নবাবগঞ্জের বাজারে
গান্ধারী বোধ হয় আজও এল না।
মাসখানেক আগে নবাবগঞ্জের বাজারে দেখা হয়ে গেছিল অনেকদিন পরে হঠাৎ-ই। ওর স্বামীর বিস্কিট-রঙা কন্টেসা গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল মকবুল মিয়ার লুঙ্গির দোকানের সামনে। ড্রাইভার বোধ হয়, তার নিজের জন্যে লুঙ্গি কিনতে নেমেছিল। বাজার হয়ে গেছিল গান্ধারীর। ওর স্বামী ছিল না সঙ্গে।
কতগুলো গাড়ি ওদের কে জানে? মানে ওর নিজের আর ওর স্বামীর মিলিয়ে। গোটা সাতেক তো হবেই।
অনেক বছর বিয়ে হয়েছে গান্ধারীর। পাটনাতে। বিয়ের পরদিন থেকেই কখনোই ওর স্বামীর সঙ্গে দেখেনি ওকে তক্ষ। ওর স্বামী এখন বিরাট কন্ট্রাক্টর, পাটনার। প্রাসাদোপম বাড়ি। একবার কোনো ব্রিজ বা রাস্তার নামকরণের বা উদবোধনের জন্যে, কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এসেছিলেন পাটনাতে। তখন গান্ধারীর স্বামীর বাড়ির প্রকান্ড হলে এই প্রেস কনফারেন্সটা হয়। ফলোড বাই ককটেইলস অ্যাণ্ড ডিনার। স্কচ খাইয়েছিল ওর স্বামী। অতজনকে। সেদিন-ই প্রথম দেখেছিল ওর স্বামীকে। বিয়ের দিনে তক্ষ ছিল না এখানে। হৃষ্টপুষ্ট হাসি-খুশি ভালোমানুষ চেহারা। জীবনের কোনো যুদ্ধে হারতে হয়নি ভদ্রলোককে। ভাগ্যবান। এবারে জোর গুজব যে, অ্যাসেম্বলি ইলেকশনে টিকিট পাবেন উনি। সাংবাদিকদের কাছেই শোনা যে, চাণক্যপুরীতে ভদ্রলোকের একজন নেপালি রক্ষিতাও আছে। হয়তো হবে। গান্ধারীর মুখের মধ্যে কেমন যেন, গভীর দুঃখ মাখানো আছে। স্বামীর রক্ষিতা না থাকলেও স্ত্রীর নানারকম দুঃখ থাকতেই পারে। স্বামীরও পারে। বিয়ে করেনি নিজে যদিও, তবু জানে যে, দাম্পত্য ব্যাপারটা বড়ো গোলমেলে। বাইরে থেকে উঁকি মেরে কখনোই ঠিক বোঝা যায় না। সাংবাদিকদেরও কিছু কিছু ব্যর্থতা থাকে খবর সংগ্রহের ব্যাপারে। দাম্পত্যের খবর তারমধ্যে অন্যতম। এই এলাকাটুকুতে ওরা বিশুদ্ধ কল্পনা ও রসালো গুজবের ওপর নির্ভর করেই বোমাবাজি করে যায় অবলীলায়।
কে জানে, গান্ধারীও হয়তো তক্ষর মতোই সেক্স-স্কার্ভড। কে জানে, কেন সেদিন তক্ষর কাছে আসতে চেয়েছিল ও? ওকে দেখেই গাড়ি থেকে নেমে গান্ধারী বলেছিল, ঝিরাটোলিতে এসেছিলাম কাল। মাকে দেখতে। এক্ষুনি পাটনা ফিরে যাচ্ছি। আগামী শনিবার আসব আবার। প্রায়-ই তো আসি। থাকো কোথায় তুমি? দেখতেই পাই না। তুমিই সেই কারো নদীর পাশের পোড়ো বাড়িটাতেই থাকো তো এখনও? বিয়ে করেছ?
হুঁ। ওই বাড়িতেই। বিয়ে? না।
তক্ষ বলেছিল।
এখনও ব্যাচেলার? হেসে বলেছিল গান্ধারী। তারপর বলেছিল জানো তো একটা কথা আছে! ‘আ ব্যাচেলার ইজ দ্যা স্যুভেনির অফ আ উইম্যান হু হ্যাড ফাউণ্ড আ বেটার ওয়ান অ্যাট দ্যা লাস্ট মোমেন্ট।‘
তারপর চোখ থেকে সানগ্লাসটা নামিয়ে চোখে চোখ রেখে বলেছিল, তাহলে তো তুমি আগের-ইমতো একা।
হ্যাঁ। আর তুমি? তুমি কি নও? আমরা সকলেই একা। আধুনিক শিক্ষিত মানুষমাত্রই একা। সে বিবাহিতই হোক কী অবিবাহিত। ভীষণ-ই একা।
তোমার কাছে আসব ডে-স্পেণ্ড করতে একদিন।
আসবে? এসো। খুশি হব।
বিব্রত হবে না তো? কলঙ্ক-টলঙ্কর ভয় কি এখনও করো?
হাসল তক্ষ। অনেক দিনের পুরোনো একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল।
ও কিছু বলার আগেই গান্ধারী বলেছিল, রবিবারে যাব?
হ্যাঁ। ওঃ না, না রবিবারে নয়, মঙ্গলবার।
মঙ্গলবারে কি তোমাদের ছুটি?
হ্যাঁ।
তাহলে মঙ্গলবারেই আসব। সারাদিন থাকব।
আসবে কীসে? আমার ওখানে তো গাড়ি যায় না। খোয়াইয়ের পথ। স্কুটারটা কোনোক্রমে পার করিয়ে নিয়ে যাই আমি। তবে সাইকেলরিকশা যায় হেলতে-দুলতে।
গাড়ি কেন? আমি সাইকেলরিকশা করেই যাব।
তাই-ই এসো গান্ধারী। ফেরার সময় না-হয় আমি স্কুটারে নামিয়ে দিয়ে আসব এখন।
টেবলে-এর সামনে এসে বসে সিগারেট ধরাল একটা তক্ষ। মঙ্গলবারেও এল না তবে। না এলে; না এল। গান্ধারীর বয়স এখন আটত্রিশ-উনচল্লিশ হবে। আর তক্ষর বেয়াল্লিশ। শুধু গান্ধারীই কেন, তার জীবনে সতেরো বছর বয়স থেকে বিহার-বাংলা এবং দিল্লিরও বিভিন্ন শহরে, গ্রামে এবং গঞ্জে অনেকেই তার কাছে আসবে বলে কথা দিয়ে, আজ অবধি আসেনি। থাকবে বলে, থাকেনি। এখন এই না-আসাটাতে অভ্যস্তই হয়ে গেছে। বিধাতা তক্ষকে কুৎসিততম করে গড়েছেন। মেয়েরা তার চেহারার কদর্যতা দেখেই চিরদিন-ই তাকে এড়িয়ে গেছে, দূরে রেখেছে; মিথ্যাচার করেছে চিরদিন তার সঙ্গে। তার মনের সৌন্দর্য’র খোঁজ কেউই নেয়নি। কহবতই আছেঃ ‘পহিলে দর্শনধারী, পিছলে গুণবিচারি। তার কাছ থেকে হাজারো সুবিধে নিয়েছে। ছেলেবেলায় তাকে দিয়ে নানা ধরনের জিনিস বইয়েছে। আর বড়ো হওয়ার পর বদনাম। তাদের প্রেমিকের পাংচার হয়ে-যাওয়া সাইকেল, অথবা তাদের বিজাতীয় ঘামের গন্ধ-ভরা নেভি-রু গরম-ব্লেজার। একজন মেয়ে তো তার নিজের সন্তানের পিতৃত্বর দায় পর্যন্তও বইয়েছিল তক্ষকে দিয়ে। অবশ্য অল্পদিন। পরে বীরপুঙ্গব জেনুইন পিতা এসে তার ভার লাঘব করে। তাতেও আপত্তি করেনি তক্ষ রায়। ও সর্বংসহ হয়ে গেছে। তবুও এখনও ভালোবাসে ও মেয়েদের। এতরকম বঞ্চনা, শঠতা সত্ত্বেও মেয়েদের ‘ভালোত্ব’ সম্বন্ধে তক্ষ রায় যতখানি নিঃসন্দেহ, হয়তো খুব কম পুরুষমানুষ-ই ততখানি।
গান্ধারী আসবে না। জানত ও।
ইদানীং দাড়ি কামাবার সময়ে মাঝে মাঝেই আয়নাতে নিজের মুখটা দেখে ও। মাস ছয়েক হল এই বদভ্যাস হয়েছে। বেয়াল্লিশ মাইনাস ষোল; মানে গতছাব্বিশ বছর দাড়ি কামাবার সময়ে চোখ বন্ধ করেই কামিয়েছে প্রায়। ওর শোয়ার ঘরে তখন থেকেই কোনো আয়না রাখা নেই। মানে ষোলো বছর বয়স থেকে। আজও নেই। বাবা ও মা মারা যাওয়ার পর যখন, কুহমিতলির বাড়ি বিক্রি করে দেয় তক্ষ তখনও শুধু মায়ের ঘর থেকেই একটি আয়না পাওয়া গেছিল। তক্ষর বাবাও অত্যন্ত কুৎসিত মানুষ ছিলেন। ফর্সা গায়ের রঙের গ্রেস নাম্বার পুরো পাওয়া সত্ত্বেও যে, কোনো মানুষের মুখের দিকে চেয়েই অন্যে আঁতকে ওঠে এমন করে, তা তক্ষ নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতে না জানলে হয়তো জানতই না। সুন্দর নয়, মোটামুটি চলনসই একটি মুখ নিয়ে জন্মালেও বিধাতার কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ থাকত না। বেয়াল্লিশ বছর বয়স অবধি কোনো নারীর শরীরের ভাগীদার না হতে পারার যে, কী মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা তা, তক্ষর মতো কেউই জানে না। কে জানে? জানে কি কেউ? পুরুষদের কষ্ট, পুরুষরাই জানে।
শরীরের যন্ত্রণার লাঘব সহজেই করতে পারত। যে-পথ দিয়ে ও বাড়ি ফেরে সেই পথের বাঁ-দিকের গলি দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই ঝিরাটোলির কুখ্যাত টোলি। লোকে বলে ঘুঙ্টটোলিতে যাওয়ার কথা, তক্ষ ভাবতে পর্যন্ত পারে না। ছিঃ ছিঃ। কী করে যে, যায় মানুষে? শিক্ষিত মানুষে? ‘রুচি’ কী পথ আগলে দাঁড়ায় না তাদের? আগে-পরে কত লোক ই না যায়, সেইসব শরীরে। এমন কোনো লোক, যার হয়তো কোনো রোগ আছে। এমন কোনো লোক, যাকে ‘সুরজসেনা’র সম্পাদক ভার্মার-ই মতো তীব্রভাবে অপছন্দ করে তক্ষ। অথবা হয়ত এমন কেউ, যে হয়তো সুদে টাকা খাঁটিয়ে বড়োলোক। কোনো দাদআলা মানুষ।
ভাবাই যায় না।
ভাবতে পারে না ও আরও অনেক কিছুই। তাই-ই সপ্তাহে একদিন বা কখনো দু-দিনও যখন শরীরটা খুব-ই গরম লাগে, রাতে ঘুম কিছুতেই আসতে চায় না; তখন চেনা-জানা কোনো নারীকে মনে করে তক্ষ। চোখ বুজে গভীর অন্ধকারে ভরা অথবা ছমছমে চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া ঘরে তার সঙ্গে চুটিয়ে সহবাস করে। একাকী পুরুষমাত্রই জানে এইসব রাতের কথা।
তার আত্মরতির রানি কে যে, কবে হবে তার কোনো ঠিক থাকে না। গতকাল রাতে, যেমন ‘সুরজসেনা’ সাপ্তাহিকের সম্পাদকের স্ত্রী ববিতা কাপুর হয়েছিল। আবার গতমঙ্গলবারে, তার চাকর নাগেশ্বরের বউ মুঙ্গলী। সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা এই স্বপ্নের রাজ্যে। অথচ করজোড়ে ভোটভিক্ষা ছাড়াই সে নির্বাচিত করে নিজেকে, কোনো বিশেষ নারীর সঙ্গী হিসেবে। এ, যেমন এক গভীর অভিমানের জীবন। তেমন লজ্জারও। এবং শাস্তিরও। স্বপ্নের স্ত্রীদের খেতে-পরতে তো দিতে হয় না। তারা ঝগড়াও করে না কখনো। তারা অন্য কারো সঙ্গে, তক্ষর জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সহবাসও করে না। স্বপ্নে তারা শুধুই হাসে, কেউ কালো, কেউ ফর্সা, কেউ শিক্ষিতা, কেউ অশিক্ষিতা, কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে, কারো কোমর-সমান চুল, কারো বা বব করা, কারো চুলের রং কালো, কারো খয়েরি, কারো বা ঈষৎ লালচে। তক্ষ কল্পনা করে, যেহেতু চোখে দেখেনি কখনো সে, যে নারীর মাথার চুলের যে-রং, তার জঘনের নরম রেশমি চুলের রং-ও নিশ্চয়ই সেই রঙের-ই হবে। কল্পনায়, পুলকিত তাদের, খুশি বা অখুশি হওয়া কিছু ফুট বা অর্ধোস্ফুট শব্দের শিঞ্জনেও অভ্যস্ত করে নিয়েছে নিজেকে। উঃ। মরে গেলাম। আঃ তক্ষ। ইঃ তক্ষদা! ‘অসভ্য!’ ইত্যাদি শব্দ; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্য। যার মুখে, যে-কথা মানাতে পারে বলে মনে করে, তার মুখে সেইরকম কথাই বসায়। কল্পনায়, বৈচিত্র্য আনতে কারো মুখে বা বসায়, কিচ্ছু পারে না, ওয়ার্থলেস একটা। এক আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য কল্পনার জগতে বিচরণ করে হতভাগ্য তক্ষ, রাতের পর রাত, অ্যালিসের মতো। ভাগ্যবতী অ্যালিস। সে শিশু। শিশুরা ভগবানের ই মতো পবিত্র। যুবতী হলে তার ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড অন্যরকম হত।
তবু, সবকিছু সত্ত্বেও কল্পনাতে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, এইভাবে পুরুষের বড়োই যন্ত্রণার শরীরের পাপ বয়ে বেঁচে থাকা বড়োই কষ্টের। মেয়েদের কথা তারাই বলতে পারেন। পুরুষদের কথাই জানে শুধু ও। পুরুষমাত্রই তক্ষর এই সরল স্বীকারোক্তির ন্যাংটো অসহায়তার কথা বুঝে তক্ষর প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। ও ভাবে।
কিছুদিন আগে একজন সাবএডিটর এসেছিল এলাহাবাদ থেকে বদলি হয়ে। পাঞ্জাবি। নামটা বলা ঠিক হবে না। সে তক্ষকে সমকামিতাতে হাতখড়ি দিতে চেয়েছিল। সভয়ে, তা প্রত্যাখ্যান করেছিল তক্ষ।
ওই শব্দটা শুনলেই বা মনে এলেই গা গোলায় ওর। ভাবতে পর্যন্ত পারে না।
যা পারে, তাই-ই ভাবে।
তার জীবনে কোনো নারী কি কখনো আসবে? সত্যি নারী? রক্তমাংসর? কোনো প্রাপ্তবয়স্কা নারীকে নগ্ন দেখেনি তক্ষ কোনোদিনও। একবার এক বৃদ্ধাকে দেখেছিল কুয়োতলায় চান করতে। হাড়-সর্বস্ব। তক্ষ, শত উপোসি হলেও একজন শিল্পী, লেখক; নাট্যকার। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। রবিঠাকুরের ‘কেন সে দেখা দিলো রে, না দেখা ছিল ভালো’ গানটির কথা মনে হয়েছিল। স্যরি।
তবুও ওর প্রত্যাশার শেষ নেই। প্রতিরাতেই শোয়ার সময়ে এই প্রত্যাশা নিয়েই ঘুমোত যায় ও যে, কালকের দিনটা নিশ্চয়ই অন্যরকম হবে। কিছু মানুষের প্রত্যাশার কোনো সীমা পরিসীমা থাকে না।
এলাহাবাদ থেকে আসা সেই পাঞ্জাবি অ্যাসিস্ট্যান্ট-অডিটর তাকে ঠাট্টা করে বলেছিলঃ ‘কোনো রক্তমাংসের নারী এসে একদিন সত্যিই তোমার খাটে উঠবে এই প্রত্যাশা তোমার পক্ষে সত্যিই বড়োবেশি প্রত্যাশা মিস্টার রায়। দু-জন একসঙ্গে-থাকা সমকামীর প্যারাম্বুলেটর কিনে ফেলার-ই মতো প্রায়! হাইট অফ এক্সপেকটেশন।‘
শুনে, হাসেনি তক্ষ। দুঃখিত হয়েছিল।
নারীর শরীর, এদেশে তো বটেই, কোনো দেশেই সমস্যা নয়। কিন্তু যে-সে নারীকে তো চায়নি ও কোনোদিন। তার চেয়ে এমনি করেই কাটিয়ে দেবে দিন, পরিচিতা, সামান্য পরিচিতা, সদ্য পরিচিতা নারীদের সঙ্গে কল্পনার সহবাসে ভেসে ভেসে। বিধাতা প্রত্যেক পুরুষ ও নারীকে এই দুটি মাত্র দান দিয়েছিলেন কোনো বিশেষ লিঙ্গের প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব না করে। একটি হচ্ছে ঘুম। দ্বিতীয়, আত্মরতির স্বয়ম্ভরতা। বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তক্ষর।
তবে, ও এটুকু জানে যে, ওর এই একাকিত্বর জীবন, বান্ধবহীন, আত্মীয়হীন, নারীহীন জীবন ছিল বলেই, তক্ষ রায় আজকে ‘তক্ষ রায় হয়ে উঠতে পেরেছে। ওর ব্যক্তিগত জীবন যেমন, অন্য দশজনের মতো পূর্ণ নয়, ওর শিল্পর এবং সৃষ্টিশীলতার জীবনও অন্য দশজনের মতো ‘শূন্য’ নয়। সমস্তটুকু উদবৃত্ত সময়ই তক্ষ পড়াশুনোয়, লেখালেখিতে এবং গান-বাজনা শোনায় ভরিয়ে রাখে! ওর একাকিত্ব, ওর স্বজনহীনতায় নানারকম কষ্ট থাকা সত্ত্বেও, যেসব নারী ও পুরুষ ওর নিজের চেয়েও বেশি একা, নির্জন, এবং ওর চেয়েও বেশি নিরুপায়, তাদেরও জীবন নানাবিধ আনন্দে ভরিয়ে দিতে পেরেছে ও।
এইটে ভেবেই খুব ভালো লাগে ওর।
আরও ভালো লাগে ভেবে যে, যে-নারীরা তাকে পুরুষের মর্যাদাটুকু পর্যন্ত দেয়নি শুধু তার কুরূপ এবং অর্থহীনতার জন্যে, তাদের-ই কারণে সে, নিজেই জীবনপাত করে গেল। নারীমুক্তির প্রবক্তারা যদি, একজনও জানতেন যে, তাদের প্রজাতির একজনের মাত্র অপেক্ষায় বসে থাকা একজন নারীমুগ্ধ-পুরুষ এক নিঃসঙ্গ বন্দিত্বের জীবনযাপন করছে?
একজনও কি জানেন না? এই ‘মুক্তি’ নিয়ে কী করবেন তাঁরা? তক্ষর স্বপ্নর কারাগার থেকে মুক্তি নেই কোনো নারীর। চিরদিন-ই তাঁরা তক্ষর বন্দিনি হয়েই থাকবেন।
বেলা পড়ে এল। ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে’ কিন্তু সুরে সুরে সুর মেলাতে তো কেউই এল না। ঝটি জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে বাইরে এসে, তিতিরগুলো গলার শিরা ফুলিয়ে ডাকাডাকি শুরু করেছে। পুবে, কারো নদীর মধ্যে একটি দহ-মতো আছে। সেখান থেকে একদল ছন্দবদ্ধ গো-বক তাদের মসৃণ রেশমি সাদা ডানাগুলি শেষবিকেলের রোদের সিঁদুরে রাঙিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে উড়ে যাচ্ছে বিছিয়ার জঙ্গলের দিকে।
এই তিতিরগুলোর-ই ক্ষুদে ক্ষুদে বাচ্চা হয়েছিল, গত চৈত্রের শেষে। তারাই এখন দিব্যি ডাগর-ডাগরটি হয়ে উঠেছে। তক্ষ এই জানলার সামনে বসে থেকেই জেনেছে যে, প্রকৃতির মধ্যে নানারকম জিনিস লক্ষ করার আছে। প্রাণী, সরীসৃপ বা পাখিমাত্রই নীড় বাঁধে, ডিম পাড়ে। কয়েক ধরনের স্তন্যপায়ী জন্তু, যেমন হাতি, বাইসন, বুনোমোষ, শম্বর ইত্যাদির একরারা ছাড়া অন্যরাও কি ওর-ই মতো একলা কাটিয়ে দেয় সারাজীবন, প্রাণীজগতেও? নারী-সঙ্গহীন হয়ে? তা হয়তো যেমন হয় না, ওদের বাছাবাছি ব্যাপারটাও যে-নেই। এই বাছাবাছির অবাধ অধিকার সঙ্গিনী অথবা সঙ্গী-নির্বাচনের ব্যাপারে, তা কি একমাত্র মানুষের ই একচেটিয়া? যুদ্ধে দল থেকে পরাজিত, রক্তাক্ত হয়ে একা একা অপমানের সঙ্গে বিতাড়িত না হয়েও, একমাত্র মানুষ পুরুষ-ই সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, এমন একা জীবন কাটাতে পারে। এবং অনিচ্ছাতেও। যেমন তক্ষ কাটায়। অভিমান, আবেগ, কল্পনাশক্তি এসব শুধুমাত্র মানুষের-ই। অনেক সুখের মধ্যে কিছু দুঃখও আছে যা, অন্য প্রাণীর নেই।
এই আসন্ন সন্ধ্যার মুখে, অন্ধকার হয়ে-আসা ঘরে, রাশ-রাশ বইপত্রর মধ্যে লেখার টেবলের সামনে বসে, বাড়ির চারপাশের গাছেদের হ্রস্ব, দীর্ঘ এবং দীর্ঘতর হয়ে-আসা ছায়াগুলিকে শিশুর কপালের কাজলের-ই মতো, পৃথিবীর কপালে ক্রমশ লেপটে-যাওয়া দেখতে লাগল তক্ষ, শিশুর-ই কৌতূহলে। নারীহীন পুরুষে আর শিশুতে তফাত বেশি নেই। ঠিক সেই সময়েই একটি সাইকেলরিকশা এসে দাঁড়ানোর ‘কিরকির আওয়াজ শোনা গেল কাঁকর-মাটির ওপর।
রিকশাওয়ালা একবার ঘণ্টা বাজাল।
গান্ধারী বাইরে থেকেই বলল, তক্ষদা, আছ তুমি? আমি এসেছি।
তক্ষর হৃৎপিন্ড লাফিয়ে মুখে উঠে এল যেন। চেয়ার পেছনে ঠেলে দিয়েই দৌড়ে এল দরজার কাছে। ‘আমি এসেছি! আমি এসেছি! আমি এসেছি!’–ঝংকৃত হতে লাগল ওর সত্তার অলিগলিতে।
গান্ধারী তক্ষর কথার জবাব না দিয়ে, রিকশাওয়ালাকে দুটো টাকা দিয়ে বলল, বাজার সে চায়ে পিকর আনা! ঠিক ন বাজে লওটকে আনা। সমঝা?
