ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : কুলসম সম্বন্ধে
ফুলসাহেব যখন বলিলেন, সন্ধ্যা হইয়া আসিল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতে বিলম্ব ছিল না। এসময়ে কামদেবপুরের পথ নির্জ্জন, কদাচিৎ দুই-একজন লোকের গতিবিধি। পথের দুইধারে ছোট- বড় ডোবা বনজঙ্গল, বড় বড় গাছপালা; কোথায় বড় বড় বাঁশঝাড় মাথার উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া খানকার পথটা একেবারে অন্ধকার করিয়া ফেলিয়াছিল। বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণ হইয়া মধ্যে মধ্যে এক- একবার বিকট শব্দ হইতেছিল। শৃগালেরা এদিক্-ওদিক্ করিয়া সেই অন্ধকার পথের উপরে ছুটাছুটি করিতেছিল; কোন কোনটা দূর বন মধ্যে গিয়া হাঁকিয়া হাঁকিয়া নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ দিক্দিগন্তে বিস্তৃত করিতেছিল। এবং নিজেদের নিদ্রার ব্যাঘাত হইতেছে দেখিয়া, পরিশ্রান্ত কুকুরেরা নিকটবর্ত্তী গ্রাম হইতে তাহাদিগকে নীরব থাকিবার জন্য কর্তৃত্বের নিরতিশয় কর্কশকণ্ঠে বারংবার ভর্ৎসনা করিতেছিল। মাথার উপরে নিবিড় বাঁশঝাড়, অশ্বত্থ-বটের ঘনপত্রাচ্ছন্ন শাখা-প্রশাখা, তদুপরিস্থিত কৃষ্ণমেঘাবৃত নীরব আকাশ সন্ধ্যাকে স্বাগত সম্ভাষণ করিবার পূর্ব্বে কামদেবপুরের পথ হইতে বিদায় অভিনন্দনে পরিতুষ্ট করিয়াছিল। অরিন্দম সেই অন্ধকারময় পথ অতিক্রম করিতে করিতে তখনও কুলসম ও ফুলসাহেবের কথা ভাবিতেছিলেন। কুলসম তাঁহাকে ফুলসাহেবের সম্বন্ধে যেসকল কথা বলিয়াছিল কই ফুলসাহেবকে তেমন ভয়ানক কিছুই দেখিলেন না; ফুলসাহেব পূর্ব্বাপর নিতান্ত ভদ্রলোকেরই ন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন। কুলসমের কথা শুনিয়া আগে তাঁহার মনে হইয়াছিল, হয়ত পথে ফুলসাহেব তাঁহাকে একা পাইয়া ছুরি মারিবেন, না হয়ত পিস্তল ধরিবেন, কি অন্য কোন প্রকারে তাঁহাকে বিপদগ্রস্ত করিতে চেষ্টা করিবেন। সেরকম কিছুই দেখিলেন না; সুতরাং তখন তিনি মনে করিলেন, কুলসমের মস্তিষ্ক কোন কারণে বিকৃত হইয়া থাকিবে; হয় ত ফুলসাহেবের উপরে তাহার কোন কারণে দারুণ ঘৃণা জন্মিয়া থাকিবে। যাই হোক্, ফুলসাহেবের কথা লইয়া এখন ভাবিলে চলিবে না। এখন তাঁহার হাতে অনেক কাজ আছে; সেসকল কাজ আগে শেষ করিতে হইবে।
যথাসময়ে কামদেবপুর আসিয়া, বাসায় যাইবার পূর্ব্বে অরিন্দম একবার যোগেন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিতে থানায় উপস্থিত হইলেন।
তখন যোগেন্দ্রনাথ সেখানে বসিয়া দুই-একখানি প্রয়োজনীয় পত্র লিখিতে নিবিষ্টচিত্ত ছিলেন। অরিন্দমকে দেখিয়া, তখনকার মত লেখনী বন্ধ করিয়া তাড়াতাড়ি উঠিলেন; তিনি অরিন্দমকে উপবেশন করিতে বলিয়া তাঁহার নিকটে আর একখানি স্বতন্ত্র চেয়ারে উপবেশ করিলেন। বলিলেন, “হঠাৎ কি মনে করিয়া, অরিন্দম-বাবু? সেই বালিকার মৃতদেহের কেস্টা কিছু করিতে পারিলেন কি?”
অরি। না—এ পর্যন্ত কিছু করিতে পারি নাই।
যো। রেবতী সংক্রান্ত ঘটনার, সেই কেশব নামে লোকটার কোন সন্ধান হইল কি?
অ। না, তাহা হইলে আপনি সংবাদ পাইতেন। সে কথা থাক্, আমি এখন আপনাকে আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি; ফুলসাহেব বলিয়া কোন লোককে আপনি জানেন কি?
