Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দুপুরে প্রচণ্ড জোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ভুবনবাবু জানালা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লেন। দিবানিদ্রার অভ্যাসটি নীরজারই দান। খাওয়া হয়ে গেলেই নীরজাকে দেখা যাবে তার ঘরের বিছানার চাদর ঝেড়ে বিছানা ঠিক করে দিচ্ছে। মানুষটা শোবে। যত বিশ্রাম পাবে মানুষটা তত বেশিদিন বাঁচবে। তার শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় থাকবে ততদিন। তাছাড়া ভুবনবাবুর আগে যাবারও একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে নীরজার মনের মধ্যে রয়েছে। তালে কত সতী লক্ষ্মী প্রমাণের তার আর কিছু বাকি থাকে না। পাশ ফিরে শোবার সময় ভুবনবাবু মুচকি হাসলেন। মানুষের কত রকমের যে ইচ্ছে থাকে।

আর তখনই মনে হল রাসবিহারীবাবুর মেয়ের কোষ্ঠি নিয়ে যতীন সেন আজ আসবে। এই মানুষটি তাঁর দেশের মানুষ। যতীন সেনের বাবাও ভালো জ্যোতিষী জানতেন। ভুবনবাবুদের সব কোষ্ঠি ঠিকুজি তাঁরই করা। এ দেশে এসে যতীন সেন বাবার বিদ্যেটা তুলে দেয়নি। এল. আই. সি—তে ভালো কাজ করে। আর সকাল সন্ধ্যা এই পুণ্য কাজটাও সেরে বেড়ায়। যতীন সেন এ কাজটাকে ভারি পুণ্য কাজ ভেবে থাকে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গেলে খুব নিষ্ঠা আছে কাজে। যতীন সেনের কিছু কিছু কথা ফলেও ভুবনবাবুর জীবনে। বিশেষ করে নীরজা জ্যোতিষ বলতে এক যতীন সেনকেই বোঝে। সবরকমের কাজকর্মের পরামর্শে যতীন সেনকে প্রায়ই এ বাড়িতে আসতে হয়—তাছাড়া কিছুক্ষণ ফেলে আসা দেশ—বাড়ির গল্প করতেও ভালোবাসে যতীন সেন। এলে সহজে আর উঠতে চায় না। নীরজাকে সবসময় বউদি বউদি করে। আজ যতীন সেন আসবে বলেই নীরজা মানদাকে দিয়ে আলাদা মিষ্টি আনিয়ে রেখেছে। এই সব সাতপাঁচ ভেবে ভুবনবাবুর হাই উঠছিল, ঘুম এল না। উঠে বসলেন, বাইরে বের হয়ে দেখলেন বেলা বেশি গড়ায়নি। তিনটে বাজে। আর কী যে হয় আজকাল, কেউ আসার কথা থাকলেই ঘুমটুকু আর আসে না চোখে। আজকাল মাথাটাকে তিনি আর ফাঁকা রাখতে পারছেন না কিছুতেই। মানুটা সারাদিন বাড়িতেই থাকে না। কোনো দিন দুপুরে খেতেও আসে না। নানুর সঙ্গে আজকাল নতুন নতুন মুখ দেখা যায়। ওরা কারা! মানুকে বলে, এক কথা, ওরা বন্ধু। ব্যস ওই কথা—কেমন ছেলে, কোথাকার ছেলে, কার ছেলে, বংশমর‍্যাদা কী এসব আর তিনি জিজ্ঞেস করতেই সাহস পান না। যতীন সেন এলে এবারে সাফ সাফ বলবেন। দেখতো আর কত দেরি মানুর কাজের। একটা কাজটাজে ঢুকে গেলে বাঁচি যতীন। পড়াশুনা যখন হবে না তুমি গুণে বলে দাও না—এ বছরের মধ্যে ওর কোথাও কিছু হবে কিনা?

যতীন সেন এর আগেও বলেছে সময় হলেই হবে।

সময়টা কবে হবে আর। এবারে তিনি একটা নির্দিষ্ট সময় চান। তা ছাড়া আজকাল ভুবনবাবু পাথর—টাথরে বিশ্বাস জন্মে গেছে। রাহুর অবস্থান খারাপ বলে তিনি একটা বেশ বড় আকারের গোমেদ ধারণ করেছেন। রমাকে যতীন সেন একটি মুনস্টোন পরতে দিয়েছে। এতে ভুবনবাবুর মনে হয়েছে—সংসারে কিছু শান্তি ফিরে এসেছে এবং বেশ উন্নতিরও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ভানুকে অবশ্য কোনো আংটি ধারণ করার ব্যাপারে এখনও রাজি করতে পারেননি। পরস্ত্রীর প্রতি টানটা ক্রমশই মনে হচ্ছে বাড়ছে ভানুর। এজন্য তিনি নিজেই দায়ী। বয়েস হলে বিয়ে দিতে হয়। শরীর তো অবুঝ! তার একটা কিছু চাই।

এবং এ সময়েই তিনি নিচে সিঁড়িতে কারও শব্দ পেলেন। যতীন সেন হতে পারে ভেবে তিনি করিডোর ধরে হেঁটে গেলেন। তারপর সিঁড়ির দরজা খোলার মুখে দেখলেন অন্য একজন কেউ। লোকটাকে তিনি চেনেন না। শুধু বললেন, কী চাই?

