Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

জয়া বলল, আর কতদূর?

আয় না। বলে একটা সরু গলিতে কালিদাস ঢুকে গেল। তারপর পানের দোকান থেকে দুটো সিগারেট কিনে জয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, পান খাবি?

মিষ্টি পান খাব।

এই তিনটে মিঠে পাতা লাগাও।

কালিদাস পকেটে খুচরো খুঁজছিল।

জয়া বলল, আর কে কে আসছে?

বিনয় বলল, অনেকের তো আসার কথা। না এলে বোঝা যাবে না।

জয়া এলিভেটেড সু পরেছে। মাঝারি ধরনের লম্বা শরীর, মনে হয় জয়া সবার থেকে লম্বা থাকতে চায়। সু পরায় মোটামুটি লম্বাই হয়ে গেছে। কালিদাস বেঁটে মতো মানুষ—ওর মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে জয়া এবং সারাক্ষণ তার দেহ থেকে ক্রিমের একটা সুন্দর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কালিদাস বিনয় পিছনে পিছনে এসেছে গন্ধটা শুকতে শুকতে। প্রায় দুটো কুকুরের শামিল—এবং জয়ার পিছনটা এত মনোরম যে সারা রাস্তায় ওরা আর কোনো দৃশ্য দেখেনি। শাড়ি সিল্কের হলে যা হয়, পিছনে লেপ্টে থাকে। ফলে চলার সময় শরীরের সঙ্গে শাড়িটার বেশ একটা ছন্দ থাকে। এই ছন্দ যে কত আনন্দের বেদনার এবং দুঃখের তারা এখনও জানে না।

বিনয় বলল, জয়া, ওই ছেলেটি কে রে?

ও মানু। খুব ভালো ছেলে। জয়া বলল, তোদের মতো না। তোরা তো কবিতা লিখিস। মানুর ওসব বাই নেই। ভালো ছেলে। ওর চাকরি হলে আমাকে বিয়ে করবে বলেছে।

কালিদাস বলল, আমরা কী দোষ করলাম?

তোরা তো বলিসনি বিয়ে করবি।

আজই বলে রাখলাম।

বিনয় বলল, জয়া তোর পান।

সে পানটা হাতে নিয়ে খুলে দেখল। চুন বেশি হলে গাল পুড়ে যায়। দেখল ঠিকই আছে। আরও দু’কুচি ভাজা সুপারি চেয়ে নিল হাত পেতে।

বিনয় বলল, আমি পান খাচ্ছি না। রেখে দিচ্ছি।

বললেই পারতিস কিনতাম না। কালিদাস দু’টো পান এবং সিগারেটের পয়সা দিয়ে দিল।

জয়া দেখেছে বিনয়ের একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। আরও দুবার তাকে নিয়ে দু—জায়গায় কবিতা পাঠের জন্যে গেছে। পান কিনে খেয়েছে। বিনয় খায়নি। বিনয় হাত পেতে বলেছে, জয়া দে। প্রথম দিন সে বুঝতে পারেনি, সে বলেছিল, কী দেব! বিনয় পানের ছিবড়ে চাইছে। এবং জয়া বলেছিল, কী কাঙাল রে তুই!

কাঙাল কী। তোর এঁটো খেতে আমার ভালো লাগে। তারপর এক সময় অবসর বুঝে বলে ফেলেছিল, জয়া, তুই আমার একটা কথা রাখবি?

কী কথা!

তোর জিভের ডগা থেকে আমি একটু পান নেব।

ঠিক আছে, নিস।

এবং এক বিকেলে কলেজস্ট্রিট থেকে একটা দামি পান কিনে সত্যি সে সোজা চলে গিয়েছিল জয়াদের বাড়িতে। জয়ার বাবা অফিসে। জয়ার পিসি স্কুলে। মা রুগণ। দিনরাত শুয়ে থাকে। এবং জয়ার একমাত্র সঙ্গী বাঘা পায়ের নিচে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। তখন শহরের রাস্তায় সবে মাত্র আলো জ্বলে উঠছে। বিনয় বেল টিপে ধরতেই দরজা খুলে গেল। জয়ার পরনে মখমলের পোশাক। একেবারে লম্বা গাউনের মতো পায়ের পাতা অবধি। হাতে রুপোর বালা। চুল ঘোড়ার লেজের মতো টান করে বাঁধা। বিনয় ঢুকেই খুব ফিস ফিস গলায় বলেছিল, এনেছি।

কোনো নিষিদ্ধ বস্তু নিয়ে যেন সে ঢুকেছে। চোখে মুখে খুব একটা থমথমে ভাব। —তুই, একা আছিস তো?