জি মাইজি।
খুশি হয়ে বলল রিকশাওয়ালা।
আমিই পৌঁছে দিতাম স্কুটারে।
গান্ধারী হেসে বলল, পরপুরুষের গায়ের সঙ্গে গা লাগালেই আমার সুড়সুড়ি লাগে। এবং তারপর-ই সারাগায়ে ঘামাচির মতো অ্যালার্জি বেরোয়। জান?
অবাক হয়ে চেয়েছিল গান্ধারীর মুখে ও। ইয়ার্কি কি না, বোঝবার চেষ্টা করছিল।
গান্ধারী চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, সত্যি গো তক্ষদা। বিশ্বাস করো। স্কুটারে বসে গেলে তো ছোঁয়া-বাঁচানো কিছুতেই যাবে না।
তা অবশ্য ঠিক। তক্ষ বলল।
তারপর বলল, এরকম কোনো রোগের কথা তো শুনিনি আগে। আমাদের সাপ্তাহিকে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে দেব নাকি এই রোগ সম্বন্ধে? উইকলি নোটবুকেও যেতে পারে। ইন্টারেস্টিং নিউজ আইটেম। নিউজ হিসেবেও দিতে পারি আমার উইকলিতে।
না-আ-আ।
মুখটি অকারণে হাঁ করে বলল, গান্ধারী। মেয়েরা এমন কাকের ছানার মতো মুখ-হাঁ’ করলে দেখতে ভালো লাগে না। তক্ষর সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ ধাক্কা খেল।
বোসো। তাহলে ওই চেয়ারটাতেই বোসো। ওই কোণার চেয়ারটাতে। আমারটাতে বোসো । শেষে যদি আবার…।
থ্যাঙ্ক ইউ।
তা, এই রোগের সিমটমটা কী?
তক্ষ বলল।
ওই তো, বললাম যে! কী করে কনটাক্টেড হয় তাও তত বললাম। এইডস’–এর মিনি সংস্করণ আর কী।
ডাক্তাররা কোনো নাম দেননি এখনও এই রোগের? এই রোগের কোনো চিকিৎসাও বেরোয়নি?
উঁহু।
তবে? কোনো প্রতিষেধক?
প্রিভেনটিভ বলতে কোনো ওষুধ নেই, মানে এখনও বেরোয়নি। তবে, একটা কোড-অফ কনডাক্ট আছে।
সেটা কী?
‘সতীত্ব’ বজায় রাখা। পরপুরুষের ছোঁয়া একেবারেই না-লাগানো।
‘এইডস’-এর প্রিভেন্টিভের মতোই।
তাই-ই…?
তক্ষ বলল।
চোখজোড়া অন্যমনস্ক হয়ে গেল ওর। বুকের মধ্যে ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। ভাবল, আমি তো শিশুই। এমনকী কাউকে কোনো প্রাপ্তবয়স্কদের রোগও দিতে পারার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত আমার নেই।
গান্ধারী চেয়ারে গিয়ে বসল।
বলল, তোমার এই ঘরটাতে আলো বড়ো কম।
তুমি এসেছ। আলোতে তো ভরেই উঠল।
তক্ষ বলল।
তুমি না ঠিক আগের মতোই আছ তক্ষদা। সবসময়ই সকলকে খুশি করার চেষ্টা সমান-ই আছে। কী পেলে এমন করে? নিজে কি খুশি থাকো? সুখী হলে? আমার তো মনে হয়, সবাইকে যে, সুখী করতে চায়, সে, একজনকেও সুখী করতে পারে না।
গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে তক্ষ বলল, সবসময়ে করি না। সকলকে তো নয়ই। চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? দু-দিনের তো পৃথিবী! কার কাছ থেকে কতটুকু পেলাম আর পেলাম না সেটাই তো বড়োকথা নয়। কিছু লোককে খুশি করতে পারলে, আনন্দ দেওয়বার চেষ্টা করতে পারলে, সেইটেই বা কম কী? জানো গান্ধারী, আমার মা বলতেন, তকু, তোর কপালটা বড়োই মন্দ। তুইও তোর বাবার-ই মতো কুৎসিত হলি। কিন্তু কুশ্রী, সুশ্রী চেহারাতে হয় না বাবা; ব্যবহার’-এই হয়। সবসময়ে হাসবি, কথা বলতে তো পয়সা খরচ হয় না! সুন্দর করে কথা বলবি। তোর আশেপাশে যারাই থাকে, তাদের সকলকে খুশি রাখবি। এই বা কম কী! এও তো চমৎকার একধরনের বেঁচে থাকা। অন্যদের বাঁচিয়ে রাখা। তোর চেহারা যেরকম-ই হোক-না-কেন, দেখবি কত মানুষে তোকে ভালোবাসবে, কত মেয়ে তোর প্রেমে পড়বে…’
তক্ষর গলার স্বর স্তিমিত হয়ে এল। মা কি জেনেশুনেই ওকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন? অন্য সবাইকেই তো ও বাঁচাতে চায়, বাঁচিয়ে রাখে, ওকে তো একজনও বাঁচাল না! এমনকী বাঁচাবার চেষ্টাটুকু পর্যন্ত করল না।
বাঃ। তোমার মা তো চমৎকার মানুষ। তবে তোমার প্রেমে কি পড়েছিল অনেক মেয়ে?
তক্ষ হাসল।
মানে, হাসবার চেষ্টা করল।
সবে-অন্ধকার-হওয়া ঘরে টেবল ল্যাম্পটার স্বল্পআলোতে ওর কুৎসিত মুখের হাসি দেখা গেল না।
মুখ ঘুরিয়ে বলল, কী জানি! হয়তো পড়েছে। মেয়েদের ভালোবাসা! বোঝা বড়ো কঠিন। আর সময়ে বোঝা না গেলে, তা যে, ফিরে যায় নিঃশব্দ চরণে। শব্দ পেয়ে ধেয়ে গিয়েও তাকে ধরা যায় না। সে তো তখন ছায়া, স্বপ্নকায়াবিহীন। রবিঠাকুরের গানের মতোই সত্যি!
এইজন্যেই তোমার প্রেম হল না। তোমাদের রবিঠাকুর পড়তে ভালো, শুনতে ভালো, কিন্তু কোনো কাজের নয়। রবিঠাকুর জমিদারি বুঝতেন, ঈশ্বর বুঝতেন, মেয়েদের যে, খুব একটা বুঝতেন বলে, আমার কিন্তু মনে হয় না।
বলো কী? ছিঃ ছিঃ অমন করে বোলো না। ঠিক নয়। ঠিক নয়।
আলোটা এবার জ্বালো প্লিজ। অন্ধকার ঘরে ভয় করে আমার। গান্ধারী নেকু-নেকু গলায় বলল নেকু পুষুমুনুর মতো।
উঠে গিয়ে, ঘরের বড়োআলোটা জ্বালাতে জ্বালাতে তক্ষ বলল, অন্ধকারের সঙ্গে কোনো দুঃস্বপ্ন জড়িয়ে আছে বুঝি? তোমার হয়তো নেই, অনেকের থাকে।
না, তা নেই। তবে দুঃস্বপ্নময় ঘটনা ঘটাতে কতক্ষণ? সেইজন্যেই ভয়। তেমন কিছু ঘটার সময় বা বয়েস এখনও তো যায়নি। তোমার এবং আমারও।
গান্ধারী গোল তেপায়াতে নামিয়ে রাখা তার হাত-ব্যাগটা খুলে একটি বড়োপ্যাকেট বের করল। বিদেশি র্যাপিং-পেপারে মোড়া। তারপর তক্ষর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ও ব্যাংককে গেছিল গতসপ্তাহে। এনেছিল। তোমার জন্যেই নিয়ে এলাম।
কী? কী?
একটু অবাক হয়েই তুতলে বলল তক্ষ।
খুলে দ্যাখোই না।
বেশ ভারী চৌকো ও লম্বাটে প্যাকেটটি খুলে দেখল যে, কালো বাক্সে মোড়া একটি হুইস্কি। জনি ওয়াকার! ব্ল্যাক-লেবেল।
বাবাঃ এর তো নাম-ই শুনেছি। এই প্রথম চোখে দেখলাম। তা ছাড়া, আমি তো কালেভদ্রেই খাই এসব। তুমি তো জানোই। সেই তোমাদের পাটনার বাড়ির ককটেইলস-এ জোর করলে তুমি। মনে আছে?
শুধু কি হুইস্কি খেতেই জোর করেছিলাম? থাকতেও কি বলিনি পাটনাতে তোমাকে কয়েকদিন?
বাঃ। তখন কি থাকতে পারতাম নাকি? মা ছিলেন-না? মা থাকতে একরাতও কোথাও থাকার জো-টি ছিল?
আর এখন?
এখন তো মুক্ত পুরুষ। মা নেই। বন্ধন নেই কোনো। কিন্তু যে, পিছুটান চর্মচোখে দেখা যায় না, তা বড়ো ভীষণ। অক্টোপাসের-ই মতো জড়িয়ে থাকে সবসময়ে। তার বাঁধন ছাড়িয়ে কোথাও যাই, তার উপায়-ই নেই!
কী সে, পিছুটান?
কাজ।
আহা! বেশি বেশি কাজ দেখিয়ো না। কাজ যেন, আর কেউ করে না।
সে তো চাকরি, ব্যবসা…।
তুমিও তো তাই-ই করো।
আমি আমার চাকরির কাজের কথা বলিনি। প্রত্যেক পুরুষমানুষ এদেশে, কিছু-না-কিছু তো করেই জীবিকা হিসেবে, কিছু কিছু মেয়েরাও করে। জীবিকার কথা বলিনি আমি।
কীসের কথা বলছ তাহলে? তোমার লেখালেখি?
হ্যাঁ!
তা কত লেখক তো লিখেই বাড়ি-গাড়ি করেন। লেখা তো তাঁদেরও জীবিকা। জীবিকা বলে তো তাঁদের মানসম্মান তোমার চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়।
সে-কথাও বলিনি আমি। মানসম্মান, লেখক হিসেবে আমার একটুও নেই। চাইও না। টাকাপয়সাও নয়। যা-কিছু হতে চাই তা আমার অন্তরের গভীরে। কাউকে ইম্প্রেস করবার জন্যে নয়, টাকা রোজগারের জন্যেও নয়, কী করে বোঝাব তোমাকে জানি না, এই লেখালেখিই আমার ব্রত; পুজো। এই অন্তরের ‘ইমারত’ মনের ভেতরে গড়ে ওঠে, বাইরে থেকে দেখা যায় না তা। পুজোকে যদি জীবিকা করি ভগবান কী দেখা দেবেন?
গান্ধারী ডান পা-টা বাঁ-পায়ের ওপর তুলল। পায়জোর-পরা সুন্দর মসৃণ, নিয়মিত লোশন মাখা, পেডিকিয়োর-করা গাড়িতে ঘোরা বড়লোকের বউ-এর চকচকে, মসৃণ উজ্জ্বল গোড়ালি বেরিয়ে পড়ল। ওদিকে চোখ পড়তেই তক্ষর শরীরের মধ্যে তোলপাড় উঠল একটু। গান্ধারী যেন, ইচ্ছে করেই শাড়িটা হাঁটুর কাছে ডান হাত রেখে একটু তুলল। যেন, অনবধানে।
চোখ সরিয়ে নিল তক্ষ।
ঠাট্টার গলায় গান্ধারী বলল, আজকাল কি ভগবান-টগবানও মানছ নাকি? সমস্ত পৃথিবী যখন, দ্রুত এগিয়ে চলেছে সামনে তখন, তুমিই একা একা পেছনে ফেরার সাধনা করছ?
হাসল তক্ষ। বলল ভগবান আমি মানি না। আমি পাগলও নই; ইডিয়টও নই। বললাম; নেহাত কথার কথা। কমিউনিস্টরা ভগবান মানে না।
শুধু তারাই কেন? আঁতেলরাও মানেন না।
‘কমিউনিস্ট’ এবং ‘আঁতেল’ তো প্রায় সমার্থক-ই। দু-দলই অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে ভাবেন। তক্ষ বলল।
তাও ভালো। ভাবলাম, এই পোডড়াবাড়িতে দীর্ঘদিন একা থেকে, তোমার মাথার-ই গোলমাল হল বুঝি! তা আর একটু খোঁজ করলে এর চেয়ে ভালো এবং শহরের আর একটু কাছে একটা ভাড়াবাড়ি পাওয়া কি যেত না? আমার নিজের নামেই এক বিঘা জমি পড়ে আছে। তুমি চাও তো নিতে পারো। ছোট্টবাড়ি করবে একটা, সামনে ফুলের বাগান। সবুজ লন, চেরি গাছ, ঘুঘু আর টিয়ারা এসে বসবে। একটা কাঁচের ঘর থাকবে তোমার। তারমধ্যে বসে তুমি লিখবে। পয়সা দিয়েই নেবে। জলের দামে কিনেছিলেন বাবা আমার নামে, আমার যখন পাঁচ বছর বয়স। নেবে তো বলো।
কাঁচের স্বর্গ কেউ অত ঝঞ্জাট করে বানায়? ধুস…।
স্মিত হেসে তক্ষ বলল।
নেবে কি না বল?
না, না।
কেন? না কেন?
আমার ওসব ভালোই লাগে না।
ওইসব বাড়ি-টাড়ি তাও আবার জমি কিনে সেই জমিতে বানিয়ে নেওয়া। ওসব আমার জন্যে নয়। বিশ্বাস করো গান্ধারী, কোনোরকম বৈষয়িক ব্যাপার-ই আমার আসে না। জানাশোনা কতলোকেই তো বাড়ি করে ফেলল। বিয়ে করল, ছেলে-মেয়ে হল, অনেকে গাড়িও কিনল। টমসন্স কোয়ার্টারের দিকের ‘পল’-মহল্লায় উঠে গেল নতুন বাড়ি নিয়ে। ঝিরাটোলি ক্লাবে প্রতিশনিবারে তারা অনেক-ই যায়, অল্পস্বল্প মদ্যপান করে। হি-হি, হা-হা; সোশ্যাল লাইফ। এর বাড়ি ও যায়, ওর বাড়ি সে, অসুখ করলে খোঁজ নেয়, বন্ধুর বাচ্চার পেট ব্যথা হলে ডাক্তার নিয়ে দৌড়ে আসে। আমি পারি না। সভ্য, সামাজিক অন্য দশজনের মতো হতে পারলাম না।
সভ্য, সামাজিক না হতে পারো, না হলে অন্তত একটু স্বাভাবিক হতেই বা অসুবিধে কীসের। অস্বাভাবিকতাটা কোনো গুণ নয়।
দোষ-গুণের কথা নয় গান্ধারী। স্বাভাবিক না হওয়াটাই আমার স্বভাব।
সে তো লক্ষ করেছি ছোটোবেলা থেকেই। কিন্তু কেন?
আমি অন্যরকম। এই-ই…কেন যে, তা বলতে পারব না। সব মানুষ-ই কি একরকম হয়। বল?
তোমার কোনো কাজের লোক নেই?
হ্যাঁ। আছে তো। নাগেশ্বর। সে আজ ছুটি নিয়েছে। ওর মেয়ের নাকি খুব জ্বর।
মেয়ে কত বড়ো?
এই তিন-চার বছরের।
বাড়ি কতদূর এখান থেকে?
নদী পেরিয়ে মাইলটাক। ওইদিকে। বলে, হাত তুলে দেখাল তক্ষ।
বর্ষার সময়ে যাতায়াতের অসুবিধে হয় না?
হয় তবে তা আর কতক্ষণ। পাহাড়ি নদী তো। বান মরে গেলেই পেরিয়ে যাওয়া-আসা করা যায়। বর্ষায় এমনিতে যেটুকু জল থাকে তা পেরোতে অসুবিধে হয় না।
তার বউ-বাচ্চাকে তোমার এখানে এনে রাখলেই তো পারো। তাহলে ছুটি নিয়ে তার তোমাকে একা ফেলে যেতে হয় না বার বার। এমন নির্জনে একা থাকতে হয় না। সেও দৌড়োদৌড়ি থেকে বাঁচে।
.
সামান্য সময় চুপ করে থেকে তক্ষ কিছু বলবার আগেই গান্ধারী বলল, নাগেশ্বর না কী নাম বললে তোমার কাজের লোকের, তার বউটি কি খুব-ই খারাপ দেখতে?
চমকে উঠে তক্ষ বলল, হঠাৎ? একথা? কেন? খারাপ নয়তো। বরং খুবই সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতীও।
তাহলে?
তাহলে কী?
এখানে এনে রাখো না কেন?
বারেঃ ওরা কী আমার মতো? ওদের কাঁড়া-বয়েল, মুরগি-ছাগল, খেতি-জমিন আছে। কত্ত শেকড়-বাকড়। শেকড় তুলে কেউ কী আসে? নেহাতই নিরুপায় না হলে? ওদের বরং আরও অনেককে দেখেই তো শেকড় সম্বন্ধে ভীতি জন্মেছে আমার। জীবনের মতো ফেঁসে গেছে ওরা। পা আটকে গেছে মাটিতে।
যদি কেউ সব শেকড় তুলে আসে তোমার কাছে, তুমি কি থাকতে দেবে তাকে?
চমকে উঠল তক্ষ। মুহূর্তের জন্য। তারপর-ই ভয়ার্ত গলায় বলল, না না। আমি কাউকেই থাকতে দেব না। তা ছাড়া, শিকড় কেউ তুলুক, ছিড়ক, তা আমি চাই না। আমার যখন পাঁচবছর বয়েস তখন ফরিদপুরের গ্রাম ছেড়ে বিধবা মায়ের হাত ধরে এসেছিলাম আমি একদিন বিহারের এই ছোট্টশহরে, মায়ের এক দূর সম্পর্কের দাদার কাছে। দূর এবং দুঃ–ও ছিল সম্পর্কটা। তবুও আসতে হয়েছিল। গান্ধারী, শিকড় ছিঁড়ে আসতে যে, কেমন লাগে, তা আমি জানি। আমাকে পূর্ণ করার জন্যে কেউ তার শেকড় উপড়ে অন্য কোথাও গহবর সৃষ্টি করে আসুক তা আমি অন্তত চাই না। এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ পূর্ণ করতে চায় নিজেকে তবে সে যে, অন্য কাউকে শূন্য করেই করে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
নাটক লিখে, আর নাটক পড়ে তোমার কথাবার্তাও এখন কেমন ‘নাটুকে নাটুকে’ হয়ে গেছে। জানো তক্ষ, নাটক করতে মঞ্চ লাগে, মেক-আপ লাগে, রাজা-মহারাজার পোশাক লাগে, মুখের এবং চোখের ওপর তীব্র আলো ফেলতে হয়। এমন পোড়োবাড়িতে মেক-আপ হীন তোমার সঙ্গে কোনোরকম নাটক করতেই রাজি নই আমি। তুমি নাট্যকার হতে পারো, জীবন আর নাটক একে অন্যর সঙ্গে কোথায় যে, মেলে তাই-ই তুমি জানো না। থাকগে। এবারে দুটো গেলাস আনন। হাতে করে নিয়ে এলাম জিনিসটা। তোমার জন্মদিনে একটু ভালো জিনিস খাই।
আজ আমার জন্মদিন?
তাই-ই তো জানি আমি। তুমি জান না?
তক্ষর কুৎসিত মুখ বিধুর হয়ে এল এক, আশ্চর্য উচ্ছলতায়।
কুৎসিতদেরও সৌন্দর্য থাকে। শারীরিক সৌন্দর্যও। ভাবল, গান্ধারী। শুধু দেখার চোখ চাই। ঠিক মুহূর্তটিতে দেখা চাই।
তক্ষ বলল, মা থাকতে পায়েস বেঁধে রাখতেন।‘ মনে পড়ে যেত তখন। অনেক-ই বছর ভুলেছিলাম এই দিনটিকে। সেসব তো ছেলেবেলার-ই কথা। তা ছাড়া জন্মদিন তো পালিত হয় বড়ো বড়ো মানুষদের। কৃতী মানুষদের, আমার আবার জন্মদিন!
আমরা ব্রাহ্ম। কৃতী-অকৃতী সকলের-ই জন্মদিন করি আমরা। এটা একটা ট্র্যাডিশন। সকলের-ই মানা উচিত। কী সুন্দর জিনিস বলো তো। একজন মানুষ, সে যত সামান্য, যত অকিঞ্চিৎকর-ইহোক-না-কেন, বছরে অন্তত একটি দিন সে, বিশেষ কেউ হয়ে ওঠে। জীবনে, এই অনেক এবং অনেক-ইরকম দুঃখ-কষ্টর জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই করার একটা মানে খুঁজে পায়। তার চারপাশের জগতের মধ্যে হঠাৎ সে যেন, তাকে নিজের নিজস্ব মূল্যে আবিষ্কার করে। সে-মূল্য কম হতে পারে, তবু যত কম-ই হোক-না-কেন, নিজের কাছে নিজেকে কখনো-কখনো দামি না করে তুললে, কোনো মানুষ কি বাঁচতে পারে? বলো? এই কঠিন পৃথিবীতে? এই জীবনে?
