Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

‘আয়রে আয় ছেলের দল মাছ ধরিতে যাই’— বাংলাভাষার শিশু-ভোলানো ছড়ার জালে ঝলমল করছে নানা বর্ণের, নানা আকারের মাছ। দাদার হাতে কলম ছিল ছুড়ে মেরেছে, কারণ ও-পারেতে রুই-কাতলা ভেসে উঠছে। তাতে রুই-কাতলার মতো বড় মাছের কোনও ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না; কিন্তু দাদার কলমটা গেছে। অত বড় মাছ চোখে পড়ার উত্তেজনায় এটা হয়েছে। তা ছাড়া, মাছ ধরেও যে খুব সুবিধে হয়েছে সব সময় তা নয়— সেই একবার তো শুধু ধরা মাছটাই চিলে নিয়ে গেল তাই নয়, মাছ ধরার ছিপটাও নিয়ে গেল কোলাব্যাঙে।

কেবল ছড়ার ছন্দলহরী নয়, আমার বাল্যস্মৃতি ভরে আছে মাছের ঘ্রাণে। সে ঘ্রাণ শুধু কাঁচা মাছের আঁশটে গন্ধের নয়, তার পাশাপাশি রয়েছে সারা বাড়ি উঠোন-অন্দর-বাইরে ভ্রাম্যমাণ মাছ ভাজার বা সাঁতলানোর ভারী সুঘ্রাণ এবং সর্বোপরি মশলা ও মদের গন্ধ-মেশানো মাছের চারের মৌতাত।

আমার ছেলেবেলার পূর্ববঙ্গীয় মফস্বলে মাছকে সীমাবদ্ধ করা উচিত হবে না। ‘বাঙালীর জীবনে নারী’র মতোই চাঞ্চল্যকর গ্রন্থ রচনা করা যায় ‘বাঙ্গালীর জীবনে মাছ’ নাম দিয়ে। আমাদের জীবনচর্চায় মাছ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। মাছ দশাবতারের প্রথম অবতার। পুজো-পার্বণে, আহারে-বাসনে মাছ অপরিহার্য। সরস্বতী পুজোয় যে জোড়া ইলিশকে বরণ করতে হবে তাকেই কপালে সিঁদুরের ফোটা পরিয়ে মঙ্গলাচরণ করে বিদায় জানাতে হবে বিজয়া দশমীতে।।

অন্নপ্রাশনে ভাতের শিশুর মুখে ছোঁয়াতে হবে এক টুকরো মাছ। ভোজের পাতে নিমন্ত্রিতদের খাওয়াতে হবে অন্তত দু’রকম মাছ— একটা সরষেবাটা ঝোল, আর-একটা ঘি-গরমমশলা দিয়ে। তা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে অসুখ সারার পর অন্নপথ্য হবে একটু গলা ভাত আর লেবুর রস দিয়ে কাঁচকলা সেদ্ধ সহযোগে মাগুর বা শিঙি মাছ দিয়ে। মাছ পাঠাতে হবে বিয়ের তত্ত্বে, আশীর্বাদে, পাকা-দেখায়। ঝালে-ঝোলে-চচ্চড়িতে বিয়ের ভোজ হবে জমজমাট। মরার পরেও মাছ; শ্রাদ্ধ মিটে যাওয়ার পরে মৎস্যমুখী হবিষ্য-উত্তর নিয়মভঙ্গ।

বৈষ্ণব কবিরা নিরামিষ, নিকষিত হেম ছিলেন। কিন্তু মঙ্গলকাব্যে মাছের ছড়াছড়ি। ঈশ্বর গুপ্ত থেকে বুদ্ধদেব বসু তপসে মাছ থেকে ইলিশ মাছ— বাঙালি কবিরা মাছের জয়জয়কার করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছন্দের নমুনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘পাতলা করে কাটো সখি কাতলা মাছটিরে’। তাঁরই ছড়ায় খেঁদুবাবুর এঁদো পুকুরে মাছ ভেসে ওঠায়, সেই মরা মাছের চচ্চড়িতে পদ্মমণি লঙ্কা ঠেসে দিয়েছিল।

