মামন : পর্ব – ৪ (Mamon)
মানুষের জীবনের গতিপথ কখন যে পাল্টে যায় তা কি কেউ আগে থেকে আন্দাজ করতে পারে ? হয়ত কেউ কেউ কিছুটা পারে কিন্তু পুরোটা আজ পর্যন্ত কেউই পারেনি। যদি পারত তাহলে সেটাই হত খোদার ওপর খোদকারী।
নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান মামন ছোটবেলা থেকেই অর্থের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শিখেছিল। বাবার অবস্থা দেখেছিল, দেখেছিল তার লাবণ্যময়ী মা কিভাবে সংসারের হাল ধরে রেখেছিল। সে নিজেও প্রয়োজনের বাইরে বেরিয়ে একটা টাকাও খরচা করেনি বরং টিউশানির টাকায় তার কলেজ আর লেখাপড়া সংক্রান্ত খরচের বাইরে সংসারে অল্প হলেও টাকা দিত। কোনদিন মেকাপ সরঞ্জাম কেনে নি, সিনেমা দেখেনি হলে গিয়ে, কলেজের বন্ধুরা ওকে জোর করে নিয়ে যেতে গেলে সবিনয়ে তাদের অনুরোধ ফেরৎ পাঠাত। হোটেল রেস্টুরেন্টের চৌকাঠ মাড়ায় নি, বরং কলেজের বেশিরভাগ সময় অফ পিরিয়ডে লাইব্রেরিতে সময় কাটাত। রাণার সঙ্গে প্রেম হবার পর রাণা তাকে দামি জামা কাপড় একবার উপহার দিয়েছিল , কুন্ঠিত মামন রাণার হাতদুটো ধরে তাকে আর এইসব উপহার দিতে নিষেধ করেছিল, মোবাইল ফোন পর্যন্ত কিনতে দেয় নি। আগে ফোন বুথে ঢুকে ফোন করত, মোবাইল সার্ভিস চালু হবার পর সে পাড়ার পানের দোকান আর কলেজের পাশে মোবাইল রিচার্জের দোকান থেকে ফোন করত। আর সে করবেই বা কা’কে, কেবলমাত্র শিক্ষককূল বাদে তার অত আত্মীয় বা বন্ধু ছিল না। যদিও ঈশ্বরের কৃপায় নম্র, বিনীত, সদাহাস্যময়ী এবং উপকারী চরিত্রের মুর্তি ছিল সে। রাণাকে সে পই পই করে নিষেধ করেছিলে যেন তাকে নিয়ে রাণা সিনেমা হল বা হোটেল রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। রাণা মেনেও চলত, বলত তোমার চিন্তা ভাবনাকে সম্মান করি। মামনের রূপ ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত, তাই তাকে মেকাপ নিয়ে সং সাজতে হত না। তার মহিলা বন্ধুরা বলত যে তাদের মামনকে দেখে হিংসে হয়।
রাণার মা যেদিন সরাসরি মামনকে বলেছিল যে মামন বামন হয়ে চাঁদ যেন না ধরতে যায়, শুনে মামন ফ্যালফ্যাল করে সজল চোখে রাণার দিকে তাকিয়েছিল, রাণা সঙ্গে সঙ্গে মামনের হাত ধরে বলেছিল বিয়েটা সে করবে, কে কি বলল তা নিয়ে মামন যেন না ভাবে।
আবার এই রাণাই মামনের স্কুলে চাকরি পাবার খবর পেয়ে বলেছিল যার জন্য সে বাবা মা ভাই বোন এদের ত্যাগ করতে চলেছে তার এইটুকু মুরোদ আছে তার স্ত্রীকে দুবেলা মোটা চালের ভাত দেবার। রাণা সেই কাজটা করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই মামন রাণাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করত। মামন তাই বিয়ের আগে চাকরিটাতে জয়েন করেনি, ছেড়ে দিয়েছিল। রাণা আর মামনের প্রেমপর্বের গল্প হত মূলত কলেজে, তারা বাইরে এদিক ওদিক ঘুরতে খুব কমই গেছে, তার একটাই কারণ ছিল, তা হল মামনের টিউশানি, প্রত্যেকদিন মামন টিউশানি করাতে যেত সন্ধ্যেবেলাতে , তার সময় ছিল না মাঠে ঘাটে বসে প্রেমিকের সাথে গল্প করার।
ট্রেন জার্নি করা মামন আর বেশি স্মৃতিচারণ করতে পারল না, ঘুমিয়ে পড়ল। পরেরদিন ওরা মামনকে নিয়ে বের হল। ওদের গাড়ি আছে তিনটে। মামন কৌতুহলী হয়ে সুমঙ্গলার কাছে জানতে চেয়েছিল ওরা বাচ্চা নেয়নি কেন, উত্তর ছিল সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না আর তাছাড়া দুজনেই সমস্তদিন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকে। বাচ্চা নিলেই তো হল না তার পরভরিশের উত্তম ব্যবস্থা না থাকলে লায়েক হলেই ওরা বাপ মায়ের মুখে লাথি মারবে। মামন কথাটা মেনেছিল।
