মামন : পর্ব – ১৩ (Mamon)
ছোটবেলাতে শিশুদের তাদের গুরুজনরা প্রায়শই একটা নিষেধ করত, ” ওখানে যাস নি, ভূতে ধরবে বা জুজু ধরবে “, এই ভূত বা জুজু কি বস্তু তা জানার চরম কৌতুহল শিশুরা মনে মনে পুষে রাখত, আর যেই দেখত গুরুজনরা চোখের আড়াল হয়েছে তারা দিত একছুট ওই ভূত বা জুজু দেখতে অবশ্যই বুকে নিয়ে একবস্তা ভয়। মামন যে অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে এতদিন হেঁটেছে সে আজ বৈভব কি বস্তু আর তা যদি করায়ত্ত হয় তার যে ফল বুঝতে পারছে। সেই সম্পদ পাবার জন্য আছে অগণিত প্রলোভন। আজ মামনের ঠিক ওই শিশুদের মত অবস্থা।
পরের দিন পার্লারে গিয়ে ইস্তক মামনের মন শান্ত হল না, সে কি করবে, মহেশের কথা মেনে আর কিছুদিন অপেক্ষা করবে না গুলাটির কথা মেনে রক্ষিতা হবে কোন এক ক্ষমতাশালী ব্যক্তির, আবার যতক্ষণ না মহেশ তার অবস্থান পরিষ্কার করছে সেখানেও রয়ে যাচ্ছে ধোঁয়াশা। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। যেন পড়ার বই না দিয়ে তাকে সরাসরি পরীক্ষার হলে ঠেলেঠুলে পাঠান হয়েছে।
গুলাটি যেমন আসার বিকেলে এল, মামন সরাসরি তাকে বলল সে কিছু আলোচনা করতে চায় কিন্তু এখানে বসে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। গুলাটি বলল সে দেখছে। কিছুক্ষণ পরে বলল আগামীকাল মামন যেন রেডি থাকে সে মামনকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। কারুর ফ্ল্যাটে? আঁৎকে উঠে মামন প্রশ্ন করতেই গুলাটি হেসে উত্তর দিল নাহ্ ,সে ভেনাসকে নিয়ে যাবে রায়পুর শহরের বিখ্যাত প্রমোদ উদ্যান টিকরাপাড়া তালাও বা জয় বজরঙ্গী তালাও ঘুরতে, গুলাটি মহেশের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে, ওখানে ওরা ঘুরবে, মজা করবে, পানিপুরি খাবে, আরও কত কি।
রাতে মামনের ঘরে টোকা, এই আওয়াজ মামনের পরিচিত, মহেশ এসেছে, উঠে গিয়ে দরজা খুলে মহেশকে ভেতরে আনল মামন, মহেশ আজ বসল না, শুধু বলল কাল ঘুরতে যাবে যাক তবে যেহেতু মামন এখনও ওর কাস্টডিতে আছে তাই জগ্গু ওকে ফলো করবে, জগ্গু ওদের কাছে যাবে না, মামনকে চিনতে পারবে না, মামন যেন জগ্গুকে দেখে আগ বাড়িয়ে কথা না বলে, যদিও মহেশ জানে গুলাটির সঙ্গে সিকিউরিটি থাকে তবুও এটা মহেশের কর্তব্য তাই পালন করছে, যদি কিছু হয়। বিরক্ত হল মামন তবুও মুখে প্রকাশ করল না ,নীরবে ঘাড় নাড়ল।
রায়পুর শহরে উল্লেখযোগ্য নদী নেই কিন্তু প্রচুর দিঘি আছে, তার একটি বজরঙ্গী তালাও। বেশ সুন্দর করে সাজানো বাগান, চলার পথ, বাচ্চাদের খেলার জায়গা ,ক্যাফেটেরিয়া । মামনের খুব ভাল লাগল, অনেকদিন পরে উন্মুক্ত আকাশের তলায় নিজেকে নতুন করে চেনার চেষ্টা করল মামন। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে আলতো কামড় দিতে দিতে গুলাটি বলল – সে নিজেও গ্রাজুয়েট, মামনের বিষয় বা ওর রিহ্যাব নিয়ে সে বড়া সাব বা মিস্টার ভাতখন্ডের সঙ্গে বহু আলোচনা করেছে। প্রথম ধাক্কাটাই আসছে মামনের ভাষা, তার ওপর শাসক দলের অনুমতি বিনা কাজ করা যাবে না। প্রাইভেট চাকরি, সেই ভাষাগত প্রবলেম। প্রাইভেট মন্টেসরি স্কুলে এক্ষুনি ঢুকিয়ে দিতে পারে, কিন্তু পাঁচ হাজার মাইনের কাজ। যতদিন না মামন হিন্দী পরীক্ষা দিয়ে পাশ করবে তার আগে অবধি এর বাইরে কিছু নেই। তাহলে ? মামনের হতাশ কন্ঠস্বর। স্বগোতক্তি করে উঠল,সেই মহেশ, সেই ওর খাঁচা। বর্ষার কি হবে ? গুলাটি পরম যত্নে ওর হাত ধরে বলল – ভেনাস, মহেশ একটা মিথ্যুক, আমাকে যেমন ও বিয়ে করে নরক থেকে উদ্ধার করবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছিল ঠিক তেমনই পিঙ্কিকেও বলেছিল। পিঙ্কি আমাকে আরও বলেছে যে কলকাতাতেও মহেশের একটা রক্ষিতা আছে, তাকেও একই স্বপ্ন দেখিয়েছিল। মহেশ আজও অবিবাহিত আর ওদের বংশের ট্রাডিশন আগে নিজের যৌবন চূটিয়ে উপভোগ করা আর হাফ বুড়ো হলে বিয়ে করে সংসার পাতা। আমি খবর নিয়ে জেনেছি, তা মহেশ এতদিন ধরে তো তোমাকে ভোগ করছে, স্বপ্ন দেখায় নি ? না না না, মহেশ আমার সঙ্গে কিচ্ছুটি করেনি আজ পর্যন্ত, আর তেমন ভাবে স্বপ্নও দেখায়নি, শুধু বলেছে আমাকে নিয়ে ওর কি একটা প্ল্যান আছে , কি সেই পরিকল্পনা, আজও বলেনি। হো হো হো করে হেসে উঠে গুলাটি বলল ইয়ে হুই না বাত। এ তো ওর পুরোনো ছক। মহেশের পরিকল্পনা যখন অসহ্য হয়ে উঠল তখনই তো আমি চলে গেলাম। মামন হতবাক, মহেশকে নিয়ে তার মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিল, তা মিথ্যে। ভেনাস শোনো। ওর কথায় বিশ্বাস করে তুমি পরে পস্তাবে, আজ নয় কাল করে ও ঘোরাবে, তারপর পিঙ্কিকে তাড়িয়ে ওই বাড়ি বিক্রি করে তোমাকে রক্ষিতা বানিয়ে অন্য বাড়িতে রাখবে, নামে বেনামে এই শহর বা অন্য জায়গাতে ওর প্রচুর সম্পত্তি আছে। বুঝতেই পারছ তোমার মাস্টার্স ডিগ্রি এই রাজ্যে তোমাকে কি চাকরি দেবে, বিশেষ করে মহেশের মত যদি মালিক থাকে। তাহলে , আমি অদৃষ্টের শিকার, মামন বলে উঠল। তীব্র হতাশায় মামন টেবিলে মাথা নাবিয়ে রাখল। ভেনাস, গুলাটির সহানুভূতির স্বর, তুমি কলকাতাতে ফিরে যাও ওখানে তোমার মত করে বাঁচার চেষ্টা কর। আমি কিছু টাকা তোমাকে দিচ্ছি , তুমি তাই দিয়ে আপাতত কাজ চালাও, ঈশ্বর মঙ্গলময় তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা করবেন। ম্যাম ওখানে যে আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তোমার দেওয়া অর্থে হয়ত অন্ন জুটবে কিন্তু এই চেহারায় বর্ষাকে নিয়ে আমি থাকব কোথায়, অন্তত রাত্রে ! ওই শহর কি ভাল মনে করেছ , আরও নোংরা। অশ্রুসজল চোখে মামন বলে উঠল। হে ভগবান, বলে গুলাটি হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে টানতে আরাম্ভ করল, খুব চিন্তিত লাগছে গুলাটিকে। ঠিক তখনই জগ্গু ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ইশারাতে মামনকে ওর হাতের ঘড়ি দেখিয়ে ইঙ্গিত করল যে আর নয় এবার মামন যেন উঠে পড়ে। তো ভেনাস, য়ে তো বড়া মুসিব্বত। থোড়া সোচনে দো মুঝে।এখন চল রাত হয়ে যাচ্ছে।