বাংলা সিনেমায় এমন কোনও নায়ক নেই যিনি কোনও-না-কোনও ছবিতে মাছের মুড়ো চিবিয়ে খাননি। এখনও এমন কোনও দিন নেই যেদিন বাংলা খবরের কাগজে মাছ নিয়ে কোনও সংবাদ থাকে না। সে সংবাদ বাংলাদেশের ইলিশ নিয়েই হোক অথবা সুন্দরবনে গলদা চিংড়ি প্রকল্পের সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে হোক।।

মাছ ধরা ভেতো বাঙালির প্রিয়তম শখ। এ-শখ নাগরিক জীবনে তেমন পূরণ হয় না। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে এমন কোনও বাড়ি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব, যে-বাড়িতে মাছ ধরার ছিপ নেই। মহানগরেও আছেন অদম্য মৎস্যশিকারিরা, যাঁরা দিনের পর দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা বহুমুল্য একশো টাকার টিকিট কেটে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন পুকুরের জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরার আশায়— যদিও মাছের দেখা মেলে ক্বচিৎ-ক্বদাচিৎ।

এক মিউনিসিপ্যাল পুকুরে বিনা অনুমতিতে মাছ ধরার অপরাধে এক ভদ্রলোক ধরা পড়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, সেই ভদ্রলোক, যিনি কখনও বঁড়শিতে মাছ ধরতে পারেন না, সেদিন দুটো ছোট মাছ ধরেছিলেন। অন্যান্য দিন যখন কোনও মাছ তিনি ধরতে পারেন না, তখন লজ্জায় বাজার থেকে দুটো মাছ কিনে নিয়ে যেতেন; বাসায় গিয়ে বলতেন, ছিপে ধরেছি। তাঁর সহধর্মিণী কিন্তু এই চালাকি ধরে ফেলেছিলেন, ফলত যথারীতি নানারকম গঞ্জনা, টিটকিরি। আজ মিউনিসিপ্যাল পুকুরে ধরা পড়ার পর বিনা অনুমতিতে মাছ শিকার করার অপরাধে তাঁর পঞ্চাশটাকা জরিমানা হল; অবশ্য শিকার করা মাছ দুটো তিনি ফেরত পেলেন। আজ হাসিমুখে পঞ্চাশটাকা জরিমানা দিয়ে জরিমানার রসিদ হাতে করে বাড়ি ফিরলেন, দজ্জাল বউকে দেখাবেন, ‘এ মাছ ধরা মাছ না কেনা মাছ, এই রসিদ দেখো।’

মাছ শিকারের হাজারো গল্প। সবাই কিছু কিছু জানে, আমিও অনেক শিখেছি। সবচেয়ে বেশি গল্প— যে মাছ বঁড়শিতে আটকে ছিল কিন্তু ডাঙায় তোলা যায়নি, তার আগেই পালিয়ে ছিল— সেই মাছ নিয়ে। গল্পে এই সব মাছের আয়তন সাধারণত খুবই বড় হয়। এক ভদ্রলোক তাঁর ছিপ থেকে ছুটে-যাওয়া মাছের দৈর্ঘ্য একেক জনকে একেক রকম দেখাতেন।

এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কী আর করব? যে যেমন বিশ্বাস করে তাকে সেইরকম বলি।’ অন্য একজন এই সব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধার ধারতেন না। তাঁর ছিপের ছুটে-যাওয়া মাছ ক্রমশ বড় হতে লাগল, দেড় হাত থেকে দু’হাত-আড়াই হাত শেষে চার হাতে পৌঁছল।

তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ‘পলাতক মাছটা যে জলের মধ্যে বড় হচ্ছে। যেমন-যেমন বড় হচ্ছে, তেমন-তেমন দেখাচ্ছি।’

Pages: 1 2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *