অষ্টম পরিচ্ছেদ : অরিন্দমের বিপদ
যোগেন্দ্রনাথের নিকট হইতে বিদায় লইয়া অরিন্দম বাসা-বাটীতে ফিরিলেন। বাটীর বহির্দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ ছিল। ভিতর হইতে ভৃত্যের গম্ভীর উচ্চ ঘন ঘন নাসিকাধ্বনি অরিন্দমকে তাহার গভীর নিদ্রার পরিচয় দিল। তিনি অতিকষ্টে ভৃত্যের চৈতন্য সম্পাদন করিলেন। মনে-মনে-বিরক্ত ভৃত্য উঠিয়া তাড়াতাড়ি দ্বারোন্মুক্ত করিল। অরিন্দম দ্বিতলে নিজের শয়ন গৃহে গিয়া আহারাদির জন্য সর্বাগ্রে ব্যগ্র হইলেন। উদরস্থ অগ্নিদেব সারাদিন একাদশী করিয়া বড়ই উপদ্রব আরম্ভ করিয়াছিলেন; ইতিপূর্ব্বে সুবুদ্ধি পাচক ঠাকুর সে ঘরে আহার্য্য প্রস্তুত রাখিয়া নিজের নির্বিঘ্ন দীর্ঘনিদ্রার সুবিধা করিয়া লইয়াছিল। অরিন্দমও তাহাতে তখন অনেকটা সুবিধা বোধ করিলেন। যত শীঘ্র সম্ভব, আহারাদি শেষ করিয়া শয়ন করিলেন। নিদ্রা হইল না, তাঁহার মন কুলসম ও ফুলসাহেবের কথা লইয়া বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। তখন তিনি ফুলসাহেবের প্রদত্ত চুরুটে অগ্নি সংযোগ করিয়া টানিতে লাগিলেন—আর ভাবিতে লাগিলেন—নিদ্রার নামগন্ধ নাই; ভাবিতে লাগিলেন, “বোধহয়, আমি যাহার সন্ধানে আহার নিদ্রা বিশ্রাম ভুলিয়া দিবারাত্র ঘুরিতেছি, সে আর কেহই নয়—ঐ ফুলসাহেব। ঐ বোধহয়, সেই খুনী। অত সংশয় সন্দেহের ভিতর হইতে মন যেন বলিতেছে, ঐ ফুলসাহেব—আর কেহই নয়—সেই বালিকার হত্যাকারী।”
ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাঁহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত হইয়া আসিল। একটু তন্দ্রাবোধ হইল, মাথাটা একটু পশ্চাদ্দিকে ঝুলিয়া পড়িল, সেই সঙ্গে একটা হাই উঠিল।
অরিন্দম আপনার মনে বলিলেন, “এই যে দেখিতে পাই, এখন একটু ঘুম আসিতেছে। আকৃতিতে অনেকটা মিল আছে, লম্বা সাড়ে পাঁচ ফুট, মাংসপেশীতে বক্ষ ও স্কন্ধ অস্বাভাবিকরূপে প্রশস্ত, কোমরটা কিছু সরু, বয়সও চল্লিশ বৎসরের বেশী বলিয়া বোধ হয় না—”
তাহার পর অরিন্দম আবার একটি বৃম্ভণ ত্যাগ করিলেন। পূর্ব্বাপেক্ষা এবার কিছু বড়। অরিন্দম পূর্ব্ববৎ বলিতে লাগিলেন, “দেখিতে গৌরবর্ণ তেমন উজ্জ্বল না হইলেও—” আবার একটা হাই উঠিল—”পরিষ্কার বটে, বিশেষতঃ মুখের চেয়ে হাত দুখানার রং কিছু বেশী পরিষ্কার—” এবার একটা বড় রকমের হাই উঠিল।
“একি! আজ এত ঘুম পাইতেছে কেন? বরং ইহা অপেক্ষা বেশী রাত্রেই প্রায় ঘুমাইয়া থাকি, কোনদিন ত এমন হয় না।” এই বলিয়া অরিন্দম উঠিয়া গৃহমধ্যে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। সেইরূপ আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন, “চুলগুলি একটু কোঁকড়া, খুব কাল”–আবার একটা হাই উঠিল, তাহার পর আর একটা—আর একটা—”চুলগুলি মাপেও সেইরূপ বড়–”আবার একটা হাই উঠিল—”নিশ্চয়ই এই ফুলসাহেব সেই বালিকাকে হত্যা করিয়া সিন্দুক মধ্যে লাস্ চালান করিয়াছিল।”
অরিন্দম আর দাঁড়াইতে পারিলেন না—বসিয়া পড়িলেন। হাতের উপরে মাথা রাখিয়া ঢুলিতে লাগিলেন। একটার পর একটা—তার পর একটা—আর একটা—ক্রমান্বয়ে হাই উঠিতে লাগিল। চিন্তামগ্ন অরিন্দম তন্দ্রাজড়িতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “ফুলসাহেবেরও দাড়ি গোঁফ নাই—” আবার হাই উঠিল—”লোকটা যেরূপ মিষ্টভাষী”—আবার হাই উঠিল—”দেখিলাম—” আবার হাই উঠিল—”তাতে’ আবার একটা হাই উঠিল—”কি”আবার একটা হাই উঠিল—”বো-
আবার একটা হাই উঠিল—”ধ—” আবার একটা—অরিন্দম শেষে আর কথা কহিতে পারিলেন না। তিনি সেই অর্দ্ধদগ্ধ চুরুট দূরে নিক্ষেপ করিলেন। মাথার উপরে দুইখানি হাত ঋজুভাবে তুলিয়া, দুই হাতের অঙ্গুলিগুলি পরস্পর সংবদ্ধ রাখিয়া ঊর্ধ্বমুখে কেবলই জম্ভণ ত্যাগ করিতে লাগিলেন। একটার পর একটা—একটার সঙ্গে আর একটা—সেই সঙ্গে আর একটা, এইরূপ জম্ভণের উপর জম্ভণ ত্যাগ করিতে লাগিলেন। একবার মুখ বন্ধ করেন, এমন অবসরটুকুও পাইলেন না। চক্ষু মুদিত হইয়া আসিল। যদিও একবার জোর করিয়া চাহিলেন, কিছুই দেখিতে পাইলেন না—চারিদিকে ঘন অন্ধকার; ঘরে যদিও দীপ জ্বলিতেছিল, তথাপি তিনি অন্ধের ন্যায় হাতড়াইয়া বিছানা খুঁজিতে লাগিলেন। তাঁহার মস্তিষ্কে তখন এমন একটা যন্ত্রণা হইতেছিল, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ এমনই ভাবে অসাড় হইয়া আসিতেছিল যে, অপর কেহ হইলে এতক্ষণ তাহার ভবলীলা সাঙ্গ হইয়া যাইত। অরিন্দম মৃদুস্বরে বলিলেন, “অবশ্যই আমি কিছু খেয়েছি;নতুবা এমন হইবে কেন? ওঃ! ঠিক হইয়াছে! ঐ চুরুটে কোন রকম বিষ ছিল! কি সৰ্ব্বনাশ! নিশ্চয়ই ফুলসাহেব নরঘাতী পিশাচ—এখন আর কোন সন্দেহ নাই—এখন ঠিক বুঝিতে পারিয়াছি, বালিকার হত্যাকারী আর ফুলসাহেব একই ব্যক্তি। পিশাচ পত্রে লিখিয়াছিল, একদিন অরিন্দমকে হত্যা করিবে, শীঘ্রই সে তার প্রতিজ্ঞা পালন করিয়াছে!”