সপ্তম পরিচ্ছেদ : শেষ রাত্রে
সেই ঘটনাপূর্ণ রাত্রের কথা বলিতেছি।
যখন রাত দুইটা, তখন প্রহরীসকল বদলি হইতে লাগিল। সুতরাং সেই পূর্ব্বদিক্কার প্রাচীরের সেই নিহত প্রহরীর পরিবর্ত্তে একজন প্রহরী সেইদিকে আসিল। সে যাহার বলিতে আসিয়াছে, তাহাকে তথায় দেখিতে না পাইয়া বিস্মিত হইল। তাহার পর প্রাচীরের উপরে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া দেখিল। তথায় তাহার সম্মুখে, যাহাকে না দেখিতে পাইয়া বিস্মিত হইয়াছিল, তাহারই রক্তাক্ত শবদেহ পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া সে আরও বিস্মিত, স্তম্ভিত এবং ভীত হইল। দেখিল, বিশ্বাসী প্রভুভক্ত, কর্ম্মঠ প্রহরী শতছিন্ন বক্ষে, অর্দ্ধনিমীলিতনেত্রে, প্রাণহীন দেহে পড়িয়া। ভাবিয়া পাইল না—কে ইহাকে এমন নিষ্ঠুরতার সহিত হত্যা করিল।
তখন যে বৃষ্টি হইতেছিল না, তাহা নহে। তবে পূৰ্ব্বাপেক্ষা বেগটা অনেক কমিয়া গিয়াছিল। ঝড়ের বেগও মন্দীভূত হইয়া পড়িয়াছিল। ফুলসাহেব ও জুমেলিয়ার কি হইল—মরিল কি উঠিল জানি না—তাহাদের দুইজনকে, আর এই নিরীহ, নিরপরাধ, নিহত প্রহরী দুইজনকে গ্রাস করিয়া ক্ষুধাতুরা ভয়ঙ্করী রাক্ষসী নিশা যেন কথঞ্চিৎ শান্ত ও সুস্থির হইতে পারিল। মেঘান্ধকারময় আকাশ এখনও পরিষ্কার হয় নাই; শীঘ্র যে হইবে, এমন সম্ভাবনাও নাই;এখনও তারা ঢাকিয়া, চন্দ্ৰ ঢাকিয়া, কোমল নীলিমচ্ছবি ব্যাপিয়া মেঘ তেমনি পুঞ্জীকৃত হইয়া রহিয়াছে। তটিনীতীরবর্ত্তী খদ্যোৎ-খচিত ঝিল্লিমন্দ্রিত সুদূরব্যাপী অরণ্যানী তেমনি বায়ুচঞ্চল হইয়া, আলোড়িত-বিলোড়িত হইয়া সেই অন্ধকারসমুদ্র উত্তালভাবে তরঙ্গায়িত হইতেছে।
একটা যে দারুণ দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, সেই শোণিতাক্ত মৃতদেহ দেখিয়া প্রহরীর বুঝিতে বাকী রহিল না। ফুলসাহেবকেই প্রথমে সে সন্দেহ করিল। কারণ এ দুঃসাহসিকতা তাহাতেই সম্ভব। ফুলসাহেব বন্দী হওয়ায় এইরূপ একটা অবশ্যম্ভাবী দুর্ঘটনার আশঙ্কা করিয়া কারাধ্যক্ষ হইতে প্রহরীরা পৰ্য্যন্ত পূৰ্ব্ব হইতে সন্ত্রস্ত ছিল।
প্রহরীরা তখন ফিরিয়া গিয়া, সেখানে আর একজনকে মোতায়েন রাখিয়া ঊর্ধ্বতন কৰ্ম্মচারীকে সংবাদ দিল। নিশ্চিন্ত জেলখানা পরিপূর্ণ করিয়া তখনই একটা ব্যাকুলতা, একটা অধীরতা সজীব হইয়া উঠিল। সৰ্ব্বাগ্রে ফুলসাহেবের সন্ধান হইল—
সেখানে ফুলসাহেব নাই।
সে জুমেলিয়াও নাই।
প্রকোষ্ঠ শূন্য।
দ্বারসম্মুখে লঙ্কেশ্বরের জীবনবিচ্যুত দীর্ঘদেহ ভূলুণ্ঠিত, নীরব এবং নিস্পন্দ। তখনই ফুলসাহেবের সন্ধানে চারিদিকে লোক ছুটিল। থানায় থানায় সংবাদ দেওয়া হইল। শুনিয়া যত পুলিসের মস্তক অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল—যোগেন্দ্রনাথের মস্তক তত অধিকতর চঞ্চল হইল।
গ্রামের লোকেরা একদিনেই ফুলসাহেবের যথেষ্ট পরিচয় পাইয়াছিল; পরদিন প্রত্যুষে তাহার পলায়ন-কাহিনী সকলে সবিস্ময়ে শুনিল। শুনিয়া সশঙ্ক হইল, সাবধান হইল। পাছে গ্রামে আসিয়া ফুলসাহেব হঠাৎ কাহারও সর্ব্বনাশ করে, এই ভয়ে সকলে উৎকণ্ঠিত হইল।
সকলেই একাগ্রমনে স্ব স্ব ইষ্টদেবতার নিকটে কায়মনোবাক্যে তাহার পুনর্বন্দিত্ব প্রার্থনা করিতে লাগিল। কেহ মনে মনে একেবারে তাহার ফাঁসিকাষ্ঠের আয়োজন করিতে লাগিল। সে যে জেলখানার তেমন অত্যুচ্চ প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিতে গিয়া পড়িয়া মরিল না—তাহার অস্থিগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া, রেণু রেণু হইয়া গেল না, সেজন্য দুই-চারিজন আন্তরিক আক্ষেপ করিয়া, মুহুর্মুহুঃ দীর্ঘনিঃশ্বাসে বর্ষপ্রভাতে শীতল বায়ু উষ্ণ করিয়া তুলিতে লাগিল। প্রহরীর ছুরি ফুলসাহেবের বুকে না বিঁধিয়া, ফুলসাহেবের ছুরিখানা যে প্রহরীর বুকে বিঁধিয়াছিল, এবং সেটা যে তেমন অন্ধকারে বিধাতারই একটা মহাভ্রম ঘটিয়া গিয়াছিল, সেজন্যও আবার লঘুপাপে গুরুদণ্ডের বিধানে কেহ একেবারে বিধাতার মুখাগ্নির, কেহ দগ্ধ কচু ও রম্ভার, কেহ নিত্য ব্যবহারে অর্দ্ধাংশ-ক্ষয়প্রাপ্ত পুরাতন সম্মার্জ্জনীর, এমনকি কেহ কেহ মৃত্যুর ব্যবস্থা করিয়া তবে কতকটা সন্তুষ্টচিত্ত হইতে পারিল।