মাফিয়া রহস্য : 09
কর্নেল একটু হেসে সুনীথের উদ্দেশে বললেন–আপনাদের কলকাতা অফিসে আমার যাবার প্রোগ্রাম ছিল, মিঃ ব্যানার্জি। কিন্তু এখান থেকেই দিল্লি যাব ভাবছি। তারপর বোম্বে হয়ে ফিরব। তো আপনাকে পেয়ে ভালই হল। আপনাদের টোটাল এক্সপোর্টের খবরাখবর…..
সুনীথ বাধা দিয়ে বলল–দেখুন মিঃ ডেভিস, খুব দুঃখিত যে, আমার কাছে তেমন কোন কাগজপত্র নেই–যাতে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। হঠাৎ একটা কাজে চলে এসেছি এখানে।
কর্নেল বললেন–না, না মিঃ ব্যানার্জি। কোন ফিগার আমার দরকার নেই। শুধু একটা ধারণা করে নেওয়াই যথেষ্ট। ইয়ে মিঃ চৌধুরী।
জয়ন্ত বলল–বলুন মিঃ ডেভিস।
–আপনি এখানে যা কালেক্ট করার করুন। পরে আপনার কাছে টুকে নেব। আমি মিঃ ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলি।
সুনীথকে অনিচ্ছুক দেখাচ্ছিল। মিঃ কৃষ্ণান বললেন–চলুন মিঃ চৌধুরী। আপনাকে আমাদের স্ট্যাটিসটিকাল ডিপার্টে নিয়ে যাই। ব্যানার্জি, আপনি ততক্ষণ মিঃ ডেভিসের সঙ্গে গল্প করুন।
ওরা দুজনে বেরিয়ে গেল। তারপর কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে সুনীথের দিকে তাকিয়ে বললেন–আজ এখানে এসে শুনলুম, একজন মহিলার ডেডবডি পাওয়া গেছে। একটা পোড়ো বাংলোয়। একজনকে হাতেনাতে গ্রেফতারও নাকি করা হয়েছে।
সুনীথ তখনই চোখ নামিয়ে পাইপে তামাক ভরছিল। মুখ তুলে বলল তাই বুঝি? আমি শুনিনি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় তো খুনখারাপি লেগে আছে।
কর্নেল নিষ্পলক তাকিয়ে বললেন–মহিলার নাম রুবি চ্যাটার্জি।
সুনীথ একটু চমকাল। ফের বলল–তাই বুঝি?
রুবি চ্যাটার্জি এই কাবাডিয়া অ্যান্ড লাখোটিয়া কর্পোরেশনের কলকাতা অফিসের মার্কেটিং সুপারভাইজার।
সুনীথের মুখ এবার সাদা হয়ে গেল। ঠোঁট কাপল একটু। পরক্ষণে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল–অসম্ভব! রুবি এখানে এসে খুন হবে কী ভাবে? আপনি হয়তো ভুল শুনেছেন মিঃ ডেভিস।
কর্নেল হাসলেন। বললেন–পুলিশ ওকে সনাক্ত করেছে।
সুনীথ ব্যস্ততা ও বিরক্তি দেখিয়ে বলল–তাহলে তো এ অফিসেই প্রথমে খবর আসত। খোঁজ নিয়ে দেখুন মিঃ কৃষ্ণান বা মিঃ পটবর্ধন কেউ জানেন না। আপনি ভুল করেছেন।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। সেও তো ঠিক। তাহলে কি আমি ভুল শুনলুম?
–নিশ্চয় ভুল। এ হতেই পারে না। বলে সে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। তবে আপনি যখন বলছেন, আমার খোঁজ নেওয়া কর্তব্য।
কর্নেল বললেন–ফোনে খোঁজ নিন মিঃ ব্যানার্জি। বাইরে গিয়ে কী হবে? ওই তো হাতের কাছে ফোন রয়েছে।
সুনীথ মুহূর্তে বদলে গেল। খাপ্পা হয়ে বলল–আমি কী করব বা না করব তাতে আপনি কেন নাক গলাচ্ছেন মশাই? কে আপনি?
এবার কর্নেল বাংলায় বললেন রুবি আপনাকে ভালবাসত, সুনীথবাবু। সে আপনাকে বাঁচাতেই ছুটে এসেছিল এখানে। কিন্তু সে ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারাল। আর আপনি তার পরিণতির কথা জেনেও এভাবে গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছেন! পুলিশকে সাহায্য করছেন না হত্যাকারীকে ধরিয়ে দিতে। কেন বলুন তো? সুনীথ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল। ভাঙা গলায় বলল-কে আপনি?
