পড়িয়াছিল, কেহই স্পর্শ করা দূরে থাক্, অধিকক্ষণ সেইখানে দাঁড়াইয়া থাকিতেও তাহাদের ভয়ে হাত-পা কাঁপিতে লাগিল; রক্তের সঙ্গে এমনই একটা বিভীষিকা সকল সময়ে মিশিয়া থাকে। তখন তাহাদের হাতের লাঠি এবং হাতের লণ্ঠন হাতেই রহিল; কেবল তাহারা যে সাহসে ভর করিয়া এতদূর আসিতে পারিয়াছিল, সেই সাহসটি তাহাদের মনের ভিতর হইতে যাদুকরের হাত হইতে খেলার বর্তুলটির মত অলক্ষ্যে কোথায় উড়িয়া গেল।
সকলে ফিরিয়া আসিল।