দশম পরিচ্ছেদ : মোহিনীর সন্ধান
কেশবচন্দ্র বাহিরে আসিয়া গোরাচাদকে বলিল, “গোরাচাঁদ, রেবতী পলাইয়া গিয়াছে।”
সবিস্ময়ে গোরাচাঁদ বলিল, “সে, কি! কোথায় গেল? কখন?”
কেশবচন্দ্র বলিল, “কোথায় জানি না—একঘণ্টা হইবে, আমার চোখের সামনে সে পলাইয়া গিয়াছে।”
কেশবচন্দ্র আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা গোরাচাদকে বলিল। শুনিয়া গোরাচাঁদ আরও বিস্মিত হইল। বলিল, “কী সৰ্ব্বনাশ! এখনি রেবতীর খোঁজ করতে হবে।”
“এখনি কি, এই মুহূর্ত্তে তাকে যেমন করে হ’ক্ ধরতে হবে নতুবা সব পণ্ড হবে। তুই ত সব গোল বাঁধাস্। তোর ফিরতে এত দেরী হ’ল কেন, বল দেখি? বেটা; যদি একঘণ্টা আগে ফিরতিস্ তা’ হ’লে আর আমাকে বাইশ হাত জলে পড়তে হত না। এখন আমার এমন রাগ হচ্ছে তোর উপর যে—তোরই মাথাটা ভেঙে ফেলি।”
“হাঁ, আমারই বেশী দোষ কি না;আটক হয়ে চুপ্ করে ব’সেছিলেন, আমি এসে আপনাকে বা’র কলেম—এই আমার অপরাধ।”
[সক্রোধে] “অপরাধ না বেটা, তুই যেখানে যাবি, সেইখানেই বাঘের মাসী—একঘণ্টার জায়গায় দশঘণ্টা কাটিয়ে তবে ফিবি, তোকে নিয়ে আমার কাজ চালানো ভার দেখছি।”
“আমি ত সন্ধ্যার আগেই ফিরেছিলেম, বিশ ক্রোশ পথ সহজ নয় ত; তারপর আপনার বাড়ীতে যদি গেলাম, সেখানে আপনাকে দেখতে পেলাম না; সেখান থেকে আবার তমীজউদ্দীনের বাড়ীতে গেলাম। তার মেয়েটির সঙ্গে দেখা হ’ল, আপনার কথা জিজ্ঞাসা করতে সে বেটী ‘নাই’ বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। তার পর এখানে এসে যা শুলুম—শুনেই চক্ষুঃস্থির।”
“এখন যেখানে তোকে পাঠিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে তুই কি ক’রে এলি বল্ দেখি? সে কি বলিল?”
“আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি একটা নিৰ্জ্জন ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে বসালে; সেখানে আমি সেটা তার হাতে দিলেম, দেখেই খুব আপ্যায়িত।”
“টাকার কথা কি হ’ল?”
“সেই দিকেই গোল বেঁধে গেছে;দুটো কাজই শেষ করা চাই, তা না করতে পারলে টাকা-কড়ির বিষয় কিছু হবে না। আপনি মনে করছিলেন, আগে একটা কাজ শেষ ক’রে, কিছু টাকা হস্তগত করে শেষে তাকে জড়িয়ে ফেলে এমন এক চাল চালবেন যে, তার জমিদারী তালুক-মুলুক সবগুলি আপনার হাতেই আসবে;তা’ আর হ’ল কই? সে ভারী ধড়ীবাজ্ লোক, আমাদের উপরের একচালে সে চলে; সে বললে দুটোতে আমার যা আশঙ্কা, একটাতেও তাই; এতে আর কাজ হাসিল হ’ল কই?”
“এত যত্ন, চেষ্টা পরিশ্রম সকলই পণ্ড হ’ল দেখছি।”
“আমি বললেম, দুটোকে একেবারে শেষ করুন, তা’ত আপনি শুনলেন না;এখনি ঘরে রোক বিশ হাজার টাকার তোড়া তুলতেন। গরিবের কথা বাসি হ’লে মিষ্ট লাগে। আপনি পড়লেন বেশী লোভে। কাজেই অতি লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।”
“কেন? তুই বলি নি, তার সঙ্গে কথা ছিল কি? এক-একটা কাজ শেষ হবে, এক-একটা কাজে দশ-দশ হাজার টাকা;এই কথাই তার বলা-কহা ছিল; লেখাপড়ার মধ্যেও ত তাই আছে যে, দুইটি কাজ দশ হাজার টাকা হিসাবে বিশ হাজার টাকা দেওয়া হবে।”
“তা’ ত বুঝলেম্, কিন্তু সেই বিশ হাজার টাকা যে দুই কিস্তি নয়, এক কিস্তিতে। তা এখানে এসে যা দেখছি, তাতে তো আপনি একেবারে কিস্তিমাৎ ক’রে ব’সে আছেন; এখন বিশ হাজার টাকার জায়গায় বিশটা পয়সাও পাবেন না।”
ক্ষণেক নীরবে থাকিয়া কেশবচন্দ্র ভাবিল। ভাবিয়া বলিল, “গোরাচাঁদ, তুই যা, যেমন করিয়া পারিস্, রেবতীকে ধরিয়া আন্। যদি তাকে জীবিত অবস্থায় আনতে পারিস, আগে সে চেষ্টা করিস্—আমি তাকে স্বহস্তে খুন করব। যদি তেমন কোন গোলযোগের সম্ভাবনা দেখ্সি, তা’ হলে খুন ক’রে তার মৃতদেহ নিয়ে আবি। জীবিত কি মৃত যে কোন অবস্থায় রেবতীকে আমারাচাই-ই চাই; তা নাহলে বিশ হাজার টাকা একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে। এখন বুঝতে পারছি অতি লোভটা করা আমার অন্যায় হয়েছে। তুই রেবতীর সন্ধানে যা, আমি মোহিনীর সন্ধানে যাই—এই বিশ হাজার টাকার শোধ আমি মোহিনীর উপরে তুল—তবে ছাড়ব;আগে আমি তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেম; যা মনে করতেম, এখন দেখছি তা নয়; সে আমার একটা ভয়ানক শত্ৰু।”
তখন অদূরে থাকিয়া অন্তরাল হইতে স্ত্রীকণ্ঠে কে বলিল, “শত্ৰু ব’লে শত্রু—পরম শত্ৰু! সে শত্রুর সন্ধান করিতে কোথাও যাইতে হইবে না, এখানে আছে; তোমাকে ছাড়িয়া সে এক মুহূৰ্ত্ত কোথাও থাকে না। তা’ যদি থাকিবে, তবে সে তোমার শত্রু কি? যদি দূরেই থাকিবে তবে বিনোদ, সে শত্রু তোমায় পদে পদে শত্রুতা করিবে কি প্রকারে?”
পাঠক, বিনোদলাল আর কেশবচন্দ্র একই লোক।
কণ্ঠস্বরে কেশবচন্দ্র বুঝিতে পারিল, সে মোহিনী;কিন্তু চারিদিকে যে ভয়ানক অন্ধকার;তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অন্ধকার ঠেলিয়া কোথায়ও তাহাকে দেখিতে পাইল না; তখন বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছিল এবং ঝড় তেমনি প্রবলবেগে তখনও গৰ্জ্জন করিয়া ছুটিতেছিল। সেই ঝড়বৃষ্টির এলোমেলো শব্দে কেশবচন্দ্ৰ কিছুতেই ঠিক করিতে পারিল না, মোহিনী কোথায় দাঁড়াইয়া তাহাকে উপহাস করিল। চারিদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিতে লাগিল, যে দুর্ভেদ্য অন্ধকার, কিছুই দেখিতে পাইল না।
“আমাকে দেখিতে পাইতেছ না? এই যে আমি”, বলিয়া তখনই মোহিনী একটি জঙ্গলের ভিতর হইতে বাহিরে আসিল। ক্রুদ্ধ শার্দুলের মতন বিকট গৰ্জ্জন করিয়া কেশবচন্দ্র মোহিনীকে ধরিতে গেল। সেই মুহূর্ত্তেই মোহিনী চকিতে আবার সেই সর্পসঙ্কুল জঙ্গলের মধ্যে লুকাইয়া পড়িল। একে নিবিড়তর অন্ধকার সেই জঙ্গলের ভিতর যাইয়া কেশবচন্দ্র ও গোরাচাঁদ মোহিনীকে অনেক খুঁজিল মোহিনীকে পাইল না।
কেশবচন্দ্র বলিল, “এক কাজে দুজনে থাকিবার প্রয়োজন নাই। গোরাচাঁদ, তুই রেবতীর সন্ধানে যা, যেমন করিয়া পারিস, রেবতীকে আনিতে চাহিস্। আমি এখানে রহিলাম—মোহিনীকে খুন না করিয়া আমি অন্য কাজে হাত দেবো না। পিশাচী আমার বড় আশায় ছাই দিয়াছে।”
গোরাচাঁদ চলিয়া গেল।