ভুবনবাবু আছেন?

আমি ভুবনবাবু।

চিঠি দিয়েছে।

কে?

যতীন সেন।

দেখি।

ভুবনবাবু চিঠি না খুলেই বললেন, ভিতরে আসুন।

আমি আর বসব না। তিনি আসতে পারলেন না। কোথায় একটা তাঁর মিটিং আছে। বড় গোছের নেতা—তিনি ভোটে দাঁড়াবেন। মনোনয়নপত্র দাখিল করার জন্য দিন দেখবেন। যতীন সেন আজ সেখানেই গেছেন।

ভুবনবাবু বললেন, বেশ। কবে আসবে কিছু লিখেছে কিনা ভেবে তিনি চিঠিটা খুললেন। লোকটি দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, আচ্ছা যাই।

ভুবনবাবু এক হাতে চিঠিটা রেখে অন্য হাতে দরজা ঠেলে দিলেন। চশমা না হলে তিনি কিছুই দেখতে পান না। বারান্দায় এসে বসার আগে টেবিলের ওপর থেকে চশমা প্রথমে নিলেন।

তারপর বাইরে এসে চিঠি খুলতে অবাক। বিরাট একটা ফুলস্কেপ পাতায় মাত্র দুটো লাইন লেখা। রাজযোটক—আপনি এ—বিয়েতে অমত করবেন না। মেয়ের কর্মফল খুবই ভালো। এত ভালো রাশিফল আমি অনেকদিন হাতের কাছে পাইনি। বিশেষ অসুবিধা থাকায় যাওয়া হল না। ইতি—আপনার বিনীত যতীন সেন। সঙ্গে মেয়ের কোষ্ঠি ভাঁজ করা খামের মধ্যে। সেটা তিনি একবার খুলে দেখলেন। বয়স বাইশ। বাইশ বয়সটা এ—কালে মেয়েদের খুবই কম বয়েস। তাঁর মনে হল, বয়েসটা আরও বেশি হলেও ক্ষতি ছিল না। ভানু আগামী মাঘে ত্রিশ পার হয়ে যাবে। এবং তাঁর মনে হল, অনেকটা বয়েস ভানুকে তিনি আটকে রেখেছেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন, একুশে। চোদ্দ বছর বয়সে প্রথম তিনি টের পেয়েছিলেন, একজন বালিকার শরীরে আশ্চর্য সুঘ্রাণ। তাঁর বয়সে যদি ভানু এটা টের পায় তবে পাক্কা ষোলোটি বছর তিনি ভানুকে এভাবে বন্দি করে রেখে ভালো কাজ করেননি। জীবনে ষোলোটা বছর কম কথা না। মানুষ যদি সময়ে আহার না পায় তবে সে গোপনে কিছু করবেই। তিনি এজন্য ছেলেমেয়েদের খুবই কম বয়সে বিয়ের পক্ষপাতী। এবং এসব ভাবনার সময়ই সহসা দেখতে পেলেন, তাঁর আত্মজা কিশোরী রমা সবে তখন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরছে কতকাল আগে থেকে যেন। সংসারে তিনি সবার সামনে বিরাট বাধা। তিনি নীরজা উভয়ে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন—কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। আসলে মেয়েদের এবং ছেলেদের সব গোপন ইচ্ছেগুলি তাঁদের চোখের ওপর নিদারুণ হয়ে দেখা দিলে তিনি ডাকলেন, নীরজা, নীরজা।

নীরজা কাছে এলে ঠিক যেমন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, সেভাবে তাকিয়ে থাকলেন ভুবনবাবু। নীরজা তুমি বুঝছ আমি কী ভাবছি! নীরজা, আমার ছেলেরা বড় হয়ে গেছে কবে, মেয়ে বড় হয়ে গেছে কবে—ওদের শরীরে কবে বান এসে গেছে অথচ ওরা এতদিন ঠিক আছে কী করে—না কী কিছুই ঠিক নেই—সবাই গোপনে খাওয়া—দাওয়া ঠিকমতোই করে যাচ্ছে।

নীরজা বললেন, তোমার যে আজকাল কী হয়েছে!

কী হবে আবার?

ডাকলে কেন?

