একাদশ পরিচ্ছেদ : সুন্দরীর কৃতজ্ঞতা
আমবাগানের ভিতর দিয়া সেই স্ত্রীলোকটি অগ্রগামিনী হইল। যুবক তাহার সঙ্গে চলিতে লাগিলেন। যুবকের বয়ঃক্রম আটাশ বৎসরের অধিক নহে। মুখশ্রী সুন্দর, সুকৃষ্ণ গুম্ফ ও অনিবিড় শ্মশ্রু, মস্তকের অনতিকুঞ্চিত ঈষদ্দীর্ঘ কেশ, প্রশস্ত ললাট, উন্নত নাসিকা ও দীর্ঘনেত্র সে মুখমণ্ডলের সমধিক শোভাবর্দ্ধন করিতেছে। দেহ নাতিদীর্ঘ, নাতিখৰ্ব্ব, বলময়, মাংসপেশীতে সকল অংশ স্ফীত ও পরিণত। বর্ণ গৌর। মুখ চোখের ভাব দেখিয়া তাঁহাকে বেশ বুদ্ধিমান্ বলিয়াই বোধ হয়
তাহারা আমবাগান পার হইয়া একটা বড় বনের ধারে আসিয়া পড়িল। বনের ভিতর দিয়া একটি শীর্ণ সঙ্কীর্ণ পথ কিছুদূরে গিয়াই দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করিয়াছে। সেই অপরিসর দীর্ঘ বনপথে পত্রান্তরালচ্যুত শীর্ণ জ্যোৎস্নালেখাগুলি মূৰ্চ্ছিতভাবে পড়িয়া যুবকের চক্ষে সেই অতুল সৌন্দৰ্য্যময়ী নবীনার প্রতি পাদবিক্ষেপে, সুকোমল চরণস্পর্শে সেই মূর্ছিত জ্যোৎস্নালেখাগুলি যেন সজীব হইয়া উঠিতে লাগিল। সেই সময়ে বায়ুপ্রবাহে তাহার চঞ্চল অঞ্চল উড়িয়া এক-একবার যুবকের গায়ে আসিয়া লাগিতেছিল। এবং ঝিল্লিরবে সেই বিজন বনপথ মুখরিত হইতেছিল, এবং অরণ্য বৃক্ষলতা- পরিব্যাপ্ত অরণ্যভূমি ছায়ালোক চিত্রিত হইয়া একখানি উন্মুক্ত আলেখ্যবৎ অতি সুন্দর দেখাইতেছিল। অত্যুজ্জ্বল চন্দ্রিমা, বনকুসুমের গন্ধ, মৃদুমন্দ মলয়ানিল, এবং মধুরকণ্ঠে বনবিহগের স্বরলহরী, সেই চিত্রাঙ্কিতবৎ বনস্থলী প্রতিক্ষণে উজ্জীবিত করিয়া তুলিতেছিল।
চুম্বকের সহিত একখণ্ড লৌহের যে সম্পর্ক, আর নারী-সৌন্দর্য্যের সহিত একটা পুরুষ-হৃদয়েরও ঠিক সেই সম্পর্ক। চুম্বকের সহিত নারী-সৌন্দর্য্যের এমন একটা অব্যর্থ আকর্ষণী শক্তি আছে যাহাতে পুরুষের হৃদয় অতি সহজে ও অজ্ঞাতভাবে আকৃষ্ট হইতে থাকে। যুবক এতদূর পথ সেই আকর্ষণেই কথাটি না কহিয়া মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়, যন্ত্রচালিতের ন্যায় অতিক্রম করিতেছিল। সেই আকর্ষণেই আমবাগানের অতি দীর্ঘপথ ছাড়াইয়া বনে পড়িল এবং সেই আকর্ষণেই সর্পসঙ্কুল ভীতিপূর্ণ বনের মধ্যে প্রবেশ করিতে কুণ্ঠিত হইল না—সেইরূপ নীরবে। তাহার পর যখন সেই বনের বিপুল গভীরতার মধ্যে একান্ত বিজনতার মধ্যে পড়িয়া আর পথ পাইলেন না, তখন স্বপ্নশেষে আকস্মিক চেতনার ন্যায়, অকস্মাৎ বিদ্যুদ্দীপ্তির ন্যায় একটা শঙ্কা আসিয়া যুবকের হৃদয়ে আঘাত করিল। তিনি তখন সেই অপরিচিতাকে বলিলেন, “আমাকে আর কতদূর যাইতে হইবে? এই গভীর বনের ভিতরে আমাকে আনিলেন কেন? নিকটে যে কোন লোকালয় আছে, এমন ত বোধ হয় না। এ বন যে কিছুতেই শেষ হয় না। শীঘ্র যে শেষ হইবে, এমনও বোধ হয় না। আমি কোনদিকে যাইতেছি, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, আমার দিগ্ভ্রম হইয়াছে। আপনি আমাকে এখন কোথায় লইয়া যাইতেছেন, এ কোন্দিকে যাইতেছি—পূৰ্ব্ব, পশ্চিম, উত্তর না দক্ষিণ?”
অগ্রগামিনী অনুচ্চস্বরে বলিল, “এখন দক্ষিণ মুখে আমরা যাইতেছি, আর বেশী দূর নাই, দক্ষিণদিকে আর কিছুদূর গিয়া পূর্ব্বদিকের একটা পথ পাইব, সেই পথ ধরিয়া অল্পদূর গেলেই আমরা বন ছাড়াইয়া একটা বাগানে পড়িব, সেই বাগানে আমাদের বাড়ী।”
যুবক কহিলেন, “তাহা যেন হইল; কিন্তু আপনি যেরূপ গোলমেলে পথ দিয়া আমাকে লইয়া যাইতেছেন, তাহাতে ইহার পর পথ চিনিয়া একাকী নৌকায় ফিরিয়া আসা আমার পক্ষে অসম্ভব হইবে।”
কৃতাবগুণ্ঠনা পূৰ্ব্ববৎ মৃদুস্বরে বলিল, “সেজন্য আপনি ভাবিবেন না, আর একটি সোজা পথ আছে, সে পথ দিয়া গেলে অনেকটা রাস্তা যাইতে হয়; বাড়ীতে শীঘ্র পৌঁছাইবার জন্য আমার মন অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছে, সেইজন্য এই বনজঙ্গল ভাঙিয়া যাইতেছি। মনেও বুঝিতেছি, আপনার ন্যায় ভদ্রলোককে এই দুর্গম পথে আনিয়া ভাল করি নাই;কিন্তু কি করিব? আপনি আমার মনের উৎকণ্ঠা ঠিক বুঝিতে পারিবেন না। যাই হ’ক্, ফিরিবার সময়ে আমাদের একজন ভৃত্যকে আপনার সঙ্গে দিব; সে আপনাকে ওদিক্কার সোজা পথ দিয়া যাইয়া আপনার নৌকায় পৌঁছাইয়া দিয়া যাইবে। না জানি, এ বনপথে আনিয়া আমি আপনাকে কত কষ্ট দিলাম! সেজন্য এ দুর্ভাগিনীর সকল অপরাধ ক্ষমা করিবেন।”
যুবক তাহার বিনয়পূর্ণবচনে আত্মবিস্মৃত হইলেন। তাঁহার সরল হৃদয়ের মধ্যে দুঃসাহসিকতার উপরে যে একটা অশুভসূচক শঙ্কার অনিবিড় ছায়াপাত হইয়াছিল, সেই অবগুণ্ঠনমন্ডিতা সুন্দরীর অত্যাধিক শিষ্ঠতায় ও বাক্যের ততোধিক মিষ্টতায়, তাহা বালুকাস্তূপের জলরেখার ন্যায় নিমিষে মিলাইয়া গেল। যুবক কহিলেন, “না, সেজন্য আপনি কেন এত ‘কিন্তু’ হইতেছেন? আমার কোন কষ্ট হইতেছে না। আমার দ্বারা যে আপনার সামান্য উপকার হইল, তাহাতে বরং আমি সুখী হইলাম। মানুষমাত্রেরই যাহা কক্তব্য, তাহার বেশী আমি কিছুই করি নাই। “
রমণী বলিল, “মহাশয় আপনি এ বিপদের সময়ে আমার কতদূর উপকার করিলেন, কেমন করিয়া জানাইব? যদি আমি নিতান্ত অকৃতজ্ঞ হই, তাহা হইলেও আপনার কথা বোধ হয়, আজীবন স্মরণ থাকিবে। আপনার নিকটে আমি কতদূর ঋণী রহিলাম, বুঝাইয়া বলা অসম্ভব। যদি আপনি এতদূর কষ্ট স্বীকার না করিতেন, তাহা হইলে আমার কি হইত, বলুন দেখি? হয়ত কোন নারকীর হাতে পড়িয়া আমার কি সর্বনাশ হইত! এত রাত্রে এসকল ভয়ঙ্কর স্থান গৃহস্থ স্ত্রীলোকের পক্ষে কিরূপ বিপজ্জনক, তাহা আপনার ন্যায় হৃদয়বান্ ব্যক্তিকে বুঝাইয়া বলা বাহুল্য। আপনার চিত্ত অতিশয় উদার, মহৎ;আপনার ন্যায় পরোপকারী, দয়ালু ব্যক্তি এ সংসারে খুব কমই আছে। আপনি যদি আমাকে এরূপ দয়া প্রকাশ না করিতেন, তাহা হইলে কে বলুন দেখি, আমার এ বিপদে মাথা দিত? কে বলুন দেখি, নিজের সময় নষ্ট করিয়া একজন অপরিচিতা স্ত্রীলোকের জন্য এতটা কষ্ট স্বীকার করিতে অগ্রসর হইত? সাহায্য করা দূরে থাক্, এ অপরিচিতার উপরে কেহ যে তাহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনা করিতে পারিত, এমন বোধ হয় না।”