মানুষের হাহাকার – চব্বিশ
নীরজা বলল, ওগো এসো, ঘরে এসো।
বারান্দায় ভুবনবাবু এক কোণে একটা নীল রঙের বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসেছিলেন। সামনের রাস্তায় একটা ভিখারি হেঁটে যাচ্ছে। পর পর দুটো বাস পাল্লা দিচ্ছে। একটা আর একটাকে পেছনে ফেলে ছুটতে চাইছে। রাস্তার ওপাশে মাঠ এবং নতুন ঘরবাড়ি উঠছে। তিনি ঘরের ভেতরে খুব কোলাহল শুনতে পাচ্ছেন। বারান্দায় ছোট ছোট কাচ্চা—বাচ্চারা দাপাদাপি করছে, রেলিং—এ ঝুঁকছে এবং ভিতরে কেউ হাসছে জোরে, কিছু যেন হাত থেকে পড়ে গেল—নীরজা এইমাত্র ডেকে গেল। আবার কেউ ডাকতে আসবে। রমা অথবা মন্দাকিনী। অরুণ এবং অমলা—আজও আসতে পারে। ছোট শ্যালিকা মল্লিকা এসেছে। অনেকদিন পরে ভানুর আশীর্বাদ উপলক্ষে রমাই নিয়ে এসেছে। আরও অন্যান্য আত্মীয়। এবং ভুবনবাবু মনে হয় সবাই কেমন বড় দূরে সরে গেল। দাদা বউদি ভাইয়েরা এবং ভাইপোরা। ভুবনবাবুর এক বিরাট আত্মীয়স্বজনের সংসার ছিল, আজকের আশীর্বাদে সামান্য ক’জন মানুষের উপস্থিতি তাকে কেমন ভিতরে ভিতরে পীড়া দিচ্ছে।
ওদিকে বারান্দায় বেশ হাসি ঠাট্টা হচ্ছিল। মন্দাকিনীর গলা স্পষ্ট। বেশ জোরে কথা বলতে পারে। এবং আশ্চর্য ভঙ্গি মেয়েটার। ওর স্বামীর মৃত্যু সেদিন হয়েছে। আচ্ছা, মানুষ কী শোক দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে পারে! বয়ে বেড়ানোটা স্বাভাবিক, না সেখানে জীবনের লক্ষণ আছে। এত সহজে যে শোক মন্দাকিনী ভুলতে পেরেছে ওটাতো জীবনেরই লক্ষণ। কিন্তু তিনি মন্দাকিনীর উচ্চস্বরে কথাবার্তার মধ্যে খুঁত ধরতে যাচ্ছেন কেন! আসলে কী মন্দাকিনী এবং ভানুর মধ্যে একটা সংশয়ের ব্যাপার ছিল বলে! আজতো আশীর্বাদের দিন। এ—দিনে এসব কথা মনে আসছে কেন! মন্দাকিনী এ—বাড়িতে আশীর্বাদের সময় থাকবে সেটা পছন্দ ছিল না বলে! মনে মনে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বারান্দার নিরিবিলি জায়গা কী তাই বেছে নিয়েছেন!
রমা ডাকল, বাবা আসুন!
ভুবনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। রমা কী আগেই জানত অরুণের বউ আছে! সে জেনেই কী মিশত? তখনই অমলা দরজায়—আসুন মেসোমশাই। সব মুখগুলি কত পবিত্র দেখতে এখন! কে বলবে এরাই কখনও কী যে ভয়াবহ হয়ে যায়। আচ্ছা, তিনি ভয়াবহ কথাটা ভাবছেন কেন! মানুষের যে স্বভাবই এই। সে ধার্মিক, লম্পট, সে সরলমতি কখনও কুটিল মতি। সে লোভী আবার উদাসীন!
এজন্য কখনও স্বার্থপর দৈত্য এবং কখনও বিদ্যাসাগরমশাই। তিনি ভিতরে ঢুকে অরুণকে বললেন, নানুর খোঁজে কেউ তোমরা গেছিলে?
