চতুর্থ পরিচ্ছেদ : পাতাল প্রবেশ
অরিন্দম যখন জুমেলিয়াকে ধরিতে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেলেন, তখন দেবেন্দ্রবিজয় একটা স্ত্রীলোককে ধরিতে তাঁহার মতন দুইজন বীরপুরুষের অগ্রসর হওয়া অতিশয় লজ্জাজনক ও অনাবশ্যক মনে করিয়া, সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলেন। হতভাগ্য দেবেন্দ্রবিজয় সেই ‘একটা স্ত্রীলোকের’ নিকটে তেমন উচ্চশিক্ষা পাইয়াও শিখিতে পারিলেন না যে, সে ঠিক ‘একটা স্ত্রীলোকের’ মতন নহে; সে মানবী মূর্ত্তিতে রাক্ষসী—রাক্ষসী অপেক্ষা ভয়ঙ্করী। দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, অরিন্দম জুমেলিয়াকে নিশ্চয় ধরিবেন, এই সময়ের মধ্যে তিনি যদি সেই ফুলসাহেবকে ধরিতে পারেন, তাহা হইলে একটা কাজের মতন কাজ হয় এবং অরিন্দম যেমন তাঁহার কিঞ্চিৎ সহায়তা ও কিঞ্চিৎ উপকার হইবে বলিয়া তাঁহাকে সঙ্গে আনিয়াছেন, তাহা হইলে সেই সাহায্যপ্রার্থী অরিন্দমেরও এই সময়ে যথেষ্ট উপকার এবং সাহায্য করা হইবে;এই মনে করিয়া তিনি ফুলসাহেবের সন্ধানে মনোনিবেশ করিলেন। এমন সময়ে নিম্নতলে কাহার পদশব্দ হইল, তখনই অনুসন্ধিৎসু দেবেন্দ্রবিজয় অনুসন্ধেয় ফুলসাহেবকে সমুচিত শিক্ষা দিতে দ্রুতপদে নীচে নামিয়া আসিলেন। সেখানে দেখিলেন, তাঁহার সেই গত রাত্রির অদ্ভুত রোগী মহাশয় তাঁহার দিকে না চাহিয়া একটি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিল। দেবেন্দ্রবিজয় তখন ছুটিয়া গিয়া সেই ঘরের দ্বার সম্মুখে দাঁড়াইলেন।
ফুলসাহেব দেবেন্দ্রবিজয়ের সহসা সম্মুখীন দেখিয়া কিছুমাত্র বিস্মিত হইল না। দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া মৃদুহাস্যে বলিল, “কি গো, দেবেন্দ্রবাবু যে, কি মনে ক’রে আবার?”
দেবেন্দ্রবিজয় বজ্ররবে বলিলেন, “কি মনে ক’রে—এখনই জানিতে পরিবে;নারকী, আমার হাতে উপযুক্ত শিক্ষা পাইবে।”
ফুলসাহেব পূৰ্ব্ববৎ মৃদুহাস্যের সহিত বলিল, “বটে, তুমি আমাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে আসিয়াছ! বেশ! শুনিয়া সন্তুষ্ট হইলাম। আচ্ছা, শিক্ষাটা তুমি একাকী দিতে আসিয়াছ, না তোমার সঙ্গে আর কেহ আসিয়াছে; অরিন্দম আসে নাই?”
দেবেন্দ্রবিজয় সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিলেন। সেই পিস্তল তিনি অরিন্দমের নিকটে পাইয়াছিলেন। পিস্তল ফুলসাহেবের মস্তক লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “যদি পলাইবার চেষ্টা কর, তাহা হইলে এই পিস্তলের গুলিতে তোমার মাথার খুলি উড়াইয়া দিব।”
ফুলসাহেব কিছুমাত্র ভীত না হইয়া পূৰ্ব্ববৎ স্মিতমুখে বলিল, “না, পলাইব কেন? তোমার ভয়ে? না তোমার ঐ পিস্তলের ভয়ে? আমাকে গ্রেপ্তার করিবে মনে করিয়াছ?
দেবেন্দ্র। হাঁ।
ফুল। কখন্?
দেবেন্দ্র। এখনই।
ফুলসাহেব হাসিতে লাগিল—সেইরূপ বিদ্রূপের মৃদুহাসি। বলিল, “তুমি কি মনে করিয়াছ, তুমি আমার হাতে হাতকড়া পরাইতে থাকিবে, আর আমি এমনি ভালমানুষটির মত চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া তাহা দেখিতে থাকিব?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাই তোমাকে করিতে হইবে।”
ফুল। আর তা’ যদি না করি?
দেবেন্দ্র। তোমাকে হত্যা করিব।
ফুল। না, এতটা কষ্ট স্বীকার করিতে হইবে না। আমি এখান হইতে নড়িব না, তোমার মনের অভিলাষটা পূর্ণ কর; কিন্তু দেবেন্দ্র, আমি ত নড়িব না, কিন্তু তুমি যে আমাকে এখান থেকে এক চুল নড়াতে পারবে, এমন বোধ হয় না।
দেবেন্দ্রবিজয়, “সে বন্দোবস্ত আমি করিতেছি”, বলিয়া যেমন ফুলসাহেবকে ধরিতে দ্রুতপদে অগ্রসর হইলেন, সহসা একটা বিকট শব্দ হইল, এবং সেই সঙ্গে দেবেন্দ্রবিজয়ের সর্ব্বাঙ্গ সেখান হইতে এক নিমিষে ভূগর্ভে অদৃশ্য হইয়া গেল!
ফুলসাহেব হাসিতে হাসিতে ঘরের বাহির হইয়া গেল।