এটা ঠিক নয়। তুমি নিজেকে বড়োই হেলা করো। নিজেকে একটুখানি ভালোবেসো। তোমার জগতেও তুমিই তো সব। সকলের জগতেই সকলে। তুমি আছ বলেই তো পৃথিবী আছে। তোমার ছোট্ট এই জগতে তোমাকে ঘিরেই তো সবকিছু। সকালে উঠে রোজ আয়নায় একবার মুখ দেখবে, বুঝেছ। নিজেকে ভালোবাসবে। যে নিজেকে ভালো না বাসে, সে অন্য কাউকেও ভালোবাসতে পারে না।
চমকে উঠে তক্ষ বলল, তাই-ই?
তাই-ই তো! বলছি আমি। কথা শোনো।
আচ্ছা একটু বোসো। গ্লাস নিয়ে আসি। ঝাল লেড়ে বিস্কুট আছে। খাবে? হুইস্কির সঙ্গে ভালো লাগবে বোধ হয়।
আনো। আমি কি সাহায্য করব তোমাকে?
না না ঠিক আছে। আনন, তাড়াতাড়ি আনো, তোমার জন্মদিনে আমি ড্রাঙ্ক হব আজ।
তাই-ই? আমি জানতাম, ভালোলাগার জন্যেই খায় এইসব মানুষ। নেশা করে লাভ কী?
ভালোলাগাই যখন বেশি হয়, তখন ই তো তাকে ‘নেশা’ বলে। তুমি বড়ো ব্যাক-ডেটেড।
তাই-ই কি? আমি জানি না। নিজেকে ঠিক রাখা তো উচিত-ই। সবসময়ে।
কখনো বা একটু বেঠিক হলেই! জলে তো আর পড়োনি। নিজের বাড়িতে বসেই তো খাচ্ছ। আমার-ই বরং রিকশা ঠেঙিয়ে যেতে হবে এতখানি পথ।
তবু, তুমি আছ তো। তোমার সামনে নেশা করাও কি ভালো? মেয়েদের সামনে অসভ্যতা!
তক্ষ বলল।
তাতে কী? আমিও নেশা করব। মাঝে মাঝে সবকিছুকে ভুলে যেতে হয়। নিজেকে মাঝে মাঝে ভুলতে ইচ্ছে করে না তোমার?
নিজেকে মনেই রাখি না, তাই ভোলার প্রশ্নই ওঠে না।
ভোলা দরকার। মাঝে মাঝে অসভ্যতা না করলে, আমরা যে সভ্য, সেই কথাটাই তো ভুলে যেতে বসব।
কী জানি। তাই-ই? ভেবে দেখতে হয় কথাটা।
ভাবোই তুমি! চিয়ার্স। বলে, বড়ো এক চুমুক দিল গ্লাসে গান্ধারী।
‘চিয়ার্স’। বলল তক্ষও। মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। অনেকদিন পরে হুইস্কি খেল ও। আজকাল কোথাও যায়ও না; খায়ও না এসব।
তক্ষ গান্ধারীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, যেকোনো মানুষ-ই, এই অভাবী দেশে, গান্ধারীকে ঈর্ষা করবে দূর থেকে। ওর স্বাচ্ছল্য, ওর বাড়ি-গাড়ি, ওর শাড়ি দেখেও, মানুষ গরিব-ই হোক আর বড়োলোক-ই হোক, ভেতরে যে, তারা একইরকম, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার মানুষ এটা বোধ হয়, বোঝা পর্যন্ত যায় না।
বড়োলাকেরা যে, এক বিশেষ ধরনের মনুষ্যেতর জীব, শুধুমাত্র তাদের স্বাচ্ছল্যরই কারণে– এই মেকি ও মিথ্যে কথাটা পৃথিবীর সব রাজনীতিকরা গরিবের ভোট-পাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে চিরদিন প্রচার করে এসেছে। রাজনীতিকরা মানুষকে কোনোদিনও ভালোবাসেনি, বেসেছে তাদের ভোটকে। তাই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে জুড়ি নেই তাদের।
গান্ধারীর যে, দুঃখ, অথবা তক্ষরও; সেটা আর্থিক অবস্থা-নির্ভর আদৌ নয়। বেশিরভাগ দুঃখের-ই মতো, বেশিরভাগ সুখ-ই আর্থিক অবস্থার তারতম্য নির্ভর নয়। মানুষের সুখ-দুঃখ মানুষেরই। গরিব বড়োলোকে কোনোই তফাত নেই।
গান্ধারী হঠাৎ-ই বলল, তোমার জন্যে আমি কি কিছু করতে পারি তক্ষ? জয়সোয়ালরা যে, ট্রাস্ট করেছে তা থেকে প্রতিবছর তরুণদের মধ্যে থেকে একজন ক্রিয়েটিভ মানুষকে একটা অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছে ওরা। জয়সোয়ালরা তিন ভাই-ই আমার কথায় ওঠে-বসে। পাটনাতে এক সংবর্ধনায় এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে দেওয়ালির সময়ে। তুমি কি সেই অ্যাওয়ার্ডটি চাও? ওদের মায়ের নামে দিচ্ছে। মানী দেবী’ পুরস্কার। ট্রাস্টি বোর্ড-এর আমিই প্রেসিডেন্ট। মিটিং বসছে মহালয়ার দিনে। আমার ভেটো পাওয়ারও আছে। বলো, চাও কি না।
না, না। আমি কেন চাইব? ছিঃ ওদের কোনো কমিটি-টমিটি নিশ্চয়ই আছে, মানী-জ্ঞানী মানুষের। মানে, যাঁরা নাম রেকমেণ্ড করেন। তাঁরাই নিশ্চয়ই ঠিক করেন, কাকে দেবেন, না দেবেন এবং কোন কাজের জন্যে দেবেন।
তা আছেন, তবে নামকাওয়াস্তেই। আসলে, আমরা যাকে দিতে বলব, তাকেই দেবেন ওঁরা। ওই কমিটির মেম্বাররাও যে, প্রত্যেকে হাজার টাকা করে পাবেন মিটিং ফি। ওঁদের আবার মতামত। কারো ছেলের চাকরি করে দিয়েছেন বড়ো জয়সোয়াল, কারো মেয়ের বা পুত্রবধূরও। তা ছাড়া মানী-জ্ঞানী? আজকালকার মানী-জ্ঞানীদের ‘মেরুদন্ড’ বলে আছে নাকি কিছু? সরীসৃপ-ই তো বেশি! ঠাণ্ডা রক্তর। সে-রক্ত কিছুতেই গরম হয় না। বশংবদ ল্যাজ নাড়ানো কুকুরের-ই মতো অধিকাংশ। শুধু এই অ্যাওয়ার্ডের ব্যাপারেই নয়, অন্যান্য নানা ব্যাপারেই ওদের সঙ্গে মিশে তো দেখলাম। ঘেন্না ছাড়া কিছু নেই। ওঁদের দেওয়া পুরস্কার?
তক্ষ বলল, তোমার হাতে যদি, সত্যিই কোনো ক্ষমতা থাকে তাহলে, সবচেয়ে আগে বিশ্বের ঝা-কেই দেওয়া উচিত। খুব ভালো কবিতা লিখছে ছেলেটি। মিয়া সামসুদ্দিনকেও দেওয়া উচিত ওর উর্দু ‘রুবাইয়াত’-এর জন্যে। গানে পেতে পারেন, মোহিনী দেবী। ওঁর ঠুংরির তুলনা নেই। বয়েস হয়েছে, কবে মরে যাবেন, তারও ঠিক নেই। নাটকে দিলে, জগদীশ মির্ধার অবশ্যই আমার অনেক-ই আগে পাওয়া উচিত। ওর আদিবাসী-ওঁরাও নাটক ‘সারহুল’ নিশ্চয়ই অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্য। নয়তো ঔপন্যাসিক রভীন্দ্র শর্মাকে। দারুণ উপন্যাস লিখছে ও একবারে চমকে দেওয়া ভাষায়। বলবার মত কিছু আছে বলেই লিখছে। পাতা ভরাচ্ছে না। একেবারে নতুন স্টাইল, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি! আর কী জোরালো ভাষা! তা ছাড়া, শেষে বলি, আমি কি এখনও তরুণ আছি?
হেসে বলল তক্ষ।
তরুণ নও? এদেশে রাজনীতি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ষাট বছর অবধি সকলেই তরুণ থাকে। যদিও মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি এবং অরক্ষণীয়াও। তা ছাড়া, তোমাকে তো অন্যর হয়ে ওকালতি করতে বলিনি আমি। তুমি চাও কি না, তাই-ই বলল।
গান্ধারী, যে-পুরস্কার উমেদারি করে, কাঠ-খড় পুড়িয়ে পেতে হয়, তা পেলে সে পুরস্কার কি পুরস্কার আদৌ থাকে আর? সে তো আত্মবঞ্চনাই। আয়নার সামনে দাঁড়ানো কি যায় তারপরেও? জানি না।
যদি আদৌ পেতে হয় তাহলে এমন করেই পেতে হবে। ‘লজ্জা, মান এবং ভয়’ এই তিন যার আছে, এদেশীয় খুব কম পুরস্কার-ই তার জন্যে। তা ছাড়া, তোমার বাড়িতে তো আয়নাই নেই। তোমার আবার কী প্রবলেম?
সে তো আমার মুখটি কুৎসিত বলেই। আমার বাইরের মুখ-ই। দেওয়ালের আয়না ছাড়াও প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যেও একটি করে আয়না তো থাকে। সেই আয়না? তার সামনে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দাঁড়াতে তো হয়-ই! প্রত্যেককেই। সেই আয়না অস্কার ওয়াইল্ডের ‘পিকচার অফ ডরিয়ান গ্রে’র সেলারে-রাখা ছবির-ই মতো মিথ্যে বলে না কোনোদিনও।
তাহলে, তুমি চাও না?
নাঃ। এমন প্রক্রিয়ায় পুরস্কার পেতে হলে কোনো পুরস্কার-ই চাই না আমি। সত্যিই না। কোনোদিনও না।
ভয় নেই। পাবেও না কোনোদিন। কারণ এমন প্রক্রিয়ায় যারা পুরস্কার পায়, তারাই সব পুরস্কারের বিচারকও। অন্যর প্রতি তাদের বিচারও, তাদের নিজেদের যাচাই-এরই মতো আর কী! বেশ। তাহলে আর কী চাও? আমার কাছ থেকে তোমার চাইবার কি আর কিছুই নেই, তক্ষ? তুমি অনেক-ই বদলে গেছ।
কী করে বলব গান্ধারী? কী তুমি দিতে পারো আর দিতে পারো না, তা না জেনে বলি কী করে? বলে ফেলার পর যদি না দাও? তাহলে বড়োই ছোটো হয়ে যাব যে, তোমার কাছে।
মনে মনে তক্ষ বলল, আমাকে দেবে? দিতে চাও? গান্ধারী? একটিবারের জন্যে? দিতেই কি এসেছ আজ সন্ধ্যায়? দেবে? তোমার এই সুন্দর শরীরকে? যা, তুমি এলেবেলে অবহেলায় কত অংসখ্যবার তোমার স্বামীকে দাও, দিয়েছ, দিয়ে দিয়ে শূকরী হয়ে গেছ; আমাকে দেবে তা? একবারের জন্যে? কতটুকু আর হারাবে তোমার তাতে? চিরদিন মনে করে রাখব গো তোমাকে। এই ভাদ্ৰশেষের হিমহিম রাতে, শিউলিফুলের গন্ধের মধ্যে; দেবে আমাকে? গান্ধারী? একটিবার?
গান্ধারী একবারে গ্লাস শেষ করে টকাস করে তেপায়াতে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বলল, নাও, তুমিও শেষ করো। দু-জনের জন্যেই ঢালো। আবার।
এত তাড়াতাড়ি? মাথায় চড়ে যাবে যে।
ভালো হুইস্কি কারো মাথায় চড়ে না। এ কী বাজে দিশি হুইস্কি পেয়েছ? আর যদি চড়েই তো চড়বে। তোমাকেও যে, মাথায় চড়াচ্ছি আমি, তা কী তুমি বুঝছ না?
গান্ধারী যেন, কী বলতে চাইছে তক্ষকে, কিন্তু পারছে না বলতে। তক্ষর-ই মতো। এই লেখাপড়া শেখাই ওদের কাল হয়েছে। সব স্বাভাবিকতাই নষ্ট হয়ে গেছে। বড়ো বক্র, কুটিল, জটিল হয়ে গেছে জীবন। ছেলেবেলার নিঃসংকোচে, বিনা লজ্জায় চকোলেট আর আইস্ক্রিম চেয়ে খাবার দিনগুলোই ছিল ভালো।
কী হল, তক্ষ, কথা বলছ না যে। তোমাকেও যে, মাথায় চড়াচ্ছি তা তুমি বুঝছ না?
বুঝছি তো। বুঝছি, বলেই তো বুঝছি না।
বোকার মতো বলল তক্ষ।
গান্ধারী বলল মনে মনে, একবার মুখ ফুটে বলো তক্ষ। প্লিজ একবার চাও। এগিয়ে এসো। হাত পাতো। তুমি যে, পুরুষ! তুমি একবারটি চাও গো। লক্ষ্মীসোনা। আমি যে, মেয়ে। আমরা যে, অন্য প্রজন্মের মেয়ে। বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। একবার চাও তুমি। যে নাটকের জন্যে এতভাবে এত সময়, রিহার্সাল দিয়ে তৈরি করলাম নিজেকে, আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরমুহূর্ত থেকে তা কি…
তক্ষ দু-জনের গ্লাসেই হুইস্কি ঢালতে ঢালতে মনে মনে বলল, আমি খুব-ই বুঝতে পারছি। গান্ধারী, কেন তুমি এসেছ আমার কাছে। শুধু একবার চাও। সোজাসুজি নাইবা চাইলে, আকারে ইঙ্গিতেই চাও। আমাকে ধন্য করো গান্ধারী। কৃপা করো। আমি যে, চাইতে শিখিনি। আমার শিক্ষা, আমার আত্মসম্মান, আমার শ্লাঘা যে, আমাকে সমস্ত সহজপ্রাপ্তির দোরগোড়া থেকে বারে বারেই ফিরিয়ে এনেছে! ঘুঘটটোলিতেও যেতে পারলাম না, এপর্যন্ত একদিনও! আমার বড়ো সংকোচ হয় নিজেকে খুলে-মেলে ধরতে। ভারি ভয় হয়; ‘সস্তা হয়ে যাব। এতকষ্ট করে দামি করে তুলেছি নিজেকে, সব মূল্য ধুলোয় লুটিয়ে দেব?–চাও তুমি, লক্ষ্মীটি গান্ধারী। একবারটি চাও।
গান্ধারী একদৃষ্টে তক্ষর মুখে চেয়েছিল। তক্ষও গান্ধারীর মুখে। গান্ধারীর ঈষৎ-রক্তিম চোখ দু-টি তক্ষর দু-চোখে স্থির। দু-জনের মুখ দেখে দু-জনেই বুঝতে চেষ্টা করছিল দু-জনকে। এইসব মনের গাঙে অনেক-ই জল, বুদ্ধি’র লগি তল পায় না তার। হেরে যাবে, অন্যর চোখে সস্তা হয়ে যাবে বলে মুখে কিছুই বলতে পারল না কেউই।
পাছে সস্তা হয়ে যায়, তাই দাম দিতে হল অনেক-ই!
কথা ঘুরিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে গান্ধারী বলল, তোমার এমন বিদঘুঁটে নাম কে রেখেছিল? মানে কী এর?
বাঃ। তক্ষও যেন, হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণ এক গভীর যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। বলল, তক্ষ যে, কার নাম জান না? যার নাম তক্ষশীলা। মহারাজ দশরথের নাতি। ভরতের-ই এক ছেলে তক্ষ। ‘রামায়ণ’ পড়োনি?
না। আমি পাটনার ইংলিশ মিডিয়াম কনভেন্টে পড়েছিলাম। ওসব ট্র্যাশ আমি পড়িনি।
তোমার নাম কে রেখেছিলেন? ও নাম তো মহাভারতের-ই একটি চরিত্রর।
কে জানে? তাই-ই?
তোমার নামের মানে জানো?
নাঃ। জানতে চাই-ও না। যে নিজেকেই জানে না, সে নামের মানে জেনে কী করবে?
নিজেকে কেই-ই বা জানে!
কেউই কি জানে না?
কেউ হয়তো জানে। মানে, কেউ কেউ। আমরা জানি না বলেই মনে হয়।
তোমার কোনো কষ্ট নেই তক্ষ?
কষ্ট?
চমকে উঠল তক্ষ।
একটু চুপ করে থেকে বলল, কষ্ট’ নেই, এমন মানুষ কী একজনও আছে?
কী সে কষ্ট?
নিজের কষ্টর কথা অন্যকে বলতে নেই। একজন শিক্ষিত, আধুনিক মানুষ তো নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে পারে না কারো কাছেই। তাহলে তো সে, ভিখিরি’ই হয়ে গেল। নিঃস্ব একেবারে। ভিখিরি হয়ে বাঁচার চেয়ে, না বাঁচাই ভালো। আমরা প্রত্যেকে হিমবাহই হয়ে গেছি। যতটুকু দেখা যায় সেটুকু কিছুই নয়। প্রায় সবটাই থাকে চোখের এবং মনের গভীরে।
তাই-ই? কী জানি। হয়তো তাই-ই। কিন্তু এত কষ্ট নিয়ে বাঁচাও কি বাঁচা?
কী করবে বলো? আমরা যে, মানুষ। জানোয়ারদের আত্মসম্মানের, আত্মাভিমানের বালাই ই নেই। ওরা তাই-ই সহজে সুখী।
জানোয়ার হয়ে যেতে বাধা কোথায়? যদি তাতেও সুখী হওয়া যায়।
সে-সুখ তো ক্ষণিকের সুখ গান্ধারী। জানোয়ার হয়ে গেলেই মানুষ জলে-ডোবা মানুষের-ই মতো প্রাণপণে মনুষ্যত্বর খড়কুটো আঁকড়ে আবারও মানুষ হয়ে উঠতে চায়, যদি তার মনুষ্যত্ব তখনও পুরোপুরি নষ্ট না হয়ে গিয়ে থাকে।
সেই চেষ্টা মানে; মানুষে ফিরে-আসা বড়োই করুণ। তার চেয়ে মানুষ হয়েই থেকে মানুষের কষ্ট বুকে করে বাঁচাই ভালো।
তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো কিন্তু।
হুঁ। অনেকেই বলে। কিন্তু শুধু কথাই।
সুন্দর করে কথা বলার চেয়ে সুন্দরভাবে বাঁচা অনেক বেশি কঠিন। এবং জরুরিও।
সুন্দর কথাও তো কম নয়! ক-জন এমন সুন্দর করে কথা বলতে পারে?
ভাষা এবং ভাষার এমন ঐশ্বর্য তো মানুষের-ই একার। নিজের মনের ভাবকে স্পষ্ট করে লক্ষ লক্ষ শব্দর মধ্যে থেকে, ঠিক শব্দটি বেছে নিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে তো একমাত্র মানুষ-ই পারে। কবিতা বলো, গান বলো, গদ্য বলো, নাটকের সংলাপ, ফিলমের ডায়ালগ যাই-ই বলো না কেন, এসব-ই তো শব্দ নিয়েই নিঃশব্দ খেলা। এই স্থূপীকৃত শব্দ নিয়েই তো বাক্য গড়ে মানুষ, আজ রাতে ফোঁটা শিউলি ফুলের-ই মতো শব্দ কুড়িয়ে মালা গেঁথে বাক্য বানাই আমরা। আমি, তুমি…সকলেই, তাইনা?
হুঁ। বাক্য।
গান্ধারী বলল।
তারপর বলল, জানি না, তক্ষ। শুধুই কি শব্দ? বাক্যবিন্যাস? সুন্দর করে নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করা? এইটুকুই কি সব? এইজন্যেই কি শুধু মানুষের আসা এখানে, বেঁচে থাকা? শব্দের আর বাক্যের সুগন্ধর আড়ালে যদি মানুষ হাহাকার করে বুভুক্ষুর মতো জীবন কাটায়, তবে এই বাক্যবিন্যাসের তাৎপর্যই বা কী? কতটুকু?
আমিও জানি না। তুমি হয়তো ঠিক। অন্যদের কথা জানি না, নিজের কথাই বলতে পারি শুধু। আমি এই শব্দের-ই কারাগারে বন্দি এক মানুষ। অনেক আশীর্বাদের-ই মতো বোধ হয় মানুষের এ-এক অভিশাপ। এই অভিশাপ নিয়েই একজন আধুনিক মানুষ জন্মায়।
হুইস্কির নেশাটা বেশ চাড়িয়ে গেছে মাথার কোষে কোষে। মন, জাপানি মেয়েদের জবরজং পরতের পর পরতের পোশাক খুলতে শুরু করেছে, এক এক করে। মোড়কে চিড় ধরেছে। মনকে নিরাবরণ না করে শরীরকে নিরাবরণ করা যাবে না, তক্ষর সামনে। পারবে না ও। হুঁশ থাকতে পারবে না। অন্যমনস্ক মনে ভাববার চেষ্টা করছিল যে, আজপর্যন্ত তাকে কতজন পুরুষ শারীরিকভাবে পেতে চেয়েছিল বিয়ের আগে এবং পরে। তার হিসেব রাখলে খাতা ভরে যেত, এতদিনে। তাদের মধ্যে পায়েও ধরেছিল কেউ কেউ। কী না করেছিল তারা। পুরুষেরা বড়োই, ছোটো করতে পারে নিজেদের। অনেকে এখনও করে। তবু, উপবাসী শরীরটিকে তার স্বামীর ছাড়া আর কারো হাতেই তুলে দিতে পারেনি সে। ঘৃণায়, বিরক্তিতে প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের। সেইসমস্ত জানোয়ার পুরুষদের-ই। অনেক সুপুরুষ, সুবেশ, সবল পুরুষকেই। কিন্তু গান্ধারী যে, নিছক একজন মেয়ে নয়। দশজনের মতো যে, নয় সে। মানুষী যে, কেবল যথার্থ মানুষের কাছেই নিজের সম্মান খোয়াতে পারে। নিজের শরীর-মনের নিভৃততম নিভৃতিকে দলিত হতে দিতে পারে। সে যে সুন্দরী, শিক্ষিতা এবং সুরুচিসম্পন্না। কেউকেটা এক পুরুষের স্ত্রীও। বড়োনারীকে ভ্রষ্টা হতে হলে, তাকে নষ্ট করার মতো বড় পুরুষেরও যে, দরকার। যা তার ‘দেয়’, তা সে, যাকে-তাকে দিতে পারবে না। যার-তার কাছ থেকে নিতেও না। তার চেয়ে তোলা থাক, এ-জন্মের মতো সবকিছু। মনের আর শরীরের কুলুঙ্গিতে নিভৃতপ্রাণের দেবতা হয়েই থাকুক তার চাওয়া।
তক্ষ ঠিক-ই বলেছিল, কষ্ট ছাড়া কী মানুষ হয়?
