Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

এই বাড়িটায় নানু আরও ক’বার এসেছে। একবার সে এসে দেখেছিল, কেউ নেই, কাজ করে যে বালিকাটি শুধু সেই আছে। আর একবার এসে দেখেছিল, জেঠু বের হয়ে গেছে কোথায়। জেঠুর মহিয়সী ভূড়ি দুলিয়ে ব্যাগ দুলিয়ে মেয়ের হাত ধরে কোথায় রওনা হবার জন্য বের হচ্ছে। ওকে দেখেই, আরে নানু এলি। ও—মা কত দিন পর এলি। তোর বুঝি আমাদের কথা মনে থাকে না। তোর জেঠুর তো ঘুম নেই দুচোখে, তোর কথা ভেবে। যাক তবু যে এলি। বোস। তারপরই সেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ডাল বসিয়ে দে। পোস্ত বাটা আছে। মাছ টাছ তো আর পাওয়া যায় না।

নানুর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি খেয়ে যাবে। জেঠি তার বেশি সোহাগে তুই তুকারি করে। আর বিরক্ত হলে তুমি তুমি করে।

নানু বলেছিল, জেঠু কোথায়।

মহীয়সী বলেছিল, আসবে। তুমি কিন্তু চলে যেও না আবার। তোমার জেঠু তবে খুব খারাপ ভাববে।

নানু বলেছিল, না না। জেঠুর সঙ্গে দেখা করে যাব।

খেয়েও যাবে।

তা যাব।

আমি যাচ্ছি বুঝলে। এই কণা, শুনতে পাচছিস না, মহীয়সী চিৎকার করে সেই বালিকা চাকরাণীকে ডেকে, বলেছিল, নানুবাবুকে চানের জল তুলে দিস। রান্না হলে গুল দিস। পুকুর থেকে জল এনে সাদা শাড়িটা কাচবি। কলের জলে ধুলে তোমার একটা দাঁতও আস্ত রাখব না।

জেঠুর মেয়েটা তখনই কুঁই করে উঠল। চল মা। যাবে না।

নানু বলেছিল, এই হাবলা।

আমাকে হাবলা বলবে না আমার নাম কুটু।

নানু চুল নেড়ে বলেছিল, কেমন আছিস। যাবি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে। ছোট্ট বোনটিকে মাঝে মাঝে নানুর ভারি আদর করতে ইচ্ছে হয়। সে বলেছিল, কোথায় যাচ্ছিস, আমার সঙ্গে থাক।

কুটু বলেছিল, না। মার সঙ্গে আমি যাব।

নানু বলেছিল, আমি তোর দাদা। দাদার কথা শুনতে হয়।

বের হবার আগে আর কী কী আদেশ জারি করা বাকি আছে ভেবে বোধ হয় সেই মহীয়সী বারান্দায় দু—বার পায়চারি করল, একবার শোবার ঘরে ঢুকে তালা ফালা সব জায়গা মতো দেওয়া আছে কিনা দেখে নিয়েছিল। শোবার ঘরের জানালা বন্ধ করে দরজার শেকল তুলে সেখানেও একটি বৃহৎ ঘণ্টার মতো তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কেবল খোলা রেখে গেল বাইরের ঘরটি—সেখানেই জেঠু না আসা পর্যন্ত নানুকে অপেক্ষা করতে হবে। বড়ই সাবধানী মহিলা। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে ঠকতে রাজি না। নানুর স্বভাব কেমন কে জানে! নানুর মনে হয়েছিল, তখনই সে চলে যায়—কিন্তু গেলে জেঠু কষ্ট পেতে পারে—জেঠু, আহা সেই জেঠু যে তাকে হাত ধরে পার্কে নিয়ে যেত, লাল বল নিয়ে তার সঙ্গে খেলা করত। একজন মহীয়সীর পাল্লায় পড়ে জেঠুর লাইফ জেরবার—এবং তখনই মনে হয়েছিল, সারাদিন থেকে জেঠুর জীবনের বাকি সময়টা কেমন করে কাটে দেখে যাবে।