কী হবে একা থাকলে।

বিনয় কলাপাতার ভাঁজ থেকে একটা পানের খিলি বের করে বলেছিল, নে খা।

পান খেলে ঠোঁট টুকটুকে লাল হয় না জয়ার। জয়া কতদিন ঠোঁট উলটে দেখেছে। মোটেই লাল হয়নি। সে বলল, ঠোঁট লাল হবে তো?

হবে। খা না। কে আবার এসে পড়বে তখন আর হবে না। তাড়াতাড়ি খা তো—

জয়া খেতে খেতে প্রায় সবটাই খেয়ে ফেলেছিল। বিনয় দেখছে। —এই রে সবটা খেয়ে ফেলেছিস! কী কথা ছিল?

ও! বলেই জয়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। নে—জিভের ডগা সামান্য বের করে দিল। আর বিনয় কাছে আসতেই আবার জিভটা ভেতরে পুরে ফেলল। বিনয় হতাশ গলায় বলেছিল, এই জয়া এমন করিস না। মাইরি, মরে যাব। জয়া খুব কুঁচকে বলেছিল, তুই দাঁত মাজিস না।

আজকাল রোজ দাঁত মাজি। বিনয় দাঁত বের করে দেখিয়েছিল।

আচ্ছা নে।

জয়া মা কালীর মতো অনেকটা জিভ বের করে রেখেছিল। এবং মিষ্টি পানের অতীব সুমধুর গন্ধ। বিনয় জিভ থেকে সবটা চেটে খেয়ে বলেছিল, কী আরাম! জয়া তোরা যে কী না! তোরা আমাদের দেখছি মেরে ফেলবি।

কালিদাস তখন বলল, এসে গেছি।

দরজায় নীরদ দাঁড়িয়ে। সতরঞ্চি পাতা। দু—একজন ইতিমধ্যে এসে গেছে। জয়া চেনে না এদের। নীরদ বলল, জয়া, ভিতরে বস গিয়ে। নীরদ ওদের তুলনায় সামান্য বেশি বয়সের মানুষ। এবং গলায় একটা গম্ভীর স্বর রেখে দেয় সব সময়। কবিতার ক্ষেত্রে সে কিছুটা অভিভাবকের মতো। ওরা সবাই নীরদদা বলে ডাকে। সব কবিতার আসরেই মানুষটিকে দেখা যায়। নিজে খুব ভালো কবিতা লিখতে পারে না। তবে কবিতা—অন্ত প্রাণ। ভালো কবিতা কী, মানুষটা বোঝে। এবং এই কবি অন্তপ্রাণ মানুষটিকে জয়া শ্রদ্ধা করে। মান্য করে। সে ভেতরে ঢুকে ভালো মেয়ের মতো বসে পড়ল। খাতাটা এক পাশে।

কালিদাস বলল, এই হচ্ছে আলোক, এই হচ্ছে কাশী আর এই আমাদের জয়া। পৃথিবীর নতুন নতুন সব খবর এর ঝোলায় ভরা আছে।

ওরা হাত তুলে নমস্কার করল জয়াকে। জয়া দেখল একজন বড় গোঁফঅলা মানুষ। লম্বা গোঁফ। গালপাট্টায় অধিকাংশ মুখটা ঢেকে আছে। লোকটার নাম কাশী। কাশীনাথ দত্ত। ওর কবিতার বিষয় মৃত জীবজন্তু নিয়ে। যুবতী নারীর কোনো গন্ধ নেই কবিতায়। জয়া মনে মনে বলল, কিচ্ছু হবে না। গবেট। গবেট ছাড়া মুখটাতে লোকটার আর কোনো চিহ্ন নেই।