আর একটা দাও। গান্ধারী বলল।
আরও খাবে?
গান্ধারী নিজে ভ্রষ্টা না হতে পেরে ওর হাসিটাকে ভ্রষ্ট করল। করল হুইস্কিই। এক একজন মানুষের ওপর এক একরকম প্রভাব হয় হুইস্কির’। সাংঘাতিক জিনিস এ। ভাবল গান্ধারী। বলল, ও বুঝেছি! তোমার নিজের-ই জন্যে কি এটাকে পুরোপুরি বাঁচিয়ে রাখতে চাও?
নিজের জন্য? অবাক হল তক্ষ। হেসে বলল, নিজের জন্যে নিজেকেই বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। আর এই বোতলের লালচে জল?
তবে আর কী? ঢালো ঢালো। আমাকে দাও বড়ো করে, তুমিও নাও। দেখেছ! ন-টা প্রায় বেজে গেল! এরই মধ্যে? ভাবছিল, সময় বড়োই দ্রুত শেষ হয়ে যায়, ঘণ্টা, দিন, জীবন। যা-করবার তাড়াতাড়ি করতে হয়। গান্ধারী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, একবার জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে।
তক্ষ বলল, সত্যি। সময় বড়ো কম, বড় কম আমাদের আয়ু, বড়ো, ছোটো এই জীবন।
তারপর হুইস্কি ঢালতে ঢালতে নিরুচ্চারে বলল, বেশিরভাগ মানুষের-ই জীবনের সবটাই কেটে যায়, এমনি করেই সুখের প্রার্থনায়, সুখ’-এর জন্যে তৈরি হতে হতেই। এটাই ঘটনা।
হুইস্কিটা একচুমুকে গিলে ফেলল গান্ধারী। তক্ষকেও বলল, বটমস আপ।
তারপর-ই বলল, দেখেছ! তোমাকে তোমার জন্মদিনের আসল প্রেজেন্টটাই দেওয়া হল না।
আসল প্রেজেন্ট?
হ্যাঁ।
তক্ষও একচুমুকে গ্লাস শেষ করল। ওর নিজস্বতা, আমিত্ব, অহং, আত্মাভিমান সব ছানা—না–হওয়া কেটে–যাওয়া দুধের-ই মতো দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। নেশা হয়ে গেছে। দু-কানের লতিতে গরম।
গান্ধারী ইশারায় ওকে কাছে উঠে আসতে বলল। তারপর বলল, জন্মদিনে কিসি দিতে হয় যে, তাও জানো না বুঝি? এসো, কাছে এসো।
তক্ষর সারাশরীর অবশ হয়ে গেল, ভালো লাগায়। হাঁটু কাঁপতে লাগল থরথর করে। অব্যবহারে অব্যবহারে ওর শরীরের যন্ত্রপাতি, কী সব মরচে ধরে নষ্ট হয়ে গেল? কী যেন, বলতে গেল, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো তক্ষ, অস্ফুটে…। শোনা গেল না কথাটা। বলল, গান্ধারী…
ঠিক সেই সময়েই, জানলার গরাদ দিয়ে মুখ-বাড়িয়ে একজন দাড়িঅলা লোক চেঁচিয়ে বলল, রিকশাওয়ালা! ন বাজ গ্যয়ি মাইজি!’
তক্ষুনি, তক্ষকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি জামা ঠিক করে নিতে নিতে ও বাথরুমের দিকে দৌড়ে গেল। ইচ্ছুক, উন্মুখ শরীর একটু ছোঁয়াতেই গলে যায়; যা ঘটে না, স্বামীর নিয়ত অভ্যাসের চরম বন্য আদরেও। বিয়ের পর পর ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে সে, শূকরীই হয়ে গেছিল। অনেক বছর পর মানুষী হয়ে উঠল। এক মুহূর্তের জন্যে হলেও।
তবু অপরাধবোধে জর্জরিত লাগছিল ওর। সংস্কার এখনও অনেক গভীর।
গান্ধারী চকিতে একবার তক্ষর চোখে তাকাল। ঘৃণা, অনুকম্পা এবং অসহায়তা মিশেছিল সে-চাউনিতে। বাথরুম থেকে ফিরে এসে রিকশাওয়ালাকে বলল, চলো। রিকশায় উঠতে উঠতে তক্ষকে বলল, মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে। দেখা হবে। চলি তক্ষ।‘
তক্ষ রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে লজ্জিত, ক্ষুব্ধ মুখ নামিয়ে বলল, আবার কবে আসবে?
শিউলি আর হিমের গন্ধ ভাসছিল তখন বাইরের আশ্বিনের রাতের আকাশে। একলা ‘টি-টি’ পাখি ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে ঝাঁটি জঙ্গলে ভরা টাঁড়ের ওপরে উড়ে উড়ে ডাকছিল। ওরাও একলা দু-জনেই। টি-টি পাখি।
গান্ধারী চুলটা ঠিক করে নিল, রিকশাতে বসেই। অনেক বেশি বিস্রস্ত হলেই খুশি হত। তবু, ঠিক করে নিল। একটু পর-ই আলোকিত পথে গিয়ে পড়বে।
তক্ষ আবারও বলল, কবে আসবে?
গাল থেকে অলক সরাতে সরাতে গান্ধারী বলল, দেখি।
ঘরের আলো, খোলা দরজা দিয়ে এসে পড়েছিল, তক্ষর মুখের একপাশে। বড়ো কুৎসিত সেই মুখটি। কুৎসিত মুখকে কাম আরও কুৎসিততর করে তুলেছিল। কী করে? কী করে সে, এই মানুষটার কাছে, কী চাওয়ার জন্যে এসেছিল, ভেবেই পেল না, সেই মুহূর্তে গান্ধারী। বড়োই ঘেন্না হল নিজের ওপরে। কেমন করে কামদংশিত হয়ে যে, নিজেকে এত ছোটো করতে এসেছিল, এই জন্তুর-ই মতো ভাবাবেগহীন জানোয়ারটার কাছে, তা বলা বড়োই মুশকিল। বড়ো লজ্জা।
মুখে বলল, চলি। তক্ষ।
নিরুত্তাপ গলায়।
রিকশার চাকা গড়িয়ে গেল কাঁকরে। কিরকির’ শব্দ করে মোড় নিল রিকশাটা। টি-টি পাখিটা তখনও ডাকছিল ‘ডিড-ইউ-ডু-ইট? ডিড-ইউ’?
অন্ধকার ঝাঁটি জঙ্গলের দিকে আর তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে শরীরের একপাশে অন্ধকার মেখে দাঁড়িয়েছিল তক্ষ। প্রাচীন, কোনো কুৎসিত যক্ষর-ই মতো। জলের গন্ধ আসছিল, অন্ধকারে হেঁটে আসছিল কারো’ নদী থেকে। নদীপারে কাশফুল ফুটেছে থোকা থোকা। এখন দেখা যাচ্ছে না। তবে হিমের রাতের গন্ধর সঙ্গে আলতো হয়ে মিশে ভেসে আসছে সে-গন্ধ। আশ্বিনে পড়েছে বছর। এই আশ্বিনে, দু-তিনমাস হল বিয়ে-হওয়া মেয়েদের মতোই এক, খুশি-খুশি আদুরে-আদুরে ভাব থাকে। গন্ধ পেল নাকে, তাদের তাঁতের শাড়ি আর পারফিউমের।
গান্ধারী আর কোনোদিনও আসবে না তার কাছে। ভাবছিল, কেনই যে, মানুষ অন্যর কাছে আসে, আর কেন যে, এমন করে ফিরে যায়!
রিকশাটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলছিল এবড়ো-খেবড়ো পথে। গান্ধারীর সিক্ত জরায়ুতে ঝাঁকি লাগছিল। নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছিল ও। চুমু খাওয়ার কথাতেই এই! একটু হলে কী অঘটন-ইনা ঘটতে যাচ্ছিল। তৈরি হয়েও তো আসেনি। আর ওই কালচারড কথাসর্বস্ব ইডিয়টটা তো একটা স্টুপিড ব্যাচেলার। ওর কাছে থাকার কথাও ছিল না কিছুই। পাটনার গান্ধারী, কী করে মুখ দেখাত, সেখানের হাইসোসাইটিতে? কিছু একটা ঘটে গেলে! ছিঃ। আর কখনো এমন দুর্মতি হবে না ওর। এইসব কালচারড ন্যাকাবোকার চেয়ে, জংলি পশু-মার্কা প্র্যাকটিকাল অভিজ্ঞ পরপুরুষও বোধ হয় অনেক ভালো। মেয়েদের তারা বোঝে, কদর করে।
রিকশাটা ক্রমশই দূরে চলে যাচ্ছিল এঁকে-বেঁকে। সেদিকে তাকিয়ে তক্ষ ভাবছিল, প্রেম, কাম, সব-ই বোধ হয় এমনি করেই একেবারে বিনা নোটিশে বিনা প্রস্তুতিতে সাইক্লোনের মতো হঠাৎ-ই আসে। বোঝবার আগেই হঠাৎ-ই চলে যায় আবার। হয় বিধ্বস্ত করে দিয়ে যায়, নয়; একটু এঁকে পর্যন্ত দেখে না। তারপর আর আসে না কোনোদিনও।
রিকশাটা অন্ধকারে হারিয়ে গেল। যাকগে যাক। আজ রাতে গান্ধারীকে খুব, খু-উব-ই আদর করে দেবে তক্ষ। উলটেপালটে, চেটেপুটে খাবে। এবং খাওয়াবেও। যা-কিছুই বেচারি চেয়েছিল মনে মনে সব-ই ওকে দেবে! একটুও বাকি না রেখে। যে-ভুল করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত অমনভাবেই করবে। ভুল-ই কি? কে জানে?
যাও গান্ধারী, যাও তুমি। তোমার নিরাপদ আত্মপ্রবঞ্চনার জগতে। আমিও ফিরে যাই আমার লেখার টেবলে, আমার অশান্তি যেখানে ‘শান্তি’ হয়ে ওঠে। ফিরে যাই আমার কাজে, যেখানে সব জ্বালার নিবৃত্তি। কাজের মতো পুজো, এতবড়ো প্রেম এবং কাম আর কীই-ই বা আছে? গান্ধারী! তুমি যাও। আমার অপেক্ষায় রূপমতী দাঁড়িয়ে আছে অধীর আগ্রহে। পাঁচ শো বছর থেকেই সে, দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যপ্রদেশের দার জেলার উঁচু পাহাড়ের ওপরের দুর্গম দুর্গ মাণ্ডুতে। রূপমতীকে স্বপ্নে প্রায়ই দেখছে তক্ষ, যেদিন থেকে নাটকটি লেখা শুরু করেছে। স্বপ্নে আদরও করে দিয়েছে তাকে দু-তিনদিন। রূপমতীর কোনো ছবি দেখেনি ও। ইতিহাসের কোনো বইতেই স্পষ্ট ছবি নেই। তবে, ঐতিহাসিক আর পরিব্রাজকদের লেখায় তার রূপগুণের বর্ণাঢ্য বর্ণনা পড়ে, মনে মনে তাকে গড়ে নিতে একটুও অসুবিধে হয়নি ওর। লেখক, কবি, নাট্যকার তারা তো আসলে কুমোর-ই! কল্পনায় যে-রাতে যেমন, রূপমতীকে সে-গড়ে নেবে তার প্রয়োজনমতো রূপমতী সেই আকার-ই নেবে। যে শাড়ি খুশি পরাবে তাকে, স্বপ্নে খুলে নেওয়ার জন্যেই। এ-রূপমতীকে হরণ করে নেয় সাধ্য নেই কোনো আধম খাঁ-এর। এর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে সে, সাধ্যও নেই কোনো বাজবাহাদুরের।
কল্পনা করে নেবে কোনো, বর্ষার রাতকে। মুগ্ধতালাও-এর জল এখন কানায় কানায় ভরা। পদ্ম আর কুমুদিনী, সারস, আর জলপিপিরা, এখন রাত, তাই-ই নির্বাক। স্বপ্নে আছে তারাও। সেই তালাও-এর পাশের জেহাজ মেহালের ওপর থেকে গম্ভীর আফগানি খানদানি রাবাবের রিওয়াজের মেজাজভরা আওয়াজ ভেসে আসছে। ভেসে আসছে নানারকম ধূপ, গুলগুল আর ইত্বরের মিশ্রগন্ধ। খুশবু উড়ছে মার ভেজা বাতাসে। আলোর মালা-পরা জেহাজ মেহালকে মনে হচ্ছে সত্যিই যেন এক ভেসে-যাওয়া জাহাজ-ই। এইমুহূর্তে জেহাজ মেহালও স্বপ্নে আছে। রূপমতীর সখীদের কণ্ঠের গান। কী গান গাইত তারা কে জানে? গজল কি তখন ছিল? রাগ-রাগিণী তো ছিলই, ঠুংরি গাইত কি তারা? মেঘ রাগের উদাস পর্দাগুলি জলে হয়তো তিরতির করে কাঁপন তুলছে এখন। প্রতিটি কোমল ও শুদ্ধ পর্দা পানজর্দা আর জাফরানের গন্ধ-ভরা গোলাপি ঠোঁটে ভরপুর সুরে বলছে। একটুও খামতি নেই সেই সুরে, দ্রুত পায়ে ঝরোকার মধ্যবর্তী অলিগলি দিয়ে দ্রুতসঞ্চরমাণ রূপমতী চলে যাচ্ছে। আলো-আঁধারিতে, নূপুর আর রাবাব আর তবলার আর তানপুরার আর সারেঙ্গির আওয়াজের মধ্যে মধ্যে যেন, তালফাঁকের-ই মতো আলতো পায়ে। বাজবাহাদুরের সঙ্গে পারস্য-দেশীয় রেশমি গালচেতে ফুলের চাঁদরের ওপরে আশ্লেষে মিলিত হবে বলে।
আহা! কল্পনা ভাগ্যিস ছিল। ‘কল্পনা’ই হচ্ছে আর্টের গোড়ার কথা। রক্তমাংসের পুরুষ ও নারী ছাড়াই কোনো মানুষ বা মানুষীর এই একটা ছোট্টজীবন দিব্যি চলে যায়, যদি কল্পনার কামধেনু, তার মনের দুয়ারে বাঁধা থাকে।
দরজা বন্ধ করে টেবলে ফিরে এসে বসে অনেকক্ষণ ধরে একটা সিগারেট খেল তক্ষ। তার আগে আরও একটা হুইস্কি ঢালল। বেশ লাগছে ভাবতে। একজন পরস্ত্রী, পরমা সুন্দরী নারী তার দুয়ারে শরীর ভিক্ষা চাইতে এসেছিল উপঢৌকন নিয়ে। যদি দিত, তবে সুন্দর কল্পনা বেড়ালে-ছেঁড়া সাদা কবুতরের-ই মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। গান্ধারী তার চোখে আর সুন্দরী থাকত না। বাস্তব, বড়োই কদর্য! তা যত সুন্দর-ই হোক-না-কেন। কারণ বাস্তবের সৌন্দর্য একদিন ফুরিয়ে যায়-ই যায়। বার্ধক্য একদিন এসে তাকে গ্রাস করেই। কল্পনা কোনোদিনও ফুরোয় না। বুড়ো হয় না। মরেও না। কারণ, তা থেকে যায় কাগজে-কলমে, রঙে-তুলিতে; কণ্ঠস্বরে।
নাটকের শেষটুকু পড়ল আবারও। মন কিছুতেই ভরছে না। অথচ কাল-ই, দিয়ে দিতে হবে বোকাকে। পুজোর দেরি তো আর বেশি নেই।
নাঃ। মন ভরছে না কিছুতেই। নানা তত্ত্ব এসে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তো আর কলকাতা নয় যে, কাউকে দেখিয়ে নেয়, বা পরামর্শ করে এ-নিয়ে।
কোনো কিছু সৃষ্টির আনন্দে বড়োই দুঃখ। দুঃখটাই আনন্দ না আনন্দটাই দুঃখ, বুঝতে পারে না তক্ষ।
শেষ করেও তবু শান্তি পাচ্ছে না। ক্লাইম্যাক্সটি কোথায় তুলবে সেটাই এখন ভাববার। তা ছাড়া, এ নাটক তো সাধারণ নাটক নয়। সাদামাটা একটি ঐতিহাসিক ছক বা গল্পের মধ্যে দিয়ে চিরন্তন-ই কিছু বলতে চাইছে যে, তক্ষ।
জন হাওয়ার্ড লসন, তাঁর ‘থিয়োরি অ্যাণ্ড টেকনিক অফ প্লে-রাইটিং অ্যাণ্ড স্ক্রিন রাইটিং বইয়ে বলেছেন; ‘অ্যাজ ফার অ্যাজ দ্যা প্রসেস ইজ ক্রিয়েটিভ, নো পার্ট অফ দ্যা স্টোরি ইজ রেডিমেড; এভরিথিং ইজ পসিবল (উইদিন দ্যা লিমিটস অফ দ্যা প্লে-রাইটার্স নলেজ অ্যাণ্ড এক্সপিরিয়েন্স) অ্যাণ্ড নাথিং ইজ নোন’।
গল্পটা তো সাদামাটাই। মাঁলোয়ার আফগান নবাব বাজবাহাদুর তাঁর প্রেমিকা অথবা রক্ষিতা অথবা স্ত্রী অসীম রূপমতী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী ও দারুণ গায়িকা রূপমতীকে কাপুরুষের মতো ফেলে শাহানশা আকবরের সেনাপতি আধম খাঁর সঙ্গে সারাংপুরের যুদ্ধে হেরে তার নিজের প্রাণের ভয়ে মা ছেড়ে যেমন পালিয়েছিলেন তেমন অসংখ্য পুরুষ-ই পালিয়েছেন ইতিহাসে। এই ছোট্ট সাবডিভিশনাল শহর ঝিরাটোলিতে এমন পালানোর ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে সামনে রেখে এবং আনুষঙ্গিক অনেক ঘটনা কল্পনা করে নিয়েই তক্ষ ঘটনা-পরম্পরাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে রূপমতী ও বাজবাহাদুরের চরিত্রটিকে গড়ে তুলতে চাইছিল নিজের মনোমতো, একেবারে নিখুঁত করে কিন্তু নাটকের পরিভাষায় যাকে ‘রুট-অ্যাকশন’ বলে, তাকে অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি করে তুলতে পারল কি?
এখানে নাটক নিয়ে আলোচনা করার মতো একজনইমাত্র মানুষ ছিলেন। রমেন চাটুজ্যে। তিনি তো চলে গেলেন গতবছরের এই সময়ে। খালি পেটে মদ খেয়েই!