বাথরুম খোলা ছিল বলে একবার সেখানে ঢুকতে পেরেছিল। আর বাকি সময়টা ভীষণভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল বালিকাটি একহাতে সব কাজ কেমন করে একে একে করে যাচ্ছে। ওর ভারি চা খেতে ইচ্ছে হয়েছিল। এবং সেজন্য সে মুখ বাড়িয়ে বলেছিল, কীরে এক কাপ চা হবে? বালিকাটি ভারি কাঁচুমাচু চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল—তখনই বুঝেছিল, কত অসহায় এই মেয়েটি।

জেঠু এল বারোটা বাজে বাজে সময়ে। নানুকে দেখেই খুব ছেলেমানুষের মতো জড়িয়ে ধরেছিল, তুই এলি তবে! কেমন আছিস। তোর জেঠিমা বাড়ি নেই। থাকলে কী খুশি হত।

নানু বলেছিল, দেখা হয়েছে।

ওয়েল। দেন, বাড়ি চিনে আসতে কোনো ট্রাবল ফেস করতে হয়নি তো!

নানু বলেছিল, আমি তো আরও এসেছি। জেঠি ছিল। তোমার অফিসে ফোনে জানিয়েছিলাম মনে নেই? ট্রাবল ফেস করতে হবে কেন।

ও ইয়েস, ইয়েস। ইউ কেম। ভেরি গুড, নাউ ইউ কমপ্লিট ইউর বাথ। আমিও চানটা সেরে নেই। তারপর দুজনে জানালা খুলে শুয়ে পড়ব।

নানু জানে জেঠু সারাক্ষণ বক বক করতে ভালোবাসে। এবং জেঠু একটিই রেকর্ড চালিয়ে দেয়। রেকর্ডে সব মহৎ ব্যক্তিদের উক্তি এবং জীবন সম্পর্কে অতিশয় কঠিন সত্যের প্রকাশ থাকে। আরম্ভ হল বলে। প্রথম দিন শুনলে মনে হবে, বড়ই পণ্ডিতপ্রবর। দ্বিতীয় দিন শুনলে মনে হবে বড়ই রাজনৈতিক সচেতন। তৃতীয় দিন শুনলে মনে হবে, দেশের একজন চিন্তানায়ক তিনি! চতুর্থ দিনে আদর্শ শিক্ষক, পঞ্চম দিনে পরম রসিক, ষষ্ঠ দিনে ধর্মপরায়ণ, সপ্তম দিনে কবিয়াল, অষ্টম দিনে হাপুর বাজারের দালাল, নবম দিনে কোতোয়ালের পুত্র, দশম দিনে রমণীরঞ্জন, একাদশ দিনে একটি আস্ত আরশোলা। অর্থাৎ দশ দিনের ওপর জেঠুর সঙ্গে যে ব্যক্তি আলাপ করেছে তার বিন্দুমাত্র ভাবতে কষ্ট হয় না, মানুষটা জীবনে কোথাও এতই জেরবার যে পা রাখার আর জায়গা নেই। আস্ত একটি ভাঁড়। এ—হেন ব্যক্তিটি খেতে বসে বলেছিল, পোস্ত আলু আর ডাল বড়ই ডেলিসিয়াস ফুড। আমার ফেবারিট লাঞ্চ।

ভোজ্যদ্রব্য গলাধঃকরণ করতে নানুর খুবই কষ্ট হয়েছিল। বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আসলে সেই মহীয়সী তোমার জন্য আর কিছু বরাদ্দ করেনি। তুমি যা রোজগার করো এবং মহীয়সী যা রোজগার করেন, সঞ্চয়ের জন্য। বেঁচে থাকার চেয়ে সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি বড়ই আরামদায়ক। অথবা তোমাকে একটি আস্ত অশ্ব বানিয়ে চেপে বসেছেন, এখন তোমার সওয়ারি নিয়ে শুধু ছোটা বাদে অন্য কোনো গত্যন্তর নেই। তবু নানু সাধারণত এই কাপুরুষ মানুষটিকে দুঃখ দিতে চায় না। সেও জেঠুর সঙ্গে খেতে খেতে বলেছিল, বড়ই সুস্বাদু খাবার!

যাইহোক আজ সে খবর দিয়ে এসেছে। এতদিনে জেঠির শরীর ভালো হয়ে যাবার কথা। এবং পেটের চর্বির নীচে বড়ই আন্ত্রিক গোলযোগ। মাঝে মাঝে যখন ঢেকুর তোলে তখন কাছে তিষ্ঠোয় এমন নরাধম জগতে কমই আছে। সেদিন সে বাড়ি ঢুকেই দেখেছিল মহীয়সী পা ছড়িয়ে বসে আছেন। কুলোয় পোয়াটেক খেসারীর ডাল। কাঁকর এবং আবর্জনা বাছার কাজটি তিনি সারছিলেন। এ—হেন সময়ে নানুর প্রবেশ। জেঠি আপাতত বিড়ম্বনা এবং বিরক্তি লুকিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলেছিলেন, হ্যাঁরে এসেছিস। তবু যে তোর জেঠির কথা মনে পড়ল।

রান্নাঘরে আজ সে অন্য এক বালিকাকে দেখতে পেল। ঠিক বালিকা বলা চলে না, কিশোরী, ছেঁড়া ফ্রক গায়ে—চোখ দুটো ভারি মিষ্টি। গরিব দুঃখী ঘরের মেয়ে—শীর্ণকায়, কতদিনের উপবাসের কত বড় দুর্ভাগ্য হলে এমন একটি পরিবারে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় পায়। জেঠু ভেতর থেকে কাঁধটা সামান্য স্রাগ করে লম্বা প্যাকাটির মতো মুখ বার করে দিয়ে বলল, হ্যালো নানু। এসে গেছ। মাই লিটল চ্যাপ। ভিতরে চলে এসো। বসে পড়। লুডু খেলছি। কুটুর সঙ্গে। উড য়ু লাইক টু প্লে লুডু।

শোবার ঘরটিতে নানুর ঢুকতে সাহস হচ্ছে না। কারণ এক্ষুণি জেঠি বাজারে যাবে। সেদিন যা দেখেছে তাতে মনে হয়েছে, যাবার আগে জেঠি আজও শোবার ঘরে জীবজন্তুসহ তালা বন্ধ করে চলে যাবে। ফাঁক পেলে কে কখন জান মাল দুই তছরূপ করে নেবে সেই একমাত্র ভয়। তখনই ছোট ছোট কাপে চা নিয়ে এল সেই কিশোরী। নানু এত সকালে এসে উপস্থিত হবে হিসেবের বাইরে ছিল। দুখানা করে স্যাঁকা পাউরুটি এবং চা। নানু আসায় স্যাঁকা রুটির ভগ্নাংশ বেড়ে গেল। মেয়েটি একটা স্টিলের বড় থালায় চা সাজিয়ে এনেছে। এবং নানু দেখল, বড়ই জবু থবু হয়ে হাঁটছে মেয়েটি। ওর ফ্রকের পেছনটা একটা হিংস্র বাঘের থাবায় পড়েছিল বোঝা যায়। বাঘ না বাঘিনী এখনও নানু সেটা আন্দাজ করে উঠতে পারেনি।

জেঠি বলল, নানু চা নে। তারপর রুটির প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল, খা। তুই এত সকালে আসবি বুঝতে পারিনি। ঘরে মাখন ডিম আজই ফুরিয়ে গেল। আর তোমার জেঠু এমন জায়গায় বাড়ি করেছে যে যদি কিছু পাওয়া যায়। নানু জানে সবই মিথ্যা বাক্য। জায়গাটি জেঠিই পছন্দ করেছে—বাজার বেশি দূরেও নয়। সবই পাওয়া যায়। সে শুকনো রুটি একদম খেতে পারে না। অগত্যা চায়ে ভিজিয়ে তিনবারের মাথায় খেতে গিয়ে দেখল অভাগা রুটি সবটুকু চা শুষে নিয়েছে। এ—সব কারণেই নানু জেঠুর বাড়ি আসতে চায় না।

কুটু বলল, এই দাদা, খেলবে তো ঠিক হয়ে বস।

নানু বলল লুডু খেলছিস, পড়াশোনা নেই।

জেঠু বলল, আছে, পড়াশোনা আছে। তবে সকাল থেকেই বায়না, তুমি আসছ, সুতরাং পড়বে না। বললাম পড়বি নাত কী করবি? কুটু বলল লুডু খেলব। তাই লুডু নিয়ে বসেছি।

নানু বলল, খেলতে চাইলেই খেলতে দেবে। সময় অসময় নেই?

জেঠি বলল, আর বলিস না। কুটুকে নিয়ে আর পারছি না। একদম কথা শোনে না। কী যে হয়েছে!