ক্রমে ক্রমে আরও দুজন, পরে একজন, আবার একজন শেষে পাঁচ—সাতজন এল। কবিতা পাঠ করতে বেশ সময় লাগবে। চারটেয় আরম্ভ হওয়ার কথা। কিন্তু যার বাড়িতে কবিতা পাঠ, তিনি কোথায়! তার দেখা নেই। অথচ সুন্দর করে সতরঞ্চি পেতে রেখেছে। মাঝখানে মাটির কাজ করা ফুলদানি! একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুটে আছে ওপরে। দেয়ালে রবিঠাকুরের ছবি। আর কোনো ছবি নেই। সতরঞ্চির ওপর ফুল—ফল আঁকা চাদর পাতা। সবার খুব গম্ভীর চোখ মুখ। কবিতা ব্যতিরেকে আর কিছু জানা নেই। পাশেই জয়া, কিছুক্ষণের ভেতরেই ফুল্লরা, আর একজন কেউ হবে, সেও যুবতী, এল। তবে এত কালো আর শীর্ণ যে কেউ ওর দিকে তাকাচ্ছে না। ফুল্লরা দেখতে মন্দ না, তবে জয়া সবার চেয়ে সুন্দরী। কেবল যখন কোনো সভায় সেই বজ্জাতটা আসে, নবীনা না কী যেন নাম, তখন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এবং তখন কালিদাস, বিনয়, এমনকি যে নীরদদা এত গম্ভীর মানুষ, তিনিও খুব বিচলিত হয়ে পড়েন! জয়া সে সব ঘয়োয়া আসরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বড়লোকি চাল, গাড়ি, সোফার উড়ু উড়ু চুল, চোখে টানা আইল্যাশ আর দামি পারস্য দেশের আতর বোধহয় শরীরে মেখে রাখে। যতক্ষণ থাকে একইভাবে গন্ধটা ম ম করে। জয়ারও কম জানা নেই। বাজারে কার কী রকম গন্ধ সব সে জানে। কেবল নবীনার গন্ধটা তার এখনও জানা নেই, কোথায় কোন পৃথিবীতে কিনতে পাওয়া যায়। নবীনা মেয়েটিই একমাত্র ঈর্ষার উদ্রেক করতে পারে তার।

নীরদদা এবার বোধহয় বেশ গুরুগম্ভীর গলায় কবিতা কত পবিত্র ব্যাপার এ সম্পর্কে সামান্য বক্তব্য রাখবেন। যিনি উদ্যোক্তা তাকেও দেখা গেল। আদ্দির পাঞ্জাবি, ফিনলে ধুতি পরে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে হাত তুলে সবাইকে অভিবাদন করলেন। নীরদদা তখন তার কথাবার্তা আরম্ভ করে দিয়েছেন। হাত তুলে ইশারায় বসতে বললেন। ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ খাতা খুলে দেখছে কিছু। জয়ার কিছু দেখতে হয় না। তার কবিতা মুখস্থই থাকে। তবু কোথাও আটকে গেলে অসুবিধা হবে ভেবে খাতাটা অথবা দুটো একটা মুদ্রিত কবিতা সামনে রাখার স্বভাব।

সেই কাশীনাথ দত্ত উঠে বলল, নীরদদা, আজ আপনাকে দিয়েই কবিতা পাঠ আরম্ভ হোক।

সে হবে’খন। বোস।

প্রায় এক ধমকে বসিয়ে দেবার মতো। জয়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল, সে এক ফাঁকে সামান্য হেসেও নিল। তারপরই মনে হল, বাথরুমে গেলে মন্দ হত না। সে চারপাশে তাকাল। মানুটা খুব দুঃখ পেয়েছে। মানুর জন্যে একটা দুঃখবোধ শরীরে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কবিতা পাঠ ভারি উজ্জ্বল ঘটনা জীবনে। একটা সুখানুভব খেলা করে বেড়াচ্ছে শরীরে। গুঁফো লোকটার চোখ মাঝে মাঝে তাকে বিব্রত করছে। সামান্য অস্বস্তিও বোধ করছে। এ সব অনুভূতি একই শরীরে খেলা করে বেড়ালে সে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এবং সে জানে কবিতা পাঠ প্রথম তাকে দিয়েই আরম্ভ হবে। সে উঠে এক মিনিট সময় চেয়ে নিল নীরদদার কাছে। তারপর বলল, আজ কিন্তু সবার শেষে আমি।