অরুণ এরকম কথা এই সময় প্রত্যাশা করেনি। সে বলল, না, মানে…..অরুণ কেমন সত্য গোপন করতে চাইছে।
তোমরা ওর খোঁজখবর নিচ্ছ না, বাবা নেই ছেলেটার!
অরুণ কাঁচুমাচু গলায় বলল, যাব ভাবছি।
কোথায় যেন গেছে!
মানু তো কিছু বলে না। মানু এখন দেখছি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। দেখা কোথায় হয় যে তার কাছ থেকে নানুর খবর নেব। সারাদিন কোথায় কী করে বেড়ায় তাও জানি না। নানুর মা বিয়েতে আসবে তো?
আসার কথা আছে। তবে সরকারি কাজ ছুটিছাটা নিয়ে নানা ঝামেলা। নানুর মা আমাদের বিয়েতে আসতে পারেনি।
অমলা এক কোণায় দাঁড়িয়ে জানালায় মুখ রেখেছে। ওর মুখ স্পষ্ট নয়। অমলাদের বাড়ি থেকে ওর জামাইবাবু এবং অরুণ এসেছে আশীর্বাদ করতে। আশীর্বাদের কাজ প্রায় শেষ—ভানু বড় আসনে বসে আছে শুধু বাবার জন্য। বাবা মাথায় সামান্য ধানদূর্বা দিলেই তার ছুটি। সে উঠব উঠব করছিল—কিন্তু এতক্ষণ অমলা এবং অরুণই জোর করে বসিয়ে রেখেছে।
ভুবনবাবু আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন, তখন রমা অরুণের দিকে তাকাল অরুণ ভুবনবাবুর দিকে—গোপন বেদনার ঝড় কোথা থেকে যে উঠে আসে কখন কে জানে, রমা হাত বাড়িয়ে বলল, বাবা ধরুন। হাতে ধানদূর্বা দিয়ে বলল, দাদার মাথায় দিন।
ভুবনবাবু কেমন যন্ত্রের মতো হাত তুলে পুত্রের মাথায় দিলেন। সবই হচ্ছে, কিন্তু কেন জানি প্রবল জোর পাচ্ছেন না ভিতর থেকে! সংসারে একটা বড় রকমের ফাটল দেখা দিয়েছে। তখনই সবাই উলু দিল। নীরজা এবং মন্দাকিনীর উলু বেশ তীক্ষ্ন। মল্লিকাও কম যায় না। বড়ই নিষ্প্রভ রমার উলু তার চেয়েও নিষ্প্রভ অমলার।
তখন ভুবনবাবু বললেন, মানু কোথায়?
রমা বলল, আপনার ছোট পুত্রটির কথা আর বলবেন না, একদণ্ড যদি বাড়ি থাকে।
মনে মনে ভুবনবাবু বললেন, ওর দোষ কী। সংসারে সবাই সব টের পায়। তোমরা মনে করো কেউ কিছু বোঝে না। কিন্তু রমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভুবনবাবুর কষ্ট হল! যেন রমা এক গোপন দুঃখ আজকাল লুকিয়ে রাখছে। কত পালটে গেল সব। এক জীবনে তিনি কী না দেখলেন! এক সময় মানুষের সামনে বড় রকমের আদর্শ থাকত। তাদের সময় কত সব শ্রদ্ধেয় মানুষ বেঁচেছিলেন। একবার মনে আছে ভুবনবাবু প্রায় ত্রিশ মাইল রাস্তা ঝড়বৃষ্টিতে হেঁটে গিয়েছিলেন। সঙ্গে একটা চিঠি। তাঁদের স্কুলের অনাদি মাস্টারমশাই চিঠিটা পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। তখন স্বদেশি যুগ, গান্ধীজীর স্বরাজ আন্দোলনে কত মানুষ জীবনের সবকিছু অবহেলা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নেতাজীর কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আসা, আরও কত উত্তেজক খবর তখন মানুষের জীবনে একটা আলোড়ন তুলত। এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মানু কিংবা সেই ছেলেটা কী যেন নাম, হ্যাঁ নানু একটা ঝি—মেয়ের খোঁজে চলে গেল, তারা এ—ছাড়া আর কী করবে! তিনি বললেন, অরুণ বাইরে এসো। কথা আছে।
অরুণ সেই ঘটনার পর অনেকদিন এ—বাড়িমুখো হয়নি। এই বুড়ো মানুষটাকে মনে মনে সে ভয় পায়। এবং সমীহ করে। কথাবার্তা কম বলেন। খুবই সহিষ্ণু মানুষ। এখন ডেকে নিয়ে কী বলবে কে জানে!
অথচ ওরা যখন পাশাপাশি বসল, তখন ভুবনবাবু অন্য মানুষ। তিনি বললেন, বিয়েতে আমরা কিছুই চাইনি। শাঁখা সিঁদুর দিয়ে বিয়ে দিলেও আপত্তি নেই তুমি জানো। কিন্তু একটা কথা—মিতা এ—বাড়িতে এসে সুখী হবে তো! মানু বড়ই অবুঝ ছেলে। ওকে নিয়েই আমার ভয়।
অরুণ বলল, আপনি কিছু ভাববেন না। আজকালকার ছেলে এ—রকমেরই সবাই। বয়স হলে, চাকরি করলে তারপর বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর কী ভেবে বলল, নবীনদার সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি। ওকে ডাকি।
ভুবনবাবু বললেন, ডাকো।
নবীন এলে অরুণ বলল, এই দাদাটি আমার বোম্বাই থাকে। কাগজে কাজ করে।
কোন কাগজে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপে আছে।
খবরের কাগজের লোকদের সম্পর্কে ভুবনবাবু এক ধরনের শ্রদ্ধা আছে। তিনি বললেন, বসুন। আপনারা খবরের কাগজের লোক কত খবর রাখেন।
নবীন বলল, ওই বাইরে থেকে এমনটা মনে হয়।
ভুবনবাবু কথাটা শুনেও শুনলেন না। তিনি বললেন, কাগজে আজকাল খুব আশার কথা লেখা থাকে।
নবীন বুঝতে পারল না ভুবনবাবু কেন এ—কথা বলছেন।
প্রায়ই দেখি দেশের নেতারা কেবল হোপস দিচ্ছে, বেকার থাকবে না বলছে। কিন্তু দিন দিন যে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
নবীন বলল, দেশের সম্পদ কম। জনসংখ্যা বেশি। আন্ডার ডেভালাপড কান্ট্রিগুলোর এই একটা বড় বিষফোঁড়া।
মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে আজকাল কাগজে খুব লেখা হচ্ছে।
সত্যিকারের স্বাধীনতা এখনও অর্জন করা গেল না।
মহান ব্যক্তিদের মাথা কাটা হচ্ছে। কারা করছে জানেন?
ভুবনবাবু খুবই অসংলগ্ন হয়ে পড়েছিলেন কথাবার্তায়। আসলে একটু আলাপ করা। সত্যবাদী কাগজগুলির একজন এই লোকটা। দেশের লোক ঈশ্বরের পরই খবর কাগজ সত্য ভেবে থাকে। সেই দপ্তরের একটা লোক তাঁর বাড়িতে আজ অতিথি। এটা একটা বড় রকমের অহংকার তাঁর জীবনে। তিনি নবীনের সঙ্গে কী বিষয় নিয়ে কথা বলবেন—ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি অগত্যা অরুণের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সবাই চা মিষ্টি খেয়েছ ত!
অমলা তখন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাসবিহারীবাবুর মেয়েদের চেহারায় আভিজাত্য আছে। অমলা কাছে আসতেই বললেন, এসো মা! আমরা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছি।
অমলা হাসল। রমাও তখন উঁকি মারছে। বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, জানো তো নবীন আমাদের একজন জাঁদরেল রিপোর্টার। ওর এক কলমের খোঁচায় কত কিছু হতে পারে। তারপর নবীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের খুব দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।
তা করতে হয়।
আচ্ছা কাগজে যে দেখি দেশের গরিবদের নিয়ে সরকারের খুব মাথাব্যথা সেটা কি সত্যি। না লিখতে হয় বলে লেখা। জনমনে সুড়সুড়ি দেওয়া।
নবীন বলল, কাগজ বিক্রি চায়। জনগণ যাতে খুশি তাই লেখা হয়। সরকারও চায় যে—কোনোভাবে ক্ষমতা দখলে রাখা।
অথচ দেখো আমরা সব সত্য ভেবে রোজ সকালে সন্ধ্যাপাঠের মতো কাগজ পাঠ করি।
অভ্যাস।
এই অভ্যাসের কথা আসতেই ভুবনবাবুর মনে হল, সত্যি এটা অভ্যাস। এক সময় ছিল, যখন খবরের কাগজ সম্পর্কে তার কোনো স্পৃহা ছিল না। তখনও দিন চলে যেত। এখন খবরের কাগজ না পেলে দিনটা বড়ই ফাঁকা ঠেকে। কোথায় কী ঘটছে জানার জন্য বড়ই উদগ্রীব তিনি। ভুবনবাবু এবার নবীনের দিতে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের নানুও একটা খবর হতে পারত।
নবীন বলল, নানু মানে, রানুদির ছেলের কথা বলছেন!
ভুবনবাবু বললেন, কেন তুমি ওকে চেন না?
মানে ওকে খুব ছোট দেখেছি।
নানুকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হয়। একটা ছেলে সংসারের সবকিছুই অবহেলায় ফেলে চলে গেল—সে না জানি কত বড়!
নানুর সম্পর্কে কোনো কথা উঠলেই ভুবনবাবু বুঝতে পারছেন অরুণরা খুব ঠান্ডা মেরে যায়। কিন্তু যা বুঝেছেন তাতে তো নানুকে খুবই পরোপকারী এবং আদর্শবাদী যুবক বলে মনে হয়। তিনি বললেন, বিয়েতে নানুকে আসতে বলো, আমি তার সঙ্গে আলাপ করব। বাবা নেই, মা দূরে থাকে, বড়ই একা।
অরুণ কিঞ্চিৎ অন্যমনস্কভঙ্গিতে বলল, কারও কথা শোনে না। মানুবাবুকে পাঠাব, যদি আসে।
আমার কথা বোলো। নিশ্চয়ই আসবে। ছেলেটা নাকি আমাদের বাড়িতেও এসেছে। কত ছেলেইতো আসত মানুর কাছে—আমি ঠিক এখন মনে করতে পারছি না নানুটা কে!
সবই অহেতুক কথাবার্তা। মন্দাকিনী বারান্দায় আলো জ্বেলে দিল। সব ঘরে এখন আলো জ্বালা হচ্ছে। এই বাসা বাড়িটা যেন মুহূর্তে প্রাণ পেয়ে গেল। অথচ ভুবনবাবুর মনে হয় যতই আলো জ্বালা হোক, বাড়ির চামচিকেটা ঠিক উড়বেই।
সংসারে এই একটা চামচিকে নিয়তই উড়ছে। চামচিকেটা একটা উদ্বেগের মতো, এই উদ্বেগ নিয়ে সব সময় দিন কাটে। বিয়ের পর থেকেই ভুবনবাবুর এটা হয়েছে। এখন মনে হয় শুধু ভুবনবাবুর জীবনে হবে কেন সবার জীবনে চামচিকেটা অন্ধকারে উড়ে বেড়ায়। এবং এজন্যই ভুবনবাবু আসল কথাটা এবার পাড়লেন। বললেন, অরুণ তোমার তো অনেকের সঙ্গে আলাপ, তুমি রমার জন্য একটা ভালো বর দেখে দাও। নবীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকেও বলছি। তোমরা তো আমার এখন আর পর নও।
রমা সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে উঠে গেল। ওরা না থাকলে সে হয়তো ভুবনবাবুকেই ধমক দিত। তুমি আর সংসারে মানুষ পেলে না, তুমি অরুণকে আমার বর খুঁজে দিতে বলছ। তুমি তো জান না, ও কত বড় স্বার্থপর। ও বউ বাদে এখন আর কিছু বোঝে না। আচ্ছা, অমলার চেয়ে আমি দেখতে খারাপ! এ—কথা মনে হতেই সে বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে কতদিন পর যেন নিজেকে খুঁটিয়ে দেখল। মনে মনে বলল অরুণ তুমি আমাকে কী ভাব জানি না, তবে মনে রেখো মরে গেলেও আমি বিয়ে করছি না।
এই সংসারে এখন আরও সব ঘটনা ঘটছে। মানুর ঘরে কাকলী বসে একটা সিনেমা ম্যাগাজিন ওলটাচ্ছে। দু বার ভানু এসে বলেছে, কী কাকলী তুমি এত চুপচাপ?
