দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এ বালিকা কে?
দেখিতে দেখিতে চক্ষের নিমিষে বালিকা বাহিরের সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে কোথায় মিশিয়া গেল দেখিয়া, তথাকার সকলের—সাহসী বলাই মণ্ডল, কি তাহার অপেক্ষা অধিক সাহসী হলধর—সকলের মুখ ভয়ে শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল। সকলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়বৎ নিশ্চেষ্ট রহিল।
যে ইতিপূর্ব্বে ভূতের গল্প করিতেছিল, তাহার নাম হারাণচন্দ্র। সে বলিল, “এ আর কেউ নয়, হে হলধর; এ সে-ই, যার কথা আমি এখন বলছিলেম—সেই বাঁশঝাড়ের তলায় যাকে দেখেছিলাম, এ নিশ্চয়ই সে-ই। একবার জানাটা দিয়ে গেল। এখন দেখছি, এত রাত্রে আর আজ আবার শনিবার, যে জলঝড়, ও-কথাটা তোলাই ভাল হয় নাই; নৈলে এত জলঝড়ে মানুষের বাবার সাধ্য কি যে বাহির হয়; আমি ঠিক চিনতে পেরেছি, এ সেই গলায় দড়ি দিয়ে মরা গোয়ালাদের ছোট-বউ।”
আর একজন বলিল, “দূর সে কি এত সুন্দর দেখতে ছিল? এর মুখ চোখ দেখলে না—যেন তুলি দিয়ে আঁকা—যেন দুগ্গো পিতিমে?”
হারাণচন্দ্র তখন দুই-একটা কঠিন প্রমাণ দিল, “আমি বেশ ক’রে দেখেছি, সে যতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার একটুও ছায়া পড়তে দেখিনি। ঘোষেদের গলায় দড়ি দিয়ে মরা সেই ছোট বউ না হ’য়ে যায় না; আমি আগে একদিন একে স্বচক্ষে দেখেছি। আর সুন্দর-অসুন্দরের কথা ছেড়ে দাও, এখন ওরা যেমনটি মনে করবে, তেমনটি হ’তে পারে;আজ ওকে কী-বা দেখলে, আমি সেদিন যা’ দেখেছিলেম যেন রূপ চৌচির হ’য়ে ফেটে পড়ছে:অন্য কেউ হ’লে সেই ফাঁদে পা দিত —আর মরত, আমি বাবা বড় শক্ত ছেলে!”
বলাই মণ্ডল আর এক পথে গেল, “ওসব কাজের কথা নয়, গোঁসাইপাড়ার কোন লোকের মেয়ে টেয়ে হবে; শ্বশুরবাড়ীতে বোধ হয়, জ্বালা যন্ত্রণা দেয়, তাই আজ জলঝড়ে সুবিধা পেয়ে বাপের বাড়ীতে পালিয়ে আছে।”
তামাক বন্ধ রাখিয়া, তাস পেটা বন্ধ রাখিয়া, গল্প বন্ধ রাখিয়া এবং গুন গুন গান বন্ধ রাখিয়া, যখন অর্দ্ধ ঘণ্টা ধরিয়া তাহাদের মধ্যে কেবল এই বিষয়েরই আলোচনা চলিতে লাগিল, তখন তথায় দ্রুতপদে আর এক মূর্ত্তির উদয় হইল।
সেই আগন্তুকের চেহারা দেখিয়া সকলেই ভয় পাইল। তেমন বিকট হইতেও বিকট এবং কদাকার হইতেও কদাকার, এ-আকৃতির লোক তাহারা জীবনে আর কখনও দেখে নাই বলিয়াই ভয় পাইল। তাহার প্রকাণ্ড বলিষ্ঠ দেহ, দীর্ঘ দীর্ঘ হস্তপদাদি, দেহের সেই সুকৃষ্ণবর্ণ ও সেই বর্ণের অপরিসীম ঔজ্জ্বল্যে যথেষ্ট চিক্কণ তেলকালিও অতিশয় লজ্জিত হয়। প্রকাণ্ড মুখমণ্ডল, সেই প্ৰকাণ্ড মুখমণ্ডলে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গবৎ চক্ষু, প্রশস্ত নাসিকা, বিকট দন্তশ্রেণী।
তাহার উপরে আবার তেমনি কর্কশকণ্ঠ, “ওহে তোমরা এদিক দিয়ে একটা মেয়েকে যেতে দেখেছ?”
কেহ কোন কথা কহে না।
তখন সেই বিকট আগন্তুকের সুবিকট কর্কশকণ্ঠ সপ্তমে উঠিয়া আরও কর্কশ শুনাইল, “কি হল, তোমরা যে কেহই কথা কও না? বোবা নাকি? যদি সত্যকথা না বল, এই দেখেছ আমার হাতে কি?
এই বলিয়া একখানি দীর্ঘ ছুরি বাহির করিয়া দেখাইল।
তখন সেই অতি সাহসী হলধর ভয়-কম্পিত-কণ্ঠে বলিল, “হাঁ, আধঘণ্টা হবে, একটা মেয়ে দক্ষিণদিকের বড় দীঘির ধার দিয়ে গোঁসাইপাড়ার দিকে গেছে।”
আগন্তুক আর তথায় মুহূৰ্ত্তমাত্র বিলম্ব করিল না। বালিকার অনুসরণে বাহির হইয়া গেল। অতি সাহসী হলধর তখন একটা সুদীর্ঘ অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল।
হলধর বলিল, “ব্যাপারটা কি বল দেখি?”
বলাই মন্ডল বলিল, “কিছুই ত বুঝতে পারছি না, এর ভিতরে গূঢ় রহস্য আছে।”
হারাণচন্দ্র বলিল, “এ আর কিছু নয়—সবই ভূতের খেলা।”
বলাই মণ্ডল বলিল, “না—না ভূত নয়। এ লোকটার কিছু মন্দ অভিসন্ধি আছে।”
কিছুক্ষণ ধরিয়া এইরূপ কথা কাটাকাটি চলিতে লাগিল। অকস্মাৎ অতি দূর হইতে স্ত্রীকণ্ঠে কে আর্তনাদ করিয়া উঠিল, “ওগো কে আছ, শীঘ্র এস, খুন—খুন করলে, খুন—খুন—”
বলাই মণ্ডল উঠিয়া দাঁড়াইল; বলিল, “ঠিক হয়েছে, সেই লোকটাই বুঝি সেই মেয়েটাকে খুন করলে। চলো, চুপ্ ক’রে ব’সে থাকলে চলবে না; এসো—সকলে মিলে যদি এখনও মেয়েটাকে বাঁচাতে পারি।”
তখন বলাই তিন-চার গাছা মোটা মোটা লাঠি বাহির করিল।
এক-একজনের হাতে এক-একটা দিল;সকলেই লইল—লইল না কেবল, বীরকুলভ হারাণচন্দ্র সে বলিল, “তোমাদের কথায় ভুলিয়া আমি প্রাণ খোয়াইতে পারি না। যেতে হয়—তোমরা যাও আমি ত প্রাণ থাকতে যাচ্ছি না। ভূতে ঐ রকম অনেক মায়া জানে—ঐ রকম ক’রে ভুলিয়ে ভালিয়ে একবার দীঘির ধারে নিয়ে যেতে পারলে হয়—তখন কত ধানে কত চাল, তা’ বেশ ভাল করে দেখিয়ে দেবে। কি বল, হলধর?”
হলধর ‘হাঁ’, কি ‘না’, কিছুই বলিল না।
হারাণচন্দ্রের বড় মুস্কিল বাধিয়া গেল—সকলেই যদি চলিয়া যায়, তাহা হইলে তখনকার মত তাহাকে সেইখানে একাকী থাকিতে হয়। আর তাহাদের সঙ্গে গেলে যে বিপদ্ সে অনুমান করিয়াছিল তাহাও বড় সহজ নয়; সেইজন্য হারাণচন্দ্র হলধরকে নিজের দলভুক্ত করিতে চেষ্টা করিতেছিল। তখনই সে চেষ্টা এমনভাবে সফল হইল, কেহই তাহার বিন্দু-বিসর্গ জানিতে পারিল না। অন্যের অলক্ষ্যে চোখ টিপিয়া দুই-একবার হলধরের গা টিপিয়া, এমনভাবে হারাণচন্দ্র তাহার আপাদমস্তকপূর্ণ করিয়া এমনই একটা মহাভয় ঢুকাইয়া দিল যে, হলধর আর কিছুতেই তাহাদের সঙ্গে যাইতে চাহিল না। তখন হলধর আর হারাণচন্দ্র ছাড়া অপর তিনজন একটা লণ্ঠন লইয়া লাঠি হস্তে লাফাইতে লাফাইতে বাহির হইল।