বৃত্তটিকে নিপুণভাবে সম্পূর্ণ করতে পারার ওপরও নির্ভর করছে নাটকের সাফল্য। আরও নির্ভর করছে, কীভাবে এবং কোথায় ‘ক্লাইম্যাক্স’ আনবে ও। ‘ক্লাইম্যাক্স’ যে, নাটকের ঘটনার অনিবার্য ও স্বাভাবিক পরিণতি হয়ে উঠবেই এমন কোনো কথা নেই। লসন-এর মত ছিল, দ্য ওভার সিমপ্লিফিকেশন অফ দ্যা রুট-অ্যাকশন মিনস দ্যাট দ্যা সিস্টেম অফ কজেশন লিডিং টু ইট ইজ নট ফুললি ডেভেলাপড।‘ ‘পয়েন্ট অফ রেফারেন্স’ তো ক্রমশই সরে আসছে। ইবসেনের নাটকের নোরা যখন, তার স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেই মুহূর্তটি অথবা অন্য একটি বিদেশি নাটকে হেডার আত্মহত্যা, এই দুই ঘটনাই হয়তো হিস্টোরিক্যাল। কিন্তু কনটেমপোরারি নয়। আজকে যেভাবে নাটকের মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণ করা হয় তাতে ওই দুই নাটকের দুই ঘটনার কোনোটিই আনঅ্যাভয়ডেবল নয়। এগরি লাজোস এবং জন হাওয়ার্ড লসন এই দু-জনের সঙ্গেই মতের অমিল আছে তক্ষর নিজের। পয়েন্ট অফ হায়েস্ট টেনশন’ এবং পয়েন্ট অফ ইনটেন্স স্ট্রেইন’…’পয়েন্ট অফ রেফারেন্স’ অথবা ‘দ্যা মোস্ট মিনিংফুল মোমেন্ট’ এর কোনোটিই তক্ষর মতে ‘কালমিনেটিং পয়েন্ট’ নয়। ও কালমিনেটিং পয়েন্টটির মধ্য দিয়ে রূপমতীর মতো ‘কনক্রিট ইভেন্টস ভরা নাটকটির অ্যাবস্ট্রাক্টটা আইডিয়ার ভাবটিকে এমনভাবেই উপস্থাপিত করতে চায়, যাতে যাঁরা নাটক বোঝেন, তাঁরা এ-নাটক শেষ হওয়ার পর ক্লাইম্যাক্স’ কোথায় যে, লুকিয়েছিল আসলে, তা নিয়েই তর্কে মাতবেন।
তক্ষ, করে দেখাতে চায় যে, এই অঞ্চলেও নাটক নিয়ে ভাবাভাবি চলেছে। ঝিরাটোলির ‘ভ্রাতৃসংঘ’ তাকে নাটক লিখতে বলেছে বলেই এবং বোকা সে-নাটক পরিচালনা করবে বলেই যে, ঝিরাটোলির স্থায়ী বাসিন্দারা আর পুজোর সময় বেড়াতে আসা, মাথায় বাঁদুরে টুপি এবং গলায় মাফলার-বাঁধা, ঠাণ্ডা-লাগার ভয়ে সর্বদাই ভীত কিছু চেঞ্জাররা দেখে ‘ধন্য ধন্য’ করবেন বলে যে, নাটকটি ও লিখেছে, তা নয়। এই নাটকের ঘটনাপরম্পরা, মঞ্চসজ্জা, আলো, সংলাপ সাধারণ দর্শক উপভোগ করবেন যে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই ওর। শেষ হলে, খুশিমনে বাড়িও ফিরবেন তাঁরা। কিন্তু তক্ষ রায়, নিজে অপ্রস্ফুটিত মস্তিষ্কর বালক নয় বলেই, বালখিল্যদের আনন্দ দেওয়ার জন্যেই শুধু, এ-নাটক লিখতে বসেনি।
‘রূপমতী’ নাটকের ক্লাইম্যাক্স নাটকের শেষদৃশ্যে নয়। ইচ্ছে করেই করেনি তা। শেষদৃশ্যর তিনটি দৃশ্য আগে ক্লাইম্যাক্সকে লুকিয়ে রেখেছে। যেখানে ‘রূপমতী মেহাল’-এর ওপরের মিনারআলা ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছেন রূপমতী পুবে চেয়ে। সেই মেহাল থেকে মাণ্ডুর প্রায় তিন-শো মিটার খাড়া নীচে নিমারের বিস্তীর্ণ উপত্যকা। ঘনজঙ্গলাবৃত। সূর্য উঠছে। দূরের সোনালি আঁকা-বাঁকা সাপের মতো নর্মদার জল চিকচিক করে উঠছে, প্রথম সূর্যর আলোর সোনার ছটা গায়ে মেখে। ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল দ্রুত। ঘোড়া থেকে নেমে, রূপমতী মেহালের সরু সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতপদে উঠে এলেন সুলতান বাজবাহাদুর। মিথ্যে কথা বললেন রুপমতীকে, যেমন চিরকাল পুরুষেরা বলে এসেছে নারীদের। বললেন, লড়াই করতে যাচ্ছি। আকবরের বাহিনী পৌঁছে গেছে সারাংপুরে’।
ধার্মিক হিন্দু রূপমতী স্নান করে এসেছিলেন। পুণ্যতোয়া নর্মদা নদীর ওপরে সূর্য না-দেখা অবধি জলগ্রহণ করতেন না পর্যন্ত উনি। চুমু খেলেন বাজবাহাদুরকে। রূপমতীর-ই কায়দায়। বললেন, অপেক্ষা করে থাকব তোমার জন্যে। যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে এসো।
মিথ্যুক, ভীতু, ভোগবিলাসী, গোন্দদের গোণ্ডোয়ানার রানি দুর্গাবতীর কাছে যুদ্ধে গো হারান হেরে গিয়ে যার ভেতরের, সামান্য পৌরুষটুকুও উবে গেছিল অনেকদিন-ই আগে, সেই বাজবাহাদুর আবারও মিথ্যা বললেন রূপমতীকে। কয়েকজন অনুচর নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বাজবাহাদুর। পুরুষরা যে, মেয়েদের তুলনায় চিরদিনের মিথ্যুক, চিরদিনের ভীতু, চিরদিনের ভন্ড; এইটাই দেখাতে চায় তক্ষ।
এবার উঠল ও। বোতলটা তুলে রাখল। রুটি আর মেটের তরকারি রেখে গেছিল নাগেশ্বর। একটু গরম করে খেয়ে শুয়ে পড়ল।
আজ রাতে রূপমতীকে নয়, গান্ধারীকেই আদর করবে ও।
রূপমতী তো ঐতিহাসিক নারী। তার বয়েস হবে না কোনোদিনও। ফুলওয়ালির বেশ নিয়ে, ফুলের গয়না পরে মসলিনের ওড়নাতে মুখ ঢেকে যখন, হোশাঙ্গাবাদের দিকে মাণ্ডুর দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন রূপমতী নিমারের ঘন অরণ্যর মধ্যে দিয়ে, তার প্রিয় নদী নর্মদার জলের গন্ধ নাকে নিয়ে, সেই রূপেই তক্ষর চোখে থেকে যাবেন রূপমতী সারাটা জীবন। তক্ষ একদিন বৃদ্ধ হবে, লোলচর্ম, গলিত-নখদন্ত হবে, কিন্তু রূপমতী রয়ে যাবেন তেমন-ই রূপমতী। তেমন-ই রইবে তাঁর পদক্ষেপ। তাঁর ব্রীড়াভঙ্গি। তাঁর গানের গলা। বয়েস লাগবে না কিছুতেই। রূপমতী ক্লাসিক্স-এর পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। সময় তাঁদের ছুঁতে পাবে না। স্যুট হামসনের ‘গ্রোথ অফ দ্যা সয়েল’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, বা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’-এর মতোই। তক্ষদের মতো অগণ্য প্রতিভা আসবে যাবে, রীতি বা গান্ধারীর মতো সুন্দরীও; তারা সবাই-ই সমসাময়িক কালের চোখে আসাধারণ, কিন্তু সময়ের কবলে পড়ে তারা মিলিয়ে যাবেই একদিন না একদিন।
মাঝে মাঝেই এমন ‘ক্লাসিক’ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে তক্ষরও। ওই পর্যায়ে না পৌঁছোতে পারলে সৃষ্টিশীলতার বাজারে লুঙ্গি আর চটি পরে ছেঁড়া থলে হাতে কুচোমাছ কিনতে এসে লাভ-ই বা কী?
জোড়াখাটে নিজের পাশেই গান্ধারীর জন্য জায়গা করে দিল সযতনে, পরমআদরে তক্ষ। জিজ্ঞেস করল, তুমি একটা বালিশ নাও? না দুটো? পায়ের কাছে কাঁথা থাকল। মাঝরাতের পর লাগবে। এখন না লাগলেও। শেষরাতে হিম পড়ে। কই? জামাকাপড় খুললে না? সত্যি! জামাকাপড়ে নিজেদের এত জটিল করে তোলোনা তোমরা! পাশের আলনায় খুলে রাখো। এখন বাঁ কাত-এ শোও। আমি তোমায় জড়িয়ে ধরে, তোমার ডান বুকে হাত রেখে শুয়ে শুয়ে গল্প করি, তোমাকে পাশবালিশ করে।
কী গল্প?
কত গল্প আছে। নববিবাহিত দম্পতিরা যেসব গল্প করে। অর্থহীন প্রলাপ। মানে নেই কোননা। নববধূটি কবে কুল পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে গেছিল ছেলেবেলায়, অথচ কিছুই হয়নি কিন্তু তার। কিছুমাত্র চোট না-লাগাটাই গল্প। নতুন বর ফুটবল খেলতে গিয়ে কুড়ি বছর আগে পেনাল্টি কিক থেকে দারুণ একটি হেড করে গোল করেছিল। সেই হেড করার ব্যথা তার বাঁ-কপালে নাকি এখনও আছে। নতুন বউ কি টিপে দেবে একটু?
আর কী কথা?
আরও কত্ত কথা। যত্তসব অর্থহীন মিথ্যেকথা, যেসব কথার একটিও মনে রাখবে না তাদের দুজনের কেউই পাঁচবছর পর। টাকাপয়সা, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, ট্রিপল-অ্যান্টিজেন, এনকেফেলাইটিস তাদের পুরোপুরিই ভুলিয়ে দেবে যে, রাতে তারা একে অপরের কানে মুখ রেখে রুদ্ধশ্বাসে বলেছিল, অ্যাই! তুমি-না, আমার আগে কক্ষনো মরে যেয়ো-না কিন্তু। তুমি মরে গেলে, আমি আর বাঁচব না একদিনও। বিয়ের পনেরো বছর পরে এরাই একে অন্যকে রাগের মাথায় বলবে, মরো মরো। তুমি মরলে হাড় জুড়োয়।‘ এর নাম-ই সংসার করা। যারা করেনি, তারা এর অসারতা জানে না বলেই, ঈর্ষা করে এত।
আসলে দিব্যিই বাঁচে। মানুষ বা মানুষী নিজের চেয়ে বেশি ভালো আর কাউকেই বাসে না। মোটা ইনশিয়োরেন্স থাকলে তো স্ত্রী মনেই রাখে না স্বামীকে। না থাকলে, ছেলে-মেয়ের অনাদরে অবহেলায় পড়ে মনে, মাঝে মাঝে মৃতদারের যদি বাত না থাকে, হাঁপানি না থাকে, সেরিব্রাল বা হার্টঅ্যাটাক না হয়ে থাকে এবং অবস্থা স্বচ্ছল থাকে, ছেলে-জামাইদের ওপর নির্ভর করতে না হয়, কোনো ব্যাপারে, তবে তিনিও দিব্যি বেঁচে থাকেন। রিটায়ার্ড লাইফের-ই মতো, মৃতদার জীবনের মুক্তির হাওয়াও তিনি পুরোপুরিই উপভোগ করেন। ক্লাবে যান। নয়তো বেয়ানদের সঙ্গে প্রেম করেন। প্রেম সব বয়সেই করা চলে। প্রেম-ই তো জীবন। তবে পঁচাত্তর বছরের বেয়াই-এর সঙ্গে সত্তর বছরের বেয়ানের প্রেমের রকমটা, কুড়ি বছরের যুবক আর পনেরো বছরের যুবতীর প্রেমের চেয়ে কিছু আলাদা, এই-ই যা।
গান্ধারী পাশে শুয়ে উশখুশ করছিল।
বলল, নতুন জায়গায়, প্রথম রাতে ঘুম হয় না ভালো।
হবে হবে। ঘুমপাড়ানি ওষুধ দেব আমি। আদর। খেলেই ঘুম। গাঢ়।
তোমার নামের মানে জান তুমি গান্ধারী? নামের মানে? না তো!
কে রেখেছিল তোমার নাম?
বাবা।
হঠাৎ এই নাম?
পরে জানি, কেন। নামের মানে জানি না যদিও। বাবা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেখানের এক প্রবীণ অধ্যাপকের মেয়ের নাম ছিল গান্ধারী। সে ‘টমটম’ চড়ে বেড়াতে যেত। অমন রূপ নাকি, এই মর্ত্যভূমিতে আর হয় না। প্রেমে পড়েছিল বাবা। বাবাদের প্রেম তো বুঝতেই পারছ। দূর থেকে দেখেই প্রেম। কথা হল না, আলাপ হল না। মেজাজ কেমন? রাগি না ঠাণ্ডা, স্বভাব কেমন? দয়ালু না কঞ্জুষ। চরিত্র কেমন? রক্ষণশীল না ঢিলে, মানে আমার মতো; এসবের কোনো খোঁজেই দরকার ছিল না তখন। দূর থেকেই প্রেম। রক্তমাংসের মানুষটাকে কখনো হাত দিয়ে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখার সুযোগ হয়নি।
প্রেম তো সেরকম-ই হয়। হওয়া উচিত। প্রেম, দু-টি রক্তমাংসের মানুষের মিলন কখনোই নয়। প্রেম এক মানসিক অবস্থা। দু-পক্ষেরই সবচেয়ে বেশি মানবিক এই বোধ, মানুষের সব বোধের মধ্যে। প্রেম করতে, হাত ধরতে বা চুমু খেতে হয় না। রূপমতীর সঙ্গে আমার প্রেম যেমন। অবয়বের মধ্যে প্রেমকে বাঁধলেই প্রেম মরে যায়, জলের ওপরে তোলা ইলিশ মাছের মতো। যেমন গান্ধারী, তোমার আমার প্রেমও মরে যাবে আজ রাতের শারীরিক মিলনের পর।
মিলনের পর? মনে মনে বলল, তক্ষ।
বাবা, তাই আমি যখন হলাম; আমার নাম রাখলেন গান্ধারী। মায়ের কাছ থেকেই শোনা গল্প। মা কিন্তু রাগ করতেন না, করেননি।
করবেন-ই বা কেন? প্রেম তো রাগের নয়। ওইরকম প্রেম শুধুমাত্র আনন্দর-ই। তখন মনে হয় দুঃখ। তীব্র দুঃখ। কিন্তু বয়েস বাড়লে, সময় বয়ে গেলে, জীবনের ঘোলা জল থিতু হলে জানা যায় যে, যা দুঃখ বলে জানা গেছিল তা গভীর আনন্দই। সেই আনন্দরস্বরূপ যিনি বুঝেছেন জীবনে তাঁকে দুঃখিত করে, এমন কিছুই নেই। সেই আনন্দই আস্তে আস্তে বিশ্বপ্রকৃতির প্রেম হয়ে ওঠে, কুয়াশার মতো ছড়িয়ে যায় চারদিকে তারপর একদিন বাষ্প হয়ে উঠে, ঈশ্বর-প্রেমে পর্যবসিত হয়। তোমার বাবার মতো, দূর থেকে দেখা টমটম-এ চড়া অধ্যাপক-কন্যাকে যিনি ভালোবাসতে পারেন তাঁর মতো মানসিকতার মানুষ-ই ঈশ্বর-প্রেম যে কী, তা জানতে পারেন। সকলের জন্যে সব জিনিস নয়, গান্ধারী। তক্ষ বলল।
আদর করো এবারে। ঘুম পেয়ে যাচ্ছে আমার ঠাণ্ডায়।
এখনও নয়। মধ্যরাতে যখন শেয়ালরা ডেকে উঠবে ঝাঁটি জঙ্গল থেকে, কারো নদীতে লণ্ঠন জ্বেলে পাহাড়ি মাছ ধরবে যখন মুণ্ডারা সারারাত জেগে, তাদের বিক্ষিপ্ত কথার টুকরো টাকরা রাতের শিশিরভেজা নিস্তব্ধতা পিছলে যখন, প্রতিসরিত হয়ে আসবে আমার এই ঘরে; তখন। এখন গল্প করো গান্ধারী। আমাদের যেন, আজ-ই বিয়ে হয়েছে। কেমন? আমরা যেন নতুন বর-বউ। বেশ?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল গান্ধারী।
তোমার স্বামীর কথা মনে হচ্ছে বুঝি?
যে, আমার কাছে থাকে যখন, যে, আমার স্তনে মুখে ছোঁয়ায়, জঘনে যতনে হাত রাখে; সেই-ই আমার স্বামী। যে, যখন আমার আত্মার কাছে থাকে সেই-ই আমার আত্মীয়।
বাঁধন যদি শক্ত না হয়ে থাকে, এত বছরেও তাহলে ছিঁড়ে ফ্যালো-না কেন? তুমি তো স্বাবলম্বী। তোমার স্বামীর ওপর তো নির্ভরশীল নও তুমি।
পারি না, অভ্যেস হয়ে গেছে। বাঁধন কোনো বিয়েতেই তেমন শক্ত হয় না। শক্ত বলে যেটুকু থাকে তা অভ্যেস-ই। প্রয়োজন। ভুলভুলাইয়া।
অভ্যেস ভাঙতে পারো না? জোর পাও না? তোমার তো ছেলে-মেয়েও নেই।
না। তারজন্যে নয়। থাকলেও কিছু যেতে আসত না। আমি জেনে গেছি অনেককে দেখে যে, একটি অভ্যেসের বাঁধন ছিঁড়ে, অন্য আর একটি অভ্যেসের ফাঁস গলায় পরে, মুক্তি পাওয়া যায় না কখনো। এই বাঁধনের মধ্যে বাঁধা থেকেও মুক্তির স্বাদ যে, যতটুকু পেতে পারে সেই-ই পেল; না পেলে, পেল না। অভ্যেসের ভারে চাপা পড়ে কাটিয়েই যেতে হবে তাকে এই একটামাত্র জীবন। তাকে, আমাকে; প্রায় সবাইকেই।
‘ফেউ’ ডেকে উঠল নদীর দিক থেকে। অথচ এদিকে বাঘ নেই। লেপার্ড বা হুণ্ডারপ নেই। ফেউটা দু-নম্বর। মিথ্যেমিথ্যি ভয় দেখায় মানুষকে। ফেউও দু-নম্বর হয়ে গেছে।
কী দিনকাল হল!
ভাবল, তক্ষ।
এদিকে বেশ জঙ্গল। তোমার ভয় করে না?
গান্ধারী বলল। দুর।
একে কী জঙ্গল বলে? এ তো জঙ্গলের আভাস-ই মাত্র। তোমাদের ব্লাউজের ফাঁকের স্তনসন্ধির-ই মতো। কিশোরের চোখ তাকেই ‘পূর্ণ’ বলে জানে। পূর্ণ স্তনের সৌন্দর্য আর তার আভাসে তফাত আছে। শুনেছি, এই কারো নদী গিয়ে পালামৌতে, কোথাও কোয়েলে মিলেছে। কোয়েলের অববাহিকায় গভীর জঙ্গল আছে। যেখানে চাঁদের রাতে ঘাই হরিণীর যোনির গন্ধ ভাসে। জিন-পরিরা খেলে বেড়ায় এখনও।
গেছ? কখনো সে-বনে?
না।
ইচ্ছে করে না? যেতে? চলো, গাড়ি করে, আমি আর তুমি যাই সেখানে। থাকি গিয়ে কোনো নির্জন বাংলোতে।
নাঃ।
কেন? না কেন?
এই ছোট্টজীবনে কতটুকুই বা দেখা যায় গান্ধারী? সবকিছু দেখতে যাওয়ার চেষ্টা করাও মূর্খামি। তা ছাড়া, কল্পনার চোখে যা, দেখা যায়, অনুভব করা যায়, সেই সৌন্দর্যর কাছে বাস্তব তো হাস্যকরভাবে খেলো। বাস্তবে বাস করে মুদিরা। আমি কবি; লেখক, নাট্যকার, গায়ক আমি। আমার বাস কল্পনাতেই। ভারি সুখে আছি গো। সুখেই থাকি। একটু বাঁ-দিকে ফেরো।
কেন? হঠাৎ?