নীরদদা আবারও হাত তুলে ওকে বসতে বললেন। তিনি সুন্দর বর্ণনা সহকারে কবিতার কথাবার্তা বলতে পারেন। এবং বলতে বলতে ভারি নিমগ্ন হয়ে যান। চারপাশে কোথাও দুঃখ—টুঃখ আছে বোঝাই যায় না। এই বড় শহরে ফুটপাতে লোক থাকে, একবেলা আহার জোটে না মানুষের, মৃত্যু এবং ঈর্ষা অথবা অনুতাপে দগ্ধ হয় শহর—এখন এই সরু গলির অন্ধকারে টের পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় সর্বত্রই ফুল ফুটে আছে। কেবল কবিতা পাঠই মানুষের একমাত্র কাজ।

নীরদ হাজরা বলে চলেন, শরীর মন ঈশ্বর অথবা যন্ত্রণা মানুষের কবিতার বিষয়বস্তু হতে পারে। কবিতা দুঃখ জাগায়। কিছু না পাওয়ার দুঃখ থেকেই কবিতার জন্ম। আমরা নিয়তি—তাড়িত, অথচ কখনও পরাজিত হতে চাই না।

ফুল্লরা তখন শাড়ি টেনে পা ঢেকে দিল। ফুল্লরা আলতা পরেছে। ফুল্লরা আজ চুলে শ্যাম্পু করেছে। ওর চুল সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে। কবিতা পাঠের সময় ফুল্লরার খুব ঘাম দেখা দেয়। দুটো রুমাল ওর বটুয়াতে থাকে। একটা ঘামের আর একটা গন্ধের। গন্ধের রুমাল বের করে সে চশমা মুছছে।

গুঁফো কাশীনাথের চোখ ট্যারছা হয়ে যাচ্ছে। সে বার বারই জয়ার পিঠের খালি অংশটা দেখার চেষ্টা করছে। সুড়সুড়ি লাগছিল জয়ার। সে শাড়ির আঁচল টেনে ভালো করে পিঠ ঢেকে দিল।

এবং গুঁফো কাশীনাথ ভাবল এই মেদ মাংস ভেদ করে একটা ফুসফুস থাকে মানুষের। অন্তঃকরণ থাকে পাশে। দুটোই এখন জ্বলছে আর নিভছে। এবং শরীরে করাত চালালে দুটো আলাদা ভাগে ফুসফুসের অর্ধাংশ, অন্তঃকরণ সবটাই একদিকে, পাকস্থলী, মূত্রাশয় সব সমান দু’ভাগ হয়ে যায়। সে পাশাপাশি বসা দুজন মেয়ের শরীর ভাগ করে দেখছিল। সে অ্যানাটমির ছাত্র। মেয়েদের দেখলেই ফুসফুস এবং জরায়ু দুটোর রঙের কতটা আসমানজমিন ফারাক বুঝতে পারে।

কালিদাসের কাছে জয়া দেবীর মতো। নাকে নথ পরে থাকলে জয়াকে সরস্বতী ঠাকুরণ ভাবা যেত অনায়াসে। বসার ভঙ্গিটা ঠিক তেমনি। জয়ার বুক ভারী উঁচু এবং প্রবল। শাড়ির অভ্যন্তরে থাকতে চায় না যেন। সে চুরি করে এখন মাঝে মাঝে তাই দেখছে।

এবার কবিতা পাঠ আরম্ভ হোক, নীরদ হাজরা বলে উঠলেন।

তখনই গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল দরজায়। জয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল।