ব্যস্ত হবেন না, সুনীথবাবু। আগে ঝটপট আমার প্রশ্নের জবাবগুলো দিন।
–যদি না দিই?
–আপনার কাঁধের ওপর খাঁড়া ঝুলে আছে, ভুলবেন না।
–আপনি আমায় বাঁচাতে পারবেন?
–চেষ্টা করব। সত্যি কোন অপরাধে না জড়িত থাকলে আপনাকে আমি বাঁচাবই। সে প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি।
–আপনার প্রতিশ্রুতির মূল্য কী? কারণ আপনাকে তো আমি চিনি না।
–আপাতত শুধু এটুকু জেনে রাখুন, হতভাগিনী রুবি আমার কাছে গতকাল সকালে সাহায্য চাইতে গিয়েছিল। আপনাকে সে গভীরভাবে ভালবাসে–তা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। রুবির খাতিরেই আমি মোহনপুরে এসেছি।
সুনীথ বসে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকার পর বলল–আপনি রুবির ব্যাপারে যা বললেন, তার প্রমাণ দিতে পারেন?
কর্নেল হাসলেন।–অন্তত এটুকু পারি যে রুবিকে আপনি একটা গোপন চিঠি দিয়েছিলেন মিঃ মৈত্রকে দেবার জন্যেতা রুবির ঘর থেকে আপনি বেরুনোর পর…
বাধা দিয়ে সুনীথ বলল–জানি, রুবি আমাকে বলেছে।
জিরো জিরো আট নয় সাত মানে কী সুনীথবাবু?
–আমাদের একটা কনসাইনমেন্ট নম্বর।
আগামীকাল ওই কনসাইনমেন্টের মাল জাহাজে তোলা হবে?
–হবে না। দয়াময়ী ট্রেডিংস জাহাজের ব্যবস্থা করতে পারেনি।
–কিন্তু মাল গোডাউন থেকে চলে গেছে?
–হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কী ভাবে জানলেন এসব?
—যে ভাবেই হোক, জানি। এবার বলুন, মালটা আছে কোথায়?
দয়াময়ী ট্রেডিংসের নিজস্ব গোডাউন আছে ডক এরিয়ায়। সেখানে রাখা হয়েছে। বরাবর তাই হয়। ওরা নিজেদের তদারকিতে প্রথমে ডকে, তারপর জাহাজে পৌঁছে দেয়।
–হুম! রুবি এখানে এসে কীভাবে যোগাযোগ করল আপনার সঙ্গে?
প্রথমে এই অফিসে এসে আমার খোঁজ করেছিল। এখানে পায়নি। তখন ওকে এখান থেকে বেরুবার সময় দেখতে পেয়েছিলুম। এটা নিচু এলাকা। আমি হোটেল নন্দনের ব্যালকনি থেকে দেখতে পেয়েছিলুম। কাছেই বড় রাস্তার ধারে নন্দন হোটেল।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন সাড়ে চারটে বাজে। সুনীথবাবু, এখানে বসে ডিটেলস শোনা বা আলোচনা অসুবিধে আছে। আমি আপনার সঙ্গে নন্দন হোটেলে যেতে চাই।
সুনীথ একটু ভেবে বলল–আপনি যেই হোন, অনেক কিছু আপনার জানা দেখছি। কিন্তু বুঝতে পারছিনে, রুবি আপনার কাছে কেন গেল? আমাকে ও কিছু বলেনি কিন্তু। আপনি কি লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছেন?
না।
–সি. বি. আই.?