তোমার বাম স্তনে, যে-তিলটি আছে তাতে চুমু খাব একটা।
বড়োবেশি রোমান্টিক তুমি।
জানি। চিতায় ওঠার মুহূর্ত অবধি যেন এমন-ই…।
এই যে। এই নাও, তক্ষ।
উঁ।
রুন নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল।
স্টেজ রিহার্সাল আছে বিকেল তিনটে থেকে। আজ রবিবার। থিয়েটার দ্বাদশীর দিনে। বেঙ্গলি ক্লাবের হলে। পুজোও এসে গেল। নাটকটা কিন্তু মন্দ দাঁড়ায়নি। বিশু নাকি আজও পাঁচহাজার দিয়েছে এবং বোকাদাও, সত্যি বোকার-ই মতো দশহাজার। সেট-ফেট দারুণ হয়েছে। তেমন হয়েছে কস্টিউমও। ইতিহাসের বই থেকে দেখে দেখে, তক্ষদা ছেলেদের ও মেয়েদের পোশাক বানিয়েছেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আজাহারউদ্দিন দর্জিকে দিয়ে। সুরম আর ইত্বর আনিয়েছেন পাটনা থেকে। রাবাবও জোগাড় করতে দিল্লিতে লোক পাঠিয়েছেন। আজ সকালেই পৌঁছে যাবে। মোটকথা ঝিরাটোলির ইতিহাসে এইরকম যত্ন সহকারে, শিক্ষিত সমঝদার লোকেদের প্রত্যেকের সহায়তায়, উৎসাহে এবং অভিনয়েও ‘রূপমতী’ একটা নাটকের মতো নাটক-ই হবে! সমস্ত ঝিরাটোলি উৎসুক হয়ে আছে। প্রথম শো-টার ইমপ্যাক্ট দেখেই কলকাতার কলামন্দির বা রবীন্দ্রসদনে একটা শো করা হবে। স্পনসর করবে দে’জ মেডিক্যাল। কথা হয়ে গেছে পাটনার ম্যানেজারের সঙ্গে বোকাদার। আর সেই শো লেগে গেলে তো পর পর কল-শো।
দাদা লিখেছে কানাডা থেকেও আসবে ডাক।
একদিন রিহার্সালও হয়েছে পুরোদমে। অত্যন্ত সিরিয়াসলি। বোকাদা মানুষটা সম্বন্ধে যা জানত তার অনেকটাই যে-শোনা কথা তেমন সন্দেহ হচ্ছে এখন রুনের মনে। নিজের অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধি দিয়ে যাচাই না করে নেওয়া পর্যন্ত কারো মুখের কথাই বিশ্বাস করা উচিত নয় বোধ হয়। বেশ মানুষ এই বোকাদা। ‘রূপমতী’-র কারণেই কাছে আসার সুযোগ হল। ঝিরাটোলির অনেকের মুখেই শুনেছিল যে, দাদার সব সম্পত্তি ঠকিয়ে নিয়ে বউদিটিকে পর্যন্ত কবজা করে এখন বাবার ব্যবসা এবং দাদার বউকে ভোগ করছে সে একা। যা রটে, তার কিছুটাই শুধু ‘বটে’।
বাবা একবার কাশলেন পাশের ঘর থেকে। মা রান্নাঘরে। উনুনে খেসারির ডালে হিং সম্বার দিলেন। তার গন্ধে পুরোবাড়ি ভরে গেল। দু-বার রুন নিজেও কাশল। এই হিং-এর গন্ধ ওর একদম-ই সহ্য হয় না। তা ছাড়া খেসারির ডাল খেলে, চোখ নষ্ট হয়ে যায়, আরও নানা রোগ হয় এ-কথা এক-শোবার বলে বলেও লাভ হল না কোনো, মা-কে। বাবাকে তো নয়ই।
বাবা খেসারির ডালের ভীষণ ভক্ত। আর মা তো হচ্ছেন বাবার সেবাদাসী। ছায়া। এ বাড়িতে বাবার ইচ্ছেই সব। হিজ উইশ ইজ আ কম্যাণ্ড টু হার।
পূর্ববঙ্গে দেশ ছিল ওদের। সেটা বিশেষ কোনো ব্যাপার নয়। রুনের জানাশোনা বহুমানুষের-ই আদিবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে। রুন অবশ্য নিজে কোনোদিনও থাকেনি সেখানে। এমনকী মায়ের গর্ভে থাকাকালীনও নয়। দাদা শিশুকালে বোধ হয় দু-বছর বয়স থাকতেই চলে আসে, মা-বাবার সঙ্গে। শুনেছে। রুনের জন্ম-কর্ম সব-ই বিহারের এই ঝিরাটোলিতেই। ওরা প্রায় বিহারিই হয়ে গেছে। অনেক ব্যাপারেই। কিন্তু অনেক ব্যাপারে বাংলার বাঙালিদের চেয়ে অনেক-ই বেশি বাঙালি আছে। ইস্ট-পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ রুনের কাছে ইংল্যাণ্ড আমেরিকার মতো অন্য একটি অদেখা বিদেশ-ই মাত্র। এখন অবশ্য বাংলাদেশ।
বাবা মায়ের কান্ড দেখে মাঝে মাঝেই রীতিমতো বিরক্ত বোধ করে ও। আজ চল্লিশ বছর দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন, শিকড় বহুদিন হল এখানেই দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে, তবু জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ওঁরা যেন ইস্ট-পাকিস্তানেই রয়ে গেলেন।
নস্টালজিয়া ভালো। কখনো-কখনো মধুর ব্যাপারও। কিন্তু যে-স্বপ্ন কোনোদিনও সত্যি হবে, যা এ-জীবনের মতো পুরোপুরিই অতীত, বাতিল, তামাদি হয়ে গেছে তার-ই মধ্যে মা বাবা অনুক্ষণ বেঁচে আছেন। যদি একে বাঁচা বলা চলে আদৌ। ওঁদের আলোচনা, যা-কিছু উত্তেজনা, সব-ই শুধু একটি বিষয়কেই ঘিরে। কবে ওঁরা দু-জনে ‘দ্যাশ’-এ ফিরে যাবেন, কী করে যাবেন, সেখানে কার বাড়িতে উঠবেন, মকবুল ভাই চিনতে পারবেন কি না? কার কার সঙ্গে দেখা করবেন সেখানে, এসবের-ই নিরন্তর জল্পনা-কল্পনা করে দিন ও রাতের অনেকখানি সময়ই কাটে রোজ-ই। এই-ই শুনে আসছে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই। যদিও জানে রুন যে, তাঁদের এই পুণ্য তীর্থযাত্রা কোনোদিন-ই হয়ে উঠবে না। সত্যি সত্যিই গেলে, তা-নিয়ে এত স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন ছিল না।
বাকি সময়টা কাটে মা ও বাবার কোমরের ব্যথা, বাত, শ্লেষ্ম, পূর্ণিমা, অমাবস্যার এবং একাদশীর প্রভাবের আলোচনায়। কত পাপ করলেই যে, এমন সোনার দ্যাশ ছেড়ে এমন বাজে জায়গায় এসে জীবনটা নষ্ট করতে হয় তার-ই প্রাত্যহিক আলোচনা।
রুনের মনে হয়, কিছু কিছু মানুষ এমন-ই থাকেন। তাঁরা দ্যাশই থাকুন আর উদবাস্তু হয়ে এসে, ভারতে কী থাইল্যাণ্ডে, কী নেপালে কী কামাচ-কাটকাতেই থাকুন-না-কেন, বাঁচা’ কাকে বলে তাই-ই না জানার ফলে, এমনি করেই শুধু খেয়ে এবং আত্ম এবং পরনিন্দা করেই চলে যান। বাবা এবং মাকে কখনো কোনো বই পড়তে দেখেনি রুন। পড়ার বই ছাড়া অন্য বইপড়া, এ-বাড়িতে অপরাধ বলে গণ্য হয়ে এসেছে চিরদিন-ই। জীবিকাই সব এখানে। জীবন বলে কিছুই নেই। দাদা, সশরীরে কানাডাতে পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গেছে। আর মা মৃন্ময়ী এবং বাবা মণিমোহন অশরীরেই থাকেন ইস্ট-পাকিস্তানে। সবসময়েই। রুনকেই শুধু বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে এই ‘বিদেশিদের বাড়িতে থেকে নিজের ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিয়ে এখন মণিমোহনের বাঁশের ব্যবসার ভার নিতে হচ্ছে। পারিবারিক কারণে। বংশের স্বার্থে। কথাটা দ্ব্যর্থক। একসময় ভেবেছিল, বিদ্রোহ করবে। একসময় নয়, গত পাঁচবছর ধরেই ভেবে আসছে তা। মা-বাবাকে মুখের ওপর-ই বলে দেবে একদিন যে, আমাকে তোমরা পৃথিবীতে এনেছিলে তোমাদের-ই আনন্দর জন্যে। তোমাদের বডে-লেবার করে। সেজন্যে আমি আমার জীবনের সব ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, সাধ, আহ্লাদ, আমার মনুষ্যোচিত ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিতে পারি না। দেবও না। আজকে পাঁচবছর ধরে প্রতিমুহূর্তই এই কথাটাই বলার মহড়া দিয়ে চলেছে ও, কিন্তু বলে উঠতে পারল না আজ অবধি। জানে না কখনোই পারবে কি না! নিজের বাবা ও মায়ের চেয়ে তক্ষদা অথবা বোকাদা ওর অনেক-ই কাছের মানুষ। মা বাবা যে বন্ধুত্ব করেননি কখনো, প্রজা শাসন করেছেন। একবার ‘বংশারূঢ়’ এবং ‘বংশোদ্ভব’ হয়ে গেলে আর কী পারবে ও পালাতে? বংশলোচন হয়েই কেটে যাবে বাকি জীবনটা। কী যে করে ও।
রুনের মনমেজাজ এমনিতেই খুব-ই খারাপ দিন দশেক হল। রীতিটার জন্যেই ওই তক্ষক, বৃদ্ধ ভাম, তক্ষ রায়, যেন, রীতিকে অজগরের চোখের-ই মতো সম্মোহন করে রেখেছে। যতক্ষণ তক্ষ রিহার্সালে থাকে ততক্ষণ-ই লু-লাগা তিতিরের মতো ছটফট করে ও। কেন, কে জানে? রীতি যেন ওর শরীরের মধ্যে কী-এক অস্বস্তিবোধ করে, চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যায়। মাণ্ডুর ‘রূপমতী’ ঠিক সেইক্ষণেই আবার অভিনয় ক্ষমতার অন্য এক উচ্চমার্গে উঠে যায় যে, এটাও সত্যি। লক্ষ সব-ই করেছে রুন। তক্ষদা রিহার্সাল ছেড়ে চলে গেলেই আবার আস্তে আস্তে নিজের ওপর দখল ফিরে পায় মেয়েটা। সম্মোহনটা কেটে যেতে থাকে। কে জানে, তক্ষকটা হিপনোটিজম জানে কি না।
রীতি মেয়েটাও সত্যি অদ্ভুত। ওকে বোঝা ভারি মুশকিল। ও যে, রুনকে এক বিশেষ চোখে দেখে তা রুন, ভালো করেই বোঝে কিন্তু সেই ‘বিশেষত্ব’র স্বরূপটা বুঝে উঠতে পারে না। ইতিমধ্যেই দু-দিন রুন দেখেছে যে, তক্ষদার স্কুটারের পেছনে করে রীতি আসছে ‘কারো’ নদীর দিক থেকে। একবার দেখেছিল কী যেন, একটা ছুটির দিনের বিকেলে। আর একবার রাত নটা নাগাদ গত শুক্রবারে। কাগজের অফিসের লোকদের তো ডিউটি আওয়ার্স-এর কোনো মাথা-মুন্ডু নেই। নিশ্চয়ই তক্ষকের নদীপাড়ের নির্জন পোড়োবাড়ির ভূতুড়ে গর্তেই গিয়েছিল ও। সেখানে কী করতে যায়, কে জানেঃ একটা লালপাড় সাদা-শাড়ি আর লাল ব্লাউজ পরেছিল। আর রাতে যেদিন দেখেছিল, সেদিন পরেছিল জিন্স-এর ট্রাউজার। গায়ে, প্রলিনের হলুদ গেঞ্জি। ঝিরাটোলিতে রীতিই একমাত্র মেয়ে যে, জিন্স পরে, হাঁসের বাচ্চার মতো গুবলু-গাবলু হলুদ-রঙা টেনিস বলের-ই মতো গোলাকৃতি দু-টি বুক। ব্রেসিয়ার-হীন গেঞ্জির নীচে নীচে নাচাতে নাচাতে আঁটো-গেঞ্জিকে প্রায় ফাটো-ফাটো করে তক্ষ রায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে, তার স্কুটারের পেছনে বসে, ঝিরাটোলির বাজারের পথে। ঘুরে বেড়াতে পারে, ওর টেনিস বলের মতো দু-টি বুকে বল যে যথেষ্ট-ই আছে, সে-বিষয়ে সন্দেহর অবকাশ নেই ঝিরাটোলির একজনেরও। অথচ ও নিজে না চাইলে ওর কাছাকাছি আসার হিম্মত ধোবি-মহল্লার ভিগু গুণ্ডারও নেই। রীতি বেঁচে আছে পুরোপুরিই ডোন্ট কেয়ারে। ওর এই ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাবটাই মাটি করবে সব। মানে, রুনের ভবিষ্যৎ! যদি ভবিষ্যৎ বলে থেকে থাকে ওর কিছুমাত্র।
বাবা সেইক্ষণেই লাঠি হাতে চ্যবনপ্রাশ আর ইসবগুল কিনতে গিয়ে গোলবাজারে দেখেও ফেলেছিলেন, এ-পোশাকে রীতিকে, তক্ষদার স্কুটারে উপচে-পড়া কথা, ছলাৎছলাৎ-বুকে উছলোতে উছলোতে চলে যেতে। দেখেই, বাড়ি ফিরে এসে মাকে জ্বরগ্রস্ত গলায় বলেছিলেনঃ ‘শুনতাছো। তোমার প্রিন্সরে কইয়া দিয়ো য্যান এসব বাজাইরা মাইয়াগো লইয়া যাত্রা-টাত্ৰা ফিউচারে আর না করে। এই পরথম। এই শ্যাষ। হঃ। কইয়া দিয়ো।’
রুন শুনেছিল ওর ঘর থেকে।
কী বিচ্ছিরি ভাষা! যে মানুষেরা চল্লিশ বছর ধরে অমন বাজে একটা বিজাতীয় প্রাকৃত ভাষা ক্রমান্বয়ে ব্যবহার করে করে, আধুনিক পশ্চিমবঙ্গর ভব্য বাংলা ভাষাকে কোতল করতে পারেন এমনভাবে, তাঁদের আর যাই-ই বলা যাক ‘সিভিলাইজড’ বলা যায় না। খুব-ই রাগ হয় রুনের। কিছুটা রীতির ওপর, কিছুটা তক্ষদার ওপর আর বেশিটাই মা-বাবার ওপর। কেন যে, তার এমন অশিক্ষিত বাঙাল মা, বাবা হল!
‘ম্যাদা’ যদি কোনো জায়গার নাম হয়, তবে সে-জায়গা যে, কেমন তা রুনের অনুমান করে নিতেও কষ্ট হয় না কোনোই। কোন জেলার কোন শহরে সে-জায়গা তা জানবারও কোনো আগ্রহ নেই। বাবা-মা এখনও রুচিতে, মানসিকতায়, আধুনিকতায় চল্লিশ বছর আগের ‘ম্যাদা’তেই বাস করে যাচ্ছেন। সভ্য সমাজের কোথাও প্রেজেন্টও করা যায় না ওঁদের। রুনকে দেখে যদিও কারো ভালো লাগে একটুও; মা-বাবাকে দেখলেই সে, ভালোলাগা কেটে যাবে। দাদাটা তো হাওয়া হয়ে গিয়ে কানাডাতে ফুর্তি মারছে। একা রুন-ই পড়ে আছে। এই খোঁদলে জন্মের মতো একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাচীন, বিদেশি’ দম্পতির সঙ্গে ফেঁসে। বাবা-মায়ের শেকড়ে-ফেরার স্বপ্ন যে, সত্যি হবে না, তা রুন জানে। হয়তো তাঁরা নিজেরাও জানেন। সব দেশেই সব সমাজেই কিছু মানুষ থাকেন সবসময়েই যাঁরা মহড়া দেন; নাটক কোনোদিনও মঞ্চস্থ করবেন না জেনেও। অথচ জেনেশুনেও একদিনের জন্যেও ঝিরাটোলির অন্য দশজন শিক্ষিত, আধুনিক, রুচিসম্পন্ন মানুষের মতো বাঁচতে পারলেন না ওঁরা। অথবা বাঁচলেন না। ওঁদের অসামাজিক বললেই সব বলা হয় না, বলতে হয় অ্যান্টি সোশ্যাল। এইরকম এক অলীক জীবন নিয়ে, দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে, নাড়ি-উলটে-আসা দুর্গন্ধ শুঁটকিমাছ খেয়ে, একজন মানুষ আর একজন মানুষী প্রায় অন্ধর-ই মতো কী করে যে, গত চল্লিশটা বছর, রুনের জন্মর অনেক আগে থেকেই, এইভাবেই কাটিয়ে দিলেন তা সত্যিই ভেবে পায় না ও। এক ধরনের অন্ধ বোধ হয় থাকেন, যাঁদের হস্তী দর্শনের ইচ্ছেটা পর্যন্ত জাগে না মনে।
বাবা, আজকাল কানে বেশ-ই কম শোনেন। মা, নাকে যেমন, শুঁটকি মাছের গন্ধ পান না; ফুলেরও পান না। অবশ্য এইরকম মানসিকতায় ফুলের গন্ধ খোঁজেনওনি কখনো। পূতিগন্ধ আবর্জনার দিকেই নাক ছিল; ঘ্রাণ-শক্তি জন্মাবার পর থেকেই। কিন্তু তাতে তাঁদের ‘দ্যাশ’ বিলাসে কিছুমাত্রও ভাটা পড়ে না।
সত্যিই ক্লান্ত হয়ে গেছে রুন।
বাবা বললেন, অ-বউ। আজ রাঁধলা কী?
বাবা নিজের ঘরে খাটে শুয়ে তারাতে কথা বলছেন। মা উঠোন পেরোনো রান্নাঘর থেকে তারস্বরে উত্তর দিচ্ছেন।
এ-বাড়িতে লাউডস্পিকারের দরকার পড়বে না কোনোদিনও।
যা যা কইছিলা কাল রাতে। পাট পাতার ঝোল, লোত লোত কইর্যা, চিতল মাছের মুইঠ্যা। কলমি ফুলও ভাইজ্যা দিমু অনে! গরম ভাতে গাওয়া ঘি দিমু। আর গ্যান্দাল পাতার
গ্যান্দাল পাতা পাইল্যা কোত্থিকা?
তা শুইনা কী কাম। দিমু, খাইবা।
রুন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকোয়েজ-এর ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচ্যুড’ বইটা পড়ছিল শুয়ে শুয়ে, কাগজ পড়া শেষ করে! রীতিই পড়তে দিয়েছিল। গতবারে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া বই। বলেছিল, সাহিত্যে নোবেল, অনেকে অনেক কারণেই পান। নোবেল পাওয়া লেখক মাত্রই যে, ভালো সাহিত্যিক হবেন-ই, এমন কথা কেউই আজকাল আর বিশ্বাস করেন না। এবং সেইজন্যই, শুধু নোবেল-ই বা কেন, সমস্ত প্রাইজ পাওয়া বই-ই পড়ে দেখা উচিত। প্রাইজটা, পোলিটিক্যাল কারণে পেলেন লেখক, না পেলেন; যা, অর্ডার অব দ্যা ডে সেই স্ট্রিং-পুলিং করে; অথবা সত্যি সত্যিই লেখার-ই গুণে!
কী কইল্যা? কলসখান ভাইঙ্গা ফ্যালাইছো? দ্যাখছো কান্ডডা। কী ফ্যাস্টোকেলাস কলস খান।
বাবা তারস্বরে চেঁচিয়ে বললেন মাকে। বাবা কানে না শোনায়, সবসময়েই তারস্বরে চেঁচান আজকাল। এবং ধান শুনতে কান শোনেন।
আঃ কই কী, আর শুনতাছো কী। তোমারে লইয়া আর পারন যায় না। কইতাছিলাম, আমারে একখান কলম কিন্যা দিয়ে। নিবটা ভাইঙ্গা গ্যাছে গিয়া। যাইবো? পাওন?
পাওন যাইবো না ক্যান। ভাঙছো তো ভাঙছে! বাজারে যখন যামু তখন, একখান আমি লইয়া আইব অনে। এইসব দোকান বাজার করনের মতন প্রেস্টিজ-পাংচার কাম তো আবার তোমার প্রিন্সরে দিয়া অইব না। প্রিন্স তো প্রিন্স-ই, প্রিন্স অব ওয়েলস। আমরা যখন পোলাপান আছিলাম, তখন জাম্বুরা দিয়া ফুটবল খেলছি আর খাকি প্যান্ট পইরা উদলা গায়ে পাঠশালায় পড়ছি। এহনে প্রিন্সদের ফুটানিটা দ্যাহে একবার।
একটু আসতে কও, পোলায় শুইন্যা ফেলাইব অনে।
ওই প্রজন্মর প্রত্যেকটি মানুষ-ই ভন্ড। ভাবছিল রুন। ভন্ডামি’ বড়ো অসহ্য দোষ। রক্ত গরম হয়ে যায়, রুনের ভন্ডামি দেখলেই।
না, না, ঝোলায় কইর্যা যে, আনোন যাইব না কলস, তা কী আর আমি জানি না? বাহাত্তর বছর বয়স হইয়া গেল গিয়া কি অ্যামনেই? ম্যাঘে ম্যাঘে?
হঃ। এরেই কয় বাহাত্তরে ধরন। মরণ। মরণ। আমি খালি খালি কইতাছি, কলম’ আর হে শুনছে ‘কলস’।
নীচু গলায় মা বললেন।
শুনছো! এই যে। কই গ্যালা, অ-বউ।
আরে, ডাল পুইড়া যাইব্যো গিয়া। কইযা কী, তা কও না ক্যান। শুনতা তো আছিই! আমারে তো তোমার দশায় ধরে নাই। ঠসা তো আর হই নাই এহনও পর্যন্ত।
শোনলা। ছাইন্যা পোসটোকার্ড পাঠাইছে ‘ম্যাদা’ থিক্যা, একখান। তাতে লিখছে, ক্যানালের পারে এরশাদ মিয়ায় নাকি এয়ারপোর্ট না হ্যাঁলিক্যাপ্টারের লইগ্যা প্যাড বানাইতে আছেন। আমাগো যাওনের আর কোন চিন্তাডা? কও বউ? কলকাতায় যাইয়া ‘গট গট’ কইর্যা জেট প্লেনে উঠুম আর এক্কেরে সোজা নামুম গিয়া দ্যাশের এয়ারপোর্টে। কী কও?
আমি আর কী কম? যাবা যাবা তো রোজ-ই কও, পেরকিতেই কি আর যাইবা তুমি?
রুন, হাতে কাগজ ধরেই শুয়ে শুয়ে মনে মনে বলল, প্রকৃত যাওয়া এই জীবনে নয়। তোমাদের পা চিরদিন-ই রেডি, গেট-সেট এর চকের গুঁড়ো মেখে উত্তেজনায় কাঁপবে থরথর করে, গো’ কখনো সত্যি হয়ে উঠবে না জীবনে।
দ্যাখবা। এই তো। এই চৈত্র-সংক্রান্তিটা পার কইরাই দোকানের হাল-খাতাটা সাইরা ফ্যালাইয়াই আমরা দুইজনে, মিয়া আর বিবি গ্যাঁট হইয়া বসুম গিয়া প্ল্যানে।
তুমি প্ল্যানে চড়ছ কখনো?
না, বউ। আমাগো যুগে কয় হালায়াই বা প্ল্যানে চড়ছিল? এহনে তো তেলাপোকা ছুঁচারাও প্ল্যানে চইড়া ফুরফুরায়। সুযোগ হইল কই কও? এইবার অইব। তোমারে ফালাইয়া কি চড়তে পারি? কও? বোজলা, শুনছি নাকি প্ল্যানে খাবার-টাবারও দ্যায়। শুদামুদা এতগুলান টাহা তো লয় না বাংলাদ্যাশ বিমান। যামু যহন, তহন বাংলাদেশ বিমানেই যামু। আমাগো দ্যাশি পেলেন। কী কও তুমি? আরে, আমাগো কী খাতির না কইর্যা পারে? দ্যাশের ছাওয়াল মাইয়া নিজেগো দ্যাশে ফিরুম, দেইখ্যো অনে আদরের ঘটাখান। মালা পরাইয়া চন্দন লাগাইয়া এক্কেরে ওয়েলকাম কইরা লামাইব অনে লাল গালচা পাইত্বা। হ। কইয়া দিতাছি। দেইখ্যা লইও তুমি।
হ। তা ঠিক।
ডালের হাঁড়িটা নামাতে নামাতে মৃন্ময়ী ভাবছিলেন, কত চৈতসংক্রান্তিই গেল, কত অক্ষয় তৃতীয়া, কত পুজো, সত্যি দেশে আর যাওয়া হল না। গেলে একবার নিজের দেশটাও ঘুরে আসতেন। ইচ্ছে ছিল খুব-ই। দেশ ছেড়ে আসার পর এই ঝিরাটোলি ছেড়ে কোথাও যাননি। মানুষটা খাওয়া আর টাকা রোজগার ছাড়া জানল না কিছুই। গতজন্মে কি শুয়োর-টুয়োর ছিল? কিছুই জানে না। খাওয়ার ব্যাপারে ছাড়া সব ব্যাপারেই হাড়কিপটে। একদিনের জন্যেও এই ঝিরাটোলির বাইরে বেড়াতেও যাননি মৃন্ময়ী গত চল্লিশ বছর। শখ, যা-ছিল, সব ই মরে গেছে।
মণিবাবুরা পদ্মাপারের লোক। প্রমত্তা পদ্মাকে ওঁদের মন্দভাগ্য পদ্মাতীরবর্তী গ্রাম নাকি গর্ভবতী করেছিল। ওঁরা দেশ ছেড়ে আসার পর-ই। বাবার কাছেই শুনেছে রুন!