মহেশরা থাকত বিশাল নগরে আর একটা পাঁচতলা বাড়ি ছিল সিভিল লাইনে। পুরো বাড়িটাই বিভিন্ন ব্যবসার কাজে ব্যবহার হত। একতলাতে ডাক্তার চেম্বার আর প্যাথলজি, ছেলেদের আর মেয়েদের ড্রেস মেটেরিয়ালের দোকান, মিষ্টির দোকান, ছেলেদের সেলুন। পুরো দোতলা ছিল মেয়েদের বিউটি পার্লার, তিন আর চারতলা ছিল থাকার হোটেল , পাঁচতলায় ছিল রেস্টুরেন্ট। মামন সব দেখে থ। সব জায়গাতে গিয়ে ওরা মামনের সঙ্গে কর্মীদের পরিচয় করিয়েছিল এই বলে যে সে ওদের মেহমান। সবাই মামনকে খুব খাতির করেছিল। মামনকে সুভদ্রার সঙ্গে ছেড়ে ওরা কর্তা গিন্নি ব্যবসার হিসেবপত্র, অভিযোগ, অনুযোগ, চাহিদা , ভুল কাজের জন্য ধমকানি এইসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মামন আর কত ঘুরবে। এত কিছু দেখে তার কান মাথা চোখ ভোঁ ভোঁ করছে। দুপুরে রেস্টুরেন্টে সকলে লাঞ্চ করল। মামন ওপরের হোটেলে গিয়ে একটা ঘরে বিশ্রাম নিল। সন্ধ্যেতে সুমঙ্গলার সঙ্গে ফের বাড়ি ফিরে এল। রাতে খাবার টেবিলে হল মামনের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা ।
ওরা জানতে চাইল মামন তো সব দেখেছে, এখন মামন বলুক ও কোথায় কাজে লাগতে চায় ? মামনের কোনও অভিজ্ঞতা নেই কারবার সম্বন্ধে, সে কি বলবে, শুধু বলল তার ফিলোজফিতে মাস্টার্সের ডিগ্রি আছে , সে কারবার বোঝে না, সে টিচার হতে চায়। শুনে দুজনে হাত ঠোঁট উল্টে বলল তারা তো আগেই বলেছিল তাদের ক্ষমতা নেই মামনের শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে কোন কাজ জুটিয়ে দেবার, তাদের যেটুকু সামর্থ তাই দিয়ে তারা সাহায্য করতে পারে। আর মামন যদি হিন্দী জানে তবে চেষ্টা করতে পারে ,তাতেও যে তারা সফল হবে তার গ্যারান্টি নেই। শেষে মহেশ বলল দিদির ডিগ্রি তো পালাবে না আর মামনকে খুব তাড়াতাড়িই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা রূপালী বৌদির কথা মেনে মামনের জন্য একটা কিছু করতে চায় , মামনের চাহিদা তারা মেটাতে পারবে না, আর তারা অনাথ আশ্রম খুলে বসে আছে নেই।মামন যেন বাস্তববাদী হয়। আজ রাতভর ভেবে কাল সকালে উত্তর দিলেও হবে। আরও একটা কথা মামন যে কারবারের কাজ জানে না তা ওরা বিলক্ষণ জানে, ওরা শিখিয়ে নেবে। আগে মামন বলুক ও কোন ব্যবসার কাজে জয়েন করতে চায়।
সারারাত এক সমুদ্র ভেবেও মামন কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে করতে ওরা জানতে চাইল মামনের সিদ্ধান্ত। মামন আত্মসমর্পণ করল। সুমঙ্গলা তখন বলল যে তারা মামনকে দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে মামন ওদের বিউটি পার্লারে কাজ করুক। বিউটি পার্লার !!!! আঁতকে উঠল মামন। মানে ওই চুল কাটা, নখ কাটা, ফেসিয়াল করা, যেগুলো ওর কলেজের বন্ধুরা করত ? সে করবে এই কাজ। মামনের বুকে একটা বিশাল পাথর যেন চেপে বসল , তার স্বাভাবিক শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কোন রকমে বলল সে তো কিছুই জানে না এইসব কাজ , সে পারবে না । তার থেকে বরং সে জামা কাপড়ের দোকানেই থাকতে চায়। ওরা হেসে উঠল খুব জোরে।