নানু অগত্যা খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। এবং একবার জেঠিকে বলবে ভাবল, যাবার সময় কিন্তু আজ আবার তালা মেরে যেও না। তোমার ঘরে এমন কিছু মহার্ঘ বস্তু নেই যা হারাবার। কারণ তুমি জীবনের সব কিছু আগেই হারিয়ে বসে আছ। বয়স বাড়বে, এখন পেটের আন্ত্রিক গোলযোগ, পরে সেটা বুকে উঠবে, শেষে মুখে—জীবনের সবটাই ব্যর্থতায় তোমার ভরা। আমার বাপকে দেখে শেখা উচিত ছিল জীবন কাকে বলে।

যাই হোক নানু শেষ পর্যন্ত লুডু খেলতে বসে গেল। জেঠি বাজারে যাবার আগে সেই কিশোরীকে ডেকে বলল, জল হলে ভাত বসিয়ে দিবি। মশলা বাটবি—জিরে ধনে লংকা আদা। চাবির রিংটা বটুয়াতে ভরে নিয়ে বের হবার মুখে বলল, ভাত বসিয়ে ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে মুছে ফেলবি। পেছনে লেগে আমি কাজ করাব না। একদিন বললে শুনে রাখবি। সেই একদিন আজই কী না নানু বুঝতে পারল না। জেঠি গড় গড় করে বলেই যাচ্ছে, চায়ের বাসন ধুয়ে তুলে রাখ। ছাড়া সায়া শাড়ি জলে ধুয়ে দড়িতে ঝুলিয়ে দিবি। ক্লিপ এঁটে দিবি। গোনা গুনতি ক্লিপ বুঝিয়ে দিতে হবে। একটা যেন না হারায়। তারপর বের হবার মুখে বলল, বিকেলে কিছু গোবর কুড়িয়ে আনবি।

বাড়ির চারপাশে এখনও কিছু ফাঁকা মতো জায়গা আছে। সেখানে গোরু চরে বেড়ায়। অনায়াসে একটু হিসেবি হলে ঘুঁটে কিনতে হয় না। আর জেঠি বাজার থেকে ফিরে এসেই বলল, তাড়াতাড়ি মাছটা বসিয়ে দে। একটু চাটনি কর। এবং দশটা বাজলেই বলল, সব নামিয়ে রাখ। এই নে টাকা, রেশন নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আসবি। তারপর কিশোরী মেয়েটির নাম ধরে বলল, লীলা প্লাসটিকের বালটিতা কোথায় রেখেছিস। খুব মৃদু শব্দ এল রান্না ঘর থেকে—আমি জানি না মাসিমা।

জেঠির ঝংকারে বাড়িটা মুহূর্তে কেঁপে উঠল, তুমি জান না তো কে জানে! আর কে এ—বাড়িতে খেতে আসে!

লীলা আর কিছু বলল না। নানুর কেন জানি এ—সময় কিশোরী বালিকাটির মুখ দেখতে ইচ্ছে হল। পৃথিবীতে কেন এরা জন্মায়, বড় হয়! কী দরকার এমন মুখ ঝামটা খাওয়ার। ওর বুকের মধ্যে কোনো জলছবির রং ধরা আছে কী না একবার প্রশ্ন করে জানলে কেমন হয়। চোখ দুটো বড়ই মায়াবী। একবার মাত্র নানুর দিকে সামান্য চোখ তুলে তাকিয়ে ছিল—বড়ই বিহ্বল চোখ। অবোধ। নানুর কেন জানি জেঠির গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে হয়েছিল তখন।

তখনই কুটু বলল, আর খেলব না। তুমি পার না। বাবাকে বলল, তোমার কিছু হবে না বাবা। তুমি বার বার হেরে যাচ্ছ।

নানু বলল, হারলি তো তুই।

বাবার জন্য হারলাম।

নানু বলল, খেললি তুই আর হারলি বাবার জন্য।

তাই ত। বাবার গুটি বাঁচাতে গিয়েই তো দান নিলাম না।

অবনীশ বলল, তাই হয় নানু। তোমার মা চিঠি দিয়েছে তোমাকে?

দেয় মাঝে মাঝে।

আসবে লিখেছে?