এতক্ষণে মনে হল, তিনি নীরজাকে আসলে একটা প্রশ্ন করতে চাইছিলেন। নীরজার বিয়ে হয়েছিল তেরো বছরে। নীরজার সঙ্গে তাঁর মনে আছে শুভ—রাত্রিতেই সবকিছু জানাজানি হয়ে গেছিল। এবং তেরো বছরের মেয়ের মনে যে ভয় থাকার কথা ছিল, অর্থাৎ তিনি ভাবছিলেন হাত দিলে মেয়েটা ঠান্ডা মেরে, অথবা ভয়ে সরে শোবে এমন সব কিছু ভেবে যখন হাত রাখতে গেলেন —তখন আশ্চর্য নীরজা চিত হয়ে শুয়েছিল। তিনি পাশে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে নীরজা চোখ বুজেছিল। তিনি হাত দিলে নীরজা ভয়ংকর উদ্যমশীল হয়ে পড়েছিল। তেরো বছরটা কত মারাত্মক একজন মেয়ের পক্ষে ভুবনবাবু সেদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন। এবং গভীরে প্রবেশ করতে যদিও দু’চারদিন সময় লেগে গেছিল—কিন্তু তেরো বছরের বালিকা হিক্কা—ধ্বনি তিনি যেন এখনও কান পাতলে শুনতে পান। রমার বয়স বাইশ। তেরো এবং বাইশের মধ্যে কত পার্থক্য। এই বয়সটা রমা পার করে দিয়েছে—বড়ই পবিত্র চোখ মুখ মেয়েটার অথচ শরীরে নীরজার মতো কষ্টটা তার যাবে কোথায়?

তিনি বললেন, মানু কোথায়?

মানু তো ঘরেই ছিল।

ভুবনবাবু ডাকলেন, মানু আছিস?

মানুর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

নীরজা বলল, আবার বোধহয় বের হয়েছে।

কোথায় যায়! তারপরই কী ভেবে বললেন, তুমি দেখেছ কী সব বই—টই ঘরে নিয়ে আসে মানু?

কী বই?

ওর ঘরে ঢুকে মাঝে মাঝে দেখো।

তুমিই তো দেখেছ।

তুমি মা। তোমার দেখা খুব দরকার।

নীরজা বলল, আমাকে এজন্য ডেকেছিলে?

ভুবনবাবু এবার যথার্থই যেন মনে করতে পারলেন না কীজন্য নীরজাকে ডেকেছিলেন। নীরজা চলে গেলেই মনে হল তিনি আজ জানতে চেয়েছিলেন নীরজা ঠিক কত বছরে একজন মানুষের সঙ্গ কামনা করেছিল। বয়েসটা কী আট সাত না দশ। কোনটা। মেয়েরা কত বয়সে একজন পুরুষকে ঠিক নিতে পারে। একজন পুরুষের কথা তিনি জানেন, সেটা তিনি নিজে। চোদ্দো থেকে পনেরোয় মনে হয়েছিল, একজন মেয়ের শরীরে আশ্চর্য সুঘ্রাণ। তিনি সে সুঘ্রাণ পাবার জন্য প্রায় ষোলোতেই পাগল পাগল বোধ করতেন।

তিনি এবার ঘরে ঢুকে বললেন, নীরজা আমাকে চাবিটা দেবে।

তিনি আলমারির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। নীরজা হয়তো শুনতে পায়নি। আবার ডাকলেন, নীরজা চাবিটা দেবে?

মানদা ঘরে ঢুকে বলল, মাকে কিছু বলছেন?

চাবিটা দিতে বল।

নীরজা এই অবেলায় চাবি দিয়ে কী হবে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি বের হব নীরজা।

কোথায় যাবে?

রাসবিহারীবাবুর বাড়িতে।

সেটা কোথায়?

ঢাকুরিয়ার কাছে। ঠিকানা চিঠিতে আছে। কত নম্বর বাসে যেতে হবে তাও লেখা আছে।

সেই সম্বন্ধের ব্যাপারে?

হ্যাঁ।

বারে তুমি একা যাবে কেন। কী যে তোমার বাই। রমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। প্রিয়নাথ ঠাকুরপো আছে তাকে সঙ্গে নাও। তা ছাড়া খবর দেবে তো দেখতে যাচ্ছ। খবর না দিয়ে যায় নাকি।

আমার অন্য কাজ আছে নীরজা।

নীরজা বললেন, জানিনা। যা খুশি করো।

সবই বড় দেরি করে ফেলেছি।

এতদিনে বোধোদয়। বলে ঠোঁট বাঁকাল নীরজা।

নীরজা, তুমি আমাকে একদম মান না।

মানার কাজটা সারাজীবন ধরে কতটা করেছ?

আমি কিছুই করিনি। তুমি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাস না।

বুড়ো বয়সে ঢং হচ্ছে।

বুড়ো হলে কী মানুষের কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই?

ইচ্ছে থাকবে না কেন। ইচ্ছের কী শেষ আছে।

ভুবনবাবু বললেন, আমি আজই যাব। যদি চাবি না দাও, এভাবেই চলে যাব।

নীরজা বাধ্য হয়ে একবার মানুর ঘরে উঁকি দিলেন। মানু বের হয়নি। আসলে সে দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। সে আজকাল কোথাও বের হলেও দরজায় তালা লাগিয়ে যায়। নীরজা জানালায় দাঁড়িয়ে ডাকলেন, মানু দেখ তোর বাবা কী আরম্ভ করেছে। কিন্তু মানু সাড়াশব্দ না করায় চেঁচিয়ে ডাকলেন, ও মানু তোর বাবা কী করছে উঠে দ্যাখ।

মানু পাশ ফিরে শুয়ে বলল, বাবার কী হয়েছে?

