ষোড়শ পরিচ্ছেদ : জুমেলিয়া ধরা পড়িল
ফুলসাহেব ধরা পড়িয়াছে। সে খুনী —সে দস্যু—সে জালিয়াৎ এবং সে ভয়ানক লোক, সুতরাং তাহার ফাঁসী হইবে। অতি অল্পক্ষণের মধ্যে কথাটা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। বাটীতে বসিয়া জুমেলিয়া ওরফে মতিবিবি সে-কথা শুনিল। প্রথমে বিশ্বাস করিল না।—হাসিয়া কথাটাকে মন হইতে একেবারে বাহির করিয়া দিল। তাহার পর অনেকের মুখে সেই একই কথা শুনিয়া বিশ্বাস করিতে হইল। তখন আপনার শয়ন-গৃহে যাইয়া, ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া মতিবিবি ঝটিকাচ্ছন্ন মাধবীলতার ন্যায় নিজের অবসন্ন দেহখানিকে প্রশস্ত বিছানার উপরে বিস্তৃত করিয়া দিল। অনেক রকম দুর্ভাবনায় তাহার সমস্ত হৃদয় উপদ্রুত ও অত্যাচারিত হইতে লাগিল।
এমন সময়ে বাহির হইতে সেই অবরুদ্ধ দ্বারের উপর করাঘাতের গুম্ গুম্ শব্দ হইতে লাগিল। জুমেলিয়া চকিতে উঠিয়া বসিল—(পাঠক, আমরা জুমেলিয়াকে আর মতিবিবি না বলিয়া এখন হইতে জুমেলিয়া বলিব।) জুমেলিয়া দৃঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কে?”
বাহির হইতে স্ত্রীকণ্ঠে উত্তর হইল, “আমি আমিনা।”
আমিনা তমীজউদ্দীনের সংসারের নবীনা দাসী; কিন্তু সে দাসীর মত থাকিত না—সে নিজের বুদ্ধি চাতুর্য্যে প্রভু-কন্যার সহচরীপদ লাভ করিয়াছিল।
জুমেলিয়া বলিল, “কেন? কি দরকার?”
আমিনা বলিল, “দরজা খোল—বলিতেছি—অনেক কথা আছে।”
জুমেলিয়া উঠিয়া কবাট খুলিয়া দিল; দেখিল বারান্দার উপরে দ্বারের সম্মুখে ভীষণ মূর্ত্তিতে দাঁড়াইয়া অরিন্দম আর তাঁহারই পার্শ্বে দাঁড়াইয়া যমদূতাকৃতি একজন দারোগা, আর একজন পাহারাওয়ালা;এবং আমিনা হাসিয়া পলাইয়া যাইতেছে—দেখিয়া, জুমেলিয়ার আপাদমস্তক শহরিয়া উঠিল। বুঝিতে বাকি রহিল না ফুলসাহেব ধরা পড়ায় সকল কথা প্রকাশ পাইয়াছে। আর আমিনা কৌশল করিয়া তাহাকে পুলিসের হাতে ধরাইয়া দিল। নিদারুণ রোষে তাহার মুখ, চোখ আরক্ত হইয়া গেল। এবং চোখ দুটি উল্কাপিণ্ডবৎ জ্বলিয়া উঠিল। কোন কথা কহিতে পারিল না; সেই মুহূর্ত্তেই—এই অংশটি পাঠ করিতে পাঠকের যতটুকু সময় ব্যয়িত হইল—তাহার শতাংশের একাংশও লাগিল না—জুমেলিয়া সবেগে বাম হস্তে আমিনার কেশাকর্ষণ করিয়া ধরিল—সেই সঙ্গে অপর হস্তে কটির বসনাভ্যন্তর হইতে একখানি শাণিতোজ্জ্বল তীক্ষ্ণাগ্র অতি দীর্ঘ কিরীচ বাহির করিয়া তাহার বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিয়া দিল—পৃষ্ঠ ভেদ করিয়া কিরীচের কিয়দংশ বাহির হইয়া পড়িল জুমেলিয়া তখনই কিরীচ টানিয়া তুলিয়া লইল। “বাবা রে—মারে—গেছি রে” বলিয়া আমিনা সেইখানে পড়িয়া শোণিতাক্ত কলেবরে লুটাইতে লাগিল। এবং প্রবলবেগে রক্ত বাহির হইয়া সেখানকার অনেকটা স্থান প্লাবিত করিল। তখন সেই পিশাচীর সম্মুখীন হওয়া কতদূর শঙ্কাজনক তাহা পাঠক সহজেই বুঝিতে পারিয়াছেন। দারোগা ও পাহারাওয়ালা ভয়ে দুই পদ হটিয়া দাঁড়াইল। অরিন্দম বুঝিলেন, এ সময়ে ভয় করিলে চলিবে না।—বরং তাহাতে বিপদ আছে; যেমন বুক হইতে জুমেলিয়া কিরীচখানি টানিয়া তুলিয়াছে, অমনি ছুটিয়া গিয়া অরিন্দম তাহার সেই কিরীচ সমেত হাতখানি মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ধরিলেন। দারোগা ও পাহারাওয়ালা তখন সত্বর হইয়া জুমেলিয়ার কেশাকর্ষণ করিয়া ধরিল; কিন্তু জুমেলিয়া সেই সময়ে অকৰ্ম্মণ্য দক্ষিণ হস্ত হইতে বামহস্তে সেই কিরীচখানি লইয়া ঘুরাইয়া তাড়াতাড়ি অরিন্দমকে আঘাত করিতে গেল; অরিন্দমকে না লাগিয়া, সেই লক্ষ্যভ্রষ্ট কিরীচ পার্শ্ববর্তী পাহারাওয়ালার কটিদেশে লাগিয়া অনেকটা বিদ্ধ হইয়া গেল। দুই হাতে ক্ষতস্থান চাপিয়া আমিনার মতন সেও রক্তপ্লাবিত দেহে মাটিতে পড়িয়া ছট্ফট্ করিতে লাগিল। দারোগা তখন দুই হাতে জুমেলিয়ার কিরীচ সমেত হাতখানি চাপিয়া ধরিল। অরিন্দম জোর করিয়া জুমেলিয়ার হাত হইতে কিরীচখানি কাড়িয়া লইলেন। তাহাতে নিজের হাতে দুই এক স্থান কাটিয়া গিয়া রক্তধারা বহিতে লাগিল; অরিন্দম সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া জুমেলিয়ার হাতে ডবল হাতকড়া লাগাইয়া দিলেন।
জুমেলিয়া ধরা পড়িল।
অরিন্দম পূর্ব্বে জুমেলিয়াকে যত সহজে গ্রেপ্তার করিবেন মনে করিয়াছিলেন, কার্য্যতঃ তাহা ঘটিল না। অরিন্দম তখন বুঝিতে পারিলেন, জুমেলিয়ার মতন এমন প্রখরা, প্রবলা, দুর্দমনীয়া মরিয়া স্ত্রীলোক আর কখনও তাঁহার দৃষ্টিগোচর হয় নাই; দুইজনকে আহত করিয়া তাহার পর সে ধরা পড়িল। দৃঢ়স্বরে জুমেলিয়া অরিন্দমকে বলিল “বড় জোর কপাল তোমার অরিন্দম! তাই তুমি আমার হাত হইতে আজ পার পাইলে, যদি আর একটু অবসর পাইতাম—যদি এত শীঘ্র আমাকে নিরস্ত্র হইতে না হইত, তাহা হইলে দেখিতে পাইতে কেমন করিয়া আমি তোমার রক্তে স্নান করিতাম!”
অরিন্দম বলিলেন, “ফুলসাহেবের উপপত্নীর পক্ষে এ বড় আশ্চৰ্য্য কথা নহে।”
জুমেলিয়া বলিল, “আমি ফুলসাহেবের উপপত্নী? এ মিথ্যাকথা তোমায় কে বলিল?”
অরিন্দম বলিলেন, “জুমেলিয়া, আমি ফুলসাহেবের মুখে সব শুনিয়াছি;তুমি বিষ দিয়া কুলসমের পিতা, মাতা, ভ্রাতাকে হত্যা করিয়াছ, তাহাও আমি তাহার মুখে শুনিয়াছি।”
জুমেলিয়া বলিল, “মিথ্যা কথা! ইহাও কি ফুলসাহেব স্বীকার করিয়াছে?”
অরিন্দম বলিলেন, “হাঁ।”
জুমেলিয়া বলিলেন, “তবে আমিও স্বীকার করিতেছি। (ক্ষণপরে), এখন আমাকে কোথায় লইয়া যাইবে?
অরিন্দম বলিলেন, “যেখানে তোমার পাপের ঠিক প্রায়শ্চিত্ত হইবে।”
জুমেলিয়া বলিল, “চল যাইতেছি; কিন্তু শুনিয়া রাখ, নির্ব্বোধ অরিন্দম! সর্পিণী অপেক্ষাও ভয়ঙ্করী জুমেলিয়াকে ঘাঁটাইয়া তুমি ভাল কাজ করিলে না; তুমি সাধ করিয়া সাপের গায়ে হাত দিয়াছ—ইহার উপযুক্ত প্রতিফল তোমাকে একদিন ভোগ করিতেই হইবে।”
অরিন্দম ব্যঙ্গস্বরে বলিলেন, “সেজন্য তোমাকে চিন্তিত হইতে হইবে না—আমার ভাবনা ভাবিতে আমার যথেষ্ট অবসর আছে। অরিন্দম তোমার মত সাতটা জুমেলিয়াকে তৃণাদপি তুচ্ছ জ্ঞান করে।।
জুমেলিয়া একটা উপহাসের অট্টহাসি হাসিয়া—হাসিতে হাসিতে বলিল, “আরে যাও, অরিন্দম, আর মুখ তুলিয়া কথা কহিয়ো না, ছিঃ ছিঃ—তাই একটা স্ত্রীলোককে ধরিতে একা আসিতে সাহস কর নাই—দল বাঁধিয়া আসিয়াছ—ধিক্ তোমায়? এখন দেখিতেছি, তোমার মত কাপুরষের দেহে অস্ত্রাঘাত না করিয়া আমি ভালই করিয়াছি—তাহাতে আমার হাত কলঙ্কিত হইত।”
জুমেলিয়াকে লইয়া অরিন্দম ও দারোগা থানায় চলিলেন। সেই কথা লইয়া তখনই গ্রামের মধ্যে আবার একটা হৈ-চৈ পড়িয়া গেল।
অনতিবিলম্বে আহতা আমিনার প্রাণবিয়োগ হইল। আঘাত তেমন সাঙ্ঘাতিক না হওয়ায় সেই পাহারাওয়ালার প্রাণটা এবারকার মত থাকিয়া গেল।
ফুলসাহেব ও জুমেলিয়াকে তথাকার জেলখানার একটা ঘরে হাজত বন্দী রাখা হইল, অধিকন্তু তদুভয়ের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে একজন প্রহরী চব্বিশঘণ্টা সেখানে ফিরিতে লাগিল।