আসতে পারে।

তোমার মাকে নিয়ে, তারপর কী ভেবে, অবনীশ সবটা শেষ করল না। স্ত্রীর নাম ধরে ডাকল। ও—ঘর থেকে তখন জবাব, অত চিল্লাচ্ছ কেন। বলতে হয় এখানে বলে যাও। অবনীশ সুড় সুড় করে উঠে গেল। তারপর ফিরে এসে বলল, তোমার মা এলে এখানে নিয়ে আসবে। ক—দিন এখানে থাকবে।

নানু বলল, দেখা যাবে। বলেই সে বাইরে বের হয়ে বারান্দায় পা দিতেই দেখল, জেঠি দরজায় দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে বকছে। —এতক্ষণ লাগে! ওখানে কী পাত পেড়ে খেতে বসেছিস। আজ একবার ফিরে আয় কত ধানে কত চাল দেখাচ্ছি। এক ফোঁটা জল রেখে যায়নি বাথরুমে।

নানু বলল, কখন তুলবে। এক দণ্ড তো বসে নেই।

জেঠি নানুকে যে—কোনো কারণেই হোক ভয় পায়। সেটা সেই বাবার আত্মহত্যাজনিত অপমান বোধ কী না নানু জানে না।

জেঠি খুব বিপদে পড়ে যাচ্ছিল নানুর কাছে। সুতরাং বিপদ থেকে ত্রাণ পাবার জন্য বলল, যাও চান সেরে নাওগে। কী করবে কপাল। জেঠির বাড়িতে এসেছ বেড়াতে, সেখানেও জল তুলে চান করতে হচ্ছে।

নানু জল তুলে চান টান করে বের হয়ে দেখল জেঠি দরজা হাট করে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ লাল। এবং মনে হচ্ছে, রাগে দুঃখে জেঠির এবার চুল খাড়া হয়ে উঠবে। বাথরুমে ঢোকার মুখে দেখেছিল, জেঠির খোপা বাঁধা। বের হয়ে দেখল, খোপা খোলা, এবং মনে হল কিছুক্ষণের মধ্যেই চুল পট পট করে দাঁড়িয়ে যাবে। নানু বুঝতে পারল, আজ লীলার কপালে খুবই দুর্ভোগ আছে। ঘণ্টা দেড়েক হয়ে গেল। কী করছে মেয়েটা?

এমন সময় লীলা চাল, চিনি, গম, তেল নিয়ে বাড়ি এল। আর অমনি জেঠি করালবদনী হয়ে গেল—লম্বা দুই হাত আরও লম্বা করে দিল, অনায়াসে লীলার বড় বড় চুল খামচে ধরল—তারপর টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে সজোরে লাথি, মুখে পিঠে পায়ে—যেখানে যতটা সম্ভব লাথি চালাতেই নানু মাথা ঠিক রাখতে পারল না। বলল, এ—সব কী হচ্ছে!

জেঠু বলল, মাই লিটল চ্যাপ, তুমি মাথা গলিও না। সব এক সময় ঠিক হয়ে যাবে। সংসার এমনই জায়গা।

নানু বলল, তার মানে!

মানে ঝড় একদিক থেকে কেটে গেল। যে রক্ত তোমার জেঠির মাথায় উঠে গেছিল চড়াৎ করে তা সহজেই এবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। নইলে অনর্থ ঘটত। তোমার জেঠি হয়তো সংজ্ঞা হারাত। মাথায় রক্ত ওঠা বলে কথা।

নানু বসার ঘরে গুম মেরে বসেছিল। কারণ লীলার এই নির‍্যাতন তার মাথার মধ্যে কে আবার রেল গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে। তার মনে হয়েছিল, জেঠুর তবে এই সংসার! জেঠুর এই হেনস্থা দেখে তাজ্জব। জেঠুর সামনে লীলাকে এত মারধোর করতে সাহস পায় কী করে! জেঠুকে বিন্দুমাত্র সমীহ করেন না মহিলা বোঝাই যায়। জেঠির সঙ্গে জেঠুর একদা প্রেম হয়েছিল—কেমন সব অবিশ্বাস্য ঠেকে। কুটু আস্তে আস্তে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। কেউ আর কোনো কথা বলছে না। লীলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান্না ঘরে একটা আহত জন্তুর মতো ঢুকে গেল। একটুও কাঁদল না। বাড়িটা এখন ঠান্ডা। জেঠি খাটে বসে হাঁপাচ্ছিল বোধ হয়। এবং লোডশেডিং বলে, জেঠু পাখা খুঁজছে। সংসার এত বিরক্তিকর—জেঠু বলল, এই লীলা পাখা কোথায়? কোথায় যে সব তোরা রাখিস! কুটু বাথরুমে মাথায় জল ঢালছে—কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। নানু তখন চিৎকার করে বলল, পাখা দিয়ে কী হবে?