কী হবে আবার। উঠে দেখতে পারো না।

মানুর মনে হল বাবার কিছু একটা হয়েছে। বড় আর্ত গলা মার। সে দৌড়ে বের হয়ে এসে দেখল, বাবা আলমারির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।

সে মাকে বলল, কী হয়েছে?

কী জানি! এখন বলছে কোথায় মেয়ে দেখতে বের হবে।

ভুবনবাবু কেমন অপরাধীর গলায় বললেন, তোমাকে বলেছি আমি মেয়ে দেখতে যাচ্ছি?

তবে কী করতে যাচ্ছ?

আমার অনেক কথা আছে বুড়ো মানুষটার সঙ্গে। বলেই তিনি ফের চাবিটার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন।

মানু ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। আজকাল প্রায়ই সে দেখছে মায়ের সঙ্গে বাবার খিটিমিটি চলছে। এসব সময়ে সে প্রায়ই চুপচাপ থাকে। আর দিদির জন্য মাথায় যে তার একটা শিরঃপীড়া আছে সেটা তখন কেন জানি চাগিয়ে ওঠে। সে গুম মেরে যায় তখন।

ভুবনবাবু বললেন, অনেকদিন আমার সঙ্গে কোনো বুড়ো মানুষের দেখা হয় না নীরজা। আজ আমি আমার সমবয়সি একজন মানুষের কাছে যাব। কথা বলব। কথা বললে বুঝতে পারছি মনটা হালকা হবে।

কী যে বলে মানুষটা! আজকাল প্রায়ই এমন সব কথা বলে যাতে করে বড়ই অপরিচিত লাগে মানুষটাকে। এতদিন যাকে নিয়ে ঘর করেছে সে যেন এই মানুষ নয়। সে ছিল অন্য মানুষ। যত দিন যাচ্ছে তত নীরজার কাছে ভুবন নামে একটা পৃথিবী আলগা হয়ে যাচ্ছে। নীরজা বাধ্য হয়ে বলল, প্রিয়নাথ ঠাকুরপো আছে। ওঁর বাড়িতে যাও। সেও তো তোমার বয়সি মানুষ।

প্রিয়নাথ! ভুবনবাবু দু’বার প্রিয়নাথ নামটি উচ্চারণ করলেন। মেয়েদের কবেই বিয়ে হয়ে গেছে। প্রিয়নাথের। ছেলের মৃত্যুর পর সে বোধহয় আরও হালকা হয়ে গেছে। সংসারের মায়া মমতা তার এখন কাকলীকে নিয়ে। কাকলীর বয়সে নীরজাকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। এ—সময়ে প্রিয়নাথের সঙ্গে দেখা হলে কাকলীর কথা তিনি বলতেন। প্রিয়নাথ, কাকলীর ভিতরে কষ্টের উদ্রেক হচ্ছে এটা তুমি যত সত্বর টের পাবে তত মঙ্গল হবে সংসারের। এবং তখনই প্রিয়নাথের বিধবা পুত্রবধূর কথা তাঁর মনে হল। এমন কাম ও যৌবন নিয়ে প্রিয়নাথের বিধবা পুত্রবধূই বা দিন কাটাচ্ছে কী করে । ভানু আর কতদিন। অথবা যে সংশয়টা মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে সত্যি নাও হতে পারে। প্রিয়নাথ জীবিত থাকতে ঘরের মধ্যে কোনো ব্যাভিচার চলবে সেটি বিশ্বাস করাও পাপ। তিনি বললেন, চাবিটা দাও নীরজা। আমি যাব।

নীরজা আর না পেরে চাবির গোছাটা ছুড়ে দিল। যা খুশি করো।

মানু আর থাকতে না পেরে বলল, কোনো খবর থাকে তো দিন, আমি দিয়ে আসি।

যাবি তুই!

তোমরা যা করছ?

যদি যাস তবে আর আমি যাব না। চিঠি নিয়ে যা। ওদের দিনক্ষণ দেখে আসতে বলবি। আমরা পরে যাব। তুই যাবি আমাদের সঙ্গে?

মানুষ সোজাসুজি বলল, না।

ঠিক আছে, আমি রমা তোর মা আর প্রিয়নাথ সঙ্গে যাবে।

ভুবনবাবু এবার কলম এবং প্যাড নিয়ে বসলেন। চিঠি লিখলেন, আপনার ছোট কন্যা মিতাকে দেখতে আমাদের অমত নেই। তবে প্রথমে আপনারা এসে দেখে যান। পরে আমরা যাব। পছন্দ হলে কথাবার্তা হবে। এই কয়েকটা কথা লিখে তিনি মানুকে চিঠিটা দিতেই, চিঠির উপর ঠিকানা দেখে মানু কেমন বিস্মিত হল। এই ঠিকানায় আজ তার এমনিতে যাবার কথা। নানু চলে যাবার আগে একটা চিঠি রেখে গেছে। চিঠিতেও এই ঠিকানা লেখা আছে। রাসবিহারী নানুর দাদু। সেই দাদুর কাছে মানুকে আজ তবে দুটো চিঠি নিয়ে যেতে হচ্ছে। একটা নিখোঁজ মানুষের চিঠি, অন্যটা বিয়ের চিঠি। সে ভাবল ভবিতব্য আর কাকে বলে?