যো। ফুলসাহেব? এখানকার সকলেই তাঁহাকে জানে।
অ। সকলেই কেন যে তাঁহাকে জানে, তা আপনি জানেন কি?
যো। লোকটা চিকিৎসা বিদ্যায় খুব পারদর্শী। এখানকার অনেকের বাড়ীতে ফুলসাহেব চিকিৎসা করিয়া থাকেন। কেন অরিন্দমবাবু, তাঁর কথা আপনি বার বার জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?
অ। আগে আমার কথার উত্তর দিন, তাহার পর আপনার কথার উত্তর করিব। আপনি তমীজউদ্দীনকে চেনেন কি?
যো। চিনি বৈকি, তিনি একজন বিখ্যাত জমিদার।
অ। তিনি প্রভূত ধনশালী, কেমন না?
যো। নিশ্চয়ই, তাঁহার বিষয় আমি কিছু কিছু জানি।
অ। বলুন দেখি।
যো। আজ দুই বৎসর ধরিয়া তাঁহার স্বাস্থ্যভঙ্গ হওয়ায় তিনি এখন শয্যাশায়ী। ইতিমধ্যে তাঁহার পত্নীর মৃত্যু হয়, তাহার পর তিনি আবার বিবাহ করিবার জন্য উৎসুক হন; কিন্তু তাঁহার কন্যা, যাহাতে তিনি আর বিবাহ না করেন, সেজন্য চেষ্টা করিতে থাকে। তমীজউদ্দীন তাঁহার সেই কন্যাকে অতিশয় ভালবাসেন; পাছে সে জানিতে পারে, এজন্য গোপনে বিবাহ করেন। এবং যাঁহাকে বিবাহ করেন, শুনিয়াছিলাম, তিনি ঐ ডাক্তার ফুলসাহেবের একজন আত্মীয়ের কন্যা, সেইজন্য ফুলসাহেবই এ বিবাহের বিশেষ উদ্যোগী হইয়াছিলেন। বিবাহের পূর্ব্বে ভিতরে ভিতরে বৃদ্ধ তমীজউদ্দীন আর একটি বড় বুদ্ধিমানের মত কাজ শেষ করিয়াছিলেন। তিনি নিজের মত কিছু রাখিয়া স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি তাঁহার কন্যাকে দানপত্র লিখিয়া দিয়াছেন; তাহার কিছুদিন পরে তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সেসকল জানিতে পারেন। তখন তিনি আত্মহত্যা করিবেন বলিয়া স্বামীকে বারংবার ভয় দেখাইতে লাগিলেন;কারণ বিবাহের পূর্ব্বে দানপত্র সমাধা হইয়াছিল, স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁহার এক কপদকও পাইবার সম্ভাবনা ছিল না। কখনও তিনি রাত্রে দড়ি লইয়া ঘুরিতেন, কখনও তাঁহার বাক্সে আফিম থাকিতে দেখা যাইত, কাজেই তমীজউদ্দীন মহাবিভ্রাটে পড়িলেন। শুনিলাম, তাহার পর না কি তমীজউদ্দিন তাঁহার কন্যাকে অনেক বুঝাইয়া বলিয়া-কহিয়া একলক্ষ টাকা চাহিয়া লইয়াছেন; সেই টাকাটা তাঁহার স্ত্রীর নামে উইল করিয়া দিয়াছেন।
অরিন্দম বলিলেন, “তমীজউদ্দীন যে মারা গিয়াছেন!”
সবিস্ময়ে যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সে কি! বলেন কি!”
অরি। আজ সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমারই হাতের উপরে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।
যো। তারপর——তারপর—
অ। তার পর আর কি—এখন তাঁহার কন্যা সমস্ত বিষয়ের অধিকারিণী হইল।
যো। তাহা ত হইবারই কথা।
অ। কত টাকার বিষয় হবে?
যো। প্রায় বিশ লক্ষ টাকার।
অ। বিশ লক্ষ! বলেন কি? আচ্ছা, বিশ লক্ষই যেন হইল। এখন বলুন দেখি, ফুলসাহেব অবিবাহিত কি না?
যো। হয় অবিবাহিত, নয় তাঁহার স্ত্রী গতায়ুঃ হইয়া থাকিবেন। একথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?
অ। জিজ্ঞাসা করিতে দোষ কি? হঠাৎ কথাটা মনে উঠিল, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করিলাম।
যো। আমার কাছে এতটা গোপন করা কি আপনার ভাল দেখায়?
অ। তমীজউদ্দীনের কন্যাকে ফুলসাহেব এখন বিবাহ করিবার চেষ্টায় আছেন।
যো। বটে, ফুলসাহেব বড় চতুর লোক! তাঁহাকে দেখিলে সেটি বেশ বুঝা যায়। তবে শুনিয়াছি, তমীজউদ্দীনের মেয়েটা কিছু পাগলাটে ধরনের
অ। যাক্, ফুলসাহেব লোকটা কেমন বলুন দেখি? এমন ভাবে বলিবেন, যে কখনও দেখে নাই, সে যেন দেখিলেই চিনিতে পারে। মধ্যে মধ্যে আপনি পলাতক খুনী আসামীকে ধরিবার জন্য যেমন অবিকল রূপবর্ণনা করিয়া চারিদিকে হুলিয়া পাঠান, বর্ণনাটা যেন ঠিক সেই রকমের হয়।
যো। বলিতেছি, কিন্তু আমি যে আপনার এসকল কথার মানে কিছুই বুঝিতেছি না।
অ। ইহার পর বুঝিবেন। এখন একবার ফুলসাহেবের রূপবর্ণনা করুন দেখি।
যো। লোকটা মোটা—
অ। কিরকম মোটা বলুন, সাধারতঃ লোক যেরূপ মোটা হইয়া থাকে, সেইরূপ মোটা, না ব্যায়ামাদির দ্বারা যেরূপ চুয়াড় ধরনের মোটা হয়, সেইরূপ মোটা?
যো। মোটের উপরে এখন একরকম মোটা বলিয়াই মনে করুন না। লম্বায় পাঁচ ফুট ছয়-সাত ইঞ্চির বেশী নয়, গৌরবর্ণ, বয়স চল্লিশের মধ্যে, মুখখানি একটু গোলাকার, কপালের পাশে একটা বড় আঁচিল আছে, নাকটা টানা ও একটু লম্বা, গোঁফ দাড়ি কামান, সৰ্ব্বদাই হাসিমুখ, চুলগুলি অল্প কোঁকড়া, চলিবার সময়ে একপাশে মুখখানি প্রায় বাঁকাইয়া চলেন, মুখে সৰ্ব্বদাই মিষ্টকথা লাগিয়া আছে, চোখ দুটির দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ণ, ছোটর উপর টানা চোখ।
অ। কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে ফুলসাহেবের সঙ্গে আমার যথেষ্ট আলাপ হইয়াছে; লোকটা খুব আলাপী বটে।
যো। ফুলসাহেবকে যদি আপনি দেখিয়াছেন, তখন তাঁহার রূপ বর্ণনা শুনিতে আপনার কি এত আবশ্যক, অরিন্দমবাবু?
অ। কিছুই না।
যো। আপনি আবশ্যক ছাড়া নিঃশ্বাসটি ফেলিতেও কুণ্ঠিত হন্, আর বলিতেছেন, কিছুই না? আমি কি আপনাকে জানি না।
অ। কিছুই না, তবে এইটুকু জানিবেন, যদি আমার হাতে একটা উপস্থিত খুনী কেসের ভার না থাকিত, তাহা হইলে আমি একবার ডাক্তার ফুলসাহেবের চরিত্রটা সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করিবার চেষ্টা করিতাম।
যো। ফুলসাহেবের উপরে সহসা আপনার এমন কৃপাদৃষ্টিপাত কেন হইল?
অ। তিনি এখন তমীজউদ্দীনের মেয়েকে বিবাহ করিয়া তাঁহার সমস্ত বিষয় আত্মসাৎ করিবার চেষ্টায় ফিরিতেছেন।
যো। ফুলসাহেব যেরূপ চতুর লোক—তাহাতে তাঁহার পক্ষে সেটা বড় আশ্চর্য্যের কথা নহে তবে শুনিয়াছিলাম, তমীজউদ্দীনের মেয়েটি নাকি কিছু মাথা পাগ্লা গোছের?
অ। এই আপনি আর আমি যেরূপ মাথা-পাগ্লা গোছের—সেই রকম, তার বেশী বলিয়া আমার বোধ হয় না। আমি তাহাকে দেখিয়াছি, তাহার নাম কুলসম। যোগেন্দ্রবাবু, শীঘ্রই দেখিতে পাইবেন, কুলসমের অদৃষ্টে এই তিনটি ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা নিশ্চয় ঘটিবে। হয়, কুলসম ফুলসাহেবের স্ত্রী হইবে; সেটি যদি না ঘটিয়া উঠে, কুলসম মরিবে; সেটিও যদি না ঘটে—
যো। [ বাধা দিয়া ] তাহা হইলে কি হইবে?
অ। তাহা হইলে নিশ্চয় জানিবেন, অরিন্দমের এসম্বন্ধে একটু মাথা-ব্যথা পড়িবে; সে এ-বিপদের মুখ হইতে একদিন কুলসমকে উদ্ধার করিবে।