নবীনা এখানে আসবে, কালিদাস বলেনি। জয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল। না আসবারই তো কথা। তবু চুপি চুপি ঠিক বলে রেখেছে। কালিদাস এবং বিনয় এখন আর ওর দিকে তাকাবেই না। শুধু ওরা কেন, সবাই। সে এলেই সবাই যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। নীরদদা দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে গেলেন। এবং নবীনা যখন এল, প্রায় সম্রাজ্ঞীর মতো। নবীনাকে এলিভেটেড সু পরতে হয় না। ঈশ্বর আসল জায়গাতেই জয়াকে মেরে রেখেছে। সে কেবল তীব্র ঈর্ষাবোধে কাতর হতে থাকল।

নবীনা সবাইকে এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ নীরদদাকে তুই তুকারি করে। এমন একটা ভঙ্গি কথাবার্তায় অথবা চালচলনে, যে সে এই সব যুবকদের থোরাই কেয়ার করে। যেন এদের সবার জন্যে সে কিছুটা দিতে পারে। কার জন্যে ঠ্যাং, কার জন্যে জঙ্ঘা, কার জন্য বুক, চিবুক অথবা ঠোঁট সবাই কিছুটা কিছুটা পাবে, সবটা পাবে না। সবটা সে কোনো একজনকে দিতে পারে না। জয়া কিন্তু সবটা একজনকেই দিতে পারে। জোর জবরদস্তি না করে দু’মাস আগের এক সকালে ওর চোখে মানু চুমো খেয়েছিল। মানুটা এত বোকা! বুঝতে এত সময় নেয় কেন তার মাথায় আসে না। সে কেমন নীরস গলায় বলল, নবীনাদি, তোর আসতে এত দেরি কেন রে!

আর বলিস না ভাই। উমাশংকর এসেছিল। উঠতেই চায় না। ওর কোথায় জলছবির কারখানা আছে, ওটা দেখাতে নিয়ে যাবে। প্রেস খুলেছে নতুন। কবিতার বইয়ের জন্য ঝোলাঝুলি করছে।

ফানটুস! ভেতরে এই একটা শব্দ বেলুনে পিন ফুটিয়ে দেবার মতো বের হয়ে গেছিল প্রায়। সে বলল, তোর মাইরি ভাগ্য বলতে হবে।

কালো মতো, রোগা মতো মেয়েটা বলল, নবীনাদি তোমার মতো ভাগ্য ক’জনের আছে। আমাদের একটা কবিতার বই ছাপিয়ে দাও না।

হবে হবে। বলে পা আলগা করে বসে পড়ল নবীনা। তারপর বলল, এখনও আরম্ভ হয়নি।

হবে এবার। তুমিই আরম্ভ কর। নবীনা থাকলে আর কারও যেন আরম্ভ করার অধিকারই নেই। নবীনা আসায় নীরদদা গর্বে ডগমগ করছেন। ফুল সেসান! নীরদদা গৃহকর্তার দিকে তাকালেন। এ সময়ে একরাউন্ড চা হলে মন্দ হয় না। গৃহকর্তা কোঁচা দুলিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

জয়ার মনে হল, আজই সব সে একজনকে দেবে। দিয়ে দেখবে কবিতার চেয়ে কত বেশি তীব্র সুখ। এবং এ সময় মানুর জন্যে প্রবল টান বোধ করল। মানুকে বাড়ি ফিরেই ডেকে পাঠাবে। তার চোখ মুখ উত্তাপে জ্বলছিল। যেন প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে জ্বর আসছে। রোমকূপে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিচ্ছিল। সে আর সত্যি বসে থাকতে পারছে না। কবিতা—ফবিতা মাথায় উঠেছে।

নবীনা তখন বলল, কী রে জয়া, শরীর ভালো নেই! এমন করছিস কেন?