তখন কাকলী বিছানায় শুয়ে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখেছিল। বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠান্ডা। সারাদিন পেটের নীচে আবার সেই ফিক ব্যথাটা সে টের পাচ্ছে। ব্যথাটা উঠলে কাকলী স্কুলে যায় না। স্নান করতে ভালো লাগে না। খেতে ভালো লাগে না। কেবল শুয়ে থাকে। মুখে একটা ক্লিষ্ট ছাপ থাকে। সে জানে ব্যথাটা সন্ধ্যার দিকে সেরে যাবে এবং তারপরই সে ঋতুমতী হবে আবার। মাস ছয়েক ধরে এমনই চলছে। এবং তার মাও টের পায় তখন ভিতরে মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। গরম জলে তলপেটে সেঁক দিতে বলে। এবং সন্ধ্যার দিকেই কাকলী বাথরুমে ঢুকে গেল। মার কাছে থেকে সে কিছুই জেনে নেয়নি। সংসারে যে এটা হয়, এবং একেই নারীত্ব বলে আসছে মানুষেরা, অর্থাৎ কাকলী বুঝতে পারে সময় বড় সুসময়। তিন—চারটে দিন তার একটা গা ঘিন—ঘিন ভাব থাকলেও কেমন মনের মধ্যে একজন পুরুষের জন্য হাহাকার বাজতে থাকে। ভানুকাকা রাতে মার সঙ্গে এ বাড়িতে আসবে। সে বাথরুম থেকে বের হয়েই আয়নার সামনে দাঁড়াল। দাদু এখন নিচে নেমে যাবে। রান্নার মেয়েটা শুধু বাড়িতে। একা কাকলী এখন আয়নার সামনে। দরজা বন্ধ। জানালাও বন্ধ করে দিল কাকলী। আয়নার সামনে ফ্রক খুলে, বগলে পাউডার দেবার সময় কেমন এক নীলাভ রঙের মধ্যে সে ডুবে যায়—শরীরের প্রতিটি অংশ বড় বেশি ফুটে বের হচ্ছে। সে শরীরের চারপাশটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। পৃথিবীতে কোথাও কোনো অন্য কষ্টে আছে, কাকলীকে দেখে এখন আর এতটুকু বোঝার উপায় নেই। সে পাউডারের ব্রাশ আলতো করে মুখে বুলিয়ে কাজল দিল চোখে। খুব লম্বা কাজল চোখে সে নিজের সৌন্দর্যে কেমন মুগ্ধ হয়ে গেল। যেন কোনো যুবক এখন চারপাশে কেবল নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। কাকলী সুন্দর লেস দেওয়া ফ্রক গায়ে বের হয়ে রেকর্ড প্লেয়ারে একটা আশ্চর্য মিউজিক দিয়ে দিল। সে খুব নিভৃতে মিউজিকের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে দেখল, ভানুকাকার সঙ্গে এক বড় সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। ভানুকাকা তাকে ক্রমে একটা অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরছে। ভিতরে প্রচণ্ড উষ্ণতার জন্ম হচ্ছে। শরীর কাঁপছে থির থির করে মুখ কাঁপছে প্রতিমার মতো। সে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। তার ঘুম চলে আসছে।

মানু চিঠির নম্বরটা মিলিয়ে দেখল—না, সে ঠিকই এসেছে। সামনে সুন্দর লন, পাঁচিলের পাশে কিছু গন্ধরাজ কাঠ—মালতীর গাছ। গেটে সবুজ বোগেন—ভেলিয়ার ঝাড়। নানুর দাদুর রুচি আছে।

লন পার হলেই দোতলা বাড়ি। ওপরের ঘরগুলিতে একটাও আলো জ্বলছে না। সেটা যেন নিচের ঘরগুলিতে পুষিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নিচের ঘরগুলোতে বেশ মানুষজনেরও ভিড়। এ—বাড়ি থেকে একটা ছেলে উধাও হয়ে গেছে এত আলো জ্বলতে দেখে সেটা আদপেই অনুমান করা যায় না। প্রায় উৎসবের মতো বাড়িটা। নিচের ঘরে সে রাস্তা থেকে মানুষজনের চলাফেরা টের পাচ্ছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে মানু ঝুঁকে দেখল, কাছে কেউ নেই—সে গেট খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, খুলছে না। কোথায় আটকে যাচ্ছে। গেট থেকে সোজা লাল নুড়ি বিছানো পথটা বারান্দায় সিঁড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। নানু ওর সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, এই চিঠিটা তুই দিয়ে আসবি। চিঠিটাতে নানু লিখেছে, দাদু আমি লীলাকে খুঁজতে যাচ্ছি। কবে ফিরব, কী ফিরব না ঠিক নেই। আমার জন্য তুমি চিন্তা করবে না। এবং এই চিঠি পৌঁছে দেবার ভার মানুর ওপর রেখে গেছে। আরও কত কথা বলে গেল নানু। সে একবার তার খোঁজেও এসেছিল। কিছু সমস্যার কথা বলার ছিল তখন। কিন্তু লীলা চলে যাবার পর তার নাকি মনে হয়েছে জীবনে তার একটিই সমস্যা—এবং সে লীলাকে আবার খুঁজে পেলেই সে সমস্যাটা মিটে যাবে। অদ্ভুত গম্ভীর রাশভারি ছেলে নানু—অথচ কাল ওকে খুব উদাস দেখাচ্ছিল। লীলা! কে এমন প্রশ্ন করেছিল মানু। জবাবে নানু বলেছে, লীলা কিশোরীর নাম। লীলা বড় সুন্দর নাম। শুনেই তোমার বোঝা উচিত মানু লীলা বড় ভালো মেয়ে। তারপর নানু সহসা গান গেয়ে ওঠার মতো বলেছিল ন…ব…নী…তা। আজকাল নানুর মনের মধ্যে পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য নাড়া খেলেই এমন একটা শব্দে সে তা প্রকাশ করতে চায়।