মৃন্ময়ীদের বাড়ি ছিল চাঁটগায়ে। মৃন্ময়ীর কাছেই শুনেছিল রুন যে, পার্টিশান হওয়ার বেশ কিছুদিন পর-ই আসামের গোয়ালপাড়া জেলার এক গ্রামে তাঁর ছোটোভাইয়েরা এসে বসেন। ওঁরা এসেছিলেন ষাটের দশকের মাঝামাঝি। পশ্চিমবঙ্গে তখন জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট সবকিছুর-ই দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছিল। আসামের দিকে জায়গা-জমি তখনও সস্তা ছিল সেই তুলনায়। চাটগাঁর জমি-বাড়ি জলের দামে বিক্রি করে হুণ্ডি করে যেটুকু, টাকা পয়সা আনতে পেরেছিলেন তাই নিয়েই মামারা আসামে এসে থিতু হয়ে বসেন। পঁচাশির আসাম চুক্তির জন্যে আবারও উদবাস্তু হতে হবে হয়তো তাঁদের। কারণ, তাঁরা বিদেশি।
রুনের ছোটোমামা ব্যাচেলার। মায়ের কাছে তাঁর অনেক গল্পই শুনেছিল। একটু কবি প্রকৃতির মানুষ। অত দুঃখ-কষ্টের পরও কবিতা লেখা সমানে চালিয়ে যাচ্ছেন। একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন। নাম ‘অজানা’। চাটগাঁর মুসলমান জেলেদের নিয়ে লেখা। চমৎকার উপন্যাসটি। পড়েছিল রুন। ছোটোমামাকে চোখে কখনো না দেখলেও ওর মনে হয় উনি যেন ওর খুব-ই কাছের লোক। বাবা-মায়ের থেকেও কাছের। যিনি ‘আত্মার কাছে থাকেন, তিনিই তো ‘আত্মীয়’! নাড়মামা মাকে চিঠি লিখেছিলেন একটি, আসামের বঙ্গাইগাঁও থেকে। চিঠিটা মা পড়তেও দিয়েছিলেন রুনকে। বালিশের নীচেই রেখে দিয়েছিল রুন।
মা আবার বললেন, বাবাকে, নাড়র চিঠিখান পড়ছিল্যা?
ঝাড় ফাড় লইয়া আমারে ডিস্টার্ব কইরো না। ভাবছটা কী তুমি? আমি ব্যবসা থিক্যা রিটায়ার করছি বইল্যা কী আমারে দিয়া ঝাড় কলস কিনাইবা? আমার কী স্টেটাস নাই কোনোই? স্টেটাস?
রিটায়ার ঘোড়াই করেছেন। টাকা-পয়সার ব্যাপারটা পুরোপুরিই নিজের কবজায় আছে। খাটনিটাই রুনের। এই প্রকৃতির মানুষের কপালে বানপ্রস্থ নেই।
ভাবছিল রুন।
হায় ভগবান! কই কী, আর মানুষ শোনে কী? ঝাড়র কথা কই নাই। কইতাছিলাম নাড়ুর চিঠির কথা।
অঃ। তোমার হেই ছোটোব্রাদারের চিঠি? না, পড়ি নাই। তোমার সব-কয়টা ভাই-ই মাইয়া। দ্যাশ তো গেছিল গিয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের-ই কিন্তু এমন প্যানপ্যানানি কাউরেই করতে দেহি নাই; সিচুয়েশান ফেস করন লাগে! তবেই না মরদের পোলা! আমি, ও চিঠি পড়ি নাই, পড়বার টাইমও নাই। তুমি নিজে লিইখ্যা দিয়ো, নইলে তোমার প্রিন্সরে কইয়ো লিখ্যা দিবে, আমার কিসসুই করণীয় নাই। ছুটকির বিয়ায় আমি আড়াইশো টাহা দিছিলাম না। আজ তিরিশ বছর আগের আড়াইশো টাহার দাম আজ হইল গিয়্যা আড়াই হাজার টাহা, কম কইরাই যদি ধরন যায়। যা দিছি দিছি। আর এক পয়সাও আমি পারুম না, দিমুও না। ফাইট করুক। লইড়্যা খাউক। অমন ম্যাদামারা মানুষগুলানের না-খাইয়া মরণও ভালো।
রুন ভাবছিল, নিজেদের দ্যাশ ‘ম্যাদা’তে অথচ ম্যাদামারা বলছেন ছোটোমামাকে। মাঝে মাঝেই রুনের প্রচন্ড রাগ হয় মণিমোহনের ওপর। মণিমোহন-ই যে, ওর বাবা সে-কথা মানতে পর্যন্ত ইচ্ছা করে না। দাদাও এই কারণেই পালিয়ে ছিল, এই পরিবেশ ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি পারে। বেঁচেছে গিয়ে। টাকাও যে, পাঠায় না, তাও হয়তো এই রাগেই। দাদার পড়াশুনোর পথে বাবা চিরদিন-ই বাধাই দিয়েছেন। বলেছেন, হায়ার সেকেণ্ডারিটা পাশ কইরাই ব্যবসায় লাইগ্যা পড়ো। বেশি পড়াশুনা, মানুষের গুমোর বাড়াইয়া দ্যায়। আর গুমোর লইয়া ব্যবসা করন যায় না। কোনো ব্যবসাই না। ব্যবসা হইল মুখ-বেইচ্যা খাওন। মুখে ‘মধু’ যার নাই, তার ব্যবসা অইব না!
ছোটোমামার চিঠিটা পড়ে খুব-ই অভিভূত হয়েছিল রুন। বড়ো করুণ সে-চিঠি। ছটোমামা লিখেছিল–
পূজনীয়া দিদি,
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে একবার উদবাস্তু হয়ে দেশ ছেড়ে এসেছিলাম আসামের বঙ্গাইগাঁওতে। দেশ তুইও ছেড়ে ছিলি, কিন্তু বিয়ে করে। এদেশের মেয়েরা বোধ হয় শিশুকাল থেকেই শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্যে তৈরি হয়েই থাকে। শ্বশুরবাড়িটাই তাদের আসল বাড়ি। কারণ, জীবনের বেশিটা ভাগ তাদের কাটে সেখানেই। আস্তে আস্তে সেটাই নিজের বাড়ি হয়ে ওঠে, আর যখন ঠিক এমন-ই সময় এল এই ফরমান। আমরা আবারও বিদেশি হয়ে গেলাম। চলে যেতে হবে আসাম ছেড়ে।
কিন্তু যাব কোথায়?
সমুদ্রের জলে? আমি জানি না রে বড়দি, হয়তো ভবিষ্যতে একদিন বাঙালিরাও ইহুদিদের-ই মতো নিপীড়িত, নির্যাতিত, অপমানিত হতে হতে একদিন এক নতুন ইজরায়েল গড়বে। তাদের ইজরায়েল। কিন্তু এও জানি যে, এ নিছক কথারই কথা। ইহুদি’ জাতটা খাঁটি সব মানুষ দিয়ে তৈরি ছিল। তারা মেধাবী, পরিশ্রমী, আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন। কোনো দেশের-ই পরিচয় নিছক মানুষ দিয়েই হয় না, মানুষের মতো মানুষ সে-দেশে ক-জন তা দিয়েই হয়। বাঙালিরা সংখ্যায় গিনিপিগের মতোই বাড়ে প্রতিবছরে কিন্তু মানুষের মতো ‘মানুষ’ পাওয়া যায় না খুঁজে, দশ লক্ষেও একজন। অপেক্ষা করতে হবে আমাদের আরও কতদিন একজন নেতার জন্যে, কে জানে রে দিদি? নেতা কি আসবে? কুকুর-বেড়ালদের নেতা কুকুর-বেড়ালই হয়, বাঘ-সিংহ আসবে কোত্থেকে? পুরো জাতটা যেদিন বাঘের বা সিংহের জাত হয়ে উঠতে পারবে, সেদিন নেতাও হবে বাঘ-সিংহর মতো।
অপেক্ষায় আছি রে দিদি। স্বদেশ পাব, থিতু হব এই বাসনা ছিল। রয়ে গেলাম বিদেশে। সারাজীবন ধরে তোড়-জোড়, জোগাড়যন্ত্র, ম্যারাপ বেঁধেও যা হবার নয়, তা হয় না। এই কথাটাই মেনে নিতে শেখাচ্ছি এখন মনকে। আর সেই কারণেই নিজেকে মানুষ বলে মানতে ভারি লজ্জা করে রে!
ছোটোমামা শেষে লিখেছিলেনঃ তোরা সব ভালো থাকিস। আমি এক মধুর স্মৃতিমাত্র। তোরা ঠিক বুঝবি না দিদি।
আমার হাতে লাগানো আকাশমণি গাছ, বুধি বাছুর লাল; রাই গাইয়ের তৃতীয় বিয়োন, মেটে-রঙা; তার গায়ের গন্ধ, এখনও আমার নাকে লেগে আছে রে। তার উজ্জ্বল কালো চোখের চাউনিতে চোখ ভরে আছে। সমুদ্রের পারের ‘হু হু’-বওয়া নোনা গা-চিটচিট করা হাওয়ায় মেশা বালিতে শুকোতে দেওয়া বম্বে-ডাক’ আর ইলিশের শুঁটকির গন্ধ। আরও কত কী! স্বদেশ কোনো বাড়ি নয়, আরাম নয়, নিরাপত্তা নয়, স্বদেশ-কাক জ্যোৎস্নার রাতে চেনা রাত-পাখির অস্ফুট ডাক, বসন্তের ভোরে শিমুলের ডালে-বসা জলের মধ্যে নকশিকাঁথা সেলাই-করা কোনো চিকন-গলার অনাঘ্রাত অচুম্বিতা কিশোরীর জল-ভেজা চুলের গন্ধ; তার হাতছানির স্নিগ্ধস্বাদ। এইসব নিয়েই স্বদেশ।
বঙ্গাইগাঁওকেই স্বদেশ করে নিলাম! দাদার সংসারে যতটুকু পারি সাহায্য করতাম। নিজের সংসার ভাগ্যিস করিনি। বাকি সময়ে কচুগাঁও, রাইমানা, যমদুয়ারের জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। সে ভারি গহন অরণ্য সব। জঙ্গলে গিয়ে গিয়েই দেশ ছাড়ার দুঃখটা ভুলেই গেছিলাম পুরোপুরি। নিজেকে বিশ্বাস করিয়েছিলাম যে, এই গ্রহ, এই সমস্ত পৃথিবীটাই আমার দেশ, সমস্ত আধুনিক মানুষের দেশ। তা ছাড়া, বঙ্গাইগাঁওতেও গাছ পুঁতেছিলাম। গাছ আর মাটি এ, বড়ো ভীষণ জিনিস। বড়ো মারাত্মক মায়াজাল তাদের মানুষের ওপর। সেইসব গাছেও ফুল ফুটত, পাখি ডাকত, কাঠবিড়ালি দৌড়ে যেত দুষ্টু শিশুর মতো। জীবিকার বন্দোবস্তও একটা হয়েছিল। দুই ভাইয়ের রোজগারে চলে যাচ্ছিল দিন। মনটা, দ্যাশ’-এর স্মৃতি ভুলে বঙ্গাইগাঁওকেই দেশ বলে মানতে শুরু করল। ভগবানের কাছে খুব-ই কৃতজ্ঞ, কারণ আমি একজন লেখক। লেখকের জীবনে কোনো অভিজ্ঞতাই ফেলা যায় না। যা-কিছুই ঘটনা তার জীবনে ঘটুক-না-কেন, সুখাবহ, দুঃখাবহ, সম্মানের-অসম্মানের সবকিছুই তার লেখার মধ্যে দিয়ে, একদিন-না-একদিন ফুল হয়ে ফুটে ওঠেই ওঠে। কখনো ফুল, কখনো রক্তাক্ত ক্ষত। সে যদি, সত্যিকারের লেখক হয়; নামেই শুধু লেখক না-হয়।
রুন অবাক হয়ে ভাবে! এই ছোটোমামার মতো একজন মানুষ, তার মায়ের আপন ভাই! জীবন, পরিবেশ একজন মানুষকে কতই না বদলে দেয়। মা এখন ডাইল-ছড়ানো তরকারি, কুচা শিঙ্গির পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা-বেগুন দিয়ে রাঁধা বাবার মুখরোচক রসসা, হালুয়া আর পাঁপড়ভাজা আর, ভেটকি মাছের কাঁটাচচ্চড়ির ছোট্টজগতে কেমন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লীন হয়ে গেছেন। অথচ ছোটোমামার জগৎ কত উদার, কত বড়ো। বাবার জন্যেই মা এমন হয়ে গেছেন। অথচ মায়ের সে, বোধটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই যে, একজন মানুষের ঠিক এইভাবে বেঁচে থাকা কখনোই উচিত নয়, ক্রীতদাসীর মতো, নিজের সমস্ত নিজস্বতা তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিয়ে। নাতসিদের জার্মানির কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পেও বোধ হয় মানুষ এতখানি অত্যাচারিত হত না, বাংলার লক্ষ লক্ষ ঘরে ঘরে মেয়েরা যেভাবে আজও অত্যাচারিতা হয়।
বাঙালি জাতটাকে ভগবান-ই স্বাধীনতার পর দাবা-খেলার খুঁটি করে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন দাবাড়ুরা তাদের যেখানে খুশি তুলছে আর ফেলছে। মানুষ তারা আর নেই। অনেকেই নিজেরা সুযোগসন্ধানী, ধূর্ত, খল, মিথ্যাচারী, ফাঁকিবাজ, দালাল হয়ে গেছে। হাতি, ঘোড়া, নৌকো, পদাতিক এইসব-ই হয়ে গেছে, তারা সুন্দর সাদা-কালো এই বিরাট জাতীয় দাবার ছকে।
কী করছিস রে? দেখ। কীরকম তোর বাড়ি চলে এলাম। এত্ত বছরে একদিনও তো বলিসনি আসতে! খাওয়াসনিও কোনোদিন।
রুন চমকে উঠে তাকাল, রীতির গলার স্বরে।
সত্যিই রীতি! তার ঘরে! একটা কালো শাড়ি পরেছে আজ। সাদা ব্লাউজ। কাজল দিয়েছে চোখে। কালো টিপ। কালো দুল। শ্রাবণের দুপুরের আকাশের মতো দেখাচ্ছে। কানে হাট থেকে কেনা দেহাতি রুপোর দুল আর গলার রুপোর হারকে বিদ্যুতের ঝলকের-ই মত মনে হচ্ছে সেই আকাশে।
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল রুন রীতির দিকে। সৌন্দর্যর আলাদা একটা আকর্ষণ আছেই। মুগ্ধ করে দেওয়ার নিজস্ব প্রক্রিয়া। যেমন হয়তো আছে, অর্থেরও।
রীতির রুনের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, দিদির বাড়ি গেছিলাম। সীতেশদা জিপ দিল পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। বাবা আবার অফিসের গাড়ি-টাড়ি পার্সোনাল কাজে ব্যবহার করা একেবারেই পছন্দ করেন না। বলেন, এ-হচ্ছে হাইট অফ ডিসঅনেস্টি; এক ধরনের মিসডিমোর। তাই সাহস করে আর বাড়ি অবধি গেলাম না। তোদের বাড়ির সামনে জিপটা আসতেই নেমে পড়লাম। ভাবলাম, সারপ্রাইজ দেব তোকে জোর। আজ তো স্টেজ রিহার্সাল। তারপর দ্বাদশীর দিনে থিয়েটার। ব্যস সব শেষ। আউট অব সাইট, আউট অফ মাইণ্ড। কলেজের পরে তাও বেশ তোর সঙ্গে দেখা হত, ঘন ঘন এই দেড় মাস। আর হবে না। ভাবতেই মনটা খারাপ লাগছে রে। তাই-ই তো এলাম এমনি করে। থিয়েটারের পর দেখা করবি তো আমার সঙ্গে? না ভুলেই যাবি?
কিছু বলতে পারল না রুন। চুপ করে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ।
রীতির ব্যক্তিত্বটিই অমন। লেসলি এবারকম্বির একটি কবিতা পড়েছিল অনেকদিন আগে। ‘শি, শি; লাইক আ ভিজিটিং সি, হুইচ নো ডোর কুড এভার রেসট্রেইন।‘ রীতি যে-দরজা দিয়েই ঢুকুক-না-কেন, যখন-ই ও, যে-ঘরে ঢোকে, সে-ঘরের সবকিছু সমুদ্রের ঢেউ হয়েই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাধা কাকে যে বলে, ওর জানা নেই। দ্বিধাও নয় কোনোরকম। ‘পরাধীনতা’ কথাটা তো ও জানেই না। ও মুক্তির প্রতীক।
রুন চেয়ারটা টেনে বলল, বোস।
তোর সঙ্গে রিহার্সালে তো কথাই হয় না। আজকাল সকলেই এত সিরিয়াস হয়ে গেছে যে, বলার নয়। সকলের-ই যেন ধারণা যে, সবাই বড়ো বড়ো অভিনেতা। হাসি পায় আমার। অভিনয়ই যেন, আমাদের জীবনের এক বিশেষ ব্রত। হাইট অফ হিপোক্রিসি! বল রুন?
এক বিশেষ বিদ্যা, সে শিল্পই হোক, কী সাহিত্যই হোক বা অভিনয়ই হোক সারাজীবন লেগে যায় তা শিখতে। সাধনার জিনিস এসব। চালাকির নয়। ব্রত’, সত্যিই ব্রত করাই তো ভালো। যখন যেটা করবি সেটা প্রফেশনালদের মতো করে করতে চেষ্টা করাটা তো ভালোই। চাওয়াটা বড়ো হলে, পাওয়াটা তার কাছাকাছি আসে।
তুই আজকাল বড্ডবেশি জ্ঞান দিস রুন। ফর্ম ফিল-আপ করেছিস? কাজের কথা বল।
কীসের?
বাঃ। কমপিটিটিভ পরীক্ষার কোচিং ক্লাসের। পান্ডে সাহেবের ক্লাস রে!
আমি পরীক্ষাতে বসব না।
মুখ নামিয়ে বলল, রুন।
কেন? অবাক গলায় বলল, রীতি। উত্তেজিত দেখাল ওকে।
বাবা-মায়ের ইচ্ছা নয়। তা ছাড়া…
তাই-ই। তাহলে বংশীবাদন বংশলোচন-ই হবি?
বৃষ্টি হয়ে যেন, ভেঙে পড়ে বলল। শ্রাবণের দুপুর, রীতি; হতাশ আর আক্ষেপের গলায়।
আর তুই? তুই-ই বা বসছিস-না কেন? রুন বলল, উলটো অনুযোগ করে।
আমি কী করে বসব? বুড়ো বাবাটা চোখে দেখে না। আমার ভরসাতেই তো আছে। বাবা যতদিন আছেন, পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি নিয়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার কথা ছেড়েই দে, এদেশের মেয়েদের পক্ষে যেটা করা সবচেয়েই সোজা, সেই বিয়েটা পর্যন্ত করা সম্ভব নয়। আমি ছাড়া বাবার কাছে কে আছে বল?
কেন? বিয়ে করতে অসুবিধে কী?
করতে পারি, যদি ঘরজামাই হয়ে থাকতে রাজি থাকে কেউ। কিন্তু ঘর-জামাই তো রাজা মহারাজাদের হয়। আমার বাবার তো সামান্য পেনশন আর কিছু এফ ডি আর ইউনিট ট্রাস্ট-ই ভরসা। আমাদের দুজনেরই টায় টায় চলে বলে।
রুন মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়েছিল রীতির দিকে। মনে মনে বলল, টায়-টায়’? তা নয়, তা নয়। রীতি যেখানেই থাকে, সে-জায়গাই পূর্ণতা পায়। শুধু তাই-ই নয়, পূর্ণ করে উপচে দেওয়ারও স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে ওর মধ্যে।
হঠাৎ-ই সীতেশদার বাড়ি গেলি? চারছকের মোড়ের মাতালদের নামে নালিশ করতে নাকি? করলি সেই শেষকালে?
দুস। তা, না। তা ছাড়া হঠাৎ আবার কী? শালি, জামাইবাবুর বাড়ি যাবে এরমধ্যে হঠাৎ এর কী দেখলি তুই? মেজদি গেছে বড়দির কাছে বেড়াতে, পাটনাতে। বড়দিদের বিয়ের দশবছর হবে কালকে। পার্টি হবে বড়ো। তাতেই বড়দিকে মদত দিতে গেছে। সীতেশদাটা একা আছে, তাই-ই ভাবলাম, সেজেগুজে গিয়ে একটু, কার্নিক মেরে আসি। জামাইবাবু বলে ব্যাপার।
একটু চুপ করেই বলল, তোরা এই পুরুষমানুষগুলো না, পেট-কাটি ঘুড়ির চেয়েও হালকা-পলকা। তোদের কোনোই ওয়েট নেই। একটু কার্নিক খেলেই তোরা গোঁত্তা মেরে পড়িস মুখে থুবড়ে। সবাই একইরকম। একটু চুপ করে থেকে বলল, না, সবাই নয়, এক্সেপশানও থাকে অবশ্য। অ্যাণ্ড এক্সেপশান প্রভস দ্যা রুল।
থাকে বুঝি?
