মামন : পর্ব – ১৯ (Mamon)
কেটে গেল পাঁচদিন , মহেশের কাজ কিন্ত মিটল না, সব কাজই ছিল জমি সংক্রান্ত, সারাদিন সে দৌড়ে মরেছে। যেসব জনগণ এসেছিল মামন ইচ্ছে করেই গা বাঁচিয়ে ছিল , তাদের প্রত্যেকের কাজ আছে, তারা একে একে বিদায় নিল, মামন বড় একা অত্ত বড় হাভেলিতে। মামন রয়েছে হাভেলির বাইরের অংশে, ভেতরে যাওয়া মানা ছিল ওদের তাও মামনকে একদিন ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল মহেশ, আলাপ হয়েছিল মহেশের মৃত্যু পথযত্রী মায়ের সাথে। বিছানায় শয্যাশায়ী মহিলা মামনের হাত দুটো ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলেন, ওনার কপাল খারাপ, ছেলে বাউন্ডুলে, এখনও ঘর বসাল না, ওনার ভাগ্যে নেই নাতি নাতনির মুখ দেখা, ওনার শ্বাশুরি কিন্তু মহেশকে আশীর্বাদ করে গিনির হার দিয়েছিল, খুব পূণ্যবতী ছিলেন,ওনার আশীষ পেয়েছিল বলে মহেশ আজ এ বংশের সেরা সন্তান, ভগবান ওনাকে অনেক কিছুই দিলেও ছেলের সংসার দেখে যাবার মওকা দিলেন না, হাঁপাচ্ছিলেন, মামন ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, খাটের পাশে থাকা ছোট টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিয়ে মাথাটা তুলে ধরে পরম যত্নের সঙ্গে একটু জল খাইয়ে দিয়ে ওনাকে চুপ করে থাকতে বলল। উনি মামনের হাত ফের ধরে বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে থাকলেন। যতক্ষণ মামন ছিল ওনার একটাই আক্ষেপ বারবার বললেন মহেশের সংসার দেখে যেতে পারলেন না। মামনের কাছে উনি জানতে চেয়েছিলেন মামন কি করে মহেশকে চিনেছে, মামন চটজলদি উত্তর দিয়েছিল, ব্যবসার কাজে ওর হাসব্যান্ড আর মহেশ বন্ধু, সে এখন বাইরে আছে কাজে তাই সঙ্গে আসেনি, কয়েকদিন পরে এখানে আসবে। উনি একসময় বলেই দিলেন যে মামনকে ওনার খুব পছন্দ হয়েছে কিন্তু সে তো বিবাহিত তাই আর কিছু করার নেই। দুজনে যখন কথা বলছিল তখন নার্স হঠাৎই পরিষ্কার বাংলাতে বলে উঠল আপনার বাড়ি কোথায় দিদি, মামন অবাক হয়ে জানতে চাইল মেয়েটি বাংলা জানল কি ভাবে ? সে বলল যে তারা প্রবাসী বাঙালি,তার বেড়ে ওঠা লেখাপড়া এমনকি নার্সিং ট্রেনিং সব নাগপুরে, বাড়িতে বাংলায় কথা হয়। মামন ফের জানতে চাইল সে যে বাঙালি ও বুঝল কি ভাবে , মেয়েটি হেসে বলল মামনের কথার মধ্যে স্থানীয় টান নেই বরং বাঙালি ঘেঁসা, তাই। মামন ওর পর্যবেক্ষণের তারিফ করে একটা যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দিল এই বলে মহেশ আর ওর হাসব্যান্ড বন্ধু ব্যবসার সূত্রে ,ওরা কলকাতার লোক, পরবর্তী সময়ে মহেশের চাপে ওরা এখানে চলে আসে এখন ওর হাসব্যান্ড এখানেই ব্যবসা করে আর রায়পুরে ওদের ফ্ল্যাট আছে। রাকা, নার্স মেয়েটির নাম, ও আচ্ছা বলল। ওর এর সুন্দর নাম কে রেখেছে মামন জানতে চাইলে বলল পূর্ণিমার দিনে ও জন্মেছিল, বাবা রেখেছে। ওদের কথাবার্তার মাঝে মহেশের আগমন, কোলে বর্ষা, মহেশের মা কে এই বাচ্চাটা ছেলের কাছে জানতে চাইতেই মামন বলল তার মেয়ে আর মহেশ বলল বর্ষা তার মেয়ে। দুজনের খুনসুটি দেখে বুড়ির খেদোক্তি, এই নালায়েক আমাকে এই দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত করছে। তারপরেই মহেশকে হুকুম দিলেন,বাচ্চার মুখ যখন উনি দেখেছেন তখন তো কিছু দিতেই হয়, মহেশ যেন ওর জন্য একটা সোনার চেন করে দেয়, সাইজটা বড় চাই, পোতি যেন সবসময়ই গলায় পড়তে পারে বড় হলে, তবেই ও নানিকে মনে রাখবে। মহেশ চলে গেল বর্ষাকে নিয়ে। বুড়ি ফের শুরু করল মহেশের নামে অভিযোগ, একই কাহিনী। একসময় রাকার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, এই বাঙালি লেড়কি খুব ভাল,শুধু আমার খেয়াল রাখা নয় এই হাভেলির সবকিছুর ওপর নজর রাখে, আমি চাই এ আমার বৌমা হোক।একটু আগেই বুড়ি যখন বর্ষাকে সোনার চেন দেবার কথা বলেছিল মামন আপ্লুত হয়েছিল কিন্তু এখনকার কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠল। দেখল রাকার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে, মামন ভালোই বুঝতে পারল তার মুখ রক্তশূন্য ।
আরও দুদিন ছিল মামন। একদিন পূর্ণিমা ছিল। মহেশদের হাভেলির কম্পাউন্ড বিশাল বড়, মেন গেট দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে শ্যামের অপরূপ মন্দির, নিত্যপুজো হয়,সেদিন পূর্ণিমা বলে বিশেষ পুজো ছিল। বুড়িকে স্ট্রেচারে করে এনে মন্দির চত্বরে রাখা হয়েছে, অনেকক্ষণ ধরে পুজো হল, প্রচুর বাইরের লোক এসেছে, পুজোর পরে শুরু হল ভজন। গাইছে মহেশ। মামন অবাক, মহেশ যে এত ভাল গায়, এত মিষ্টি সুরেলা গলা এ তার কল্পনার অতীত, মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল মহেশকে। একসময় ভজন শেষ হল,প্রসাদ বিতরণ হল, এবার হাভেলি ফেরার পালা। ফেরার পথে মামন মহেশকে বলল,মহেশের যে এই গুণটা আছে তা এতদিন সে বলেনি কেন, দ্বিতীয়ত মামন যতটুকু দেখেছে বুঝেছে ,মহেশ খুব ধর্মভিরু, মদ খায়না দেবতার জন্য, তাহলে বুড়ি মাকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছে। কেন এত বেপরোয়া জীবন কাটাচ্ছে। কেন বিয়ে করে সংসারী হচ্ছে না যেখানে ওর মা ওর পাত্রী পছন্দ করে রেখেছে। মহেশ চুপ করে সব শুনে বলল, মামন ওনাকে দুদিন হল দেখছে আর কথা বলছে, ওনার কথা বা আগের ওনাকে দেখলে এই জ্ঞান দিত না। মানে , মামন কৌতূহলী, মানে খুব সোজা, শোনো আমরা জমিদার বংশ আর উনি ছিলেন জমিদার গিন্নি, কম বয়সে ওনার দাপট ছিল দেখার মত, এই বাড়ির চাকর বাকররা শুধু নয় পুরো তল্লাট ওনাকে ভয় করত, এটা উনি একা বলে ন’ন এ বংশের সব কর্তীরাই এমন ছিলেন, এবার দেখ যেহেতু আমরা জমিদার আমাকে বিয়ে করতে হলে সেম টাইপের ফ্যামিলির মেয়ে আনতে হত, সে যদি সহ্য করতে না পারত ওনার দাপট আর শাসন আত্মহত্যা করে ফেলতেই পারত, আমার যেমন পয়সা আছে তাদেরও থাকতে হবে ,এটাই দস্তুর, তখন তার বাপের বাড়ির লোক কি ছেড়ে দিত আমাকে ? আমার যেমন সোর্স আছে তাদের কি থাকত না। সবদিক ভেবেই বিয়ে করিনি, আর শুধু আমি একা নই আমাদের বংশের সবাই এই কারণে লেট ম্যারেজ করেছে, বুঝলে এবার। কি হল ব্যাপারটা, মামন ঘেঁটে ঘ, গুলাটি তাকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল তার তো পুরো উল্টো মহেশ বলছে, গম্ভীর গলায় মামন বলল , দিব্যি খেয়ে বল এতক্ষণ যা বললে তা ঠিক বললে। মহেশ মামনের হাত ধরে টেনে জোরে হাঁটতে লাগল মন্দিরের দিকে, পৌঁছে মন্দিরের ভেতরে বিগ্রহের গায়ে হাত দিয়ে দিব্যি খেতে মামন বুঝল এতদিন গুলাটি যা বলেছে তা ডাহা মিথ্যে। ওরা ফের হাভেলির দিকে হাঁটা দিল, মামন ফের বলল, এখন তো উনি শয্যাশায়ী এখন তো আর আগের মত দাপট দেখাতে পারবেন না , ওনার ইচ্ছে তুমি রাকাকে বিয়ে কর, দেখলাম তো মেয়েটাকে, খারাপ তো নয়, দেখতেও সুন্দর, ব্যবহার ভাল, ঘরের বৌ হল আবার তোমার মায়ের সেবা করার লোকও হল। মহেশ বিষম খেল, মামন দেখল মহেশের মুখটা কেমন অদ্ভুত দেখতে লাগছে ।