দ্বিতীয় খণ্ড : শোণিত প্রবাহ – প্রথম পরিচ্ছেদ : কুলসম
অরিন্দম নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না। যে হত্যাকারী সেই বালিকার লাস সিন্দুকের মধ্যে পুরিয়া, থানায় পাঠাইয়া একটা অতি বড় দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়াছিল, যতক্ষণ না তাহাকে কোন রকমে ধরিতে পারিতেছেন, তিনি কিছুতেই নিরুদ্বিগ্ন হইতে পারিবেন্ না। তিনি ইহাও বুঝিতে পারিয়াছিলেন, যত ঘটনা ঘটিতেছে, সকলের সঙ্গে সকলের যেন কিছুনা কিছু সংস্রব আছে। সকলেই যেন এক শৃঙ্খলে গ্রথিত; তথাপি তিনি সেই সকলের মধ্যে এমনভাবে জড়াইয়া পড়িলেন যে, কিছুকালের জন্য তিনি কোন উপায় অবধারণে সমর্থ হইলেন না। যেখানে সন্দেহের একটু ছায়াপাত দেখিতেন, সেইখানেই যাইতেন, যতদূর সম্ভব সংবাদাদি সংগ্রহ করিতেন; কিন্তু কাজে এ পর্য্যন্ত কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। অরিন্দমের ন্যায় একজন নামজাদা ডিটেক্টভের পক্ষে ইহা নিশ্চয়ই একটা গুরুতর কলঙ্কের কথা।
একদিন অপরাহ্ণে তিনি দূর লোকনাথপুর গ্রামের মধ্যে দিয়া বাটী ফিরিতেছেন। প্রাতঃকালে বাহির হইয়াছিলেন, তখনও তাঁহার আহারাদি হয় নাই। লোকনাথপুর তাঁহার বাসা-বাটী হইতে কিছু- কম এক ক্রোশ—বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। তখন পশ্চিম গগনে থাকিয়া কতকগুলি তরল নির্গলিতাম্বুগর্ভ শ্বেতাম্বুখণ্ড অস্তগত-প্রায় রবির স্বর্ণোজ্জ্বলকিরণ-রঞ্জিত হইয়া বড় সুন্দর দেখাইতেছিল। আরও সুন্দর দেখাইতেছিল, তাহারই কোমলোজ্জ্বলচ্ছায়া বীচিচঞ্চলবক্ষে ধরিয়া লোকনাথপুরের আম জাম নারিকেলবৃক্ষপরিবৃত স্বনামখ্যাত বিমলী* সরোবর। এসকল ফেলিয়া চাহিয়া দেখিতে হয়, এমন এক অপূৰ্ব্ব শোভাময় তখন ঐ সরোবরের পশ্চিমঘাটে বিকশিত ছিল, যেখানে অনেকগুলি সৌন্দর্য্য সমুজ্জ্বলা স্নিগ্ধজ্যোতিৰ্ম্ময়রূপিণী নবীনা, কেহ আকণ্ঠনিমজ্জিত, উপরে অতি সুন্দর মুখখানি, সদ্যঃপ্রোদ্ভিন্ন পদ্মবৎ, তাহারই উপরে একখণ্ড অতি সুন্দর হেমাভকিরণ। কেহ ডুবিয়াছে—কালোজলে তাহারই রাশীকৃত কালো কেশগুলির উপরে তরঙ্গে তরঙ্গে আন্দোলিত হইতেছে—সেখানে একখণ্ড অতি সুন্দর হেমাভকিরণ। যেখানে কেহ সাঁতার কাটিতেছে, কেহ ঢেউ দিতেছে, এবং কেহ জল ছিটাইতেছে, সেখানে সেই অতি সুন্দর হেমাভকিরণ খণ্ড খণ্ড, চঞ্চল—তথাপি অতি সুন্দর!
[*এইরূপ প্রবাদ, বিমলা নাম্নী কোন বৃদ্ধা ঐ পুষ্করিণীর তটে একখানি পর্ণকুটির বাঁধিয়া আমরণ বাস করিয়াছিল; সেইজন্য উহার এইরূপ অপূর্ব্ব নামকরণ। যখনকার কথা বলিতেছি, তখন সে বিমলা ছিল না, এবং তাহার পর্ণকুটিরের কোন চিহ্ন ছিল না। এখন সেই পুষ্করিণীরও চিহ্নমাত্র নাই।]
যখন সকলে যে যাহার কাজ সারিয়া, একে একে উঠিয়া যাইতেছিল, অরিন্দম তখন সেই পুষ্করিণীর দক্ষিণপার্শ্ব দিয়া ফিরিতেছিলেন। তিনি দেখিলেন, সকলেই চলিয়া গেল, একজন গেল না সে বসিয়া রহিল। তাহার রূপে সেখানটা আলো করিয়া সে বসিয়া রহিল। তাহার সে রূপের বর্ণনা হয় না। বুঝি, সেই ষোড়শবর্ষীয়া সুন্দরীই বিধাতার একমাত্র চরমোৎকৃষ্ট শিল্পচাতুৰ্য্য। এত অল্প বয়সে সর্ব্বাঙ্গে এমন পরিণত ভাব বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। কি সেই স্নেহপ্রফুল্ল মুখখানি! কি সেই বিশালায়ত, ফুল্লেন্দীবরতুল্য চক্ষু, সেই চোখে পীযূষনিস্যন্দিনী দৃষ্টি! যেমন আকর্ণবিশ্রান্ত চক্ষু, তেমনি আকর্ণবিশ্রান্ত চিত্ররেখাবৎভ্রুযুগল, তেমনি চূর্ণকুন্তলাবৃত অৰ্দ্ধ প্রকাশিত ললাট; তেমনি সেই সুগঠিত নাসিকা, তেমনি অধর নির্ম্মল, স্ফুরিত, রক্তাভ; ললিত, নির্ম্মল, আরক্ত সে কাপোলদুটির কমনীয়তা চোখে না দেখিলে লিখিয়া কি বুঝান যায়! সে চিবুক দেখিয়া কে না বলিবে, যাহা কখন দেখি নাই, তাহা দেখিলাম? এ যে পুষ্পপরাগসমাচ্ছন্ন নবনীর সমষ্টি! সংসর্পী, দীর্ঘ অথচ কুঞ্চিত, রাশীকৃত সিক্ত কৃষ্ণকেশাদাম গুচ্ছে গুচ্ছে কতক বা পৃষ্ঠে, কতক বা ঈষদুন্নত বক্ষে সংলগ্ন রহিয়াছে। সেই শশাঙ্করশ্মিরুচির বর্ণবিভার নিকটে গোধূলির উজ্জ্বলতম কাঞ্চনঘটাও ম্রিয়মাণ বোধ হইতেছিল। পাঠক! আপনি কি ভাদ্রের ভরা নদী কখনও দেখেন নাই? যদি দেখিয়া থাকেন, বুঝিতে পারিবেন, এই বরবপুতে কেমন সে অলোকসামান্য সৌন্দর্য্যরাশি সেইরূপ কূল কূলে উছলিতেছিল—অথচ সীমাতিক্রম করে নাই। সর্ব্বাঙ্গ পূর্ণায়ত পরিপুষ্ট প্রসৃত, সেই সবর্বাঙ্গ বহিয়া অপরূপ রূপরাশি উচ্ছ্বসিত। সেই নির্জ্জনতার মধ্যে, গাছ-পালার মধ্যে, গোধূলির কনকরাগের মধ্যে, মৃদুমন্দ স্নিগ্ধ সমীরণের মধ্যে, দিদিগন্ত পরিব্যাপ্ত ফুলগন্ধ মধ্যে থাকিয়া ঘাটের শৈবালাচ্ছন্ন প্রস্তর চাতালে বসিয়া সেই বনদেবীমূৰ্ত্তি চিত্রার্পিতপ্রায় ও নীরব।
যখন সেই সুন্দরী দেখিল, সেখানে সে ছাড়া আর কেহ নাই, তখন উঠিয়া তাড়াতাড়ি জলে নামিল এবং অধিক জলে গিয়া ডুবিল। অনেকক্ষণ গেল তথাপি উঠিল না। অরিন্দম দূরে থাকিয়া দেখিয়া বিস্মিত হইলেন, বড় কিছু বুঝিতে পারিলেন না। তিনি সেই সরোবরের পূর্ব্ব-পশ্চিম কোণে বটবৃক্ষতলে গিয়া দাঁড়াইলেন; মনে কেমন একটা সন্দেহ হওয়াতে তিনি সেইখানে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিলেন, তথাপি সেই লোকললামভূতা সুন্দরী উঠিল না; অরিন্দম চিন্তিত হইলেন, এত অধিকক্ষণ জলে ডুবিয়া থাকা মনুষ্যমাত্রেরই অসাধ্য। তিনি দেখিলেন, যেখানে সে ডুবিয়াছিল, তাহার আরও অনেকটা দূরে দুইখানি হাত একবার ভাসিয়া উঠিতেছে, আবার ডুবিয়া যাইতেছে, আবার কিছুদূরে গিয়া ভাসিয়া উঠিতেছে।
তখন অরিন্দমের বুঝিতে আর বাকী রহিল না। তিনি তাড়াতাড়ি জলে নামিলেন। সেই হাত- দুখানি আবার ভাসিয়া উঠিতে ধরিলেন, এবং নবীনাকে ঘাটে আনিয়া তুলিলেন। নবীনা যদিও সংজ্ঞাশূন্য হয় নাই, কিন্তু সে এত অবসন্ন হইয়াছিল যে, বসিতে পারিল না, ঘাটের চাতালের উপরে শুইয়া পড়িল। এবং জল এত অধিক পরিমাণে তাহার উদরস্থ হইয়াছিল যে, কথা কহিতে পারিল না—এমনকি নিঃশ্বাস ফেলিতে কষ্ট হইতেছিল, একটা নিঃশ্বাস দুই-তিনবারে টানিতেছিল।
দেখিতে দেখিতে সেখানে গ্রামের অনেকগুলি লোক আসিয়া পড়িল। অরিন্দম তাহাদের মুখে শুনিলেন, সেই! জলমগ্নাসুন্দরী সেইখানকার বিখ্যাত ধনী তমীজউদ্দীনের কন্যা—নাম কুলসম। তাহারা সকলেই সেই তমীজউদ্দীনের প্রজা; তাহাদের সাহায্য পাইয়া অরিন্দম কিছু সুবিধা বোধ করিলেন, কুলসমকে বারংবার ঘুরাইয়া ও উঠা-বসা করাইয়া, তাহার উদরস্থ সমস্ত জল বমন করাইয়া ফেলিলেন। কুলসম অনেকটা সুস্থ হইল। একবার অরিন্দমের মুখপানে চাহিয়া মৃদুনিক্ষিপ্তশ্বাসে বলিল, “কেন আপনি আমার জন্য এত করিলেন? ভাল করিলেন না, আমার মরণই ভাল ছিল।”
অরিন্দম সে কথায় কোন কথা কহিলেন না। যখন কুলসমের শারীরিক অবসন্নতা অনেকটা কমিয়া আসিল, তখন একদিকে অরিন্দম, অপরদিকে অপর একটি লোক কুলসমের হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। কুলসম তাহাদের সঙ্গে ধীরপাদবিক্ষেপে চলিতে লাগিল। বেশী দূরে নয়, সেইখানেই সেই সরোবরের পূর্ব্বপার্শ্বে তমীজউদ্দীনের প্রাসাদতুল্য প্রকাণ্ড অট্টালিকা।