রুন ঈর্ষার গলায় বলল, ঈর্ষাটাকে ওর পরিচিত এবং অনুপস্থিত একজন মানুষের জামার বুকপকেটে রেডক্রসের ফ্ল্যাগ-ডে’র ছোট্ট লাল ফ্ল্যাগের-ই মতো আলপিন দিয়ে, মনে মনে সেঁটে দিয়ে।
রীতি ওর চোখেই বুঝল সে-কথা।
বুঝল বলেই, জোর গলায়-ই বলল; থাকে বই কী। নিশ্চয়ই থাকে। ব্যতিক্রম’-ই সব নিয়মকে বাঁচিয়ে রাখে। ব্যতিক্রম না থাকলে নিয়মমাত্রই মাঠে মারা যেত।
হঠাৎ বাবার গলা শুনল রুন।
ক্ষুধা লাগছে কইলাম না তোমারে! চূড়া ভাজাটা কী হইল? ঝরিরে কওনা লইয়া আসবোনে। গলাটাও খুশ খুশ করতাছে। আদা দিয়া একগ্লাশ সরেস চা কইর্যা দাও দেহি। অ, অ বউ। তোমার প্রিন্স তো আজ বাড়িতেই আছে বোদয়, তাঁরেও এটু দিয়ে।
কোথায় স্যা? তার তো গলা শুনি নাই সকাল থিক্যাই! বাইরাইছে বোদয়।
দ্যাখো যাইয়া, ঘরে শুইয়া রিটায়ার্ড মানুষের মতো ঠ্যাং-এর উপর ঠ্যাং তুইল্যা প্যাপার পড়তাছে বোদয়।
বাবা নিজে কানে কম শোনেন বলে এতই চেঁচিয়ে কথা বলেন যে, পথের লোকও শুনতে পায়। যেমন ভাষা তেমন-ই গলা।
ভীষণ-ই লজ্জা করতে লাগল রুনের! অথচ রীতির বাবা কীরকম আস্তে আস্তে কথা বলেন। কী জ্ঞান ভদ্রলোকের। কত বিষয়ে জ্ঞান। গেলেই, বন্ধুর মতো ব্যবহার করেন। নিজে যা খান তাই-ই খাওয়ান, কত বিষয়েই যে, আলোচনা করেন উনি। প্রকৃত শিক্ষার প্রভাব একজন মানুষের ওপর যে কী, সুন্দর হতে পারে, প্রসূনবাবু যেন, তার-ই এক চমৎকার উদাহরণ। আর তার বাবা? মণিমোহন? অশিক্ষার প্রভাবের সাইনবোর্ড। জীবনে সাহিত্যের বই কিছুমাত্রই পড়েননি। খবরের কাগজ, নয়তো রহস্য-রোমাঞ্চ বিষয়ক কোনো রগরগে বই। পঞ্জিকা। একটামাত্র ইংরিজি বই বাবার ঘরে দেখেছিল। একটা নয়; দুটো। কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের ম্যানুয়াল একটা। আর বাঁশের জঙ্গলের সুন্দর ছবি দেওয়া আর্টপেপারে ছাপা কভারের একটি ইংরিজি বই; ‘হাউ টু মেক মানি অন ব্যাম্বুজ।
মা উত্তর দিলেন, তেমন-ই গলা তুলে; নইলে বাবা শুনতে পাবেন না।
ঘরে আছে, না, দ্যাখো গিয়া হেই প্রফেসরের বাড়ি পৌঁছাইছে সক্কালে সক্কালে? সেই নষ্ট ছেমড়িটা তো পোলাড়ার মাথাটাই এক্কেরে চিবাইয়া খাইতাছে। কী যে অইব, ভগবান-ই জানেন।
আরে অত্ত ইসপেকুলেশানে কামডা কী! সাইকেলডা আছে না, নাই দ্যাহো দেহি উঠানে।
একটু পরেই মা বললেন, আছে ত দেহি।
তবে তো তোমার প্রিন্স প্যালেসেই আছেন। দিয়ো তারেও, চূড়া ভাইজ্জা। মধ্যে একটু বাদাম, একমুঠ ডালমুট, ধইনা পাতা আর শুকনা লঙ্কা। মুচমুইচ্যা কইর্যা ভাইজ্জা দিতে ভুইলো না য্যান। বোঝলা বউ!
রীতি, ভীতা হরিণীর চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ রুনের দিকে। ওর কাছে, এই ভাষা ল্যাটিন বা জার্মান বা ফ্রেঞ্চের-ই মতো বিজাতীয়। তবু একমুহূর্ত চুপ করে থেকে রুনকে বলল, ছেমড়ি” মানে কী রে?
রুন চুপ করে রইল। ওর দু-টি কান গরম হয়ে লাল হয়ে গেছিল।
তোর সঙ্গে এত বছরের আলাপ, তুই কিন্তু একদিনও আমাকে তোর বাড়িতে নিজে আসতে বলিসনি। ভাবতাম, তুই খুব-ই অভদ্র। তাই আমি নিজেই এলাম। তোদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল জিপটা।
অপরাধীর গলায় নীচুস্বরে বলল রীতি।
বলল, ভেবেছিলাম, তুই, তোরা; বোধ হয় খুশি হবি।
বাবা আবার বললেন, ওই প্রফেসরের বউটাও তো এক্কেরনম্বরের ক্যারেকটারলেস আছিলো। তার মাইয়াও তার-ই মতো অইব যে, ইতে আর আশ্চর্য হওনের আছেটা কী?
রীতি বলল, আমি তোর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে যাই? প্রণাম করে যাই? প্রথম দিন এলাম।
রুন বলল, কথাটা বলতে ওর বুক ফেটে গেল; তবু বলল, রীতি। আমার বাড়ি নেই রে! আমার কিছু নেই। আমি বড়ো একা। তুই চলে যা রীতি। তোর জন্যেই বলছি। তোকে আমি সম্মান করি। তোর বাবাকে সম্মান করি, তোকে আমি…তুই এক্ষুনি চলে যা রীতি; আমি কোনোদিক দিয়েই যোগ্য নই তোর। তুই আমার সঙ্গেও কথা বলিস না কোনোদিন আর। আর, তুই আমার বাবা-মাকে ক্ষমা করে দিস রে। আমি ক্ষমা চাইছি, ওঁদের হয়ে।
রীতি সামান্য সময় পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইল রুনের মুখের দিকে। এক আশ্চর্য রহস্যময় এবং হয়তো ক্ষমাময়ও, হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, সহনশীলতা, ভদ্রতা, শিক্ষা সব সেই হাসিতে মাখামাখি হয়ে গেল।
বলল, তোর মাথা-ফাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোর বাবা-মা তোর গুরুজন। তাঁদের হয়ে তুই আমার মত একটা বাজেমেয়ের কাছে ক্ষমা চাইলি? কী রে তুই? ক্যারাকটারলেস একজন মহিলার ক্যারাকটারলেস মেয়ে আমি। আমিও তো জানি তা। তুইও জানিস। তবু কী সুন্দর, ভদ্র, তোর ব্যবহার আমার সঙ্গে প্রথমদিন থেকেই, বল? তুই অন্য কারো মতোই না রে রুন। তাই-ই তো তোকে এত…
তুই এখনও গেলি না?
তাড়িয়ে দিচ্ছিস আমাকে?
আমার বাড়ি নেই। আমার কিছু নেই!
বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এল রুনের গলা!
তাহলে, যাচ্ছি। কিন্তু যদি যাই তো চল তুইও চল। তোর এখন এখানে থাকা ঠিক নয়। উত্তেজিত হয়ে থাকবি তুই। বাড়ি গিয়ে বাবার জন্যে ব্রেকফাস্ট করব। তুই তো খাসনি কিছুই সকালে। চল বাবার সঙ্গে খাবি। আমিও বসব তোদের সঙ্গে।
রুন কী ভাবল একমুহূর্ত। তারপর-ই বলল, চল। তাড়াতাড়ি চল।
এগো, বলেই, আলনা থেকে আলোয়ানটা তুলে নিয়ে গায়ে দিতে দিতেই দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল রীতির সঙ্গে! যেন, চুরি করে পালাচ্ছে পরের বাড়ি থেকে।
পথে পড়েই, কিছুটা হেঁটে এসে রুন বলল, একটা রিকশা করি?
না। কেন? চলনা হাঁটতে হাঁটতে যাই। চল, পাচুয়া হয়ে যাই। কী সুন্দর শিউলির গন্ধ এখন পথে। রোদটা কেমন ‘পুজো পুজো’ হয়েছে! কাশ ফুটেছে খুব, ফুলকির মাঠে। যাবি? থাক, ব্রেকফাস্ট খেয়ে তারপর যাব। শিশিরের গন্ধে এখনও মাঠ, গাছ সব ভেজা। বেশ, তোের সঙ্গে তোর পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে যাব। তোর ভালো লাগবে-না? আমার দারুণ লাগবে।
রুন কথা না বলে, পাচুয়ার পথ-ই ধরল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে চার্মস’ এর প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল দেশলাই জ্বেলে।
অ্যাই। আমাকে একটা দে তো। সীতেশদা মেজাজটাই খিঁচড়ে দিয়েছে সাতসকালে।
কেন?
ধ্যাত। যাচ্ছেতাই। একলা পেল, একটা চুমু খেয়ে দিল জাপটে ধরে। তার আগে এমন করে পায়ে ধরল যেন, আমি কোনো দেবীটেবীই! পায়ে সুড়সুড়ি লাগছিল। দিয়ে দিলাম ভিক্ষা। মেজদিটার বর বলে কথা। বেশি শক্ত হতে পারলাম না। কিন্তু দেখ, চুমু খাওয়ার রকম আছে অনেক-ই। চুমু তো খেল না; যেন আধ-সেদ্ধ পাঁঠার মাংস ছিঁড়ছে দাঁত দিয়ে। এমন জ্বালা করছে না!
এ কী! লাল হয়ে ফুলেও তো গেছে।
রুন বলল।
রীতি ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখে বলল, তাইতো। থাকগে। তুই তো সঙ্গে থাকবি। বাবা কিছু বলবে না। বুঝবে যে, নিশ্চয়ই তুই খেয়েছিস। তোকে বাবা ভালোবাসে, সীতেশদাকে দেখতে পারে না। দাঁত চেপে বলে, ও ছেলেটি ডিসঅনেস্ট। নীতিও তাই। জীবনে দেবীরা তাঁদের-ই যোগ্য দেব খুঁজে পান। তবে এইটুকুই বাঁচোয়া যে, বাবা ঠোঁট দেখতে পাবেন না। মাইনাস টেন পাওয়ারে মেয়ের ঠোঁটের চুমু দেখা যায় না। বাবারা চোখে কম দেখলে কিছু সুবিধেও আছে। কী বল?
ঠোঁটে আবার একটু হাত বুলিয়ে বলল, বিবাহিত পুরুষমাত্রই জংলি। আমার ঘেন্না লাগে। দুস, মুখটাই তেতো করে দিয়েছে রে! এমন আশ্বিনের সকালবেলায়। তিন বছর বিয়ে হয়েছে এখনও একটা চুমু কী করে খেতে হয় শিখল না? আর এইরকম একজন মানুষের ওপর, সাব-ডিভিশনের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ভার? দেশের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার।
কেউ যদি দেখে ফেলে?
কী?
তুই সিগারেট খাচ্ছিস?
ছাড় তো। ক্যারেকটারলেস মহিলার ক্যারেকটারলেস মেয়ের আর বেশি বদনাম কী হবে?
তুই ক্ষমা করিসনি, না রে?
রুন বলল।
কাকে?
আমার মা-বাবাকে?
মা-বাবা তো গুরুজন। তাঁদের ক্ষমা করার যোগ্যতা আমার আছে, এমন ভাবার ধৃষ্টতাও যেন, আমার কখনো না হয়। আমার বাবা আমাকে তেমন শিক্ষা দেননি। আমি কিন্তু তোকে ক্ষমা করিনি রুন। তুই ক্ষমার অযোগ্য।
আমি? কেন?
এদেশের মেয়েরাই পরাধীন জানতাম। আর্থিক স্বাধীনতা নেই তাদের। আজকে জানলাম যে, আর্থিক স্বাধীনতাই একমাত্র স্বাধীনতা নয়। তুই বড়োই পরাধীন। তুই বড়োই একা। বড়ো কষ্ট হল তোর জন্যে। ওই বাড়িতে তুই থাকিস কী করে? দমবন্ধ হয়ে আসে না। তোর? তোর জীবনটা তো নিজের-ই! আর মোটে একটামাত্র জীবন।
বাবা-মায়ের আমি ছাড়া কেউই যে, নেই। দাদা আসবে না। কে দেখবে ওঁদের?
ইডিয়ট। তুই-ই দেখবি। বাবার ব্যবসায় না ঢুকলে, কি কোনো মানুষের বেঁচে থাকা, সুখে থাকা বন্ধ হয়ে যায়? তোর মা-বাবা অন্য জগতের মানুষ, তুই অন্য জগতের। ভালো-মন্দর কথা আমি বলছি না, ভিন্ন জগতের কথা। বুঝলি? তোর নিজের জগতে বাঁচতে না পারলে মরে যাওয়াও ভালো। খাওয়া-পরা, আর বেঁচে থাকা কী এক? এই সিরাটোলিতেই থাক তুই। তবে অন্য কিছু কর। একটা বইয়ের দোকান দে-না। তুই যদি দিস, আমিও তোর ওয়ার্কিং-পার্টনার হব। বেশ অনেক ইংরেজি আর বাংলা বই থাকবে। রেকর্ডও রাখতে পারিস। বাংলা, ইংরিজি। আবদুল করিম খাঁ, বড়ে গোলাম আলি, আমির খাঁ, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, রবিশংকর, আলি আকবর, নিখিল ব্যানার্জি, বাখ, বিটোভেন, মোজার্ট, চাইকোভস্কি। তা ছাড়া রবীন্দ্রসংগীত, অতুলপ্রসাদ, আর নিধুবাবুর গানের। পল রোবসন। থেকে বনি-এম, আব্বা; মাইকেল জ্যাকসন। মানে, এমন একটা দোকান কর বইয়ের আর রেকর্ডের যেখানে, সবরকম রুচির মানুষের মনের জিনিস থাকবে। ঝিরাটোলিতে শিক্ষিত মানুষ অসংখ্য আছেন কিন্তু বইয়ের দোকান, রেকর্ডের দোকান সব অশিক্ষিত মানুষদের হাতে। মানে, ওঁরা শিক্ষিত পাঠক বা শ্রোতা আজকে যে, ঠিক কী ধরনের বই বা রেকর্ড চান, সে-সম্বন্ধে নিজেরা বিশেষ ওয়াকিবহাল নন। আমার ইচ্ছে আছে, তার সঙ্গে ফুলও রাখব নানারকম। সারাবছরের মতো অ্যাডভান্স নিয়ে কার্ড সই-করিয়ে, জন্মদিনে, ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে আমরা নিজেরা আমাদের তরফ থেকেও একগুচ্ছ ফুল নিয়ে তাঁদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেব শুভদিনে। যদি সত্যিই শিক্ষিত মানুষ হন তবে সেই খুশির দিন পেরিয়ে গেলে তিনি একদিন আমাদের দোকানে না এসেই পারবেন না। রুচিটা তো ব্যক্তিগত ব্যাপার। যতদিন ইণ্ডিভিজুয়াল থাকছে, তার দাম থাকছে। যতদিন দেশ রাশিয়া না হয়ে যাচ্ছে পুরোপুরি, ততদিন ব্যক্তির ব্যক্তিগত গুণ এবং ব্যক্তিগত রুচির দাম থাকবেই।
বাঃ কিন্তু তোর ভাবনা বড়ো দ্রুতগতির। তোর কল্পনার কোনো রাশ নেই।
রুন বলল।
বলল বটে, কিন্তু ওর নাক নতুন বইয়ের গন্ধে ভরে গেল। এল-পি’ রেকর্ডের কাভারের ছবিগুলো ভাসতে লাগল চোখের সামনে।
রীতি বলল, শুধু কল্পনাতে কেন? আমার জীবনেও কোনো রাশ নেই। আমি জীবনেও বরাহীন বল্গাহরিণের মতো বাঁচতে চাই।
কোথায় করব?
কী? চমকে উঠে বলল রীতি।
দোকানটা?
কেন? তোদের বাড়ির বাইরের ঘরে কর।
বাবা মেরে বের করে দেবেন।
আমাদের বাড়ির বাইরের ঘরে কর তাহলে। তোদের বাড়ির চেয়ে আরও ভালো লোকেশন। বাবার ছাত্র-ছাত্রীরা মাস্টারমশাই-এর বাড়ি চেনেন-ই। সেটাও একটা অ্যাডেড ফ্যাক্টর। কী বল?
বাবা-মাকে দেখব না? ওঁরা একা মরবেন?
গাধা, নিজের বিজনেসে যা-প্রফিট হবে, নিজের খরচ রেখে সব-ই মা-বাবাকেই দিয়ে আসবি। যতদিন না বিয়ে করছিস, বাবা-মাকে নিয়ে হলিডে করতে যাবি প্রতিবছর। ছেলের সব কর্তব্যই করবি। কর্তব্য করেও নিজের মতো বাঁচা যায়। বাবা-মার যোগ্য ছেলে হতে হলেই যে, বাবার বাঁশ, কী গামছা, কী ঠিকেদারিকে আঁকড়ে ধরে, নিজের ঘাড়ে চাপাতেই হবে, এমন কথা যেসব ছেলে ভাবে সেগুলো পুরুষ-ই নয়। একটা ছেড়ে অন্যটা ধরার সাহস যার নেই, সে…। বড়ো হ রুন। আর কবে বড়ো হবি বল? সময় তো চলে যাচ্ছে। অ্যাডাল্ট হ।
টাকা দিলেই হয়ে যাবে? বাবা-মায়ের কাছে থাকব না? বুড়ো বয়সে তাঁদের দেখব না? অসুখ-বিসুখ। টাকা দিলেই কী সব হয়?
আঃ। এক-শোবার দেখবি। তোর বাড়িতেই তো থাকবি তুই। সকালে ব্রেকফাস্ট করে সাইকেল নিয়ে এসে দোকান খুলবি। দুপুরে বন্ধ করে বাবা-মায়ের সঙ্গেই বসে খেয়ে আসবি, মায়ের হাতের সুক্তো আর বড়ি ভাজা, আঃ। বাঙালরা দারুণ রান্না জানে রে! খুব শখ ছিল যে, আমার শাশুড়ি বাঙাল হবেন আর সারাদিন এটা-ওটা বেঁধে খাওয়াবেন। কনসিভ করেছি শুনলেই দশরকম আচার বানাবেন বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে। থাকগে। যা বলছিলাম! তুই খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম-টিশ্রাম করে তারপর ফিরে এসে তিনটে নাগাদ আবার দোকান খুলবি। রাতে বাড়ি যাবি। বাবা-মায়ের কোল জুড়ে শুয়ে থাকবি। বুড়ো খোকা।
ক্যাপিটাল? চিন্তিত গলায় রুন বলল।
এইজন্যেই বাঙালির ব্যবসা হয় না। ব্যবসা মানেই, বাঙালি ভাবে, প্রথমেই এয়ার কণ্ডিশনড অফিস। উর্দিপরা-ড্রাইভার। দারুণ ইংরিজি-বলা সুন্দরী রিসেপশনিস্ট। গবেট। তোর হাতঘড়ি, সাইকেল, কলম যা-কিছু আছে বিক্রি করে দে। আমি গয়না বিক্রি করব। ভারী ভারী সোনার গয়না কোনো সত্যিকারের শিক্ষিতা মেয়েরা পরে? শিক্ষাই আমার গয়না, গয়না, আমার গলার গান। আরও যদি দরকার হয় তো ফুলের গয়না আছে, দেহাতি গয়না। আছে, রুপোর গয়না। কত দামি। গয়না তো, সোনা দেখানোর জন্যে নয়, নিজেকে সুন্দর করে তোলার-ই জন্যে। যাদের শিক্ষা নেই, তারাই সোনা দেখিয়ে বেড়ায় গয়না পরে। তোকে দেব যত টাকা পারি, সব বিক্রি করে দেব। যত জঞ্জাল!
তুই! তুই কেন দিবি রীতি?
বাঃ তুই আমার বন্ধু বলে। তোকে আমি পছন্দ করি বলে। আবার কেন? কারো উপকার করব, তারজন্যেও এত্ত কৈফিয়ত। যাঃ। যাঃ। বিদ্যাসাগর মশাই লক্ষ লক্ষ বাঙালি মেয়েদের বাঁচিয়েছেন, আমি না-হয় একজন অবোধ, অবলা পুরুষকেই বাঁচালাম। মানে, বাঁচার হদিশ দিলাম। এই-ই আমার আনন্দ। পুরুষদের ওয়েলফেয়ারে কনট্রিবিউশন। তারপর বাঁচা-মরা তোর-ই ব্যাপার।
ব্যবসা জমে গেলে ব্যবসার প্রফিট থেকে আমার গয়না-বেচা টাকা উইথ ইন্টারেস্ট ফেরত দিয়ে দিবি। আমি একটা লাল মারুতি কিনব সেই টাকা দিয়ে। মাথায় লাল স্কার্ফ বেঁধে খুব জো-ও-ও-রে গাড়ি ছুটিরে দাপিয়ে বেড়াব।
মুখ ঘুরিয়ে রীতি, রুনের দু-চোখে তাকাল পূর্ণদৃষ্টিতে।
ওর ভুরু দু-টি কুঁচকে এল। সিগারেটে একটি টান লাগিয়েই ‘খুক খুক’ করে কাশল দু বার। বিষম খেল। খুঁয়ে ছেড়ে বলল, শুধু এই-ই। সত্যি বলছি রে। আর কিছু করতে হবে না তোকে।
অবাক গলায় রুন বলল, এত্তসব তুই আমার জন্যে করবি এমনি এমনিই। আর কিছুর জন্যে নয়?
আর কীসের জন্যে? প্রশ্নটাকে বুমেরাং করে দিল রীতি। বলল, ইয়েস স্যার। এমনিই।‘
রুন, যে-কথাটি আজ অবধি বলতে পারেনি রীতিকে, অনেক চেষ্টা করেও, এখনও, এমন শিউলির গন্ধ-ভরা আশ্বিন-শেষের সকালেও বলতে পারল না। যা বলতে পারল না আজও, তা কী আর কোনোদিনও পারবে বলতে? কিছু কথা থাকে জীবনে, কিছু মহড়া দেওয়া নাটকের-ই মতো, যা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে না বলে ফেলতে পারলে বা মঞ্চস্থ না করতে পারলে আর কখনোই বলা বা করা হয়ে ওঠে না।