জেঠু বলল, বাতাস!

নানু বলল, কাকে?

অবনীশ বলল, তোমার জেঠিকে। কেমন করছে দেখে যাও।

নানু বলল, তুমি দেখ। আমার দেখে কাজ নেই।

অবনীশ বড়ই একা। সে পাখাটা দেখল খাটের ও—পাশে পড়ে আছে। টেনে আনল পাখাটা। তারপর হাওয়া করতে লাগল। বোঝাতে থাকল—তুমি কেন মিছিমিছি মাথা গরম করো বুঝি না। মাথা গরম করলে কার ক্ষতি। তোমার না লীলার।

নানুর মুখে তখন কূট হাসি খেলে গেল। —জেঠু তাহলে তোমার এই সংসার। এই জীবন। জেঠু লীলাকে মুখ দেখাতে ফের তোমার লজ্জা হবে না! আমার কিন্তু হবে। এমন অসহায় একটা মেয়ের ওপর নির‍্যাতন করো তোমরা! তোমাদের ফাঁসি হওয়া উচিত না! বল, বিচারে তোমাদের কী কী শাস্তি প্রাপ্য। অথচ সে একটা কথা বলতে পারছে না। নবনীতা যদি জানে, তার পরিবারে এসব হয়, একজন অসহায় মেয়ের ওপর নির‍্যাতন হয়—কী ভাববে!

এত স্বার্থপরতা মানুষের মধ্যে থাকলে লীলারা যাবে কোথায়! কী সুন্দর চোখ মেয়েটার। নিরীহ নিরপরাধ। সে সহসা ডাকল, লীলা লীলা।

তারপরই ভাবল সে এটা কী করতে যাচ্ছে।

নানুর মাথার মধ্যে রেলগাড়ি চলছে! নানু বারান্দা পার হয়ে গেল। দেখল, জেঠু পাখায় বাতাস করছে। সে দাঁত শক্ত করে ফেলল। এবং রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, লীলা তোমার এত দেরি কেন?

লীলা জবাব দিল না।

কেন এত দেরি? বল। চুপ করে থাকলে কেন?

অবনীশ তাড়াতাড়ি পাখা ফেলে ছুটে এল—কী হচ্ছে নানু। তুমি আবার কী আরম্ভ করলে!

নানু শান্ত গলায় বলল, জবাব না দিলে, লীলাকে আমি খুন করব।

পুলিশ আসবে নানু।

যা হয় হবে।

অবনীশ বলল, লীলা বলে দে মা। কেন নানুকে রাগাচ্ছিস, জানিস ত এ—বাড়িতে রাগলে মাথা কার ঠিক থাকে না।

তখন লীলা বলল, দাদাবাবু লাইনে অনেক লোক ছিল। না দিলে আসি কী করে।

অবনীশ বলল, নে এবারে যা লীলা বলেছে, লাইন পড়েছিল লম্বা। আসে কী করে! আর ওর দোষ কী বল! সমাজে শোষণ নানাভাবে চলছে। ফেরেববাজ না হলে এ—দেশে নেতা হওয়া যায়! সুস্থ মস্তিষ্কের লোক কটা আছে। আয় এবার।

নানু হাত ছাড়িয়ে নিল, তারপর বলল, লীলা তুমি কেন এখানে মরতে এসেছ।

লীলা চুপ।

অবনীশ কেমন হতবাক।

জেঠি উঠে বসেছে।

লীলা আজই তুমি চলে যাবে।

অবনীশ চিৎকার করে উঠল, নানু তোর সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

