মামন : পর্ব – ২০ (Mamon)
“বাবলি “, মা বলেছে তোমাকে, মহেশ প্রশ্ন করতে মামন বলল , বাবলি আবার কে। আরে ওই নার্স, মহেশের উত্তর। হুম, মামনের কথা শুনে মহেশ কাপল চাপড়ে উবু হয়ে বসে পড়ে বলল, হাজার খানেক রোগের ডিপো ছিল ,এখন দেখছি মাথাটাও গেছে। কার কথা মহেশ বলছে জানতে চাইলে বলল , কার আবার মায়ের। তুমি জান বাবলিকে আমি কবে থেকে চিনি, মহেশ বলে উঠতেই মামন বলল, সে জানবে কি করে। হুম বলে চুপ করে গেল মহেশ। হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এসেছে হাভেলিতে। পের্টিকোতে এসে মহেশ দুটো চেয়ার আনতে বলল আর হেড দারোয়ান শ্যামলালকে বলল লাডলিকে নিয়ে আসতে। শ্যামলাল জি মালিক বলে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের দিকে ছুটল। চেয়ারে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্যামলাল একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে হাজির, বাচ্চাটার বয়স খুব জোর সাত বছর,এসেই মহেশের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে হাসি মুখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। মহেশ লাডলির সঙ্গে মামুলি কিছু কথা বলল, যেমন লেখাপড়া ঠিক হচ্ছে কি’না, কোন কিছুর দরকার আছে কি’না। লাডলি বেশ গুছিয়ে উত্তর দিল ,শেষে মহেশ পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে ওর চারদিকে ঘুরিয়ে হাতে দিয়ে নাকটা টিপে দিয়ে বলল সে যেতে পারে আর ঘরে গিয়ে যেন পড়াশোনা করে। লাডলি ঘাড় নেড়ে প্রণাম করে চলে গেল, মহেশ বলল লাডলি শ্যামলালের নাতনি। ওকে দেখলে তো। হুম, মামনের ছোট্ট জবাব। আমি তখন ক্লাশ টুয়েলভে পড়ি, আমাদের একটা নার্সিংহোম ছিল, বাবা চালাতেন, বাবলির বাবা রেলে সামান্য মাইনের চাকরি করতেন, চাকরির বাইরে টুকটাক ব্যবসা করতেন, আমাদের নার্সিংহোমে উনি রুই, গজ কাপড়, ব্যান্ডেজ এইসব সাপ্লাই করতেন, তখন বাবলি ছিল এই শ্যামলালের নাতনির বয়সি, বাবা ওকে খুব ভালোবাসতেন। এইসূত্রে ওরা হাভেলিতে যাতায়াত করত,মা খুব স্নেহ করতেন, করতেন কি এখনও করেন। আমি ওকে ছোট বোনের মত দেখি। ওর বাবা আচমকাই মারা যায়, ততদিনে আমি ব্যবসার হাল ধরেছি,বাবা আর টানতে পারছিলেন না। তখন থেকে ওদের ফ্যামিলির হাল ধরেছি, বাবলি লেখাপড়াতে তেমন ভাল ছিল না কিন্তু হাভেলিতে এলে মায়ের বাবার খুব সেবা করত, আমিই ওকে নার্সিং কলেজে ভর্তি করিয়েছি, পাশ করার পরে নার্সিংহোমে চাকরি দিয়েছি। এদিকে অন্য ব্যবসা বেড়ে যাওয়াতে টানতে না পেরে নার্সিংহোম বিক্রি করে দিলাম, বাবলি চলে এল বাড়িতে , মা ততদিনে বাতের ব্যথায় কাবু বাবা তো কবেই মারা গেছে। মা ওকে হাতে ধরে হাভেলির সব কাজ দেখিয়েছে, আজও মা বাবলি বলতে অজ্ঞান, আমিও নিশ্চিন্তে থাকি বাবলি হাভেলির সবকিছুর দায়িত্ব পালন করছে বলে। বাবলি আমার ছোট বোন, মায়ের ভিমরতি হয়েছে। বাবলি আগে প্রতিবাদ করত, মা রেগে গালাগাল দিত, তখন একটু হলেও হাত পা চালাতে পারত, বাবলি দু তিন বার মায়ের হাতে প্রতিবাদের জন্য মারও খেয়েছে। এই সব পাগলামির কোন মানে নেই, বকছে, বকতে দাও,তুমি বরং বাবলিকেই জিজ্ঞেস করে দেখ। মহেশ থামতেই মামনের বুক থেকে একটা পাথর যেন নেবে গেল।
ওখানকার পাট চুকিয়ে ফেরৎ এল রায়পুরে। আসার আগে মামন যখন মহেশের মাকে প্রণাম করতে গেল হাতে পেল একটা ” আশরফি “, মোগল আমলের স্বর্ণমুদ্রা। মামন হতবাক, মহেশের মা বলেছিলেন এই আশরফি দেওয়া হয় এই বংশের মেয়েদের, এইটা গুরুজনের আর্শীবাদ। কিন্তু সে তো এই বংশের কেউ নয়,মামনের মৃদু প্রতিবাদের উত্তর ছিল, উনি জানেন মামন এই বংশের কেউ নয়,তবুও ওনার দৃঢ় ধারনা মামনের সঙ্গে এই বংশের যেন জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক আছে। মামন আর কথা বাড়ায় নি, অপার শ্রদ্ধার সঙ্গে তা গ্রহণ করেছিল। ফেরার পথে গাড়িতে তাকে কেন মহেশের মা আশরফি দিল বা কেন ওই ধরনের কথা বললেন জানতে চাইলে মহেশ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উত্তর দিয়েছিল যে দিয়েছে সেই জানে, পাগলি বুঢ্ঢি ওকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মারতে চাইছে। মানে, মামন জানতে চাইলে মহেশ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল ,মামন যদি আর একটাও ফালতু কথা বলে তাহলে সে মামনকে নাবিয়ে দেবে। মামন অবাক, হঠাৎ করে মহেশ এত রেগে গেল কেন ! শান্তি বজায় রাখতে মামন মৌনব্রত রাখল বাকি পথটুকু।
শুরু হল মামনের থোড় বড়ি খাড়া,খাড়া বড়ি থোড় জীবন। কোন নতুনত্ব নেই,নেই কোন অ্যাডভেঞ্চার, কাজকর্ম নেই , মামন হাঁপিয়ে উঠতে লাগল। এদিকে মহেশ যে কি জমি সংক্রান্ত ঝামেলাতে ফেঁসেছে তা খুলে বলছে না। বারবার দেশের বাড়িতে যাচ্ছে জানতে চাইলেও উত্তর নেই। এমন এক সময় মামনের ফ্ল্যাটে পিঙ্কির আগমন। মামনের ভ্রু কুঁচকে গেল, হঠাৎ এখানে কেন। পিঙ্কি একপ্রস্থ ক্ষমা চেয়ে যা বলল তা হল ,ভুল মানুষ মাত্র হয়, সে অশিক্ষিত, না জেনেই মামনের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেছে, মামন যেন তাকে মাফ করে দেয়। পিঙ্কি যতই ন্যাকামি করুক না কেন মামন এত সহজে ওকে বিশ্বাস করবে না, তাই চুপ করে পিঙ্কির কথা শুনছে। হঠাৎ দেখল সুভদ্রা দরজার আড়াল থেকে হাতছানি দিয়ে মামনকে ডাকছে। মামন আসছি , এক মিনিট বলে সোজা রান্নাঘরে। সুভদ্রা চাপা গলায় দ্রুত বলল , পিঙ্কি পাক্কা ধান্ধাবাজ, কেন এসেছে জানতে হলে ওকে মাতাল করে দাও, দেখবে সব সত্যি কথা বলে দেবে। মামন ঘাড় নেড়ে সুভদ্রাকে দুটো মিষ্টি নিয়ে আসতে বলল। ঘরে আসতেই পিঙ্কি বলল সে লাঞ্চ করে এসেছে, তার জন্য যেন কোনও খাবার না আনে মামন। মামন হেসে বলল ,তার ফ্ল্যাটে প্রথম এল ,তা বললে চলে। ইতিমধ্যে সুভদ্রা দুটো লাড্ডু আর দুটো প্যাঁড়া নিয়ে হাজির। ছোট টিপয়ে রেখে পিঙ্কিকে প্রণাম করে ওর কুশল সংবাদ নিয়ে সুভদ্রা চলে গেল। পিঙ্কি বকে যাচ্ছে মামন শুনে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে মামন সুভদ্রাকে ডেকে মদ আনতে বলল। মদ আসতেই পিঙ্কির খুশি দেখে কে। সুভদ্রা কি করেছিল কে জানে অল্প একটু খেয়েই পিঙ্কি বেসামাল। মামন গ্লাসে অল্প অল্প চুমুক দেবার নাটক করে চলেছে। অতঃপর মাতাল পিঙ্কি যা বলে দিল তা শুনে মামন কনফার্ম হল নাটের গুরু আসলে গুলাটি। পিঙ্কির অভিযোগ, মহেশ ইদানিং ওর সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করছে, বাড়িটা ওর নামে করে দিচ্ছে না, আর্ধেকদিন রাতে ফেরৎ আসছে না,জানতে চাইলে বলবে দেশে ছিল কাজ নিয়ে, এদিকে গুলাটি এসে পিঙ্কির হাত ধরে বলেছে যে মহেশ মামনের কাছে থাকে , মামন অকৃতজ্ঞ, আজ মামনের যেটুকু আছে সবকিছুর পেছনে গুলাটি থাকলেও মামন ওকে পাত্তা দিচ্ছে না,এমনকি এই ফ্ল্যাটেও আসতে দিচ্ছে না। মামন মহেশকে নিয়েই থাকুক, পিঙ্কির প্রবলেম নেই শুধু দিদি যেন ছোট বোনের সাহারা হয়ে বাড়িটা ওর নামে করিয়ে দেয় সঙ্গে ব্যবসার বাড়িটাও যাতে পিঙ্কির ভবিষ্যত সুরক্ষিত থাকে। পিঙ্কির অবস্থা তখন খুব শোচনীয়,কথাই বলতে পারছে না দেখে মামন কোনও উত্তর দিল না। সুভদ্রাকে বলল ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে আসতে। ড্রাইভার এলে তাকে চটপট বাড়ি থেকে দুজন বাই নিয়ে আসতে বলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই হাজির। পিঙ্কি ততক্ষণে পুরো বেহুঁশ। সবাই ধরাধরি করে পিঙ্কিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। মামন ফোন করল মহেশকে। মহেশ জানাল সে কাল বিকেলে ফিরবে, আজই আসত, মায়ের শরীর খারাপ হতে ডাক্তার বদ্যি করতে হল বলে আজ ফিরল না, মামন যেন চিন্তা না করে। মামন মহেশকে আর অবিশ্বাস না করলেও ওর চারিত্রিক গঠনের জন্য পছন্দ করে না ।
পরেরদিন দুপুর করে মামন একাই পিঙ্কির সঙ্গে দেখা করতে গেল, উদ্দেশ্য ছিল প্রথমত ওর শরীরের খোঁজ নেওয়া আর দ্বিতীয়ত ওর প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া। পিঙ্কি ওকে দেখেই বিরক্ত হল। সব বুঝেও মামন নরম সুরে ওর শরীরের হাল কেমন জানতে চাইলে পিঙ্কি ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে একগাদা কথা শুনিয়ে দিল। যেমন মামন এসে ওর সুখের সংসারে আগুন লাগিয়েছে, মহেশকে ভাঙিয়েছে, মহেশ যা আগে করেনি আজ তাই করেছে মামনের জন্য পিঙ্কিকে মেরেছে , নেমকহারাম, পিঙ্কি যদি ওকে আশ্রয় না দিত তাহলে ও পথের কুত্তাদের শিকার হত , চরিত্রহীন মেয়ে, এইসব। ভরা পার্লারে এইভাবে বলতে মামন গেল মারাত্মক রেগে , যে কাজ ও আজ পর্যন্ত করেনি তাই করল। গোদা বাংলায় যাকে বলে কোমর বেঁধে ঝগড়া করা তাই করতে শুরু করল। একতরফা তার শোনার দিন শেষ। বিস্তর গালমন্দ করে মামন ফ্ল্যাটে চলে এল ,মাথায় আগুন জ্বলছে, সুভদ্রাকে ডেকে মদ এনে খেতে শুরু করল। ফোন করল মহেশকে। ফোন ধরতেই মামন শুরু করল আগাপাছতলা রাগ দেখানো। মহেশ প্রথম দিকে থামাতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু উগ্রচন্ডী মামন যে কোন কথাই শুনছিল না দেখে সে’ও শুরু করল গালাগাল, শেষে মহেশ বলল সে বিকেলে ফিরে দুটো শালিকে দেখে নেবে, ওদের বড্ড তেল হয়েছে, সব বের করবে, ফোন কেটে দিল মহেশ।
ঝোরো কাকের মত চেহারা নিয়ে সন্ধ্যেবেলাতে মহেশ মামনের ফ্ল্যাটে ঢুকেই গালাগাল শুরু করে দিল। যতটুকু নেশা মামনের মাথায় চেপেছিল গালাগালের তোড়ে হাওয়া,মামন আত্মপক্ষ সমর্থনে একটা কথাও বলতে পারল না , সবশেষে মহেশ বলে গেল , মামন এখন থেকে মহেশের অনুমতি ছাড়া বাইরে যেতে পারবে না, কয়েকদিনের মধ্যেই মামনকে ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে জগ্গুর কড়া নজরদারিতে থাকতে হবে ,এই ফ্ল্যাট তালাচাবি দেওয়া থাকবে, সে যাচ্ছে পিঙ্কির পিন্ডি চটকাতে। যেমন ঝড়ের বেগে ঢুকেছিল ততটাই জোরে বেরিয়ে গেল মহেশ। মামন হাঁ। ফের এল মহেশ, বলল ওর মায়ের এখন তখন অবস্থা, কখন যে কি হয় বলা যাচ্ছে না, উনি শেষবারের মত মামন আর বর্ষাকে দেখতে চেয়েছেন, মহেশ এখানে তিন কি চার দিন থেকে ফের দেশে যাবে,মামন ওর সঙ্গে যাবে বুড়ির শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে। এবার মামন ঘাড় নাড়ল। এতক্ষণ মহেশের গালমন্দ শুনে মামনের মুড বিগড়ে গিয়েছিল কিন্তু যেই বিমলা দেবীর কথা শুনল মামনের মন খারাপ হয়ে গেল, ক’টা মাত্র দিন, ওই বৃদ্ধা তাকে বড্ড কাছে টেনে নিয়েছিলেন।
মহেশের SUV ছুটে চলেছে ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে, সামনে ড্রাইভার আর সুভদ্রা বর্ষাকে নিয়ে, মাঝে মামন আর মহেশ, একদম পেছনে মহেশের বোর্ডিং হোটেলের চিফ ম্যানেজার কিষেণ চাঁদ। মহেশ বলেছে কিষেণ আদতে বাঙালি হলে কি হবে একফোঁটা বাংলা জানে না, ওদের তিনপুরুষ মহেশদের গ্রামের বাসিন্দা, মামন জানতে চাইল সে বাংলা বোঝে কি’না, উত্তর পেল, একটু একটু বুঝতে পারে তবে তা কাজের কাজে লাগে না আর ওর বাড়িতে বাবাই যা একটু আধটু বাংলা বলত, ওর মা অবাঙালি। মামন মহেশের কাছে জানতে চেয়েছিল ও কি গ্রামের বাড়িতে দেখা করতে যাচ্ছে না মহেশের কোন বিশেষ কাজে যাচ্ছে। মহেশ একটা অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে যা বলল তার বাংলা মানে হল কিষেণ রথ দেখতেও যাচ্ছে আবার কলা বেচতেও যাচ্ছে । মামনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে মহেশ গম্ভীর হয়ে বলল , ক্রমশ প্রকাশ্য, অগত্যা ……।