না, না সুনীথবাবু।
–প্লিজ বলুন, আপনি কে? সুনীথের কণ্ঠস্বরে ব্যাকুলতা ফুটে উঠল। আমি কথা দিচ্ছি, সব আপনাকে বলব।
–নন্দন হোটেলে গিয়েই শুনবেন।…বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একটু হেসে বললেন–এখন অন্তত এটুকু বলতে পারি, আমি সরকারি লোক নই।
সুনীথ কী বলতে যাচ্ছিল, কৃষ্ণান ও জয়ন্ত ফিরে এল। সে থেমে গেল।
কিছুক্ষণ পরে কাবাডিয়াদের গাড়ি সুনীথকে নন্দন হোটেলে পৌঁছে দিতে এল। গাড়িতে কর্নেল এবং জয়ন্তও এল।
দোতলায় বাইশ নম্বর সিঙ্গল স্যুটে সুনীথ উঠেছে। ভেতরে ঢুকে সে ঘণ্টা বাজিয়ে হোটেলবয়কে ডাকল। চায়ের অর্ডার দিল।
কর্নেল আরাম করে বসে চুরুট ধরিয়ে বললেন–এই স্যুটটাই সম্ভবত হোটেলের সেরা। পূর্ব উত্তর ও দক্ষিণ তিনটে দিকই দেখা যায়। যাকগে সুনীথবাবু–আমাদের কাজ শুরু হোক।
সুনীথ গোঁ ধরে বলল–কিন্তু আপনি কথা দিয়েছেন, আগে নিজের পরিচয় দেবেন। তা যদি না দেন, আর আমি একটা কথারও জবাব দেব না।
কর্নেল কিছু বলার আগে জয়ন্ত বলে উঠল–উনি প্রখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
সুনীথ নড়ে বসল।–আচ্ছা। তাই বলুন! আপনার কীর্তির কথা আমি প্রচুর পড়েছি। আশ্চর্য! আমি একবার ভেবেছিলুমও যে আপনার কাছে যাব। কিন্তু এত দ্রুত অবস্থাটা খারাপের দিকে গড়াল যে সময়ই পেলুম না। কর্নেল, সরকার। আপনাকে এভাবে পেয়ে আমার মনোবল যথেষ্ট বেড়ে গেল। ইতিমধ্যে। না চেনার জন্যে কোন ত্রুটি ঘটলে ক্ষমা করবেন!
কর্নেল বললেন–কোন ত্রুটি ঘটেনি সুনীথবাবু! এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকুন। কিন্তু মনে রাখবেন, কোন ব্যাপারে এতটুকু গোপনতা থাকলে কিংবা মিথ্যা বললে আমি ভুল পথে চলে যাব এবং তার ফলে আপনাকে বাঁচানো কঠিন হবে। দু-দুটো খুনের দায়িত্ব আপনার কাঁধে এসে পড়বে।
সুনীথ শান্তভাবে বললবলব। প্রশ্ন করুন।
–গোড়ার দিক থেকেই শুরু করি। হঠাৎ আপনি মোহনপুরে চলে এলেন কেন?
সুনীথের মুখে ঘৃণার ভাব ফুটে উঠল। তার চোয়াল শক্ত হয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল–এক বাস্টার্ড আমাকে দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেল করে। যাচ্ছিল। তাকে শায়েস্তা করার জন্যে একটা ফাঁদ পেতেছিলুম মোহনপুরে। সে। মোহনপুরে চলে এল। আমিও এলুম। যেখানে অশনিবাবু খুন হয়েছেন, ওখানেই তার জন্যে অপেক্ষা করার কথা ছিল আমার। ওৎ পেতে বসে আছি, হঠাৎ…
কর্নেল বললেন–তাকে খুন করার মতলবেই কি?
–হ্যাঁ। ও আমার জীবনের শান্তি নষ্ট করেছিল।
–কিন্তু মোহনপুরে কেন? কলকাতায় চেষ্টা করা যেত না?
–হয়তো যেত। কিন্তু তাতে রিস্ক ছিল। ও খুব চতুর লোক, তৈরি হয়েই যেত। সেদিক থেকে মোহনপুর নিরাপদ জায়গা আমার পক্ষে। আর সবচেয়ে বড় কথা, কাবাডিয়া-লাখোটিয়া কর্পোরেশন এখানেও আছে। তাই ফাঁদটা সে টের পায়নি।
–আগে ফাঁদটা কী, বলুন সুনীথবাবু।
–গার্গী রায় নামে কোন মহিলার নাম শুনেছেন কি?