কাকলী সাড়া দেয়নি—সে একটা ফ্যাশান ম্যাগাজিনে ডুবে আছে। ভানু ফের বলল, তোমার মা কোথায়?
কী জানি! খুব তাচ্ছিল্য গলায় ফুটে উঠল। তারপরই বলল, ভানুকা এবার থেকে তো তুমি আমাদের ভুলে যাবে।
যা পাগলি!
আমাদের কথা মনে থাকবে না।
খুব থাকবে।
তোমার তো ভালোবাসার মেয়ে চলেই আসছে।
সংসারে সবাইকে ভালোবাসতে হয়। ভানুবাবু কেমন দার্শনিক অথচ শয়তানের প্রতিভূর মতো কথাটা একটা অবোধ কিশোরীকে শুনিয়ে দিল।
তারপর দরজা দিয়ে বের হতে গিয়ে করিডোরে মন্দাকিনীর সঙ্গে ভানুর গায়ে গা লেগে গেল। মন্দাকিনীকে আইবুড়ো মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। গলায় হার, হাতে দু গাছা সোনার চুড়ি এবং ঠোঁটে খুবই হালকা লিপস্টিক। মন্দাকিনী ফাঁক বুঝে ভানুবাবুর শরীরে একটা চিমটি কেটে দিল। ভানুবাবু বলল, এই কী হচ্ছে!
খুব তো নেবে। চোখে মুখে তো লালা উপছে পড়ছে।
কেমন দেখলে?
কাকে?
কাকে আবার?
ও মিতাকে! ধুস। তোমার পাশে ও কিছু না। অমলা আসছিল, ওরা কথা পালটে নিল। ও ভানুবাবু কাকলীকে দেখেছ?
দেখগে মানুর ঘরে চুপচাপ বসে আছে।
অমলা চোখ তুলে ভানুবাবুকে দেখল। উঁচু লম্বা মানুষ—অরুণের মতোই সুপুরুষ। মিতার সঙ্গে মানাবে খুব। এবং সেই এক দৃশ্য চোখে ভাসে—বিয়ে কেন হয়, কীজন্য এই শুভ কাজ, একজনকে ধরে আনা, অর্থাৎ বড়ই সুসময় চলে যাচ্ছে জীবনে, তাকে অবহেলায় ফেলে রাখতে নেই, জমি উর্বর, শুধু শস্য বুনে দিলে সুজলা সুফলা ধরণি। অমলা ভানুর দিকে চেয়ে এইসব ভেবে সামান্য হাসল। ভানুবাবুও সামান্য হেসে পাশ কাটাতে গেলে দু হাত তুলে দিল অমলা—কোথায় যাচ্ছেন?
কোথাও না।
খুব ভালো করে ঘুমাবেন।
কেন বলুন তো।
চোখে কালি পড়ছে কেন!
অঃ। ও ঠিক হয়ে যাবে।
অমলা তারপর বাথরুমের দিকে চলে গেল। রমা বাথরুমে আছে, অমলা দরজায় শব্দ করতেই রমা বের হয়ে এল। …….ও তুমি। তোমাকেই খুঁজছি।
রমা এই অমলাকে আজ প্রথম দেখল। মানু সেদিন বাড়িতে এসে সব ভেঙে দেবার পর কী কারণে অনেকদিন অরুণ এবং রমা পাশ কাটিয়ে গেছে। কোনো কথা বলেনি দু’জন তারপর বাবার চিঠি অরুণের হাতে দিতেই সম্পর্কটা আবার জোড়া লেগে গেল। চিঠিতে বাবা আশীর্বাদের কথা লিখেছিলেন! এখন আর মানুকে পাঠাতে হয় না। রমাই যা কিছু দরকারি কথা পাত্রীপক্ষকে অরুণের মারফত জানিয়ে দেয়।
অমলা বলল, আমরা এবার যাব।
অমলা সুন্দর লতাপাতা আঁকা সিল্কের শাড়ি পরেছে। পায়ের পাতার ওপর পড়ে আছে সায়ার কারুকাজ করা লেস। মুখটা ডিমের মতো মসৃণ, সামান্য চাপা। হাসলে গালে টোল পড়ে। ডানদিকের গজদাঁত অমলাকে কেমন সোহাগী করে রেখেছে। রমা বলল, যাবেইতো। এত তাড়াতাড়ি কেন। তোমার কর্তাকে কেউ খেয়ে ফেলবে না।
অমলা চোখ টেনে কপালে তুলে বলল। —আমার বড় ভয়, কেউ যদি সত্যি খেয়ে ফেলে! তারপর রমাকে জড়িয়ে ধরে হা হা করে হেসে দিল।
এই সেই মেয়ে—সামনের বাইকে অরুণ আগেই কী ঠিক দেখেছিল—না ছুটেছে, তার নিজের জনকে অন্য কেউ সহজেই নিয়ে চলে যেতে পারে। অনেকদিন ভেবেছে অরুণকে বলবে, কী হল, বাড়ি গিয়ে কী দেখলে?
কিন্তু বলি বলি করেও বলা হয় না। তা—ছাড়া সেদিন আর অরুণ আগের মতো সহজেই ডেকে নিতে পারত না—কেমন সাধুপুরুষ হয়ে গেছিল। রমার কাছে অরুণ দিনকে দিন দূরের মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। মানুষ দূরের হয়ে গেলে সংসারের গোপন কথা আর জানার অধিকার থাকে না। রমার মনে হয়েছিল, সে অরুণের ওপর তার অধিকার হারিয়েছে।
অমলা বলল, আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
না এমনি। রমা আঁচলে মুখ মুছল। তারপর বলল, আর এক কাপ চা খাও। বাবার সঙ্গে ওরা বোধহয় জমে গেছে।
মেসোমশাই অরুণ বলতে দেখছি অজ্ঞান।
অরুণ এবাড়ির খুবই নিজের মানুষ। ওর উপকারের কথা আমরা ভুলতে পারব না অমলা।
ওতো একটা অকম্মা লোক। ওকে দিয়ে কারও কোনো উপকার হয়!
রমা কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। অরুণের ওপর তার কোনো অভিমান নেই। কোনো রাগ নেই, যেটুকু সে অরুণের কাছে পেয়েছে তার স্মৃতিটুকু ভারী অম্লান এবং এখন বুঝতে পারে রমা যত দিন যাচ্ছে, অরুণকে ভিতর থেকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলছে। সে জানে আরও যত দিন যাবে যত গভীরতা বাড়বে। অরুণ যত ওকে পাশ কাটিয়ে যাবে তত অঘটন তীব্রতর হবে। এবং দিন যত যাচ্ছে বুঝতে পারছে এক ভয়ংকর কষ্টের মধ্যে সে পড়ে যাচ্ছে। এই কষ্ট থেকে রেহাই পেতে হলে তাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। একই অফিস বাড়িতে কাজ করা তার পক্ষে ক্রমে অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
অমলা বলল, দাদার বিয়েটা হয়ে গেলেই তোমার লাগিয়ে দেব।
রমা বলল, দিয়ো। এইটুকু বলেই সে সরে পড়ল। একটা গোপন দুঃখ নিয়ে সরে পড়ল। কেন যে সে এভাবে মরতে গেল। প্রথমে খেলার ছলে যা সে নিয়েছিল, এখন বুঝতে পারছে তাই ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড দাপাদাপির সৃষ্টি করেছে। সে ফের বাথরুমে ঢুকে চোখে জলের ঝাপটা দিল। তারপর মাকে বলল, মানদা কোথায়?