নানু ফের বলল, লীলা আজই তুমি চলে যাবে।

লীলা ঘরের কোণ থেকে জবাব দিল, কোথায় যাব দাদাবাবু।

নানু আর একটা কথা বলতে পারল না। সে কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। সত্যি তো কোথায় যাবে? মেয়েটির যাবারও জায়গা নেই। সে সোজা বসার ঘরে ঢুকে পায়চারি করতে থাকল। সমস্ত পরিবারটাকে তার এ—সময় পুড়িয়ে মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কুটু, কুটু বড় ভালো মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে, দাদা আয়। খাবি না।

কুটুর কথার মধ্যে কী যেন আশ্চর্য নিরাময়ের সঞ্জীবনী সুধা ছিল। নানুর মাথার মধ্যে ফলে রেলগাড়িটা আর চলছে না। কুটুকে সে কাছে ডেকে আদর করল। এক মাথা চুল, মিহি উলের বলের মতো। সে মাথার চুল এলোমেলো করে দিল কুটুর। তারপর ভাবল, কুটু বড় হলে যদি তার মার মতো, জেঠির মতো হয়ে যায়। সে কুটুকে বলল, চল আমরা কোথাও চলে যাই।

বিকেলে নানু দেখল সবাই ঘুমিয়ে আছে। সে বসার ঘরে শুয়ে ছিল। কুটুকে নিয়ে ওর বাবা মা দরজা বন্ধ করে ঘুমচ্ছে। লীলা রান্নাঘরেই বোধহয় সব সময় থাকে। খাওয়া শোওয়া সব তার ও—ঘরে। লীলার কোনো সাড়া—শব্দ সে পাচ্ছিল না। তাছাড়া কেন জানি লীলার কথা ভেবে আশ্চর্য এক দুঃখ বোধে সে নিরন্তর পীড়িত হচ্ছিল। সংসারে মানুষের যে কত রকমের দুঃখ। এক সময় সে ডাকল, লীলা আমাকে এক গ্লাস জল দেবে।

মুহূর্তের মধ্যে দেখল, লীলা দরজায় এক গ্লাস জল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ভিতরে এসো।

লীলা সন্তর্পণে ঢুকে জল এগিয়ে দিল।

নানু বলল, বোস।

লীলা দাঁড়িয়েই থাকল।

নানু বলল, তোমার কে কে আছে?

লীলা কিছু বলল না।

নানু পকেট থেকে কিছু এক টাকার নোট বের করে বলল, তোমার কাছে রাখো। ভালো মন্দ খেতে ইচ্ছে হলে খাবে। আর মাইনে পেলে শাড়ি কিনে নেবে। তোমার আর ফ্রক পরে থাকা ঠিক না।

লীলা কী—বলতে গিয়ে বলতে পারল না!

নানু অভয় দিয়ে বলল, বল ভয় কী!

আমার টাকা নেই দাদাবাবু। সব টাকা মাকে পাঠিয়ে দেয় মাসিমা।

তোমার মা আছে তা হলে?

লীলা আবার তেমনি চুপ।

তুমি বললেই পারো, কাজ করো তুমি, টাকা তোমাকে দিতে হবে।

লীলা চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে বলল, দাদাবাবু দোহাই ও—সব কথা বলবেন না। মাসিমা শুনতে পেলে আমার আর রক্ষে থাকবে না। মার সঙ্গে ওই কড়ারে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

নানু বলল, ঠিক আছে। তুমি যাও।

লীলা চলে যাচ্ছিল। নানু ফের ডাকল, টাকা কটা নিয়ে যাও।

না দাদাবাবু, মাসিমা জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না।

ধুস তোমার মাসিমা। যা বলছি করো।

দোহাই দাদাবাবু।

লীলা কেমন পাথর হয়ে যাচ্ছে। ওর ছেঁড়া ফ্রক গায়ে, চুল কোমর পর্যন্ত।

নানু বলল, কাল আসব। তোমার সায়া শাড়ি কিনে আনব। তোমাকে পরতে হবে। লজ্জা করে না পুরুষের সামনে তোমার বের হতে।

লীলা এবার ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিল। —দাদাবাবু, তুমি ভগবান।

নানু বলল, গুলি মার ভগবানকে।

তারপর নানু ভগবানকে সত্যি গুলি মেরে উঠে পড়ল। লীলা চলে যাচ্ছে—আবার সেই রান্নাঘরে কিংবা দাওয়ায় বসে থাকা—নিরপরাধ এই কিশোরীর জন্য নানু আজ এই প্রথম ভারি মায়া বোধ করল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *