পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : ফুলসাহেব ধরা পড়িল
অরিন্দম তখনই তাড়াতাড়ি নীচের সেই বৈঠকখানায় আসিলেন। সেখানে ছদ্মবেশী যোগেন্দ্রনাথ ও সেই দারোগা বসিয়াছিলেন। উভয়েই অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইল?”
“ডাক্তার আসিতেছে,” বলিয়া নিমেষ-মধ্যে অরিন্দম সেইখানে একখানা বেঞ্চের উপর নিজের দীর্ঘ দেহটি ছড়াইয়া দিলেন, এবং নিমেষ-মধ্যে তখন তাহাদিগকে যাহা করিতে হইবে, তাহা বলিয়া দিলেন। তাহার পর নেপথ্যে পদশব্দ শুনিয়া, অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া চক্ষু মুদিলেন।
তখন ডাক্তার ফুলসাহেব সেই বৈঠকখানার দ্বারের উপর দেখা দিলেন। ছদ্মবেশী দারোগা বলিল, “আমরা অনেক দূর হইতে আসিয়াছি। (অরিন্দমকে দেখাইয়া) এই লোকটার মূৰ্চ্ছারোগ আছে; প্রত্যহ দুইবার তিনবার মূর্ছা যায়, এতক্ষণ ভাল ছিল—এখানে আসিয়া আবার রোগে ধরিয়াছে; ভালই হইয়াছে, ইহাতে রোগ কি আমাদিগকে আর ভাল করিয়া বুঝাইয়া বলিতে হইবে না—আপনি রোগীকে দেখিয়াই ঠিক করিতে পারিবেন।”
কোন কথা না কহিয়া ফুলসাহেব রোগীর দিকে অগ্রসর হইল। নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিয়া চিনিল —এ যে অরিন্দম—অভাবনীয়রূপে চমকিত হইয়া দুই পদ পশ্চাৎ হটিয়া আসিল। মুখ চোখের ভাব বলাইয়া গেল। সে ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত—তখনই তাড়াতাড়ি পকেটের ভিতর হইতে একখানি শাণিত দীর্ঘ ছুরি বাহির করিয়া অরিন্দমের বুকে বিদ্ধ করিবার জন্য ঊর্দ্ধে তুলিল। বাতায়নপ্রবিষ্ট সূর্য্যরশ্মি লাগিয়া ছুরিখানি ঝক্ক্ করিয়া উঠিল। যোগেন্দ্রনাথ পশ্চাদ্দিক্ হইতে দুই হাতে ফুলসাহেবের সেই হাতখানি ঘুরাইয়া ধরিয়া ফেলিলেন। অরিন্দমও সহসা উঠিয়া তাহার অপর হাত দুই হাতে চাপিয়া ধরিলেন। এবং দারোগা তদুভয়ের সাধ্যমত সাহায্য করিতে আরম্ভ করিল;তখন সেই ঘরের ভিতর চারিজনের একটা খুব ধস্তাধস্তি চলিতে লাগিল। ফুলসাহেব এত বলবান্ যে অরিন্দম, যোগেন্দ্রনাথ আর দারোগা তিনজনে মিলিয়াও শীঘ্র তাহাকে বন্দী করিতে পারিলেন না। সেই ঘরের ভিতরে একটা তুমুল কাণ্ড উপস্থিত হইল—ফুলসাহেব সহজ নহে; প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টার পরে সেই তিনজন পুলিস কর্ম্মচারীর একান্ত জেদাজেদি ও আগ্রহাধিক্যে অতি পরিশ্রমের পর ফুলসাহেবের হাতে তিনজোড়া হাতকড়ি দৃঢ়সংলগ্ন হইল।
ফুলসাহেব ধরা পড়িল।
তারপর গোরাচাঁদের অনুসন্ধান করা হইল—তাহাকে পাওয়া গেল না। সে বাহিরের গোলযোগ শুনিয়া, ইতিমধ্যে ভিতর বাটীর একটা জানালা ভাঙ্গিয়া, নিজের পলায়নের পথ পরিষ্কার করিয়া লইয়াছিল। অরিন্দম উপহাসের মৃদুহাস্যে ফুলসাহেবকে বলিলেন, “কেমন গো ডাক্তারবাবু, এখন বুঝিতে পারিতেছেন যে, অরিন্দম মরে নাই—ঠিক আগের মত বাঁচিয়া আছে?”
অরিন্দমের কথা শুনিয়া ফুলসাহেবের মুখে একবার সেই চিরাভ্যস্ত অপূৰ্ব্বভঙ্গীতে-এক- অপূর্ব্বরহস্য-প্রাপ্ত অমঙ্গলের মৃদু হাসি দেখা দিল। সদর্পে সেই হাসির সহিত মিষ্টকণ্ঠে বলিল, “যতক্ষণ ফুলসাহেব বাঁচিয়া আছে, ততক্ষণ অরিন্দম না মরিলেও মরিতে বেশীক্ষণ নয়—ততক্ষণ নিজেকে নিরাপদ্ মনে করা অরিন্দমের মহাভ্রম।” তাহার পর মাথা তুলিয়া বলিল, “শোন অরিন্দম, যদি কোনরকমে কখনও তোমাদের হাত হইতে পালাইতে পারি, তখন দেখিয়ো, আবার এই ফুলসাহেব আরও কি নিদারুণভাবে—আরও কি আশ্চৰ্য্য কৌশলে তোমাকে মরণের মুখে তুলিয়া দেয়!” বলিয়া অয়ঙ্কঙ্কণাবদ্ধ হাত দুইখানি রাগ ভরে সম্মুখে উৎক্ষিপ্ত করিল—হাতকড়িগুলি পরস্পর আঘাত পাইয়া সেই সঙ্গে ঝন্ ঝন্ শব্দে বাজিয়া উঠিল।
সকলে মিলিয়া ফুলসাহেবকে থানার দিকে লইয়া চলিলেন। পূর্ব্বে যে দশজন পাহারাওয়ালাকে যোগেন্দ্রনাথ আসিতে বলিয়াছিলেন, পথে তাহাদের সহিত দেখা হইল।
অরিন্দম একজন পাহারাওয়ালা ও সেই দারোগাকে সঙ্গে লইয়া কুলসমের বাটী অভিমুখে চলিলেন। আর সকলে ফুলসাহেবকে লইয়া থানায় গেলেন।