সে এবারে গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। সন্তর্পণে সে হেঁটে যেতে থাকল। এ বাড়ির জন্য দুটো চিঠি তার হাতে। কোনটা আগে দেবে অথবা কোন খবরটা তার আগে দেওয়া উচিত। এ সময় সে বুঝে উঠতে পারল না।

বারান্দায় উঠতেই অবাক। চার পাঁচজন লোক খুব গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। আর আশ্চর্য সে এখানে এসে দেখল অরুণদাও এ—বাড়িতে হাজির। সে কখনও অরুণদাকে ধুতি—পাঞ্জাবি পরতে দেখেনি। সে দেখেই সহসা ডেকে উঠল, অরুণদা তুমি!

বারান্দায় আবছা অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দেখেই অরুণের মনে হল ভারী চেনা গলা। বুকটা ওর কেঁপে উঠল। সে বের হয়ে বলল, তুমি, কী ব্যাপার।

আপনি এখানে!

এই মানে…অরুণ আমতা আমতা করতে থাকল।

মানু বলল, এ—বাড়িতে রাসবিহারী রায় কে?

অরুণের ভিতরটা আবার কেমন ঘাবড়ে গেল। মানু কী তার সঙ্গে যে রমার সম্পর্ক আছে, গোপনে সে একটা কিছু করছিল, সে খবর এ বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসেছে।

তখন রাসবিহারী বের হয়ে এলেন। কোথাকার কোনো উটকো লোক অথবা যদি কোনো দুঃসংবাদ বয়ে আনে কেউ সবাই কেমন তটস্থ ভঙ্গিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, কাকে চাই?

রাসবিহারী রায় আছেন?

রাসবিহারী বলল, আমি রাসবিহারী।

চিঠি আছে। আগে সে বাবার চিঠিটা রাসবিহারীর হাতে দিল। বলল, আমার বাবার নাম ভুবনমোহন গাঙ্গুলী।

ভিতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন! কে একজন যেন কথাটা বলতেই সে ওদের সঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। ঘরের দেয়ালে বিদ্যাসাগরের ছবি। সি. আর. দাশের ছবি, নেতাজীর ছবি এবং গান্ধীজীর ছবি। এইসব ছবি কোনো বাড়িতে দেখলেই মনে হয় মানুর মানুষগুলো ভালো নেই। অথবা ভালো না থাকতে পেরে বড় মানুষদের দোহাই দেবার জন্য ছবিগুলিকে সাক্ষী রেখেছে। ওর তখন ঠোঁট কুঁচকে যায়। আপনারা বেশ মাছের তেলে মাছ ভাজছেন মশাইরা। সে চিঠিটা হাতে দিয়ে বলল, বাবা নিজেই আসতেন। কিন্তু ওঁর শরীর ভালো না। আমরা আসতে দিইনি।

অরুণ এখন একেবারে অপরিচিতের ভঙ্গি করে বসে আছে। এবং মুখগুলি দেখেই মনে হল ওরা কোনো গোপন শলাপরামর্শ করছিল এতক্ষণ। ওর মতো একজন মানুষের আগমনে ভেস্তে গেছে। সে বলল, বসব না। বলেই আর একটা চিঠি যখন বের করতে যাবে তখন হা হা করে উঠলেন রাসবিহারী। সে কী সে কী। তুমি এসেই চলে যাবে কেন বোস। মানু বলল, আরও একটা চিঠি আছে। আপনাকে দিতে বলেছে।—ও আমাদের বাসায় কাল সকালে গেছিল। চিঠিটা আপনাকে দিতে বলেছে।

প্রথম চিঠিটা পড়ে শেষ করেছেন মাত্র—তারপরই নানুর চিঠি। রাসবিহারী মাথার মধ্যেও নানুর মতো একটা রেলগাড়ি ঢুকে যাচ্ছে। এই প্রথম বুঝতে পারলেন, তিনিও ইচ্ছে করলে আস্ত একটা রেলগাড়ি মাথার মধ্যে ঢুকতে দিতে পারেন। সবটা ঢুকে গেলে চোখ মুখ কিছুটা অস্বাভাবিক লাগল দেখতে। অবনীশ তখন চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ, তাওওইমশাই আপনার চোখ দেখছি নানুর মতো হয়ে যাচ্ছে। নানু কী লিখেছে?

রাসবিহারী বললেন, নানু লীলার খোঁজে চলে গেছে। নানু নিরুদ্দেশ।

রাসবিহারী তারপর মানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, নানু তোমার সঙ্গে বুঝি পড়ে?

মানু বলল, হ্যাঁ। পড়ে।

নানু আর কিছু বলে যায়নি?

না। আমি যাই।

বোসো বাবা। ভিতরে এসে বসো। এখুনি যাবে কী!

তিনি ফের বললেন, অরুণ দেখতো অমলা কী করছে। তোমার মাকে বলো, ওকে একটু মিষ্টি দিতে। কত সব সুখবর আজ আমার। আমার কী হবে। তারপর অরুণ উঠে যেতে চাইলে মানু বলল, অরুণদা বাইক এনেছ? তোমার গাড়িতে যেতাম।

অরুণকেও চেন!

অরুণদা আমাকে চাকরি দেবে বলেছেন, না অরুণদা।

অরুণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকল। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। কোনো শব্দই কানে যাচ্ছে না।

রাসবিহারী বাহবা নেবার জন্য, অর্থাৎ দেখো আমি কত বড় মানুষের শ্বশুর বোঝানোর জন্য যেন বললেন, অরুণ আমার জামাই। এরাও জামাই। আর এই হল নানুর জ্যেঠু অবনীশ। ইয়েস বয়, তোমাকে নানু কী বলেছে ফের ফিরে আসবে?

চিঠিতে তো তেমন কিছু লেখা নেই।

আই মিন এনি ডিসকাসান?

মানু বলল, না। ওর ডিসকাসান করার বাড়তি সময় হাতে ছিল না।

তারপর মানুর কেন জানি মনে হল এই মুখগুলি সব মুখোশ পরা। সে রাসবিহারীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তাহলে যাই।

আরে না না। বোস। আমরা শিগগরিই খবর পাঠাব কবে যাচ্ছি।

মানুর মনে হল, টাক মাথার লোকটা আবার বোধহয় ডিসকাসানের কথা তুলবে। আসলে নানু তাকে যা বলেছে খুবই সংক্ষিপ্ত। যা পরিচয় তাতে নানুর এর চেয়ে বেশি বলারও কথা নয়। সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই চিঠি দিয়েছে। একবার মাঝে খুঁজে গিয়েছিল, পায়নি। এবং সেজন্য তার কোনো অনুযোগই নেই। নানুর সঙ্গে একদিন দিদিরও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। নানুর দিদির সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। দিদি যে খারাপ হয়ে গেছে নানু কী সেটা টের পেয়ে গেছিল!

তখন অরুণদা খুব ভালো মানুষের মতো রাসবিহারীকে বলল, বাবা, মানু আমার খুব পরিচিত। ওদের বাড়ির সবাই। মিতার সঙ্গে ভানুবাবুর বিয়ে হলে বেশ মানাবে। ভানুবাবু মানুষটিও খুব ভালো। সংসারের প্রতি বড়ই কর্তব্যপরায়ণ।

কী আশ্চর্য আমি এত সবের কিছুই জানতাম না।

মানু কী বলবে ভেবে পেল না। সে কেবল বলতে পারত, অরুণদা তুমি দিদিকে নিয়ে বাইকে কতদূর যেতে চাও! কিন্তু কিছুই না বলে সে দেয়ালে বিদ্যাসাগরমশাইর ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর একটু মিষ্টিমুখ। সে যতক্ষণ ছিল, ‘ওর আর নানু সম্পর্কে একটা কথাও বলেনি। মিতার সম্বন্ধের ব্যাপার আর এ বাড়ির এক ছেলে গতকালই নিরুদ্দেশ। তাও একটি ঝি—মেয়ের জন্য। আর সেই খবর বয়ে এনেছে ছেলের ছোট ভাই। এসব ভেবেই হয়তো ওরা নানু যে তাদের আত্মীয় হয় তা আর দ্বিতীয়বার মুখ ফুটে বলতে চাইল না।

বাড়িতে ফিরে মানু নিজের ঘরে কিছুক্ষণ বসে থাকবে ভাবল। কারণ সে আজ তার বাড়ির জন্য দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা মা এবং দিদির জন্য বিশেষ করে। অরুণদা নানুর মেসো। অরুণদাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। ভালো জামাইর জন্য একটা বয়সে বাপেদের বড় দুর্ভাবনা। মেয়েকে যে এত বড় করা তা একজন ভালো সুপাত্রের কাছে ভোগের নিমিত্ত তুলে দেওয়া। ভোগের নিমিত্ত কথাটিই তার মনে হল। রাসবিহারীবাবু ভোগের নিমিত্ত একজনকে বড় করে তুলেছেন ঘরে। ভানুবাবু ভোগের নিমিত্ত। দিদির নিমিত্ত হয়তো এতদিনে অনেকবারই হয়ে গেছে। দিদি এখন শুধু এঁটো বাসন। পড়ে থাকলে কেবল মাছি ভন ভন করবে।

বাড়ি ফিরলেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কীরে দিয়ে এলি?

সে বলল, হ্যাঁ। তারপর মানুর আর কিছু বলতে ইচ্ছা হল না। দাদা এখনও বাড়ি ফিরে আসেনি। দিদি শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল। মাথার কাছে রেডিয়োতে রবীন্দ্রসংগীত। দিদির মুখ ভারী উৎফুল্ল ছিল। দাদার বিয়ের চিঠির কথা শুনেই সে লাফিয়ে উঠেছিল। তারপর আঁচল ঠিক করে বাবার ঘরে হাজির। —কবে আমরা দেখতে যাব?

মানু সহসা কেন জানি ছোটলোকের মতো তখন চিৎকার করে উঠল, তোমায় যেতে হবে না।

রমা অবাক। মানু কখনও এভাবে কথা বলে না। বাবা অথবা মার সঙ্গে ঠান্ডা কথাবার্তা মাঝে মাঝে বলে থাকে। মাথা গরমও করে থাকে মাঝে মাঝে। কিন্তু তার সঙ্গে মানু সব সময় বেশ সহজ হয়ে কথা বলে। মানুর জামা—প্যান্ট হাতখরচা সবই রমা দেয়। ছোট ভাইটির জন্য তার ভারি মমতা। অরুণদাকে সে ধরে রেখেছে—ঠিক কিছু একটা হয়ে যাবেই। হায় সেই মানুর চোখ বাঘের মতো হয়ে যাচ্ছে কেন। রমা তাকাতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে।

বাবা বললেন, আজকাল যে তোদের কী হয়েছে বুঝি না। একটুকুতেই রেগে যাস। রমা গেলে কী হবে!

মানু ভাবল, সত্যিতো দিদি গেলে এমন কী অনিষ্ট হবে। দিদিকে জানতেই হবে সব। বাবা—মাকেও। তারপর আর বোধহয় বাবা এ—বিয়েতে রাজি থাকবেন না। মেয়ের জামাইবাবুর খবরে বাড়ির সবার সংশয় দেখা দিতে পারে। সে এবার বলে ফেলল, বাবা মেয়েটি অরুণদার আত্মীয়।

নীরজা বলল, তাই নাকি। ওমা আমরা তো তা জানি না।

মানু বলল, মেয়েটি অরুণদার স্ত্রীর ছোট বোন।

ভুবনবাবু বললেন, অরুণ মানে অরুণের কথা বলছিস তো!

তাই বলছি। বুঝতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?

সবার মুখ কেমন থম মেরে গেল। মা দিদির দিকে তাকিয়ে কী যেন আঁচ করার চেষ্টা করল। তখন দিদি সরল গলায় বলল, অরুণের স্ত্রী আছে বলে কী হয়েছে?

ভুবনবাবু শুধু বললেন, কিছু হয়নি। তারপর বারান্দার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অথবা বলা যায় ভুবনবাবুকে সহসা একটা বড় রকমের অন্ধকার সহসা গ্রাস করে ফেলল। রমা দেখল তার সামনে আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। সে কেমন একা নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। তারপর যেন জনান্তিকে বলা, একটা লোক বিয়ে করেছে বলে চণ্ডীপাঠ অশুদ্ধ হয়ে যাবে! আমি তো জেনেই মিশছি। মানুর জন্য কী চেষ্টা করছে জানো!

রমা আবার কী বলতে যাচ্ছিল—ও—ঘরে মানু ফুল ভলিউমে রেডিয়ো ছেড়ে দিয়েছে। রমার কথাগুলি শব্দের মধ্যে অসংখ্য বুদবুদ তুলে তলিয়ে যেতে থাকল। এবং রাতে বাবা অসুস্থ বলে কিছুই খেলেন না। নীরজা কোনোরকমে দরকারি কাজ সেরে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পরদিন সকালে দেখা গেল মানু নিচে একটা লোকের চুলের মুঠি ধরে টেনে আনছে। লোকটা নীরোদবাবুর ড্রাইভার। সে গাড়ি চাপা দিয়ে কাউকে হত্যা করেছে। মোড়ের মাথায় হল্লা। গাড়ি ভেঙে দিয়েছে। এবং গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। দোষ, সে গাড়ি গ্যারেজ করতে গিয়ে দেখতে পায়নি পাশে কেউ বাচ্চা রেখে বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে গেছে। ড্রাইভার না জেনেই একটা দু মাসের বাচ্চার বুকে গাড়ির চাকা তুলে দিয়েছে। রক্তাক্ত চাকার নিচ থেকে সেই শিশুর আর্তনাদ মানু শুনতে পাচ্ছিল। এবং সে জানে চুলের মুঠি ধরে এখন না নিয়ে এলে, ড্রাইভারকে সাহসী বিবেকবান মানুষেরা খুনই করে ফেলবে। সে নীরোদবাবুর ড্রাইভার অনিমেষকে আপাতত একটা ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। পুলিশের ভ্যান না আসা পর্যন্ত সে এখান থেকে নড়তে পারছে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *