ষোড়শ পরিচ্ছেদ : ছদ্মবেশ
পরদিন বেলা দ্বিপ্রহরের পর অরিন্দম বৃদ্ধবেশে যদুনাথ গোস্বামীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইলেন। নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণে অরিন্দমের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। এমনকি তিনি যখন যেকোন প্রকার ছদ্মবেশে বাহির হইতেন, কোন পরিচিত ব্যক্তিও তাঁহাকে চিনিতে পারিত না;অনেক সময়ে পুলিসের অধ্যক্ষ যোগেন্দ্রবাবুও ভ্রমে পড়িতেন। অরিন্দমের বয়স পঞ্চাশের নিকটবর্ত্তী। অনেক রকমের ছদ্মবেশ ধরিতে হয় বলিয়া, তিনি প্রত্যহ প্রাতে নিজ হস্তে নিজ শ্মশ্রুগুম্ফের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ সাধন করিয়া থাকেন। যদুনাথ গোস্বামীর সহিত অরিন্দমের সহজেই দেখা হইল। তখন যদুনাথ গোস্বামী আহারাদি শেষে বাহিরের ঘরে বসিয়া তাম্বুল চর্ব্বণ ও ধূমপানে রত ছিলেন। অর্দ্ধ শায়িত অবস্থায় ছিলেন, একজন অপরিচিত বৃদ্ধকে সম্মুখীন দেখিয়া উঠিয়া বসিলেন।
ছদ্মবেশী অরিন্দম বলিলেন, “মশাই বলতে পারেন, এখানে যদুনাথ গোস্বামী কোথায় থাকেন?”
যদুনাথ বলিলেন, “আমারি নাম। কি আবশ্যক বলুন দেখি? কোথা হ’তে আপনি আসছেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “অনেক দূর হ’তে আছি, আপনারই এক শিষ্যের বাড়ী হ’তে। উঃ বড় গরম, কি রোদ দেখছেন! উঃ বড় সু-খবর, তিনি শিব-প্রতিষ্ঠা করবেন, বড়লোক একেবারে বাঞ্ছাকল্পতরু হবেন; বিশেষতঃ আপনি তাঁর গুরু, আপনার পাথরে পাঁচ কীল! উঃ! কী গরম—প্রাণ যে যায়!”
যদুনাথ অপেক্ষাকৃত আকৃষ্টচিত্তে বলিলেন, “কে তিনি? আমার ত সকল শিষ্যই বড়লোক।”
অরিন্দম কপালের ঘাম মুছিতে মুছিতে বলিলেন, “বলছি—বড় গরম উঃ! একটু জল;পিপাসায় বুক থেকে গলাটা অবধি শুকিয়ে উঠেছে।”—ঘরটির দুইটি দ্বার, একটি বাহিরের দিকে, অপরটি ভিতরের দিকে। শেষোক্ত দ্বার দিয়া যদুনাথ গোস্বামী জল আনিতে বাড়ীর ভিতরে গেলেন। সেইদিকে আরও একটি গবাক্ষ ছিল; অরন্দম দেখিলেন, সেই গবাক্ষের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বিষণ্নমুখে সেই সৰ্ব্বাঙ্গ সুন্দরী—যাহাকে পূর্ব্বদিন একবার বাটীর পশ্চাদ্ভাগের গবাক্ষে এক মুহূর্ত্তের জন্য দেখিয়াছিলেন। অরিন্দমকে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া সেই ভুবনমোহিনী মূর্ত্তি আর তথায় দাঁড়াইল না।
কিয়ৎপরে যদুনাথ গোস্বামী জল লইয়া আসিলেন। অরিন্দমের হাতে দিলেন। অরিন্দম এক নিঃশ্বাসে যতটুকু পারিলেন, পান করিলেন।
যদুনাথ গোস্বামী সেইরূপ আগ্রহের সহিত আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাহার নিকট হইতে আপনি আসিতেছেন?”
অরিন্দম হাঁফ ছাড়িয়া বলিলেন, “বলছি, হে বল্ছি, ব্যস্ত হ’য়ো না। উঃ বড় কষ্ট হচ্ছে।
উঃ! সমস্ত শরীরটা কেমন করছে; মাথাটা যেন ঘুরছে, চোখে এমন ঝাপসা দেখ়ছি কেন? সদিগম্মীর লক্ষণ নয় ত? পাখা! পাখা নাই? একি হ’ল! প্রাণটা যেন বের হ’বার জন্য আইঢাই করছে: বড় ভাল বুঝছি না, গোঁসাই-ঠাকুর। জল, জল—আবার জল। বড় পিপাসা—উঃ গেলেম যে!” বলিতে বলিতে অরিন্দম সেইখানে শুইয়া পড়িলেন। মাটিতে পড়িয়া ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন। এবং এ- পাশ ও-পাশ করিতে লাগিলেন—উঠিতে পড়িতে লাগিলেন—শেষে নিঃসংজ্ঞ—মৃতবৎ। ব্যাপার দেখিয়া যদুনাথের ভয় হইল, ভয়ে মুখ শুকাইল এবং কি করিবেন ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলেন না। চীৎকার করিয়া ব্রাহ্মণীকে ডাকিলেন। ব্রাহ্মণী আসিলে তাঁহাকে পাখার বাতাস করিতে বলিয়া নিজে কবিরাজের বাড়ীতে ছুটিলেন। কবিরাজের বাড়ী নিকটে নহে।
সহসা একি বিপদ্!