ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : মুক্তি
রেবতীর সেই ব্যথাব্যঞ্জক কাতরোক্তিতে পাপান্তঃকরণ, নারকী কেশবচন্দ্র কর্ণপাত করিল না বরং নিজের অভীষ্টসিদ্ধির চেষ্টা করিতে লাগিল। প্রথমে বালিকার অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি মুছাইয়া দিল, তাহার পর টানিয়া আপনার বুকের উপর তুলিতে চেষ্টা করিল।
স্ফীতজটা সিংহীর মত রেবতী তখন আপন বলে উঠিয়া দূরে দাঁড়াইল। তাহার শিশিরসিক্ত কমলতুল্য ও ক্লিষ্ট মুখমণ্ডল রোষরক্তরাগরঞ্জিত হইয়া আর এক অপরূপ শ্রী ধারণ করিল। দলিতফণা ফণিনীর ন্যায় বালিকা ফুলিতে ফুলিতে রোষতীব্রকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “পিশাচ, ধিক্ তোকে! তোর মুখ দেখিতেও পাপ আছে;এখনি এখান থেকে দূর হ’–তোর যা ইচ্ছা হয় করিস্—যে যন্ত্রণা দিতে চাস্–দিস্, আমি তোকে আর ভয় করি না! তোর মত নারকীর নিকটে দয়া ভিক্ষা করা অপেক্ষা সহস্রবিধ যন্ত্রণাপ্রদ মরণও ভাল।”
বর্দ্ধিতরোষা রেবতীর দীপ্ত চক্ষুদ্বয় দিয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে লাগিল; নাসারন্ধ্র ও মুখবিবর দিয়া ঘন ঘন শ্বাস বহিতে লাগিল এবং সেই দ্রুতশ্বাসে বক্ষঃস্থল ঘন ঘন স্ফীত হইতে লাগিল।
বালিকার সেই ভাব দেখিয়া কেশবচন্দ্র কিছু বিস্মিত, কিছু স্তম্ভিত, কিছু বা ভীত হইল। তথাপি পাপী অস্খলিতসঙ্কল্পে সেই মুহ্যমাণা বালিকার দিকে পুনরগ্রসর হইল। ব্যাধতাড়িত হরিণশিশুর ন্যায় বালিকা ছুটিয়া বাহিরে আসিল। কেশবচন্দ্রও বালিকাকে ধরিবার জন্য বাহিরে আসিতে গেল। বাহিরের কবাটের পার্শ্বে একটি স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া ছিল। কেশবচন্দ্র যেমন বাহিরে আসিবে, সেই স্ত্রীলোকটি তাহাকে সজোরে এমন এক ধাক্কা দিল তাহাতে কেশবচন্দ্র পড়িয়া না গেলেও দশ পদ পশ্চাতে হটিয়া গেল। সেই স্ত্রীলোকটিকে দেখিয়া এক মুহূর্ত্তের জন্যও কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া সেইখানেই তাহাকে দাঁড়াইতে হইল। সেই এক মুহূর্ত্তের মধ্যে স্ত্রীলোকটি দুই হাতে তাড়াতাড়ি কবাট বন্ধ করিয়া বাহির হইতে শিকল লাগাইয়া দিল। তারপর রেবতীর হাত ধরিয়া সেইখানে দাঁড়াইল, রেবতী বিস্ময়-স্থিরনেত্রে সেই স্ত্রীলোকটির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।