জয়া বলল, বোধহয় ভালো নেই।

কালিদাস, বিনয় এবং অন্য সবাই বুঝতে পারছে সেই রোগটা বুঝি দেখা দিয়েছে জয়ার। নবীনা এলেই জয়ার অস্বস্তি ফুটে ওঠে।

নীরদদা বললেন, পাখাটা জোরে চালিয়ে দাও অমিয়। জয়া বড্ড ঘামছে।

নীরদদা চায়ের কাপগুলো এগিয়ে দিচ্ছিলেন! নবীনা ঝুঁকে আছে তার কবিতার ওপর। কাশীনাথ পাতা উলটে যাচ্ছে। বিনয় কালিদাস ফিস ফিস করে কী সব বলছিল। বিনয় উঠে চা এগিয়ে দিল জয়াকে, ফুল্লরাকে। আবার বসে পড়ে সেই ফিস ফিস কথাবার্তা আরম্ভ করলে জয়া ধমকে উঠল, ভালো হচ্ছে না বিনয়। কী যা তা সব বলছ, শুনতে পাচ্ছি।

তোমাকে বলছি না।

যাকেই বলছ, সে আমার গোত্রের।

কালিদাস বলল, নো আর সত্যি কথা নয়। কবিতা পাঠ এবার কার?

কাশীনাথ তাকাল নীরদদার দিকে। শেষের দিকে হলে কিছুটা অসম্মান সে ভেবে থাকে। এবং নীরদ সেটা জানে।

নীরদ বলল, কাশী এবার তুমি পড়ো। গম্ভীর গলায় পড়ো।

জয়ার হাই উঠছিল। এখনি কবিতার গোটা শরীরটা চিরে ফেলবে হারামি লোকটা। আরে মানুষের ভেতরে কী থাকে এটা তোমার কাছে কে জানতে চায়, বাইরে সে কী ভালোবাসে তার কথা বল। জয়া হয়তো বলেই ফেলত ধমাস করে, নীরদদা উঠি। ভাল্লাগছে না। এবং তখনই মানু মাথার ভেতরে হেঁটে যায় তার। সে বুঝতে পারল তার কবিতার গভীরতা একমাত্র এই বয়সে মানুই প্রথম পরিমাপ করে দেখতে পারে।

কাশীনাথ দুবার গলা খেকারী দিল। তারপর বলল, একটু জল।

একগ্লাস জল হোস্ট ব্যক্তিটি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে আনল।

কাশীনাথ জল খেল চুক চুক করে।

এই জল, বলে সে কবিতার লাইনটা দুবার দুরকমভাবে ঘুরিয়ে বলল, জল এই, এই জল। ভেতরে যতদূর যায়। দেখবে গভীর হলুদ অন্ধকার। আরও নীচে তার কোনো পরিমাপ নেই।

কাশীনাথের কবিতায় পরিমাপ শব্দটির খুব বেশি বোধহয় ব্যবহার আছে। জয়া কী তবে গভীরতা পরিমাপ করার ব্যাপারে কাশীনাথের কবিতা থেকে ইনফ্লুয়েন্সড হয়েছে। ভাবতেই গা—টা কেমন গুলিয়ে উঠল জয়ার। সে উঠে বলল, দাদা যাই।

সে কি!

হা হা করে উঠল সবাই।

আমার শরীরটা ভালো নেই।

কেন কী হল!

ঠিক বুঝতে পারছি না।

নবীনা বলল, জয়া তোমার কবিতা শুনব বলে এত কাজের ভেতরেও চলে এলাম।

আর একদিন শুনবে।

নীরদ ঠিক বুঝতে পারল না কেন জয়ার শরীর খারাপ, কেন সহসা কবিতা পাঠের আসর ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। জয়াকে আজ ইচ্ছে করেই শেষের দিকে রেখেছে। মেয়েটা সত্যি কবিতা ভালো লেখে। এবং সবার শোনার আগ্রহ থাকে। অন্য সময় ভালো কবিতা দিয়ে সে আরম্ভ করে দেখেছে সবাই কোনো অজুহাত দেখিয়ে কবিতা পাঠ শেষ না হতেই চলে যায়। এবং যারা নতুন, অথবা কবিতার মুদ্রাদোষে আক্রান্ত, খবর পেলেই গন্ধে চলে আসে যারা, ফাঁকা মাঠে পড়ে যায়। সুতরাং নীরদ এবার ভেবেছে, ভালো সবকিছু শেষের দিকে।

কালিদাস বলল, এই বোস, আমি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসব।

কোথায়?