মানদা অন্য ঘর থেকে বলল, যাই দিদিমণি।
আর এক কেতলি জল বসাও। আমি যাচ্ছি!
মল্লিকা বলল, তুই ওদের সঙ্গে কথা বল। আমি করছি।
মল্লিকা মাসিকে বলল, আমি করি না? তোমরা সবই করছ।
মল্লিকা তবু বলল, যা তো। বলে প্রায় ঠেলে ঠুলে রান্নাঘর থেকে বের করে দিল রমাকে। আসার পর থেকে মল্লিকা দেখেছে, রমা রান্নাঘরেই আছে। সেই সকাল থেকে—মাছ তরিতরকারি কোটা, মাছ ভাজা, টক, মিষ্টান্ন, ছোলার ডাল সব এক হাতে করেছে। রমা এত কাজের, কী পরিচ্ছন্ন সব কাজ! কেমন লক্ষ্মীশ্রী সব কাজে। নীরজা আজ শুধু বসে বসে হুকুম করছে আর সামনে পানের বাটা নিয়ে বসে আছে।
এবং সবার আগে রমা ছোট ভাইটিকে রান্নাঘরে বসিয়ে খাইয়েছে। কারণ সে জানে ভাইটির অভিমান বড় বেশি। আগে কত আবদার করত, এখন আর কোনো আবদার করে না। মানু অরুণকেও সহ্য করতে পারে না। তাকে ঘৃণা করে। মাঝে মাঝে রমার অসম্ভব জেদ মাথায় চেপে যায়, সংসারের জন্য এত করি, দিনরাত খাটি, বাড়ি এসে এক দণ্ড বিশ্রাম পাই না, আমার এতটুকু সুখ পর্যন্ত তোমরা হরণ করে নিতে চাও! আমি যাব। অরুণ এলেই যাব। কিন্তু আজকাল সে বুঝেছে সে ভুল করেছে। ভাইকে আদর করে আজ সে বসিয়ে রান্নাঘরে খাইয়েছে। মানু যা পছন্দ করে পাতে তা বেশি বেশি করে দিয়েছে। না খেলে বলেছে, এখনও আমার ওপর তোর রাগটা যায়নি!
সেদিনই বেশ রাত করে ফিরল মানু। চোখমুখ গম্ভীর। ভুবনবাবু বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। সবাই বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। কিন্তু এসেই মানু বলল, সে এক্ষুনি বের হয়ে যাবে আবার। সে বলল, বাবা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যান।
ভুবনবাবু এই প্রথম চিৎকার করে উঠলেন, তুই কোথায় যাবি এত রাতে?
কাজ আছে।
কী কাজ?
চিৎকার রমা নীরজা ভানু সবাই বের হয়ে এসেছে। সারাদিন খাটা খাটানি গেছে। সবাই শুয়ে পড়েছিল। কেবল ভুবনবাবু জেগে। মানু এলে দরজা বন্ধ করে দেবেন। এখন সবাই দেখছে মানু নিজের ঘরে কীসব তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। এবং একটা ব্যাগের মধ্যে সব ভরে নিচ্ছে।
ভুবনবাবু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
নীরজা একটা কথা বলতে পারছে না।
ভানু কাছাকাছি যেতে পর্যন্ত সাহস পাচ্ছে না।
রমা শুধু ঘরে ঢুকে বলল, পাগলামি করিস না। কোথায় যাচ্ছিস। বলে ব্যাগটা টেনে নিতে গেলে কেমন অনেক দূর থেকে ভারী অপরিচিতের গলায় যেন বলল, আঃ কী করছ! সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কাল সকালে পুলিশ আসতে পারে, আমার খোঁজে। বলবেন কিছুই জানেন না। বলে সে কাউকে আর কথা বলতে না দিয়ে তড় তড় করে নিচে নেমে রাস্তার অন্ধকারে হারিয়ে গেল।