সারারাত মামন মহেশ , রাণা , গুলাটি , রূপালী, পিঙ্কি, বর্ষা একসঙ্গে মেখে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম ভাঙাল গুলাটির ফোন। ভেনাস তুম আজ মেরা সাথ লাঞ্চ করোগে। রেডি রহেনা, ম্যায় গাড়ি ভেজ দুঙ্গি, আ যানা, ওকে বাই। ফ্রেশ হয়ে চা খেতে এসে দেখল মহেশ একা পিঙ্কি নেই। মামনকে দেখে বলল – তো কবে যাবে গুলাটির কাছে পাকাপাকি, ওর চক্করে তো ভালোই ফেঁসেছ। যাও লাঞ্চ করে এস। তুমি জান ? মামনের প্রশ্নের উত্তরে মহেশ বলল গুলাটি ওকে আগেই জানিয়েছে। তারপর সোজা হয়ে বসে বলল – যাই করো না কেন ওর পাল্লায় পড়ে বেশ্যাগিরি কর না, প্লিজ। কে ঠিক, কে ভুল, মামনের হাসি পেল। যা থাকে কপালে সে বুঝে নেবে, তাকে এই সমুদ্র থেকে বের হয়ে আসতেই হবে।
গুলাটির বাড়িতে লাঞ্চে সময় পাতে পোস্ত দেখে মামন অবাক, জানতে পারল ওরা খুসখুস পছন্দ করে। গুলাটির বাড়িটা ছোট হলেও যে বৈভবে ভরা তা এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। খাওরা শেষে দুজনে আড্ডা দিতে বসল। নামেই আড্ডা ,চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ মামনের ভবিষ্যতের। গুলাটি বিয়ার খাচ্ছে। সব কথার শেষে একটাই কথা যা মহেশ করতে চলেছে মামনের সাথে সেই একই কাজ মামন নিজের মত করে করুক এতে ওর লাভ আছে । ওই যে ” খোকা যাসনি, জুজু ধরবে “, মামনের ইচ্ছে হল জুজু দেখবে। হাসতে হাসতে বলল , কে তিনি !
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা গুলাটি দিল, উনি জব্বলপুরের আর্মির অ্যামুনিশন ডিপোতে এখন পোস্টেড, মেজর জেনারেল পজিশন, বাড়ি হরিয়ানার সোনপথে, বাড়িতে তিন বাচ্চা নিয়ে বৌ ঘর সংসার করছে। ওকে বিভিন্ন কাজ নিয়ে প্রায়ই রায়পুরে আসতে হয় বলে এখানে একটা দুর্দান্ত ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে, যার খবর বৌ জানে না। রাজ্য সরকারের হয়ে মিঃ ভাতখন্ডে থাকে, দীর্ঘদিন আলাপের ফলে দুজনে এখন ভাল বন্ধু, ভেনাস ওর কাছে গেলে ওর যা উপরি আছে তার দশ পয়সা পেলেই বাকি জীবন হাসতে হাসতে কাটাতে পারবে, এছাড়াও মামনের একটা সুবিধে আছে মেজর জেনারেল চৌহানের কিন্তু ট্রান্সফারের চাকরি, এক জায়গাতে বেশি থাকতে পারবে না, চালাক হলে মামন এর মধ্যে কামিয়ে নিতে পারে ইচ্ছেমত। মামন হেসে বলল মিলিটারির লোকেরা বড্ড গম্ভীর হয়। একদম নয়, খুব দিলখোলা আর উইটি, ভেরি হ্যান্ডসাম। মামন ফের হেসে বলল আগে তাকে দেখি তো, তারপর ওর পছন্দ আমার পছন্দ ম্যাচ করলে তবেই তো গাড়ি চলবে। আরে ছাড়ো, আমার ভেনাসকে দেখে ভাতখন্ডেই চিৎপাত, যে লোকটা সব থেকে খুঁতখুঁতে সেখানে চৌহান, তুমি ভেবে উত্তর দাও ভেনাস, আর মিট করতে চাও, জাস্ট গিভ মি থ্রি টু ফোর ডেস,, আই উইল অ্যারেঞ্জ দ্য মিটিং, গুলাটির সপ্রতিভ জবাব। দুদিন পরে গুলাটি এসে জানাল আজ ওর বার্থডে ,পার্টি দেবে সামনের রবিবার, মহেশের রেস্টুরেন্ট, ও এইমাত্র মহেশের সঙ্গে সব ফাইনাল করে এল, ভেনাস ওইদিন চৌহানকে দেখবে আর পছন্দ হলে বললে গুলাটি আলাপ করিয়ে দেবে।