তৃতীয় পরিচ্ছেদ : খুনি কে?
অরিন্দম দুই হাতে ধরিয়া সেই মৃতদেহ টানিয়া তুলিয়া সিন্দুক হইতে বাহির করিলেন। পার্শ্বের উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়া প্রভাত-রবির রক্তাক্ত কিরণ সেই রক্তাক্ত মৃতদেহে পড়িয়া ভয়ানক দৃশ্য আরও ভয়ানক করিয়া তুলিল। অরিন্দম যোগেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “যোগেন্দ্রবাবু, ব্যাপার কি?”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “ব্যাপার কি—আমি কি বলিব? যাহা দেখিতেছেন, তাহাই;এখন আপনাকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে, এ ব্যাপার কি—সেইজন্যই আপনাকে আনিয়াছি।”
অরিন্দম মৃদুহাস্যে বলিলেন, “সময়ে আমিই বুঝাইয়া দিব। এ খুন কে করিল?”
যোগেন্দ্র। আপনি জানেন, আপনি তাহা বলিবেন।
অরিন্দম। ভাল, আমিই একদিন বলিব। এখন আপনি বলুন দেখি, এ লাস আপনি কোথায়, কিরূপে পাইলেন?
যো। এইখানে—থানায়। কাল রাত দুইটার পর মুটে-মজুরের মত একটা হিন্দুস্থানী লোক এই সিন্দুকটা মাথায় করিয়া আমাদের এই থানার সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল। এত রাত্রে এত বড় একটা সিন্দুক লইয়া, তাহাকে যাইতে দেখিয়া আমাদের রামদীন পাহারাওয়ালার সন্দেহ হয়—সে তখনই আমাকে খবর দেয়। আমি তখন রামদীনকে সেই লোকটাকে গ্রেপ্তার করিতে বলিলাম। রামদীন লোকটাকে ধরিয়া আনিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহার কাছে সেই সিন্দুকের চাবি আছে কি না। তাহাতে সে বলিল, চাবি নাই। তখন চোর বলিয়া তাহার উপরে আমার সন্দেহ হইল। সেই লোকটাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, কোথা হইতে সে আসিতেছে, কোথায় যাইবে, কাহার সিন্দুক। তাহাতে সে আপনার নাম করিয়া বলিল, আপনার নিকটেই সে এই সিন্দুক লইয়া যাইতেছিল।
অ। [ সবিস্ময়ে] আমার নিকট!
যো। তার মুখে শুনিলাম, কলিকাতায় আপনার কে বন্ধু আছে, তিনি আপনাকে এই সিন্দুকটি পাঠাইয়াছেন। লোকটার চেহারা দেখিয়া আমার মনে বড়ই সন্দেহ হইয়াছিল বলিয়া লোকটাকে ছাড়িয়া দিলাম না—আটক করিয়া রাখিলাম বটে, তবে আপনার লোক শুনিয়া আমি সে লোকটার উপর তেমন নজর রাখিবার আবশ্যকতা দেখিলাম না। কেবল সিন্দুকটা এই ঘরে আটক করিয়া রাখিয়া দিলাম। তাহার পর দেখি, রাত্রি শেষ হইতে না হইতে সে লোকটি পলাইয়া গিয়াছে। সকালে উঠিয়া মনে করিলাম, সিন্দুকটি আপনার ওখানে পাঠাইয়া দিব;সিন্দুকটি বাহির করিয়া দেখি, তলার কাঠখানার জোড়ের চারিদিকে রক্তের দাগ। তখন আমি সিন্দুক ভাঙিয়া ফেলিলাম।
অ। যে লোক এই সিন্দুক বহিয়া আনিয়াছিল, তাহাকে দেখিতে কেমন? বয়স কত?
যো। বয়স ত্রিশ বৎসর হইবে। লোকটা হিন্দুস্থানী। আকৃতি যতদূর বিকট হইতে হয়। মুখখানা দেখিতে আরও বেশী বিকট; তাহাকে দেখিলে মানুষ বলিয়া হঠাৎ বুঝায় না। নাকটা খুব মোটা, চোখ দুটা ছোট, ঠোট দুখানি এমন পুরু, যেন উল্টাইয়া পড়িয়াছে, দেহখানা বেশ হৃষ্টপুষ্ট;রং এত কাল, তার মৃত্যুর পর গায়ের চামড়াখানা পাইলে বেশ বার্নিশ করা কয়েক জোড়া জুতা তৈয়ারী হইতে পারে। কপালে তিন-চারিটি কাটা দাগ আছে।
অরিন্দম সেই বালিকার মৃতদেহ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। মৃত বালিকার শিথিল কবরীতে দুইটি রূপার তৈয়ারী মাথার কাঁটা ছিল, তাহা তুলিয়া লইয়া নিজের নিকটে রাখিয়া দিলেন।