–হুম! বলে যান।
–গার্গীর সঙ্গে একটা এমোশানাল সম্পর্ক করে নিতে হয়েছিল। গার্গী আমাদের কোম্পানির এজেন্ট দয়াময়ী ট্রেডিংসে চাকরি করে। দয়াময়ীর বর্তমান মালিক রবীন মৈত্র আমার বন্ধু। রবীনই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল গার্গীর সাহায্য নিতে। কারণ গার্গীর সঙ্গে আমার ব্ল্যাকমেলারের পরিচয় এবং প্রেম ছিল। তা আমার মধ্যে কিছু চার্মিং ব্যাপার আছে বলে মহিলারা মনে করেন।..সুনীথ শুকনো হাসি হাসল।…সেকালে যাদের বলা হত লেডি কিলার, আমি নাকি তাই! ফলে গার্গী সহজেই আমার প্রেমে পড়ে গেল। তারপর সাবধানে গার্গীকে কাজে লাগাতে থাকলুম। গার্গী সেটা টের পায়নি। গার্গী তখন উলটে আমার ব্ল্যাকমেলার অর্থাৎ তার অন্যতম প্রণয়ীকে ব্ল্যাকমেল শুরু করল। খুলে বলছি। ব্ল্যাকমেলার…
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–দীপঙ্কর সেন, বলুন। নাম গোপন করে লাভ কী?
হ্যাঁ। দীপঙ্কর সেন দয়াময়ী ট্রেডিংসের অন্যতম লেবার সাপ্লায়ার অর্থাৎ সাব-এজেন্ট। আমাদের কোম্পানির মাল কাঠের বাক্সে প্যাক করে তার লোকেরাই। দয়াময়ী শুধু তদারক করে কমিশন পায় কোম্পানির কাছে। আবার সেই কমিশনের একটা অংশ তাকে দিতে হয় দীপঙ্কর সেনকে। রবীন কীভাবে টের পেয়েছিল, দীপঙ্কর প্যাকিংয়ের সময় মালের মধ্যে গাঁজা-আফিং চালান দিচ্ছে। কিন্তু দীপঙ্কর দুর্ধর্ষ লোক। তার হাতে অনেক গুণ্ডা পোষা আছে! রবীন ভয়ে কিছু বলেনি। যখন রবীন আমাকে কথাটা জানাল, আমি প্রথমে কোম্পানির স্বার্থের কথা ভাবলুম। বিদেশের বন্দরে মাল খালাস হবার পর দীপঙ্করের পার্টি। পূর্বব্যবস্থামতো প্যাক খুলে ডক থেকেই গাঁজা-আফিংগুলো সরিয়ে ফেলবে। কিন্তু দৈবাৎ বিদেশী কাস্টমস ব্যাপারটা ধরে ফেললে কোম্পানির প্রচণ্ড ক্ষতি হবে। কারবার বন্ধ করে দেবেন ভারত সরকার। আমি ভাবলুম, কোম্পানিকে এখনই ব্যাপারটা জানানো যাক্। কিন্তু দীপঙ্কর দুর্ধর্ষ লোক। নিশ্চয় এর প্রতিশোধ নেবে। তাই ভয় হল। মনস্থির করতে সময় লাগল। বাড়ি ফিরে আমার উদ্বিগ্ন ও মনমরা ভাব লক্ষ্য করে আমার স্ত্রী ভোরা জানতে চাইল কী হয়েছে? তখন তাকে খুলে সব বললুম। ভোরা বলল–তুমি লাইফ রিস্ক করতে যেও না। তোমার কী? ছেড়ে দাও! যে যা করছে করুক, তোমার কী তাতে? ভোরার কথায় সেদিন : হয়েছিলুম। কিন্তু তলিয়ে কিছু ভাবিনি। কদিন পরে দীপঙ্কর সেন আমার চেম্বারে এল। এসে বিদেশী পত্রিকার কিছু কাটিং দেখাল–তাতে ভোরার ছবি রয়েছে। ভোরা আন্তর্জাতিক কুখ্যাত অপরাধী বল মাফিয়ার সদস্য। জেল থেকে পালিয়েছে। ইটালির মিলান জেলে তার সাতবছর মেয়াদ হয়েছিল।..
সুনীথ থামলে কর্নেল চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর বললেন–হুম! বলে যান।
সুনীথ উঠে গিয়ে এক গ্লাস জল খেল। তারপর বলল–একমাত্র ভোরাকেই আমি গভীরভাবে ভালবাসি–সব শোনার পরও ভালবাসতে পেরেছি। তাকে ছাড়া পৃথিবী শূন্য লাগে। এই দুর্বলতা জয় করা আমার অসাধ্য। দীপঙ্কর আরও বলল যে ভোরা মাফিয়া দলের নেতার হুকুমেই আমার স্ত্রী হয়েছে। অতএব দীপঙ্করের কোন ক্ষতি হলে ভোরাও বিপদে পড়বে এবং ভোরা বিপদে পড়লে তাকে যে বিয়ে করেছে, সেও বিপদে পড়বে। তাই সুনীথ ব্যানার্জিকে চুপ করে থাকতেই হবে। এদিকে ভোরা ইজ প্রেগন্যান্ট। তিন মাসের বাচ্চা তার পেটে। আমারই সন্তান। আমি তো জানোয়ার নই–মানুষ!
সুনীথ দুহাতে মুখ ঢাকল। কর্নেল বললেন–টেক ইট ইজি, সুনীথবাবু।
সুনীথের চোখ দুটো লাল হয়েছে। সে আস্তে আস্তে বলতে থাকল–কথাটা ভোরাকে খুলে বললুম। ভোরা কাদল। আফটার অল, সে একজন নারী। মা হতে চলেছে। আমার সংসারে এসে তার মনে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। সে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইল। দীপঙ্কর সে-দলের রীতি অনুসারে কথাটা জানাতে বাধ্য হয়েছে। না জানালে ভোরার প্রতিই দলের স্থানীয় এজেন্টদের সন্দেহ হবে। সুনীথ ব্যানার্জিকে সামলাবার দায়িত্ব দিয়েই ভোরাকে পাঠান হয়েছে। ভোরা সারারাত কাঁদল, ছটফট করল। তাকে সান্ত্বনা দিলুম। কীভাবে তাকে এই পাপচক্র থেকে নিরাপদে সরিয়ে আনব, সে কথা ভাবতে থাকলুম। এমন সময় দীপঙ্কর আবার একদিন এসে আমার কাছে টাকা দাবি করল। টাকা না দিলে ভোরার সম্পর্কে সব তথ্য পুলিশকে জানিয়ে দেবে। ব্যস, তার ব্ল্যাকমেল শুরু হল। আমার সব সঞ্চয় শেষ করে ফেলল সে। তখন মরিয়া হয়ে ওকে খতম করতে চাইলুম এবং রবীনের সাহায্যে গার্গীকে কাজে লাগাবার কথা ভাবলুম।
দরজায় কে নক করল। জয়ন্ত খুলে দেখল, চা এনেছে বয়। চা রেখে সে। চলে গেল। কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, তুমি চা তৈরি করো। হুম, আলো জ্বেলে দাও!
আলো জ্বলল। চায়ে চুমুক দিয়ে সুনীথ বলল–দীপঙ্কর নিজের দলের বিরুদ্ধেও এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করল। ভোরা সিদ্ধান্ত নিল, তাদের ভারতীয় এজেন্টের কানে তুলবে ব্যাপারটা। কিন্তু তখন ভারত সরকার চোরাচালানি আর সবরকম দুষ্টচক্র উচ্ছেদে প্রচণ্ড ড্রাইভ শুরু করেছেন। ভোরার দলের লোকেরা কেউ ধরা পড়েছে–কেউ পালিয়েছে। ছিন্নভিন্ন অবস্থা। কলকাতার এজেন্ট দীপঙ্করের কিন্তু কিছু হল না। সে দিব্যি গা বাঁচিয়ে কাবাডিয়া লাখোটিয়া কোম্পানির ছত্রছায়ায় টিকে রইল। আমি পাল্টা কিছু করলেই সে ভোরাকে ধরিয়ে দেবে। বুঝতে পারছেন তো অবস্থাটা?
-পারছি। তারপর?
–গার্গীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় শুরু করলুম। তারপর বললুম, দীপঙ্কর সেনের সঙ্গে যেন সে বেশি না মেসে। গার্গী তরলমতি মেয়ে। নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে এবং সাদাসিধেভাবে থাকলেও খুব বুদ্ধিমতী আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সে দীপঙ্করকে একদিন কথায় কথায় একটা কনসাইনমেন্ট নাম্বার উল্লেখ করে বলে বসল–তুমি কী সব করো-টরো, আমি জানি। দীপঙ্কর কিন্তু গার্গীর প্রেমে তখন প্রচণ্ড আত্মহারা। নয়তো গার্গীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিত। নারীর প্রতি গভীর আসক্তি অনেক সময় পুরুষের পক্ষে ভাল হয়ে দাঁড়ায়। দীপঙ্কর গার্গীর প্রতি অতিমাত্রায় দুর্বল। গার্গী তার কারবার টের পেয়েছে দেখে সে গার্গীকে সুন্দর ভবিষ্যতের লোভ দেখাল। এমন কি টাকা দিতেও শুরু করল। প্রচুর টাকা সে কামায়। দিতে আপত্তি ছিল না।
কর্নেল বললেন–একবছরে চল্লিশ হাজারেরও বেশি টাকা সে গার্গীকে দিয়েছে।
–হ্যাঁ। গার্গী আমাকে জানিয়েছিল। তারপর আমি গার্গীকে বললুম–তুমি দীপঙ্করকে বলল, কাবাডিয়াদের মোহনপুরেও কারখানা আছে। ওখানে রেলে মাল বুক হয়–পৌঁছয় বিশাখাপত্তনমে। দয়াময়ী ট্রেডিংস ওখানেও এজেন্সি নিচ্ছে–শুধু প্যাকিং আর রেলে লোডিংয়ের কাজ। দীপঙ্কর যদি চায়, মোহনপুর হয়েও চোরাচালানের সুযোগ নিতে পারে। গার্গী সে ব্যবস্থা করে দেবে। মোহনপুরে একসময় তারা ছিল কারণ তার বাবা তারকবাবু রেলে চাকরি করতেন। মোহনপুরের অনেক লোক গার্গীর চেনা। দীপঙ্করের কোন অসুবিধে হবে না।…একথা শুনে দীপঙ্কর নেচে উঠল। জানাল, ঠিক আছে। আগামী ফা জুনই মোহনপুর যাওয়া যাক্। গার্গী রাজি হল। আমাকে এসে বলল সেকথা।
–আপনি কী করলেন?
–আমি ভাবিনি শয়তান এভাবে ফাঁদে পড়তে যাবে। যাইহোক, গার্গীকে আমায় বাঁচাতে হবে–সেটা নৈতিক দায়িত্ব। দেখতে হবে ধুরন্ধর শয়তান নিজের বিপদ টের পেয়ে তার ক্ষতি না করে বসে! তাই ওকে পরামর্শ দিলুম, তুমি কাকেও না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাবে দীপঙ্করের সঙ্গে। দীপঙ্কর অবশ্য সেটা যেন না জানতে পারে। ওভাবে গেলে স্বভাবত গার্গীর বাবা পুলিশে খবর দেবেন। পুলিশ তদন্ত করতে ওর অফিসে যাবে। রবীন মৈত্র আগের ব্যবস্থামতো পুলিশকে জানাবে যে ৩১মে গার্গীকে বিকেলে অফিস থেকে তার সাব-এজেন্ট দীপঙ্কর ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। দীপঙ্করের বাড়িতে পুলিশ জানবে, সে কোথায় গেছে। তারপর মোহনপুরে যোগাযোগ করা হবে। গার্গীর পক্ষে সেটা রক্ষাকবচের কাজ করবে। মোহনপুরে যদি বাই এনি চান্স দীপঙ্করের চেলারা থাকে, তার ক্ষতি করতে পারবে না।
জয়ন্ত বলল–যদি গার্গী বাড়িতে বলে আসত?
কর্নেল হাসলেন–তাহলে ধরে নেওয়া যায়, গার্গীর বাবা পুলিশে খবর দিতে যাবেন না।
সুনীথ বলল–গার্গীর সঙ্গে কথা ছিল, দুপুর এগারোটা নাগাদ অশনিবাবুর হত্যাকাণ্ডের জায়গায় দীপঙ্করকে নিয়ে যাবে। ওখানেই কাবাডিয়াদের এক কর্মচারীর সঙ্গে কথাবার্তা হবে। কোম্পানির ভেতরের কিছু লোককে হাত না করলে তো ওভাবে মালের মধ্যে নিষিদ্ধ জিনিস পাচার করা কঠিন। যেমন কলকাতা অফিসেও দীপঙ্করের লোক আছে। নয়তো রুবিকে দেওয়া আমার চিঠির কথা সে জানতে পারত না এবং রুবির ফ্ল্যাট থেকে চিঠি ছিনতাই করার ঘটনা ঘটত না।
–তারপর কী হল, বলুন!
সুনীথ বলল–কথামতো আমি ঝোপের মধ্যে অপেক্ষা করছি। আমার রিভলভার আছে। সেটা তৈরি রেখেছি। এলাকা একেবারে নির্জন। চারপাশে জঙ্গল। এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে গার্গী ও দীপঙ্কর নামল। আমি অবাক। এখানে গাড়ি কোথায় পেল দীপঙ্কর? তাহলে নিশ্চয় যা
আশঙ্কা করেছিলুম, তা ঠিক। এখানেও দীপঙ্করের দলের এজেন্ট আছে। গাড়ির নাম্বার নোট করে নিলুম।
কর্নেল বললেন–বি এইচ এম ৭৭৯?
–আপনি কীভাবে জানলেন?
জানি। অভ্র–যাকে আজ পুলিশ পোড়োবাংলোয় ধরেছে, সে গতকাল বিকেলে ওই গাড়িতে গার্গীকে দেখেছিল।
–আচ্ছা! …সুনীথ পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বলল। …বসে আছি। ওরা দুজনে আসছে। হঠাৎ দেখি অন্যদিক থেকে একটা রিকশো এসে দাঁড়াল। এক ভদ্রলোক নামলেন। তারপর যা ঘটল হতভম্ব হয়ে গেলুম। ততক্ষণে গার্গী ও দীপঙ্কর বটতলায় এসে গেছে। গার্গীর চেহারা দেখে প্রতিমুহূর্তে ভাবছি, মূৰ্ছিত হয়ে পড়বে। কিন্তু ওর মনোবল অসাধারণ। …একটু চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুনীথ ফের বলতে থাকল–এবার আমার সামনে যাওয়ার পালা। কিন্তু সেই ভদ্রলোক গার্গীকে দেখে গার্গী বলে চেঁচিয়ে দৌড়ে এলেন। তারপর কাছে এসেই দীপঙ্করের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অমনি দুবার শব্দ শুনলুম-মাত্র গজ তিরিশ দূরে বসে আছি। হিস হিস শব্দ হল মাত্র। তখনও টের পাইন কিসের শব্দ। তারপর দেখি ভদ্রলোক–অর্থাৎ অশনিবাবু বুকে হাত চেপে পড়ে গেলেন। বাস্টার্ডটা গার্গীর হাত ধরে দৌড়ে চলে গেল। আমি পাথর হয়ে গেছি তখন। যখন সম্বিৎ ফিরল, ঝোঁপ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে কীভাবে যে রাস্তায় গেলুম, বলে বোঝাতে পারব না। দীপঙ্করের রিভলভারে হয়তো সাইলেন্সার ছিল। তাই গুলি ফাটার প্রচণ্ড শব্দের বদলে হিস হিস শব্দ হয়েছল। কিন্তু আমি এখনও জানি না, অশনিবাবু কোত্থেকে এবং কেন ওখানে হাজির হয়েছিলেন।
জয়ন্ত বলে উঠল–গার্গী যাবার আগের দিন একটা চিঠি পোস্ট করেছিল অশনির নামে। চিঠিটা অশনির পকেটে পাওয়া গেছে।
সুনীথ অবাক হয়ে বলল–গার্গী তাহলে অশনিবাবুকে ব্যাপারটা জানিয়েছিল! কিন্তু কেন? ভারি আশ্চর্য মেয়ে তো!
কর্নেল বললেন, সম্ভবত গার্গী দ্বিধার মধ্যেই আপনার কথা মেনে চলেছে এবং পুরোপুরি আপনাকেও বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই অশনিকে মোটামুটি আভাস দিয়ে থাকবে কী করতে যাচ্ছে। অশনি ঝেকের মাথায় দীপঙ্করকে আক্রমণ করে বসেছিল সম্ভবত। যা গে–সেটা গার্গীর মুখেই শোনা যাবে।
–কোথায় সে? খোঁজ পেয়েছেন তার?
–সে কলকাতা ফিরে গেছে। এবার বলুন, রুবি কীভাবে খুন হল?
সুনীথ মুখ নামিয়ে একটু চুপ করে থাকার পর বলল রুবিকে দেখে আমি শঙ্কিত হয়েছিলুম। আমি এখানে গোপনে উঠেছি ছদ্মনামে। কিন্তু….
–নিশীথ ব্যানার্জি নামে?
–হ্যাঁ। কিন্তু রুবির আমাকে খুঁজতে আসাটা বাস্টার্ডটার নজরে পড়লে বিপদ হবে। তাই ওকে তখুনি ফিরে যেতে বললুম। ও যাবে না। ওর ফ্ল্যাট থেকে চিঠি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা তখন ও বলেছে অবশ্য। শুনে মনে মনে হেসেছি। ওটাও আমার একটা ফাঁদ। চিঠিটা ফেক চিঠি। আমাদের অফিসে দীপঙ্করের চেলা আছে নাকি জানবার জন্যেই মৈত্রকে আগে বলে মিথ্যে একটা চিঠির ব্যবস্থা করলুম। দীপঙ্করের কোন চেলা আড়ি পেতে ছিল নিশ্চয়। ওটুকু শুনেই ভাবল, চিঠিতে ফ্ল্যাটে হামলা করে চিঠি ছিনিয়ে নিয়েছে।
-হুম! রুবির কথা বলুন।
রুবি জেদ ধরল আমার কাছে থাকবে। হোটেলে আমার এই সিঙ্গল স্যুটে ওকে অ্যালাউ করবে না। খালি স্যুটও পাওয়া গেল না। হঠাৎ আমার মাথায় একটা মতলব এল। বাস্টার্ডটাকে খুন করার একটা চান্স ফস্কে গেল। দ্বিতীয় চান্সের চেষ্টা করা যাক। রুবিকে সে ভালোই চেনে। রুবির মতো সেক্সি মেয়ের প্রতি ওর লোভ জেগে ওঠা স্বাভাবিক। রুবির সঙ্গে পরামর্শ করলুম। গার্গীর মতোই রুবি আমার প্রতি আসক্ত–হয়তো গার্গীর চেয়েও তার আসক্ত বেশি।
জয়ন্ত মন্তব্য করল–নয়তো অমন করে দৌড়ে আসত না।
–হ্যাঁ। সে তো বুঝতেই পারছিলুম। তাকে বললুম, তুমি ততক্ষণ আমার স্যুটে অপেক্ষা করো। রাত দশটার পর তোমার এখানে থাকা যাবে না। হোটেল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে খুব কড়া। ওই দেখুন, নোটিস লেখা হয়েছে।
জয়ন্ত ও কর্নেল নোটিসটা দেখলেন। আফটার টেন পি. এম. লেডি ভিজিটারস আর নট অ্যালাউড।
সুনীথ বলল রুবিকে বললুম, তোমাকে একটা বিশেষ জায়গায় রাত্রিবাস করতে হবে। ভয়ের কারণ নেই। আমি আড়ালে থাকব। তুমি তো ড্রিঙ্ক করার ব্যাপারে পিছপা নও। বাস্টার্ডটার ঠিকানা যেভাবেই পারি এনে দেব তোমাকে। তুমি সেই ঠিকানায় যে কোন অজুহাতে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং তোমার আস্তানায় নিয়ে যাবে। ড্রিঙ্ক নিয়ে যেতে বলবে সঙ্গে। ওকে মাতাল করে ফেলবে। তারপর আমি যাব। মাতাল করার উদ্দেশ্য, ওর কাছেও রিভলভার আছে।
কর্নেল বললেন–পোড়োবাংলোয় রুবির থাকার ব্যবস্থা করলেন?
–হ্যাঁ।
–খুব কাঁচা ব্যবস্থা। তাহলে আপনার বক্তব্য ও দীপঙ্করের সন্দেহ হয়েছিল এবং ড্রিঙ্ক বিষ মিশিয়ে রুবিকে সে মারে। তারপর পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্যে ছুরি চালায়। রক্তমাখিয়ে শাড়ি কিটসব্যাগে ভরে। ছোরাটাও রাখে। এসবের একটাই উদ্দেশ্য। পুলিশকে ধাঁধায় ফেলা। এই বলতে চান তো? যাক গে। কিন্তু দীপঙ্করের আস্তানার সন্ধান কীভাবে পেলেন?
–তখন বেলা প্রায় দুটো বাজে। ওকে বসিয়ে রেখে ভেহিকেলস অফিসে গেলুম। এক ক্লার্ককে ঘুষ দিয়ে গাড়ির সেই নাম্বারটা মিলিয়ে মালিকের নাম ঠিকানা পেলুম। চমনলাল হাতি! পেটরোল গ্যারেজের মালিক। ব্যাচেলার।….
এই সময় দরজায় নক করল কেউ। বেয়ারা চায়ের সরঞ্জাম নিতে এসেছে ভেবে জয়ন্ত দরজা খুলতেই তাকে ঠেলে ঢুকে পড়লেন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ শর্মা আর কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ অভিসার।
পরক্ষণে শৰ্মা অবাক হয়ে বললেন– কর্নেল সরকার! আপনি?