যেখানে যাচ্ছিস রাগ করে।

সেটা কতদূর যখন জানিস না, কথা বলিস না বোকার মতো।

নীরদদা বলল, তোমার যাওয়া উচিত হচ্ছে না জয়া। বরং তুমি তোমার কবিতা পড়েই যাও। কাশীনাথের হলে তুমি পড়বে।

জয়া হেসে ফেলল। আচ্ছা নীরদদা আপনি কী!

কেন বলত!

আপনি আমাকে কী ভাবেন! কেমন গম্ভীর গলা জয়ার।

নীরদ বললে, কী ভাবি!

খুব ছেলেমানুষ ভাবেন!

ধুস, মেয়েরা বারো পার হলেই আর ছেলেমানুষ থাকে না। তোমার তো সে হিসেবে অনেক বয়েস।

গাছ—পাথর নেই।

গাছ—পাথরের কথা বলতে চাই না। এ—বয়সে মেয়েরা নিজের সম্পর্কে খুব সচেতন হয়ে ওঠে এটা বুঝি।

কাশীনাথ কবিতার খাতা বন্ধ করে দিয়ে বলল, আপনারা আর কতক্ষণ কথা বলবেন?

নীরদ খুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল কথাটায়। সত্যি যখন কবিতা পাঠ হচ্ছে, এভাবে জয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় পরেও পাওয়া যাবে। সে বলল, আচ্ছা তা হলে জয়া তুমি যাও।

জয়া বাইরে এসে ভাবল কাজটা অনুচিত হয়েছে, আসলে সে যে কেন বলেছিল দাদা আমার কিছু ভালো লাগছে না বুঝতে পারছিল না। এখন মনে পড়ছে মানুর জন্য সত্যি মনটা খারাপ হয়েছিল। একা সিনেমায় ছেড়ে চলে এল, মানু কত কিছু ভাবতে পারে। মানুকে তার খুব ভালো লাগে। লম্বা হাত পা, চোখ বেশ সুন্দর, এবং চুলে কী যে তার মহিমা আছে, এখন যে হাড়ে হাড়ে সে এটা টের পাচ্ছে। সে তখনই দেখল পেছনে কালিদাস ছুটে আসছে। কালিদাস হাঁকছে, এই জয়া দাঁড়া।

জয়া দাঁড়াল না। হন হন করে হাঁটতে থাকল। কেমন বেহায়াপনা আছে কালিদাসের ভেতর।

কী রে শুনতে পাচ্ছিস না।

জয়া গলির মোড়ে এসে দাঁড়াল। কালিদাস কাছে এলে বলল, কীরে এত চিল্লাচ্ছিস কেন!

চল তোকে আমি এসকট করি।

আর কিছু করবি না?

করতে দিলি কই।

জয়া বলল, সব এত সোজা ভাবিস কেন? জয়াকে ভীষণ গম্ভীর দেখাল। জয়ার উঁচু হিলের জুতোর ফাঁকে গোড়ালিটা দেখা যাচ্ছে। কী লাবণ্য এই পায়ে। কালিদাসের উপুড় হয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু মেজাজ মনে হচ্ছে সত্যি জয়ার ভালো না। সে পাশাপাশি হাঁটতে থাকল শুধু। কী কথা বলবে ঠিক বুঝতে পারল না।

অগত্যা যা হয়, কবিতার কথা। এবং দুটি একটি টিপ্পনি কাটল নবীনা সম্পর্কে। কাশীনাথ বুড়ো হাবড়া জাহান্নামে যাওয়া সব চিন্তা ভাবনা, যুবতীদের শরীর নিয়ে এত হ্যাংলার মতো লেখার কী আছে—এসবই কথা প্রসঙ্গে জয়াকে বলতে থাকল। জয়া কখনও না কখনও হাঁ করে যাচ্ছে। এবং ট্রাম স্টপ আসতেই প্রায় চলন্ত ট্রামে লাফিয়ে উঠে গেল। এবং হাত নেড়ে কালিদাসকে টা টা করল। কালিদাস কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে দেখল, ট্রামটা বেশ দ্রুত চলে যাচ্ছে। জয়ার শাড়ির আঁচল অতি অল্প হাওয়ায় উড়ছিল, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল। জয়ার তো এ—ট্রামে ফেরার কথা নয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *