Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মসনদ || Sanjib Chattopadhyay

মসনদ || Sanjib Chattopadhyay

মসনদ

আমার কালো অ্যামবাসাডার গাড়ি রাজভবনে ঢুকছে। যখন গেটে প্রায় ঢুকে পড়েছি, তখন বুকটা ধক করে উঠল। ধরা যাক আর আধঘণ্টা। আর আধঘণ্টা পরে এই এতবড় একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাব আমি। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট্ট একটা কৌটো বার করে, আধখানা সরবিট্রেট জিভের তলায় ঢুকিয়ে দিলুম। দুম করে মরে না যাই! আজ থেকে দশ কি বিশ বছর আগে এই ভবিষ্যৎটা তো আমি দেখতে পাইনি! দেখতে পেলে তেলেভাজা একটু কম খেতুম। হার্টটা ভালো থাকত। কোলেস্টেরল এত বাড়ত না। তখন তো মনে হত, কবে নিবি মা! এখন মনে হয়, সহজে নিস নে মা। দেশের কাজ করতে দে মা। শুধু এলুম, আর হ্যা হ্যা করে চলে গেলুম সেটা কি ঠিক হবে! মহাপুরুষরা বলে গেছেন, দাগ রেখে যা, দাগ।

পাশেই বসে আছে আমার বউ। দশ বছর আগের সেই ঘরোয়ালি চেহারা আর নেই। সাতদিনেই পালটে গেছে। ইন ফ্যাক্ট আমি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারি শুনেই, শরীরটাকে এক্সপার্টদের হাতে ফেলে দিয়েছিল। দে হ্যাভ ডান এ গুড জব। ভালো হাতের কাজ দেখিয়েছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত

এমন একটা ব্যাপার করে দিয়েছে, আড়চোখে তাকালে মনে হচ্ছে পরস্ত্রী। কেন্দ্রের মতো চেহারা করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, কেন্দ্রীয় স্ত্রী। এত কাল কোমরে আঁচল জড়িয়ে বলে এসেছে, ভাত দেওয়া হয়েছে, খাবে এসো। পরশু দুপুর থেকে বলতে শুরু করেছে, লাঞ্চ করবে এসো। কুঁচিয়ে পরা শাড়ি। ববকাট চুল। হাতকাটা ব্লাউজ। জিনিসটা দেখার মতোই হয়েছে। সংস্কার করলে সব বস্তুতেই চেকনাই আসে। পেতলের পিলসুজ আর কি!

রাজভবনের মোরাম বিছানো পথে মশমশ শব্দ তুলে আমার কালো অ্যামবাসাডার দরবার হলের সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। দুধারে দুসার আমার ক্যাবিনেট কোলিগস। শব্দটা ইংরেজি কাগজ পড়ে শিখেছি। সকলকেই আজ কেমন সম্মানিত দেখাচ্ছে! ভেরি রেসপেকটেবল। অথচ বছর দুয়েক আগেও এলাইটস অফ দি সোসাইটি এদের দেখে মুখ বাঁকাত। বলত, স্কামস অফ দি আর্থ। জমানা বদলে গেছে। এর জন্যে আমার পূর্ব পূর্ব পূর্ব নেতাদের ধন্যবাদ। একেবারে সমতল করে দিয়ে গেছেন সব। উঁচু-নীচু বলে আর কিছু নেই। সমাজ এখন ফ্ল্যাট চেস্টেড ওম্যানের মতো।

গাড়ি থেকে প্রথমে নামলেন আমার স্ত্রী। আগে খুব ইংরেজি সিনেমা দেখতুম। মনে হচ্ছে শিফনের শাড়ি পরা সোফিয়া লোরেন। দোলা লাগিয়ে দেবার মতো যৌবন এখনও আছে। গাড়ি থেকে নেমে কলিগদের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, কজন মুখ্যমন্ত্রীর এমন স্ত্রী আছে! খুব সামলে নিলুম। প্রতিদিন নদীর জলের মতো আমার স্ট্যাটাস বাড়ছে। কাল যা ছিলুম, আজ আর তা নেই। চিন্তা, ভাবনা, কথা, সবকিছুতেই চেক ভালভ পরাতে হয়েছে।

সারিবদ্ধ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আমাকে অভিবাদন জানালেন। কাল রাতে এদের নানাভাবে ট্রেনিং দিয়েছি। ভিডিও আনিয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান দেখিয়েছি। নিজে দেখেছি। আমারও তো তেমন। কিছু জানা নেই। বাপের পয়সা ছিল। ছাত্রজীবনটা কলেজ চেখে চেখে কাটিয়ে দিয়েছি। এক। সুন্দরী অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের সঙ্গ পাব বলে কিছুকাল স্পোকেন ইংলিশ শিখেছিলুম। যে কলেজেই গেছি সেই কলেজেই ছাত্র-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি। ছাত্র-আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হলে দেখা যাবে, অনেকটা সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার মতো। তিনটি পর্ব—আদি, মধ্য, অন্ত। আদিপর্বে গেট বক্তৃতা, পোস্টারিং। মধ্যপর্বে ঘেরাও, ধর্মঘট। তারপর মানুষের অন্তিম দশার মতো। বোম, ছুরি, ভাঙচুর, মাঠময়দান।

যাক অতীত এখন থাক। এখন আমার রেলার সময়। পূর্ববর্তী মুখ্যমন্ত্রীর মডেলই আমি অনুসরণ করব। তিনিই আমার গুরু। অমন সফল একজন মুখ্যমন্ত্রী তো এর আগে এ দেশে আসেননি। অদ্ভুত একটা পার্সোনালিটি ছিল তাঁর। হাঁটা-চলা, কথা বলা। তাঁর গুণের কথা বলতে গিয়ে। সাংবাদিকরা একটা কথাই বারে বারে বলতেন, ভদ্রলোকের মুখে কেউ কখনও হাসি দেখেনি। গত তিনদিন আমি একবারও হাসিনি। এখন আমার এমন আত্মবিশ্বাস এসে গেছে, কেউ কাতুকুতু দিলেও হাসব না। আমার স্ত্রী এই যে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, হাই হিল সামলাতে না পেরে উলটে পড়ে গেলেও হাসব না।

আমার পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রীর মতো, এক হাতে কোঁচা ধরে আমি গটগট করে ওপরে উঠে এলুম। বিলিতি আমলের বাড়ি, তার কেতাই আলাদা। আগে কখনও আসিনি। না এলেও ভয় করছে না একটুও। দুপাশে সার সার পামগাছের টব। লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে সোজা দরবার হলে। ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে। বিশিষ্ট অভ্যাগতরা বসে আছেন। বিদেশি কনস্যুলেটের প্রতিনিধিরা এসেছেন। ব্যাপারটা প্রায় রাজসভারই মতো।

গলিত এক বৃদ্ধ। তিনিই রাজ্যপাল। আমাদের দেশের নিয়ম অনুসারে রাজ্যপাল, রাষ্ট্রপতি এইরকমই হবেন। গেল গেল গেল গেল, রইল রইল করে এক একটা দিন যাবে। কবিরাজি, হেকিমি, অ্যালোপ্যাথি, টোটকা করে ছাগল দুধ, গরুর দুধ করে টিকে থাকা।

মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিলাম ইংরেজিতে। উপায় নেই। এই রাজ্যে, এই রাজ্যের মানুষ রাজ্যপাল হবেন, এমন আশা করাটাই অন্যায়। সেটা হবে প্রাদেশিকতা, বিচ্ছিন্নতা, সঙ্কীর্ণতা, একদেশদর্শিতা, দেশদ্রোহিতা। গোর্খারা গোর্খাল্যান্ড চাইতে পারে, অসমীয়ারা আসাম চাইতে পারে, নাগারা নাগাল্যান্ড চাইতে পারে, তামিলনাড়ু অন্য ভাষার মাতব্বরি না মানতে পারে। অন্য প্রদেশের ব্যবসায়ীদের অর্থনীতি কবজা করতে না-ও দিতে পারে; আমাদের তা চলবে না। আমরা আন্তর্জাতিক। বুক পেতে দাও নেচে যাই।

একে একে আমার মন্ত্রিসভার সদস্যরা সব শপথ নিল। দু-একজন একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এত করে তালিম দিয়ে নিয়ে এলুম, তাও ঠিক শেষ মুহূর্তে নার্ভাস হয়ে গেল। কিছুতেই বোঝাতে পারলুম না, দেশ শাসন করার মধ্যে হাতি-ঘোড়া কিছু নেই। শাসন আবার কী? সে ছিল ব্রিটিশ শাসন। ব্রিটিশরা চলে গেছে, শাসনের কালও শেষ হয়ে গেছে। আমরা স্বাধীন, স্বাধীন দেশে শাসন থাকবে কেন? যার যার তার তার ব্যাপার। লড়ে যাও। শাসন নয়, বিজনেস। ইংরেজি কোটেশন দিয়ে বুঝিয়েছিলুম, দি স্টেট ইজ এ বিজনেস। কিছু দাও। কিছু নাও। যাক অনুষ্ঠান শেষ হোক, তখন আর একবার ভালো করে বোঝাতে হবে।

শপথ গ্রহণের পর চায়ের আসর বসল। এইটাই নিয়ম। রাজ্যপাল তাঁর নতুন মন্ত্রিসভাকে চা, পেস্ট্রি খাওয়ান। আমার কোলিগদের একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলুম যে, এই সব জায়গায় অসভ্যের মতো গপগপ করে খেতে নেই। ওরা সেই ভুলটাই করল। যে যা পারল একেবারে। হামলে পড়ে খেতে শুরু করল। বিদেশি অভ্যাগতরা হাঁ করে দেখছেন। কী লজ্জার কথা!

যাক বেশিক্ষণ আর ভাবার অবসর পেলুম না। টিভি, রেডিও, সংবাদপত্রের রিপোর্টাররা একেবারে ছেকে ধরলেন। স্নানগ্লাসের চড়া আলো। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কোনওদিকে আর মুখ। ঘোরাবার উপায় নেই। যেদিকেই তাকাচ্ছি ফটাফট মারছে। এরই মাঝে রাজ্যপালের সঙ্গে অল্প একটু আলোচনা করে নিলুম। মনে হল তিনি বেশ চিন্তিত। রাজ্যের ভবিষ্যৎ কী হবে!

ভবিষ্যৎ কী হবে মানে? অতীতটা কি খুব ভালো ছিল? যা বলবেন ভেবেচিন্তে বলুন। শুরুতেই কেন্দ্রের কণ্ঠস্বর! হিজ মাস্টারস ভয়েস।

রাজ্যপাল গম্ভীর মুখে বললেন, এই ভয়টাই করেছিলুম। রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলার নিয়ম আছে। সেইটা আপনাকে শিখতে হবে। কাগজের স্টেটমেন্টে যা খুশি বলুন। ওটা স্টেট বিজনেসের একটা চাল। জনসাধারণের সামনে নানা ইস্যু রাখতেই হয়। ইস্যু হল ললিপপ। ছেলে কাঁদলে মা যেমন মুখে স্তন গুঁজে দেন। কিন্তু এখানে আমার কাছে যখন আসবেন, তখন আমরা হলুম রাজার জাত। আমাদের কথায় কোনও বিষয় থাকবে না। ঝাঁঝ থাকবে না। শ্লেষ থাকবে না। অর্থবোধক অথবা অনর্থবোধক কিছু শব্দ নিয়ে লোফালুফি। আপনি সব সময় মনে রাখবেন, আমরা নিমিত্তমাত্র।

আপনি কি আমাকে শিক্ষা দিচ্ছেন?

দিতে হচ্ছে। কারণ আপনি নভিস। পার্লামেন্টের ডেমোক্রেসির কিছুই জানেন না। ইউ আর টু লার্ন মেনি থিংস।

আমার কী বলা উচিত ছিল?

আপনার খুব থিয়োরেটিক্যাল কথা বলা উচিত ছিল। পরীক্ষার প্রশ্নোত্তরের মতো। যেমন, পাওয়ার আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি। আনএমপ্লয়মেন্ট নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। ট্রান্সপোর্ট আমরা টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করব। ডু ইউ ফলো?

আমরা টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতেই তো আছি।

ফিজিক্যালি, মেটিরিয়ালি পড়ে আছি সেভেনটিনথ কি এইটিনথ সেঞ্চুরিতে। আমাদের গ্রামে এখনও জোনাকিই বিদ্যুৎ। টোটকাই একমাত্র চিকিৎসা। দিল্লি আর বোম্বাই কোনওরকমে নাইনটিনথ সেঞ্চুরি ক্রস করেছে।

রাজ্যপালের আলাদা একটা আভিজাত্য। বেশ বুঝলুম এই আভিজাত্যে আমার খামতি আছে। মাথা নীচু করে দরবার হল থেকে বেরিয়ে এলুম। আমার স্ত্রী কেবল বলতে লাগল, হ্যাঁ গো, রাজ্যপাল তোমাকে ধমকালেন? ধমকধামক দিলেন!

আমি কথা বলতে পারছিনা। গোটাছয়েক মাইক্রোফোন আমার ঠোঁটের সামনে। আমি চলেছি, মাইক্রোফোনও পাশে পাশে চলেছে। আমার স্ত্রী-র কোমরে এক থাক চর্বি জমেছে। সেটা সুখের না অসুখের বলতে পারব না। বাঁ হাত বাড়িয়ে কটাস করে চিমটি কেটে দিলুম। বোকা, তোমার বুদ্ধি নেই। যা বলছ, সব যে টেপ হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে!

সাংবাদিকদের হাত থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আজকাল আবার মেয়েরা। সাংবাদিকতায় এসেছেন। তাঁদের আবার ঠেলে সরানো যাবে না। ইংরেজি কাগজের এইরকম একজন সাংবাদিক প্রশ্ন নিয়ে ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, আপনি কি এই মিনিস্ট্রি রাখতে পারবেন?

চান করে রক্ত উঠে গেল মাথায়! জিনস পরা ছুকরি বলে কী! বেশ একটু রেগেই বললুম, পারব না কেন?

বড় বেশি জোড়াতালি তো। আর সবাই আনকোরা নতুন। একেবারে নভিস।

কম্পিউটার কি বলেছে জানেন? এইটাই এ রাজ্যের শেষ মিনিস্ট্রি। শেষ কথা। লাস্ট ওয়ার্ডস।

কম্পিউটার তো আর দেশ চালাবে না।

দেশ আমরাই চালাব। লেটেস্ট ম্যানেজমেন্ট টেকনিকে।

একটু এক্সপ্লেন করবেন?

আমার নিজের ধারণা খুব একটা পরিষ্কার নয়। মডেলটা দিল্লি থেকে ধার করব। প্রয়োজন হলে আমেরিকা চলে যাব। তবে আমার নিজস্ব প্ল্যান হল দেশটাকে বিভিন্ন ফ্যাকালটির হাতে তুলে দেব। ব্যবসা বড়বাজার দেখবে। শিল্প শিল্পীরা দেখবেন। শিক্ষা শিক্ষকরা দেখবেন। কৃষি কৃষকরা দেখবেন। পুরো দেখাশোনার ব্যাপারটা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেব। মাসে মাসে আমরা একটা মাসোহারা পাব। আমরা আমাদের বখরাটা বুঝে নেব। আমাদের স্লেট আমরা। পরিষ্কার রাখব। কাউকে বলতে দেব না যে, তোমরা এই করলে না, ওই করলে না। যার হ্যাপা সে সামলাক, আমাদের কাঁচকলা।

নির্বাচন জিতলেন কী করে?

নেগেটিভ ভোটে।

পরের বার ফিরে আসছেন কি?

পরের কথা পরে। পাঁচ বছরে আমরা সবাই সমানভাবে গুছিয়ে নেব। গাড়িতে উঠে পড়লুম। পরের দিন কাগজের হেডলাইন দেখে স্তম্ভিত। ব্যানার হেডলাইন, নতুন মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ। মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যপালের তিরস্কার।

শ্যামলীকে ডেকে দেখালুম, তোমার কাণ্ড দেখে যাও। তোমার জন্যে প্রথম দিনেই বিশাল হোঁচট। অক্ষরের সাইজ দেখেছ। বিয়াল্লিশ কি বাহাত্তর পয়েন্টের এক একটা ঢ্যালা ছুড়ে। মেরেছে। এখন থেকে জেনে রাখো, আমরা সাধারণ ভাত-ডাল খাওয়া মানুষ নই। আমি মুখা, তুমি স্ত্রী মুখা। এক নম্বর নাগরিক আমরা। ফিলমস্টার আর পলিটিক্যাল স্টারে কোনও তফাত নেই। আমরা যা বলব, যা করব সবই সংবাদ হয়ে কাগজে বেরিয়ে যাবে। জানবে, দেয়াল আর দেয়াল নয়। বিশাল চারটে কান। রাস্তা আর রাস্তা নয়, ক্যামেরার লম্বা চোখ। সেই কারণে কথা বলবে না। কোনও কিছু করবে না। এখন থেকে আমাদের আদর্শ হবেন শ্রীজগন্নাথ। এ বাড়ি, ও বাড়ি ওই আগের মতো, দিদি কী রান্না হল, দিদি কী সিনেমা দেখা হল, ছেলের রেজাল্ট বেরোবে করে—এইসব একদম করবে না। এই অভ্যাসটা তোমার চিরকালের। লাটাইয়ের সুতোর মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখবে সব সময়। সব কথার এমন উত্তর দেবে, যেন দু-রকম মানে হয়, কি কোনও মানেই হয় না।

যদি কেউ জিগ্যেস করে কেমন আছেন?

বলবে, বর্ষা এবার ভালো হল না। না না, দাঁড়াও, ওটা তো বলা যাবে না।

কেন?

রিস্ক আছে। স্বীকারোক্তি হয়ে গেল। বর্ষা ভালো হল না মানে খরা। সঙ্গে সঙ্গে কাগজে ফলাও হয়ে যাবে। দেশব্যাপী খরা। মন্ত্রীরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে। সেচের কোনও ব্যবস্থাই করা হয়নি, ত্রাণ বিলম্বিত। ত্রাণের টাকায় পার্টিফিস্টি খেয়েছে। ওদের অনেক স্টক ছবি থাকে। খরার ছবি, বন্যার ছবি। বেহালার মাঠে গরু চরছে, ঠিক দুপুরে সেই ছবিটা ছেপে বললে, বীরভূম বাঁকুড়া জ্বলে গেল। ক্ষান্তপিসির ফাটা ফাটা মুখ, লিখে দিলে অনু দে। এজরা স্ট্রিটের ভিখিরি। অনাহারের অ্যানাটমি।

তা হলে কী বলব?

বলবে? আপাতত মাসতিনেক কিছু না বলাই ভালো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। আমাদের মন্ত্র হবে, শুনেও শুনছি না, দেখেও দেখছি না।

আমি বলব? আমাদের মেয়েদের একটা ভালো শব্দ আছে, তাইই।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তা আ আ আই। সবেতেই ওটা ব্যবহার করা যায় এবং করবেও। এখন দেখবে অনেকেই তোমাকে অনেক কিছু বলতে আসবে। আপার সোসাইটির মহিলারা আসবেন। ওঁদের সব নানা ব্যাপার আছে, বুঝলে? ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। ক্র্যাফটস ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। স্লাম ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। নিউট্রিশান প্রোগাম। আই ব্যাঙ্ক। কিডনি ব্যাঙ্ক। মেডিসিন ব্যাঙ্ক। বুক ব্যাঙ্ক। প্রিজারভেশান অফ ওম্যান রাইটস। বটল ব্যাঙ্ক।

বটল ব্যাঙ্ক কী জিনিস?

মদ ও বিয়ারের বোতল সংগ্রহ করাই যে সমিতির কাজ। নানারকম জিনিস তৈরি করে, সারা বছর ওঁরা নানা ফেস্ট অর্গনাইজ করেন, সেইখানে বিক্রি করা। ওইরকম একটা ফেস্টে আমি একবার এক মাসের মেয়ের গায়ে হবে এইরকম জামার দাম শুনে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলুম।

কত দাম হতে পারে?

তিরিশ, চল্লিশ ম্যাক্সিমাম।

সাদা, জ্যালজেলে একটা কাপড়। দাম, দুশো টাকা! ছোট্ট হাতমোছা একটা তোয়ালের দাম পঁচিশ টাকা! থাক ও প্রসঙ্গ থাক। ওই সব সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক মহিলারা তোমার কাছে প্রায়ই আসবেন। ঠোঁটে জাম রঙের লিপস্টিক। ঘর্মাক্ত মেকআপ। তোমাকে দিয়ে সভাসমিতি করাবেন, উদ্বোধন করাবেন, প্রাইজ দেওয়াবেন, আই অপারেশান ক্যাম্পে চশমা বিতরণ করতে হবে। বিরক্ত হলে চলবে না। ওই মহিলারা এখন বধূহত্যা ও নারী ধর্ষণ দিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছেন। তোমাকে হয়তো প্রশ্ন করলেন, বধূহত্যা কি খুব বেড়েছে?

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলব, তা—আই!

রাইট। সোনা আমার। ওঁরা জিগ্যেস করবেন, গ্রামেগঞ্জে, রাস্তাঘাটে, মহিলারা ধর্ষণকারীর ভয়ে হাঁটতে পারছে না।

আমি সঙ্গে-সঙ্গে বলব, তাআআই!

তুমি পারবে। তোমার সে এলেম আছে। তবে তোমাকেও সেবার কাজে লাগতে হবে। ভয় পেও না। সেবা মানে কোমরে আঁচল জড়িয়ে পঙক্তি পরিবেশন নয়। একটা গাড়ি থাকবে, তোমার। হাতে কিছু ফাইল আর কাগজপত্র থাকবে। তোমার কোথাও একটা অফিস থাকবে। আর। সমাজসেবার এমন এমন দিক সব বেছে নেবে যা ইন্টারন্যাশনাল। তোমার উদ্দেশ্যটা হবে, থেকে থেকে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ করে নেওয়া। যেমন ধরো বস্তি বা ফুটপাথের শিশুদের পুঁয়ে পাওয়া নিবারণ। চলে গেলে আর্জেন্টিনা কী উরুগুয়ে। যেমন ধরো নিম্নবিত্ত মায়েদের গর্ভকালীন অপুষ্টি। চলে গেলে নিউইয়র্ক। কর্নিয়া গ্র্যাফটিং, চলে গেলে মস্কো। সব সময় মনে রাখবে, মানুষ তোমার গিয়ে বিলেতি কুকুর নয় যে অত সেবা আর তোয়াজ করতে হবে। ভেবে দেখো, পৃথিবীতে যত গোল্ডেন রিট্রিভার, কি গ্রেটডেন, কি বকসার, কি চু হুয়াহুয়া আছে তার চেয়ে। হাজার হাজার গুণ বেশি মানুষ এই কলকাতায় আছে। মানুষ পটল তুলে কিছুই করতে পারবে না। কোনও করুণা, কোনও সহানুভূতিই আদায় করতে পারবে না। দু-হাজার এক সালে অবস্থাটা কীরকম দাঁড়াবে জানো, মরল মরল, বাঁচল বাঁচল। অনেকটা নেড়ি কুকুরের মতো। সারা রাত খেয়োখেয়ি। পথের ধারে পুঁটকিপাঁট। লোকে যেভাবে মরা কুকুরের দিকে তাকিয়ে চলে যায়, সেই উদাসীনতায় চলে যাবে। বড়জোর গা-টা একটু গুলিয়ে উঠবে। যদি আমরা গদিতে কিছুকাল স্টিক করে থাকতে পারি, তা হলে আমাদের যে দুটো কাজ করে যেতে হবে, তা হল। ক্যানিবলিক ক্যানাইন সোসাইটি তৈরি। পুরোপুরি। আংশিক নয়। একজন কসাই গরু কি ছাগল মরে পড়ে আছে দেখলে কী ভাবে? আহা, মরে গেল রে, বলে নাকের জল টানে? না। সে লাফিয়ে ওঠে, চামড়া। কাফ, ক্রোম, কিড লেদার। দুহাজার একে আমরা এমন করে দোব, মানুষ দেখলেই মানুষ কঙ্কালের কথা ভাববে। ছাড়িয়েছুড়িয়ে, ব্লিচ করে এক্সপোর্ট। বিদেশে কঙ্কালের ডিম্যান্ড জানো? সাংঘাতিক ভালো ব্যবসা। তারপর ধরো, মানুষটা জীবিত অবস্থায় ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভিয়েনা, ভেনেজুয়েলা যেতে পারল না। সেই দুঃখটা মিটল। বিকাশ সামুইয়ের কঙ্কাল ভিয়েনায় ঝুলছে। কে বলতে পারে, হাড়ের খাঁচায় আত্ম-অদৃশ্য পাখি হয়ে উড়ে আসে কি না! আসতেও পারে। বিদেশে ওই লোহালক্কড় আর কিছু জামাকাপড় ছাড়া, আমাদের সব জিনিসই তো সাব স্ট্যান্ডার্ড। ভেজালে ভরতি। কঙ্কালে তো আর ভেজাল চলবে না। তুমি বুক ঠেলে ঠুকে বলতে পারবে, এক্সপোর্টার অফ পিওর, জেনুইন কঙ্কাল।

তুমি সিরিয়াসলি বলছ?

কঠিন সত্য সিরিয়াসলি বললেও ব্যঙ্গের মতো শোনায়। তুমিও জানো, আমিও জানি পৃথিবীটা সত্যই কী? ক্ষিতি, অপ, মরু, তেজ, ব্যোম। আর্থ, ফায়ার, ওয়াটার। মাটি থেকে উঠে মাটিতে ফিরে যাওয়া। চিতায় চাপব, চড়বড় করে পুড়ে যাব। দেয়ালের দিকে তাকাও, ছবিটা নজরে পড়ছে?

হ্যাঁ। বাবা আর মা।

দুজনে দুজনকে ভীষণ ভালোবাসতেন। অন্তত আমরা তাই মনে করতুম। আত্মীয়স্বজনরা বলতেন, আহা। সাক্ষাৎ হরগৌরী! মা মারা গেলেন। বছর না ঘুরতেই আমার মাসি মা হয়ে এলেন। বোঝে ব্যাপার! সে আবার কীরকম মা, যাঁর সংসার ভালো লাগে না। দশটা বাজতে না বাজতেই সেজেগুঁজে বেরিয়ে পড়েন। কয়েকশো বন্ধুবান্ধব। আজ এর বাড়ি কাল ওর বাড়ি।

পরশু সিনেমা। দ্বিতীয় পক্ষের বউ। বাবা মিউমিউ করে বলেন, মানু সংসারটা এবার ধরো। মাসি বলেন, ধুর সংসার আমার ভালো লাগেনা। এই তো জীবন! আজ আছি কাল নেই। ফুর্তি করে যাই। আসলে মায়ের পাশাপাশি বাবা মাসির সঙ্গেও একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। সেই সময়ে আদর দিয়ে দিয়ে একটি বাঁদরি তৈরি করেছিলেন। তাকে আর সামলাবেন কী করে? আমার হাফ ব্রাদার ঝিয়ের কোলে মানুষ। আমাদের ছেলেবেলাটা মাসির ড্রেস দেখেই কেটে গেল। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, কী রে ছেলেটা! কী দেখছিস! আমার বাবা যখন মারা যাচ্ছেন, তিনি তখন কাঠমান্ডুতে কেরামতি করতে গেছেন। ফিরে এসে বললেন, মরার আর সময় পেলে না। মন্তব্যটাকে আপ্রাণ চেষ্টা করে আমরা ভুলে গেলুম। ভাবলুম, শোকে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না তো! বেড়ালের পায়খানা করা দেখেছ? নরম ভুসভুসে মাটিতে করে, তারপর চাপা দিয়ে দেয়। জীবনের নোংরা সত্যকে আমরা সেইভাবে চাপা দিয়ে দি। তারপর বাগান করার সময় মাটি খুঁড়তে গিয়ে হঠাৎ হাতে লেগে যায়। ঘেন্না ঠেকাই এইভাবে, ভালো সার। গাছ ভালো হবে। তারপর এই মাসি আমার বাবার বন্ধু সরোজবাবুর ঘাড়ে গিয়ে চাপলেন। রাধাবাজারে সরোজবাবুর ঘড়ির দোকান ছিল। মহিলার স্বভাব তিনি ভালোই জানতেন, তবু সামলাতে পারলেন না নিজেকে। সংসার ভাসিয়ে ভেসে পড়লেন। যিনি সময়ের ব্যবসা করতেন, তিনি নিজের সময় বুঝতে পারলেন না। মানসিক চাপে সেরিব্রাল অ্যাটাকিংয়ে। ছমাস বিছানায় পড়ে থেকে বিদায় নিলেন। তাঁর সাধের মানুষ একজন নার্সের হাতে তাঁকে তুলে দিয়ে যথারীতি নেচে বেড়ালেন। এইবার আমি তোমার কথায় আসি। তুমি দিনকতক আমার বন্ধু শৈবালের সঙ্গে বেশ বাড়াবাড়ি করেছিলে। মনে আছে?

শ্যামলীর মুখটা বেশ করুণ দেখাল। আমি ইচ্ছে করেই একটু ধাক্কা মারলুম। আজ আমার। সুযোগ এসেছে। আমি অবশ্য খুব সাবধানে প্রতিভার কথাটা চেপে গেলুম। আমার এই ব্যক্তিগত কাদা খোঁচাতে গিয়ে হঠাৎ একটা সত্য পেয়ে গেলুম। ল্যাক অফ ইনটেলিজেন্স মানুষকে যেমন অসহায় করে, দুর্বল করে, স্টেটের ক্ষেত্রেও ইনটেলিজেন্স ল্যাপস সাংঘাতিক একটা উইকনেস। উইক পয়েন্ট। শ্যামলী যদি প্রতিভার ব্যাপারটা জানত, সহজেই আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে পারত। আমি অমন আপারহ্যান্ড নিতে পারতুম না। আমার ক্যাবিনেটে একটা দপ্তর রাখব, উইকনেস ডিপার্টমেন্ট। ফুল ফ্লেজেড একজন মন্ত্রী থাকবে—উইকনেস মন্ত্রী। তার কাজ হবে আমাদের দুর্বলতা খোঁজা। দুর্বলতা হল নাইলন কর্ড। হোলি অ্যালায়েন্স টেকে না। ধর্মের কথা— যত মত তত পথ। আনহোলি অ্যালায়েন্স স্থায়ী হবে। হালফিল কেন্দ্রেকী হয়ে গেল! ভালো। মানুষের ছেলেরা সৎ সরকার গড়তে চেয়ে কী কেলেঙ্কারি! কোথা থেকে এক বোফর্স এসে ঢুকল। কার যেন সুইশব্যাঙ্কে টাকা বেরোল। কে নিয়ে এল জার্মান সাবমেরিন। সব তালগোল পাকিয়ে গেল। এ বলে আমি সৎ, ও বলে আমি আরও সৎ। সতে সতে বুদ্ধির লড়াই। কাদা ছোড়াছুড়ি। পদত্যাগ। বহিষ্কার। দপ্তর বদল। আমি একজন প্রলোভন মন্ত্রী নিয়োগ করব। সেই দপ্তরের কাজ হবে সৎকে প্রলোভনের মডার্ন টেকনিক দিয়ে অসৎ করে তোলা। সতের অহঙ্কার সাঙ্ঘাতিক অহঙ্কার। পাগলামি। আই অ্যাম অনেস্ট বলে ঠোঁট ফুলিয়ে, মুখ ভেটকে বসে রইল। যত সব কুসংস্কার। সোনার যেমন পাথরবাটি হয় না, মানুষের সংগঠনও তেমনি সৎ হতে পারে না। একজন মানুষ অতি কষ্টে হর্তুকি-ত্রিফলা খেয়ে, চোখে গ্লুকোমা ধরিয়ে, সর্ব অঙ্গে বাত লাগিয়ে বাবা রে মা রে করে এক ধরনের জড়দগব সৎ হতে পারে। একসঙ্গে একশোটা মানুষের একটা দল সৎ হতে পারে না। তাই যদি হবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের এ অবস্থা হবে কেন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোলনলচে খুলে পড়ে যাবে কেন? হেলদি মানুষ মাত্রেই এদিক-সেদিক করবে। কোনও নিস্তার নেই। ইতিহাসেরও মাথায় তারকেশ্বরের মোহন্ত। এলোকেশীকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। এ মাথায় রজনীশ।

হোঁদকা দুজন বডিগার্ড পাঠিয়েছে। আজকাল এই এক জ্বালা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বুকে স্টিলপ্লেট বেঁধে ট্যাঙা হয়ে ঘুরছেন। হাত দুটো বগলের পাশে টাঁশ হয়ে পড়ে না। চেতিয়ে থাকে। কোটের হাতা দুটো ট্যাঙটেঙি লাগে। হাম হিন্দুস্তানি বলে বুকে ঘুসি মারার উপায় নেই। জেনুইন বুকের শব্দ বেরোবে না। কৃত্রিম ক্যানেস্তারা পেটা শব্দ বেরোবে। টেলিস্কোপিক রাইফেল দিয়ে। কেনেডিকে মেরেছিল। সেই থেকে রেওয়াজ হয়ে গেছে কিছু শিকারির—যাই একটা প্রধানমন্ত্রী। মেরে আসি। ভারতে গন্ডা গন্ডা মুখ্যমন্ত্রী। রোজ একটা করে মারা যায়। মারে না, কে আর ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চায়। তবু রেওয়াজ হয়েছে, দুজন রক্ষী থাকবে। রক্ষীরা যে কত বাঁচাতে পারে, তা সে তো দেখা গেছে। সেই শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে বন্দুকের কুঁদো লড়িয়ে দিলে। যে মেরেছিল তার হাত ফসকে বন্দুকটা পড়ে না গেলে কী হত? আনোয়ার সাদাতের কী হল!

রক্ষী দুজন রকে বসে আছে। জানালা দিয়ে আমার ঝকঝকে গাড়িটা দেখতে পাচ্ছি। একটু পরেই আমাকে বেরোতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী হবার পর আমার জীবনের রুটিন একদম পালটে গেছে। সে আমি আর নেই। যোগব্যায়াম ধরতে হয়েছে। সেইটাই নিয়ম। এ দেশের বড় বড় লোক যোগব্যায়াম করেন, ও দেশের বড় বড় লোক করেন জগিং। আমি জগিংই করব ভেবেছিলাম। সদ্য বিলেত ফেরত এক্সপার্ট বললেন, জগিং তো এ শহরে চলবে না। এয়ার পলিউশান লেভেল এত হাই, এখুনি লাং ক্যানসার ধরে যাবে। ইউরোপ হলে সেফলি জগিং করতে পারতেন। কলকাতাটাকে তো আপনারা প্যারাডাইস লস্ট করে ফেলেছেন। নরককুণ্ড।

আপনারা বলবেন না। আমরা কিছু করিনি। করেছেন যাঁরা চলে গেলেন তাঁরা। আমরা তো জাস্ট এলুম। এইবার করা শুরু হবে।

এয়ার কন্ডিশনড মার্কেট থেকে আমার যোগব্যায়ামের জাপানি পোশাক এসে গেছে। বিলেত ফেরত একজন ডাক্তারবাবু আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। থরো চেকআপ। প্রেশার, পালস, হার্টবিট, সুগার, ব্লাড কোলেস্টরেল পরীক্ষা হয়ে গেছে। নর্মাল। এই চেকআপটা আমাকে মাঝেমাঝেই করাতে হবে। কোনও উপায় নেই। আমি তো আর সাধারণ মানুষ নই। এত বড় একটা স্টেটের মুখ্যমন্ত্রী। আমি এখন সব ব্যাপারেই এক নম্বর। এক নম্বর রোগ, এক নম্বর। রোগী। আমার ডায়েট চার্ট তৈরি। চার্ট মিলিয়ে খেতে হবে। ভোর ছটায় একগেলাস লেবুর রস। সামান্য ওয়াকিং। আসন। বাথরুমে বাথটাব গীজার এসে গেছে। এক টাব জল ভরতি করে। বাথসল্ট ছেড়ে শুয়ে পড়ে খানিক খরবলর। তারপর বাথরোব পরে পোর্টিকোয় বসে অল্প একটু দেশের চিন্তা। দেশই তো ঈশ্বর। তৎপরে ব্রেকফাস্ট। ডিম খাব। রুটি খাব। জ্যাম-জেলি খাব। ফল খাব। চায়ের লিকার খাব। চিনি ছাড়া। তারপর ভিটামিন ক্যাপসুল একটা। ভিটামিনের কনসাইনমেন্ট এসেছে লন্ডন থেকে, দিশি ভিটামিনে ভিটামিন নাও থাকতে পারে। গুঁড়ো হলুদ। এ দেশের ওষুধে ওষুধ থাকবে এমন দেশ শাসন আমরা করি না। আমাদের পূর্বতন শাসকরা একটা জিনিস শিখিয়ে গেছেন—সবকিছুর মধ্যে একটা সারপ্রাইজ ফ্যাক্টর রাখবে। কী আছে! বাঘ আছে না ভালুক আছে! ভুত আছে না প্রেত আছে! পেটে গেলে মরবে না বাঁচবে! তারপর কী হয়! এই আছি। এরপর কী হয়। বোম মারে না ছুরি! মাল বোঝাই লরি ঘাড়ে চড়ে, না মিনি!

ব্রেকফাস্টের পর রাইটার্সে গিয়ে রাজচিন্তা। এগারোটায় এক কাপ ব্ল্যাক কফি। দেড়টায় লাঞ্চ। স্যুপ। চার চামচে দেরাদুন রাইস। প্লেন্টি অফ ভেজিটেবলস। বেকড ফিস। একটা মিষ্টি। পনেরো মিনিট হালকা ঘুম। একটা ডানহিল সিগারেট। বেশ পরিবর্তন। দিনে চারবার বেশ পরিবর্তন। সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টর। পরিধেয়র সঙ্গে মনের যোগ। রাইটার্স। মিটিং। ফাইল ধরে টানাটানি। ছটায় মিট দ্য প্রেস। কর্মময় একটি দিনের অবসান। আটটার সময় মেপে মেপে ঠিক তিন পেগ স্কচ-হুইস্কি। তারপর একটা মুরগির ঠ্যাং। বেক করা। দুটো ফুলকো রুটি। একটু পুডিং। মানে যৎসামান্য ক্ষুন্নিবৃত্তি।

আমি আমার পার্সোনাল ফিজিশিয়ানকে বলেছিলুম, মশাই তিনটে মধ্যবিত্ত বাঙালি ব্যায়রাম আমি ঘৃণা করি, কোনও বড় মানুষের যা কখনও হয় না, পেটের অসুখ, সর্দিজ্বর আর কথায় কথায় মাথাধরা।

ডাক্তার বললেন, ধরেছেন ঠিক। কেরানি আর মাস্টারদের হয়। ডিফেকটিভ ইটিং হ্যাবিটস। আপনি বেগড়া চালের ভাত, পুঁইশাকের ঘ্যাঁট, পোস্ত, বাড়ির চালে যেসব আনাজপাতি হয় যেমন লাউ-কুমড়ো ছোঁবেন না। ঢ্যাঁড়স ঝিঙে চিচিঙ্গে এসব জনগণের দিকে ঠেলে দিন। স্রেফ প্রোটিনের ওপর থাকুন, আর দু-তিন পেগ বিলিত ঢালুন, দেখবেন কনস্টিটিউশান চেঞ্জ করে গেছে। আর আপনার তো কোনও টেনশান নেই।

টেনশন নেই! বলেন কী? এত বড় একটা দেশ, তার এই মিলিয়নস অফ প্রবলেম।

ও সব বলবেন না। মুখে একশোবার কেন, হাজার বার বলবেন, কিন্তু ভুলেও মনে বাসা বাঁধতে দেবেন না। সেই রবীন্দ্রসংগীতটাকে একটু এদিক-সেদিক করে গাইবেন, হবার যাহা হবে তাহা। মরার যাহা মরে। দুটো জিনিস আপ্তবাক্য নিজে মনে রাখবেন, সভা-সমিতিতে প্রত্যেকের মনে গেঁথে দেবার চেষ্টা করবেন। ডেভেলপিং কান্ট্রি। চল্লিশ বছর ধরে ডেভেলপিং। চারশো বছর পরেও ডেভেলপিং। কান্ট্রি হল কান্ট্রিলিকার, হাজার চেষ্টা করলেও স্কচ-হুইস্কি হবে না। দু-নম্বর হল সেন্টার। স্টেট থাকলেই সেন্টার থাকবে। সেন্টারের বিমাতাসুলভ ব্যবহার। সাতখুন মাপ। আপনার আবার টেনশান কীসের। চাবুক মারার মতো দুটো ঘোড়া সবসময় রেডি। আর সবশেষে সুইট ডিশের মতো মিষ্টি হেসে পরিবেশ করবেন, বন্ধুগণ, প্রবলেম ইজ লাইফ। এই করে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আপনার পূর্ববর্তীরা তো বেশ ভালোই চালিয়ে গেলেন।

সব পার্টিরই একটা পার্টি-অফিস থাকে। প্রেসিডেন্ট থাকে। চেয়ারম্যান থাকে। আমাদের তো আগে কোনও অর্গানাইজেশানই ছিল না। অন্তত আমার ছিল না। আমি হলুম গিয়ে রাজনৈতিক জেলে। খ্যাপলা জাল ফেলে পার্টিভাঙা এক একটা চেলাকে ধরেছি। রামপ্রসাদ বেঁচে থাকলে আমাকে দেখেই লিখতেন জাল ফেলে জেলে বসে আছে জলে। বড় বড় পার্টি সব ভাঙতে ভাঙতে টুকরো হতে হতে পার্টি আর নেই—মিছরির চাক নয় চিনির দানা। ইলেকশান জেতার পর টাইম। পত্রিকার একজন সাংবাদিক কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন ভারতে এখন যা অবস্থা, একটা লোক একটা পাটি। ভদ্রলোক বয়সে প্রবীণ। ইতিহাস বেশ জানেন। অতুল্য ঘোষ, কংগ্রেসের ভাঙন থেকে। রাজীবের অ্যামপুটেশান পর্যন্ত গড়গড় বলে গেলেন। ধরলেন জনসকে। চলে এলেন। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ায়। ভাঙছে, শুধু ভাঙছে।

টাইমের সাংবাদিক। বেশ সমীহ হচ্ছিল। টাইমে যদি ছোট্ট করে যে-কোনও জায়গায় ভদ্রলোক আমাকে একটু স্থান করে দেন। পত্রপত্রিকার শেষকথা নাকি এইটাইম ম্যাগাজিন! আমি শুনেছি। ভদ্রলোক আমাকে জিগ্যেস করলেন, আমেরিকান অ্যাকসেন্টে, হোয়াট ইজ দ্যাঁ বেঁ অঁ ইওর পার্টি?

সবকটা শব্দ একসঙ্গে জড়িয়ে-মড়িয়ে এমন করে বললেন, প্রথমে ধরতে পারিনি। শেষে বুঝলাম প্রশ্নটা হল, তোমার পার্টির নাম কী? আমি ঝপ করে বললুম ছত্রভঙ্গ পার্টি অফ ইন্ডিয়া।

ওয়াট। ছাত্ৰভ্যাঙ্গ। ওয়াটস দ্যাট?

সায়েব তুমি ছাতা নিশ্চয় দেখেছ? আমব্রেলা। সিকটিক লাগানো। একসময় বিরাট একটা পার্টির বিশাল ছাতা ভারতের মাথার ওপর ধরা ছিল। তার তলায় সব নৃত্য করতেন। সেই ছাতাটা গেছে ফেঁসে। ফর্দাফাঁই। সিক ফিক খুলে ছত্রাকার। এরই নাম ছত্রভঙ্গ। পুরোনো সব দলই প্রায়। ছত্রভঙ্গ। সেই সব সিক ধরে এনে আমার এই পার্টির ছাতা, দেশের মাথায় নয় নিজেদের মাথায় ধরেছি। যে কোনও দিন খুলে যাবে। সেই সম্ভাবনার কথা ভেবেই নাম রেখেছি, ছত্রভঙ্গ পার্টি অফ ইন্ডিয়া। আমাদের দেশের সবকিছুরই শেষ পরিণতি ছত্রভঙ্গ।

সায়েব শুনে মহা খুশি। এইটুকু একটা ক্যামেরা বের করে ফিচিক ফিচিক করে খানকতক ছবি তুলে নিলেন। অপেক্ষায় আছি, কবে টাইম ম্যাগাজিনে আমার ছবি বেরোয়। সায়েবদের আবার বিশ্বাস নেই। তাদের চোখে ভারতবর্ষ! ছত্রভঙ্গ পার্টির একটা অফিস হয়েছে বড়বাজার ব্যবসায়ী সমিতির কৃপায়। বড় বিজনেস হাউসের কৃপা আমরা এখনও পাইনি। পেয়ে যাব। টাউটরা ঘোরাফেরা করছে। পলিটিকস আর প্রসটিটিউশান আমরা এক করে ফেলব। সে প্ল্যান আমাদের আছে।

আজ আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। দপ্তর বণ্টন করা হবে। সবচেয়ে বড় লাঠালাঠির ব্যাপার। একটা পানীয় জল কোম্পানি গাড়ি বোঝাই বোতল পাঠিয়ে দিয়েছে। সিঁড়ির বাঁপাশে বিশাল এক আইসবক্স। জলের বোতল ঠান্ডা হচ্ছে। লাল, সাদা, হলদে। ঢোকার দরজার মাথার ওপর পাতিলেবু আর শুকনো লঙ্কার মালা ঝুলছে। দরজার দুটো পাল্লায় সদ্য আঁকা স্বস্তিকা চিহ্ন দগদগ করছে। বড় বড় করে লেখা—শুভলাভ। বড়বাজারের ম্যানেজমেন্ট। এ যেন পানমশলার দোকানের উদ্বোধন অনুষ্ঠান! টেস্টে না মিললেও সহ্য করতে হবে। সেই বলেছে না পলিটিকস মেক স্ট্রেঞ্জ বেড ফেলোজ। ওরা আপাতত মাসলম্যান সাপ্লাই করবে। টাকা-পয়সা দেবে। পেপার পাবলিসিটিতে সাহায্য করবে। দুখানা মারুতি, একটা জিপ দিয়েছে নিশান কোম্পানির। আবার কী! দুধ দিলে চাঁট সহ্য করতে হবেই বাবা। আমার আগে যাঁরা দেশসেবা করে গেছেন। তাঁরা কী করেছেন বাবা! কার সেবা? ও সবাই জানে। সদ্যোজাত শিশুটি পর্যন্ত জানে। সেবা মানে গণেশ সেবা। সর্বহারার পার্টি হয়, সর্বহারা পার্টি হয় না। আমি গান্ধীবাদকে সামান্য একটু টুইস্ট করে নিয়েছি। সেটা হল বিগ হাউসের সেবার চেয়ে স্মল হাউসই ভালো। সুলের চাহিদা সুল। বিগের চাহিদা বিগ। বিগ টেক্সটাইল মিল এক কোটি টাকার লাইসেন্স চাইবে। স্মল চাইবে দশ লাখ টাকার জিংক কি লেড। স্পেয়ার পার্টস।

মিস্টার বুবনা আজ সিল্ক টেরিনের পাঞ্জাবি পরেছেন। পায়ে সাদা মোজা, কালো বুট। ভুড়িটা ঠেলে উঠেছে। পাঞ্জাবির আবরণে মনে হচ্ছে স্টেনলেস স্টিলের কুঁড়ি। ভদ্রলোক বড় বিনীত। সফল ব্যবসায়ীরা ওই রকমই হয়। হাত জোড় করে বললেন, সোব বোবোম্বা কোরে রোখিয়েছে। ভী। বিলকুল ঠিক। কোনফারেনস টেবুলে পান ভি আছে, পান মোশালা ভি আছে।

থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার বুবনা।

লোকটির নাম রামঅওতার বুবনা। বুবনারা দু-ভাই। রাজস্থান থেকে লোটাকম্বল নিয়ে এসেছিল। বড়বাজারে প্রথমে শুরু করে কাটা কাপড়ের বিজনেস। ডজন দরে কাটা কাপড় বিক্রি করত, কিনত মুরারীপুকুরের মেয়েরা। তারা জামাপ্যান্ট তৈরি করে বেচত হরিসার হাটে। সেই রকম।

এক মেয়ের সঙ্গে বুবনার প্রেম হল। বাংলার বায়ু, বাংলার জল। বুবনাও প্রেমে পড়ল। বিয়ে হল। মিসেস বুবনা পয়া মেয়ে। ঠমক-ঠামক দেখলে এখনও মাথা ঘুরে যায়। তা না হলে রাজস্থানি কৈলাশকে বগলদাবা করতে পারে! আজ এখানে অস্থায়ী একটা কিচেন হয়েছে সম্মানিত। আমাদের খাওয়াবার জন্যে। শ্রীমতী বুবনা সিল্কের শাড়ি পরে তদারকি করছেন। হাফকাট শ্যাম্পু করা চুল ফরসা তেলা পিঠের উন্মুক্ত অংশে ঝোলাঝুলি করছে। সিল্কের কাঁধকাটা ব্লাউজ। আমি আর বলতে পারছিনা। মুখ্যমন্ত্রীর উচিত নয়, পরস্ত্রীর রূপ বর্ণনা করার। কাটা কাপড়ের বুবনা। আজ মাল্টি মিলিওনিয়ার। সত্যনারায়ণ পার্কটা কিনতে চেয়েছিল। একটুর জন্যে ফসকে গেছে। এখন ইচ্ছে হয়েছে এসপ্ল্যানেডটা কিনবে। কিনবে মানে, একটা কায়দাটায়দা করে দখল করে নেবে। গাড়ির জন্যে একচিলতে রাস্তা রেখে দুটো পাশ ফেরিঅলাদের দাদন দিয়ে দেবে। বাজার বসাবে। ফল, আনাজপাতি, রাজস্থানী চুড়ি, শাড়ি তৈরি জামাকাপড়, চপ্পল, ফুচকা, ভেলপুরি। এসপ্ল্যানেড অঞ্চলের ফুটপাত এতকাল আমার পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভার এক শরিক দলের মৌরসিপাট্টায় ছিল। বুবনা বলছে, দ্যাট ইজ নো বিজনেস। ওতে লাভ কমে যাচ্ছে। থার্ড পার্টি মুফতে টাকা মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ও বলছে কলকাতাকে সেল করতেই হবে, আর আমরাই কিনব। ইংরেজ চলে যাবার পর আমরাই সায়েব। সেল যখন করতেই হবে, ভালো ভাবে করো। লোকটা আবার একটু অশ্লীল মতো আছে। ওই রেডিমেড মেয়েটার ইনফ্লুয়েন্স। বলে কী, সঙ্গম যখন করবে নির্ভাবনায় করো, পয়দার কথা ভেবো না। ব্যাটা! হারামজাদা! না না, বলতেই পারে। ইন্টেলেকচ্যুয়াল বাঙালি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেস্কের ওপর তবলা বাজাচ্ছে। সল্টলেকে জমি কিনেছিল লটারি করে। সে জমিও বেহাত। ব্যাট না ধরেই ক্রিকেটার, বলে পা না ঠেকিয়েই। ফুটবলার, তুলি না ধরেই পেন্টার, কলম না ধরেই সাহিত্যিক। যেমন আমি, ত্যাগ না করে, দেশসেবা না করেই মুখ্যমন্ত্রী। আমার শিক্ষকরা বলতেন, ছেলেটা বলিয়ে-কইয়ে আছে, ওকে আটকাবে কে! এ পারে পুঁতে দিলে ওপারে গাছ বেরোবে। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। স্রেফ মনের জোরে পরীক্ষার পর পরীক্ষা কাঁচকলা দেখিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ছোকরার এলেম আছে। বুবনা বলে, গরু আমাদের দু-নম্বর, ব্যবসা। আর তোমাদের দু-নম্বর জ্ঞান, মাইরি বলছি, ভারতকে কোন শালা ঠেকায়! আসল টেকশালটাই একদিন নিলাম হয়ে যাবে। প্রায় হয়েই এসেছে। বাজারে নতুন নোট দেখতে পাও? খুচরোর কী টান!

শ্ৰীমতী বুবনা এগিয়ে এসে আমার হাত দুটো ধরে আপ্যায়ন করে সভাকক্ষে নিয়ে গেলেন। এ যেন মনে হচ্ছে বুবনার মেয়ের বিয়ে! শ্রীমতীর গা দিয়ে বিলিতি চাঁপা ফুলের গন্ধ বেরোচ্ছে। ফলের রস খেয়ে শরীরটাকে কেমন রেখেছে! ফল, খাঁটি দুধ আর ঘি। মেছোবাজারের রমরমা তো এদের জন্যেই। বাঙালির ফল হল মালদার দামড়া ফজলি আর বারুইপুরের পেয়ারা, কার্বাইডে পাকানো। খাও আর যাও।

আমার আসতে একটু দেরি হয়েছে। আমার বউ লাস্ট মোমেন্টে এক জ্যোতিষী ডেকে এনেছিলেন। আমি আবার ওসব মানিটানি না। তা বললে, এত বড় মোগল সম্রাট আকবরেরও নাকি জ্যোতিষী ছিল। স্টেট অ্যাস্ট্রোলজার। সেই জ্যোতিষীর জন্যে দেরি হয়ে গেল। তিনি ধরে রাখলেন। চেপে বসিয়ে রাখলেন। বারোটা পনেরোর আগে বেরোনো যাবে না। এই মন্ত্রীত্বে। আমার কোনও লোভ নেই। তবে ওই। পাঁচটা বছর টিকে থাকতে পারলে মন্দটা কী? কিছু তো একটা হবে। একেবারেই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো তো নয়।

ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে দেখি এক পশলা সব হয়ে গেছে। কোল্ড ড্রিংকসের খালি বোতল টেবিলে। কারুর কারুর মুখে পান। ভালো। পরের পয়সায় এই তো সবে শুরু। এখনও কত রাত পড়ে আছে। শ্রীমতী বুবনা আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। ব্যাপারটা ধরতে পারছিনা। শ্রীমতী কি আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি হবেন? হলে আমার আপত্তি নেই। স্টেট বিজনেসের বিরক্তিকর একঘেয়েমি খানিকটা কমবে।

আচ্ছা, শুরু করা যাক।

মিস্টার বুবনা, মুখে তার দু-খিলি পান। দরজার কাছ থেকে বললে, আরে ভাই জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু করো। বলেছে ভালো। উঠে দাঁড়িয়ে আমরা সবে শুরু করতে যাচ্ছি। জনগণমন, বুবনা বললে, নো নো। আমাদের সংগীত থোড়া ডিফারেন্ট আছে। টেবিলের ও মাথায় খুঁড়ি ফুলিয়ে দাঁড়াল, তারপর হেঁড়েগলায় ধরল,

রঘুপতি রাঘব রাজারাম
বিপন্ন বাঙালি চাইছে আরাম
ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম
মালটাল পরে পাবে আগে ফেলো দাম।

আমার কলিগরা দেখলুম বেশ খুশি হয়েছে। অনেকেই বুবনার প্রতিভার প্রশংসা করলে। বেশ যুগোপযোগী। বাস্তব মানে আছে। একজন বললে, আজকাল ক্যাসেটে যেসব হাসির গান বেরোয়, এ তার চেয়ে শতগুণ ভালো।

সভা আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি একটা খালি বোতল টেবিলে ঠুকে বললুম, অর্ডার, অর্ডার। কাম টু বিজনেস। শ্রীমতী বুবনাকে বললুম, আপনি আমাদের প্রসিডিংয়ের একটা নোট নিন।

তিনি বললেন, নোট খুচরোর দরকার নেই। সামনেই যন্ত্র বসিয়ে রেখেছি। লেটেস্ট। জাপানি রেকর্ডার, শার্প সিকস চ্যানেল। ফিল্টার লাগানো।

আমার একসময় এই সব জিনিসের খুব ঝোঁক ছিল। ইচ্ছে করছিল হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখি একটু খবরাখবর নি। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মুশকিলে পড়ে গেছি। একেই তো তেমন অভিজ্ঞতা নেই বলে পাঁচজনে পাঁচ কথা বলছে। আমার পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রীদের কেউই ফেলনা ছিলেন না। গদি থেকে। ফেলে দিলেও চিকেন লেগস, বসিয়ে দিলেও চিকেন লেগস, ক্যাডিলাক। আভিজাত্য বাড়াবার কোনও রাস্তা নেই। ডিগ্রি বাড়ানো যায়, ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স বাড়ানো যায়। নীল রক্ত কোথায় পাওয়া যায়? হায় পিতা!

বুবনা বললে, আপনি প্রথমে একটু কিছু বলুন।

বলব? বেশ বলছি। কমরেডস!

হল না বাবুজি! কমরেডস নয়। ওরিজিনাল কিছু ছাড়ুন।

গবেটস!

হাঁ সো বাত ঠিক আছে।

গবেটস, মন্ত্রীসভা কেউ বড় করে, কেউ ছোট করে।

এইটুকু বলতে পেরেছি। বাইরে দুমদাম বুমবাম বোমার শব্দ। নিশ্চয় আমার মুখে ভয়ের ছাপ পড়েছিল। বুবনা বললে,

ঘাবড়াবেন না। আমার অ্যারেঞ্জমেন্ট। যে পুজোর যা নিয়ম। বোমা ছাড়া পলিটিকস হয় না। তাই আমার ছেলেরা ফাটিয়ে গেল। আপনি বলুন।

পিলে চমকে গিয়েছিল। আমি শুরু করলুম,

গবেটস, মন্ত্রীসভা ছোট হবে না বড় হবে নির্ভর করছে, কাজকে আমরা কত ভাগে ভাগ করছি তার ওপর। আমি কাল বসে বসে একটা লিস্ট করেছি। পড়ছি। কারুর কিছু মন্তব্য থাকলে বলবেন। টেপে টেপ হয়ে যাবে। প্রথম হল কৃষি। দেশে চাষবাস তো চাই, তা না হলে তো দুর্ভিক্ষ হবে। তা যার জমি আছে সে চাষ করবে। করবেই করবে। বীজ কিনবে, সার কিনবে, ব্যাঙ্কলোন। দেবে। লোন দেওয়াই ব্যাঙ্কের বিজনেস। তাহলে আমাদের ফোঁপরদালালি করার কি আছে! আমাদের খরা ঠেকাবারও ক্ষমতা নেই, বন্যা ঠেকাবারও ক্ষমতা নেই। আমাদের পূর্বতন মন্ত্রীরা বন্যার সময়ে হেলিকপ্টার চেপে আকাশপথে বন্যাঞ্চল ঘুরে চলে এসেছেন। আর শেষ পর্যন্ত। সেনাবাহিনীকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ওদিকে মানুষ চালে উঠে বসে আছে এদিকে শাসকদল আর বিরোধীদলে কাজিয়া বেঁধে গেছে। ক্ষমতাসীন দল ত্রাণ নিয়ে আর কাউকে এগোতে দিচ্ছে না। গেলেই কামড়াতে আসছে। মেরে লাশ ফেলে দিচ্ছে। মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন— কবিতাটা মনে আছে নিশ্চয়? স্বীয় কীর্তিধ্বজা ধরি আমরাও সেই পথে এগোবো আরও আটঘাট বেঁধে। বন্যা আর খরা আসে শাসকদলের বরাত ফেরাতে। এ এমন এক ওপেন সিক্রেট যা। সকলেই জানে। খরাত্ৰাণ আর বন্যাত্রাণের সেন্ট পারসেন্ট ক্রেডিট আমাদের নিতে হবে। তাহলে কৃষি নয়, চাই ত্রাণবিরোধী দপ্তর। ত্রাণের কাজ আটকাবার জন্যে চাই ত্রাণ পুলিশ। তাহলে কী। দাঁড়াচ্ছে, পুলিশদপ্তরে আর একটি বিভাগ যুক্ত হল। সঙ্গে সঙ্গে এমপ্লয়মেন্ট অপারচুনিটি বেড়ে গেল। আনএমপ্লয়মেন্ট প্রবলেম সলভ করতে হবে তো। যারা চাকরি পাবে, তারা আমাদের। ভোটার হবে।

ঘোড়ার ডিম হবে। ইতিহাস ভালো করে পড়ুন মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়। কেন্দ্রীয় সেই রেলমন্ত্রীর কথা মনে পড়ে? তিনি তো রিটার্নড় হয়েছিলেন ভাই। ভোটাররা তো বেইমানি করেনি, বেইমানি করেছে তাঁর পার্টি।

কিন্তু পরের বার নির্বাচনে তাঁর নির্বাচন এলাকায় দল গোহারান হেরেছে।

সে ভাই খুব গোলমেলে ইতিহাস। আমরা আমাদের নির্বাচকদের অতটা অকৃতজ্ঞ নাই বা ভাবলুম। থিংক পজেটিভলি। থিংক পজেটিভলি।

আমার মনে হয় ভাবনামন্ত্রীর একটা পদ তৈরি করুন; যিনি আমাদের ভাবতে শেখাবেন।

আমি ডাবিং অ্যাডভাইটাইজিং এজেনসিকে আসতে বলেছি। তাঁদের প্রতিনিধি কি এসেছেন?

বলতে না বলতেই ঘরে ঢুকলেন মিস্টার সেনশর্মা, আসতে পারি?

আসুন, আসুন। আপনি তো মশাই মোস্ট সট আফটার পার্সন।

সেনশর্মা বসলেন। নিজের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কৃতী পুরুষ। টাকে চুল গজাবার একটা লোশানের এমন ক্যামপেন করেছিলেন, টাকে যে চুল কস্মিনকালে গজাতে পারে না, তা জেনেও হাজার হাজার। ক্রেতা সেই দামি হেয়ার টনিক কিনে, এক বছরের মধ্যে টনিক কোম্পানিকে লাল করে দিয়েছিল। সেই প্রতিষ্ঠান এখন মাঠে ঘাস গজাবার ওষুধ তৈরি করছে। সেনশর্মার আর একটি কৃতিত্ব, বৃদ্ধকে যুবক করার একটা বড়ি কয়েক কোটি টাকা বিক্রি করিয়ে দিয়েছিলেন স্রেফ প্রচারের জোরে। এখনও বাজারে সেই ওষুধের সাঙ্ঘাতিক রমরমা।

গবেটস, মিট মিস্টার সেনশর্মা। ডার্বি অ্যাডভাটাইজিং এজেনসির ডিরেকটার।

মিস্টার সেনশর্মা আমাদের কী করবেন?

আমাদের এই লিমিটেড কোম্পানিকে পাবলিকের কাছে সেল করবেন।

আমাদের তো কোনও প্রোডাক্ট নেই!

কে বলেছে নেই। মানুষের অবস্থা ফেরাবার প্রতিশ্রুতিই হল আমাদের প্রোডাক্ট। সেনশর্মা একজন নামকরা মার্কেটিং অ্যাডভাইসার। আপনি আমাদের কিছু অ্যাডভাইস করুন।

সেনশর্মার হাসিটি ভারি সুন্দর। ভেরি মাইডিয়ার। একচিলতে হাসি ছেড়ে তিনি বললেন, পুরোনো একটা প্রবাদ আছে আপনারা শুনেছেন, সর্প হয়ে দংশ তুমি ওঝা হয়ে ঝাড়ো। এই টেকনিকটা আপনারা যত ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবেন ততই আপনাদের সাকসেস। শিল্পে এই নীতিটা আপনাদের সাম্রতিক পপুলার করবে! যে কটা শিল্প প্রতিষ্ঠান এখনও আছে, লেবার খেপিয়ে সব বন্ধ করে দিন এক ধার থেকে। তারপর শিল্প দপ্তরের মধ্যস্থতায় একে একে খুলতে আসুন। আবার বন্ধ করতে করতে চলে যান। আবার খুলতে খুলতে আসুন। আবার বন্ধ করতে করতে চলে যান।

বুঝেছি, বুঝেছি। কিন্তু শিল্পের বারোটা যে বেজে যাবে!

বারোটা তো বেজেই আছে। পাট গেছে। লোহা গেছে। ওষুধ গেছে। হোসিয়ারি গেছে। টেক্সটাইল গেছে। প্রেস গেছে। কেমিকেলস গেছে। প্ল্যান্ট অ্যান্ড মেশিনারি গেছে। আছেটা কী? শিল্প বলতে তো এখন মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ। বোকার মতো। পশ্চিমবাংলায় শিল্প করুন বলে শিল্পপতিদের কাছে সচিত্র নিমন্ত্রণপত্র ছাড়বেন না। ঘাড়ে গুরুদায়িত্ব এসে যাবে। পাওয়ার দিতে হবে, র মেটিরিয়াল দিতে হবে, লেবার ফ্রন্টে শান্তি বজায় রাখতে হবে। ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যায়, তবু স্বামী বিবেকানন্দ থেকে বলি, জীবন হল খেলা। কিন্তু হোয়েন প্লে বিকাম এ টাস্ক, তখনই বিপদ। আপনারা মাছের মতো খেলুন, শিল্পে খেলুন, কৃষিতে খেলুন, শিক্ষায় খেলুন, জনস্বাস্থ্যে খেলুন। আর একটা কাজ করতে পারবেন?

বলুন?

মোটামুটি আপনার চেহারা আছে, গলা আছে। কোনওরকমে উত্তমকুমার হতে পারবেন?

উত্তমকুমার?

আমাদের জীবনে টিভি আর ফিলম ছাড়া কিছু নেই। সিনেমার নায়ক পলিটিকসে এলে যত বড় দেশসেবকই হোক নির্বাচনে কাত। তাদের গ্ল্যামারের পাশে কারুর দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। আপনারা তার প্রমাণ পেয়েছেন।

উত্তমকুমার হওয়া কি সহজ! সে প্রতিভা আমার নেই।

দক্ষিণ ভারতের পলিটিকসে দেখুন রুপোলি পর্দার নায়কদের কী দাপট! কেউ কেউ আবার গেরুয়া ধারণ করেছেন। প্রোডাকটের সঙ্গে সঙ্গে প্যাকিংটাও তো দেখতে হবে। আজকাল দেখছেন তো সামান্য ধূপকাঠি, আগে বিক্রি হত তাগড়া বান্ডিল বেঁধে, এখন আটটা কি বড়জোর দশটা কাঠির প্যাকেট দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। এখন মালের চেয়ে প্যাকিং বড়। কাজের চেয়ে ঘোষণা বড়। আপনাদের ঘোষণা কোথায়! বিজয় উৎসব, বিজয় মিছিল কোথায়?

ঘোষণা একটা করা যায়; কিন্তু কী ঘোষণা করব?

অ্যায় দেখুন। আরে মশাই কত কী ঘোষণা করার আছে। মানুষকে আশা দিন, ভরসা দিন। টাকে চুল গজাবে বলেই না লাখ লাখ শিশি বিক্রি হয়েছিল! আপনার এই মন্ত্রিসভার সকলকে বলুন। একটা করে আশার বাণী দিতে। এই পার্টি অফিসে একটা বাক্স বসান, সেই বাক্সে প্রত্যেকে একটা করে আশার বাণী ফেলুন। মানুষের আশা। ফুটপাথের মানুষ থেকে রাজপ্রাসাদের মানুষ সকলেই যেন ভরসা পায়। মা, মাসি, দাদা, দিদি, বেকার, সাকার সকলেই যেন দু-হাত তুলে। নাচতে থাকে। সেই বাণী সংবলিত সুদৃশ্য হ্যান্ডআউট রঙিন। পাঁচ রঙে ছাপা, হাতে হাতে। ঘুরবে। তার মধ্যে একটা বাণী থাকবে—অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। অশ্লীলতা বললেই আমি অশ্লীল একটা ছবি ছাপতে পারব, হ্যান্ডআউট নিয়ে তখন কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। কেউ আর না পড়ে ফেলে দিতে পারবে না। আর একটা বিজয় উৎসব করুন।

বিজয় উৎসবে লোক হবে? আমাদের তো তেমন ইমেজ নেই।

আপনাদের ইমেজ না থাক, কিশোরকুমারের ইমেজ আছে, মিঠুন চক্রবর্তীর ইমেজ আছে, শ্রীদেবীর ইমেজ আছে। তাঁদের ইমেজ আমরা ভাঙব কী করে?

খুব বলেটলে রাজি করিয়ে, বিজয় উৎসবকে যদি একটা স্টার নাইটের চেহারা দেওয়া যায়, ফাটাফাটি ব্যাপার হয়ে যাবে। মারদাঙ্গা। কত রকমের মডার্ন টেকনিক আছে রে ভাই। আমেরিকার কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। একটা বিজয় মিছিল করবেন তো! পথ পরিক্রমা!

আমাদের ফলোয়ারস কোথায়? ক্যাডার কোথায়?

ফলোয়ারস তৈরি করতে হবে। মানুষ ফলো করে, না ফলো করে মানুষের লোভ! আপনারা। একজন সাইকোলজিস্টের সার্ভিস বুক করুন। আধুনিক মানুষের সাইকোলজি না জানলে রাজত্ব চালাবেন কী করে! দমনপীড়নে কাজ হবে না, বক্তৃতাবাজিতে কিছুই হবে না। জৈনদের মতো। খটমল খিলাতে হবে। লোভের ছারপোকা বের করে আনুন মনের খাঁটিয়া থেকে। তারপর একটু একটু খাওয়ান।

মিছিলটা তাহলে কীভাবে হবে?

লটারি।

তার মানে?

মিছিল পথ পরিক্রমা করে ময়দানে মিলবে। সেখানে থাকবে দেড় হাজার সাইকেল, সেলাইকল, হাতঘড়ি, রঙিন টিভি, জামাকাপড়, পাখা, রেডিও, টেপ-রেকর্ডার যাবতীয় সব লোভনীয় জিনিস। লটারি হবে।

মিস্টার সেনশর্মা মারামারি হয়ে যাবে। রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে।

যায় যাবে। আরে মশাই, শেষমেশ তো এদেশে একটা গৃহযুদ্ধই হবে। সেইটার পথ এই পাঁচ বছরে তৈরি করে সরে পড়ুন।

কোথায় সরব মশাই, এই এতগুলো লোক।

কেন সুইজারল্যান্ডে। ওই একটাই তো দেশ আছে। পাতকী-তারণ। পাঁচ বছরে বেশকিছু পাচার করে দিন। দেশসেবার কথা ভুলেও মাথায় আনবেন না। আপনারা হেলেন কেলারও নন, নার্স সিসও নন যে, জনে জনে সেবা করে বেড়াতে হবে। সুযোগ যখন এসেছে, বেশ করে। নিজেদের সেবা করুন। টাকা পাচারের অনেক রাস্তা আছে। ওই যে আমাদের ব্যবসায়ী বন্ধু রয়েছেন, ওই ভদ্রলোক সব বলে দেবেন।

তাহলে আপনি আমাদের একজন ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট ব্যবস্থা করে দিন।

হবে হবে। আগে মন্ত্রিসভার কাঠামোটা তৈরি করে ফেলুন।

সেনশর্মা বিদায় নিলেন।

কাঞ্চন গুপ্ত, ছাত্রজীবনে কবিতা লিখত। কাঞ্চনকে দেওয়া হল কৃষি। কৃষির সঙ্গে মন্ত্রীসভার যোগ কবিতার মতোই। সার আর কীটনাশক কোম্পানি বিবিধ ভারতীতে তো চাষিভাইদের কবিতাই শোনায়। প্রথমে একটা ঢাক বাজে তারপর শুরু হয় তরজা কবিতা—শোনো শোনো চাষিভাই, মাজরা পোকা, ঝাঁজরা পোকা, ভেঁপু পোকায় ভাবিয়ে যায়। কৃষি দপ্তরকে তো বিশেষ কিছু করতে হবে না। চাষবাসে আলাদার পলিটিকস কাজ করবে। লাঠি, বল্লম, হেঁসো বেরোবে। জোর যার ফসল তার। এর মধ্যে কোনও কবিতা নেই। ফসলে মাঠ ভরে যায় কবিতার মতো। ক্ষুধার মধ্যেও কবিতা। তা না হলে সুকান্ত কি লিখতেন, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

গোবিন্দ জানা মাছের বাজারটা ভালো জানে। কলকাতার কোন বাজারে কেমন মাছ, ওর একেবারে নখদর্পণে। গোবিন্দই আমাকে মানিকতলার বাজার চিনিয়েছিল। অমন মাছের বাজার আর কলকাতায় দুটো নেই। মাছ খেতে ওর আপত্তি নেই। মাছের দপ্তরটা নিতেই ঘোরতর আপত্তি। আমি তোর ক্যাবিনেটের সকলের চেয়ে বেশি ভোটে জিতে এলুম, আমাকে দিলি মাছ। মাছে কী করার আছে?

বাঙালিকে সস্তায় র‍্যান্ডম মাছ খাওয়াবি। আমাদের আসন পাকা হয়ে যাবে।

বিধান রায় থেকে ভক্তিভূষণ মণ্ডল কেউ পেরেছেন বাঙালিকে পাঁচ টাকা কিলো কাটা পোনা খাওয়াতে? ভেড়ি পলিটিকস তুই জানিস না! রোজ রাতে লাশ পড়ে যাচ্ছে। মাছ খেলছে জলে। মানুষ খেলছে ডাঙায়।

ভেড়ির মাছ খাওয়াবি কেন? আমাদের আগের আগের মিনিস্ট্রির হাতে আমেরিকা থেকে ফ্রোজেন মাছ আবার একটা পরিকল্পনা ছিল। টিন খুলে প্লেটে এখানকার রুম টেম্পারেচারে রাখলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাছ আবার নড়েচড়ে উঠবে। দপ্তরে বসে সেই সব পুরোনো ফাইল আবার টেনেটুনে বের কর।

আমেরিকার মাছ আমেরিকান রুই তুই গুলিয়ে ফেলেছিস।

আজ্ঞে না। আমেরিকার বাঙালিরা পশ্চিমবাংলার বাঙালিকে ডলার ফিস খাওয়াতে চায়। আর তুই ভাবছিস কেন, দু-তিন মাস অন্তর অন্তর বিদেশ যা। নানারকম পরিকল্পনা নিয়ে ঘোরাফেরা কর। মাছ খাওয়াতে না পারিস, মাছের পরিকল্পনা খাওয়া। মনে নেই আমাদের আগের মিনিস্ট্রি কলকাতার বাজারে বাজারে কয়েকদিন সরকারি মাছ বিক্রির চেষ্টা করেছিলেন। তিন-চারদিন চলেছিল, তারপর সব ভুট্টা। ডিপ ফ্রিজ লাগানো সেই গাড়িগুলো কোথায় আছে খুঁজে বের কর। কাজে লাগা।

গোবিন্দ গাঁইগুঁই শুরু করল।

খুঁতখুঁত করলে তো চলবে না ভাই। দেশের কাজ করতেই হবে।

মাছ খাইয়ে দেশের কাজ! ওই তোমার বুবনা-টুবনা যাদের হাতে অঢেল পয়সা তারা সব নিরামিষাশী। আর যারা মাছ খায় তাদের ভাঁড়ে মা ভবানী। একশো গ্রাম মাছ কিনে পাঁচ টুকরো করে। বাঙালিকে মাছ না খাইয়ে মাছের জল খাওয়া।

ডিকটেটারের কায়দায় ডেমোক্রেসি চালাতে হবে। তা না হলে সব ভেস্তে যাবে। গোবিন্দকে এক দাবড়ানি লাগালুম। বেশি গাঁইগুই করলে মাছ-দুধ কিছুই পাবি না। যুবকল্যাণে ঠেলে দেব।

শোন, পশ্চিমবাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর রায় কী বলতেন জানিস? বলতেন আমার মন্ত্রীরা সব কচ্ছপ। সকালে বিধানসভায় আসার সঙ্গে সঙ্গে চিৎ করে রেখে দি, আর কাজ শেষ হবার পর। এক এক করে উপুড় করে দি, গুটি গুটি সব বাড়ি চলে যায়। গোবিন্দ। ঘোষ আর রায় জুটির এই ডিসিপ্লিন ছিল বলেই চুটিয়ে রাজত্ব করে যেতে পেরেছেন। মহাজনের পথই পথ। সেই ডিসিপ্লিন আমাদেরও অনুকরণ করতে হবে।

মাছ নিয়ে গোবিন্দ চলে গেল। খগেন সামন্তকে শিক্ষার দায়িত্ব দিলুম। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু যত দূরে, খগেন সামন্ত শিক্ষা থেকে ঠিক ততটাই দূরে। খগেন অশিক্ষাটা ভীষণ ভালো জানে বলেই তাকে শিক্ষাটা দিলুম।

বড় বিপদে ফেললে তুমি! আমি তো আমলাদের হাতের পুতুল হয়ে যাব।

তোমার একটু ইনফরমেশন গ্যাপ হয়ে আছে ভাই। গত পনেরো বছরে আমলারা সব আমলকি হয়ে গেছে। অফিসে এসেছেন, চেয়ারে বসেছেন, পা নাচিয়েছেন, ছুটির পর বাড়ি চলে গেছেন।

কেন?

ওই রেজিমে তাঁদের হোলসেল অকেজো করে রাখা হয়েছিল। অফিস চালিয়েছিলেন পার্টির ছেলেরা। আমলাদের ট্যাঁ-ফোঁকরার উপায় ছিল না। আমলাদের দাপট ছিল রায়-সেনের আমলে। আইসিএস, আইএএস, আইপিএস। আমলারা আপাতত চি-চি করছেন। তুমি যা বলবে তাঁরা তাই করবেন।

আমি কী করব?

আমার সঙ্গে কনসাল্ট করবে। আমাদের পূর্বতনরা একটা লেভেল পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দিয়ে

ভীষণ পপুলার হয়েছিলেন। কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে চমৎকার একটা পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। আমাদের সময় ভীষণ একটা ভয়ের পরিবেশ ছিল। অধ্যাপকদের ভয়ে, পরীক্ষার ভয়ে জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টা ছিল সবচেয়ে দুঃখের। কলেজে যাবার আগে বাথরুমে যেতে হত বারকতক। ডক্টর ব্যানার্জির ক্লাসে আমার মনে হত আত্মহত্যা করি। পড়া না পারলে কো-এডুকেশন ক্লাসে মেয়েদের সামনে সে কী মিষ্টি মিষ্টি জুতো। পরীক্ষার আগে পাঁচ কেজি ওজন কমে যেত। এই নেগেটিভ ব্যাপারটা এখন কেমন পজিটিভ হয়ে গেছে। ক্লাস যদি হয়, তাহলে সেই ক্লাসে আসার আগে এখন অধ্যাপকদেরই বাথরুমে ছুটতে হয়। এখনকার কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অত সুন্দর আড্ডা আর লড়াইয়ের জায়গা দ্বিতীয় নেই। রাজনীতির হাতেখড়ি, সংসারের হাতেখড়ি হচ্ছে। ভবিষ্যতের নেতাদের জন্মভূমি।

তা আমরা কি আবার আমাদের কালে ফিরে যাব?

পাগল! যুবকদের সব সময় সন্তুষ্ট রাখতে হবে। তারাই হল আমাদের ভবিষ্যৎ।

দেশের ভবিষ্যৎ?

ধুর পাগল! দেশের ভবিষ্যৎ নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ। এই তোমার-আমার ভবিষ্যৎ। আমাদের গদির ভবিষ্যৎ। বুড়োহাবড়াদের ভোটে আমরা কোনও দিনই পাওয়ারে আসতে পারব না। আমাদের নির্ভর করতে হবে যুবকদের ভোটের ওপর। নিউ ভোটারস। তরুণ সূর্য সব। শতকরা পঁচাত্তর ভাগ হল যুবক। টাটকা প্রাণ, টগবগ করে ফুটছে, দিকে দিকে গ্রামে-গঞ্জে, নট ইওর ওলড ফসিলস। তাদের ভবিষ্যৎ কী হল তোমার-আমার জানার দরকার নেই। তাদের ভবিষ্যৎ মেরামত করতে গেলে আমরা অপ্রিয় হয়ে যাব। নিউ জেনারেশান আমাদের ঘৃণা করুক, এইটাই কি তুমি চাও! ঘৃণা! না না, সে আমার সহ্য হবে না।

আমার বাবা বলতেন।

তোমার বাবা গুষ্টির পিণ্ডি কী বলতেন আমার জানার দরকার নেই। বাবাদের কাল শেষ। এখন ছেলেদের কাল।

আমার বাবা বলতেন।

আবার সেই আমার বাবা। আরে আমার বাবা আর তোমার বাবা একই কথা বলবেন, ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ।

আর বলতেন ব্রহ্মচর্য। ব্রহ্মচর্যের অভাবে আমার নাকি লেখাপড়া হল না। আকাট মূখ হয়েই রইলাম।

তুমি যে মন্ত্রী হলে, সেটা নিশ্চয় তিনি এখন ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছেন। ওসব পুরোনো থিওরি এখন অচল। ওই করে আমাদের ধর্মটা শেষ হয়ে গেল। যত সব নেগেটিভ অনুশাসন। কাম কাম করেই সব গেল। নারী নরকস্য দ্বার। এদিকে সব বিশাল বিশাল মুনি-ঋষি, কেউ যোগবলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে নৌকোর ওপর মৈথুন করছেন। কেউ বনবালাকে জাপটে ধরেছেন। ধর্ম গেছে যাক। শিক্ষাকে আমরা যুগোপযোগী করব। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হবে আনন্দের জায়গা,। ফুর্তির জায়গা। ফ্রি-স্টাইল কুস্তি, ক্যারাটে, কুংফুর জায়গা। হিরো, হিরোইনের জায়গা। হিরোইনের দুটো মানে। নায়িকা আর নেশা। পরীক্ষাটাও আমরা তুলে দোবো। পরীক্ষা মানে টোকাটুকি। টোকাটুকি বন্ধ করতে গেলেই ভাঙচুর। পরীক্ষা মানে খাতা দেখা। বছর ঘুরে যায় রেজাল্ট বেরোয় না। কাগজওয়ালাদের লেখার খোরাক মেলে। ক্লাসেরও কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম থাকবে না। যত খুশি ভরতি হও। ভরতি করা নিয়ে অধ্যক্ষদের আর ঘেরাও হতে হবে না। ছাত্র সংগঠনের পান্ডারাও আর হামলা করার সুযোগ পাবে না। একটা বড় আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে। যত খুশি ছাত্র ভরতি করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আয় বাড়াতে পারবে। টার্ম শেষ হয়ে যাবার পর ছাত্রছাত্রীরা কী করবে! ইউএসআইএস লাইব্রেরিতে দেখেছ, লেখা থাকে টেক ওয়ান। প্যামফ্লেট থাকে, বই থাকে, সেইরকম, কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কাউন্টারে লেখা থাকবে, টেক ওয়ান। যার যার ডিগ্রি, ডিপ্লোমা তুলে নাও। নিজেই সুন্দর করে নামটা কালো কালিতে লিখে নাও। বুফে লাঞ্চের কায়দা। কেমন আইডিয়াটা?

জিনিসটার মধ্যে তেমন আঁট রইল না যে।

আ মোলো, স্বাধীনতার পর পঞ্চাশটা বছর চলে গেল, এখনও শৃঙ্খল। বিশৃঙ্খলার জন্যেই তো স্বাধীনতা! অভিভাবকরা চান ছেলেমেয়ের নাম যে কোনও একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খাতায়। লেখানো থাক। আর সব শেষে যেন একটা কাজ পায়। ছাপ চাই ছাপ। সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিলুম। কোনও বাড়িতে লেখাপড়ার পরিবেশ আর আছে? দিবারাত্র টিভি চলছে। ভিডিয়ো চলছে। শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের এই মুক্ত চিন্তা, যুবমহলে কিরকম সাড়া তোলে দেখবে! একে বলে হাই ডাইনামিক মিনিস্ট্রি।

তাহলে আমার কাজটা কী হবে?

তোমার কাজ হবে নুন শো।

সে আবার কী?

তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করে কলেজ কমনরুমে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বারোটা থেকে তিনটে ঢালাও তামিল ছবি। ডাকবাংলোয় মাঝরাত, গরম শরীর!

ছিঃ ছিঃ। সে তো অপসংস্কৃতি। দেশের ভবিষ্যৎটা কী দাঁড়াবে।

বোকা বোকা কথা বোলোনা গোবিন্দ। অনেক আগে, তোমার মনে আছে নিশ্চয়, অপসংস্কৃতির

ঘোরতর বিরোধী এক সরকার লবণ হ্রদের স্টেডিয়ামে ভাল্লুক নাচ করিয়েছিলেন। টিভির। মিডনাইট ফিলমের কথা ভোলোনি নিশ্চয়। আমরা হঠাৎ এসে গদিতে বসেছি। আমাদেরও তো শিখতে হবে। কার কাছে শিখব? আগে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই আমাদের গুরু। পাবলিকের কাছে। সেইটুকুতেই তাঁরা পপুলার হয়েছিলেন। আমরা আরও এক ধাপ এগোতে পারলে আরও পপুলার হব। চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করতে হবে। মন্ত্রী হওয়া অত সহজ নয়। সব সময় স্রোতের দিকে যাবে, স্রোতের বিরুদ্ধে নয়। একটা আঙুল রাখবে পাবলিকের পালসে। ভবিষ্যৎ তো একটা আছে রে ভাই। আমাদেরও তো ছেলেপুলে আছে!

ইউ আর এ জ্যাক অ্যাস। আমাদের ছেলেরা মাউন্ট আবুতে যাবে। সেখান থেকে সোজা বিলেতে। পাবলিকের ছেলেদের নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। অত তাড়াতাড়ি সব ভুলে যাও কেন! মনে পড়ে সেই ব্যর্থ আন্দোলনের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রেসিডেন্সির কত চোখা চোখা ছেলে মারা গেল? যাঁরা আন্দোলনের নেতা ছিলেন, আর যাঁরা মারলেন, তাঁদের কারুর কোনও দয়ামায়া ছিল? ছিল না। পাওয়ার ফুটবলের মতো পাওয়ার পলিটিকস।

দপ্তর বণ্টন মোটামুটি একরকম হল। এইবার আমরা সব রাইটার্স বিল্ডিং-এ যাব। কলকাতার পাতাল রেল এখনও শেষ হয়নি। হলেই বা কী! কলকাতার সারফেসের শোচনীয় অবস্থা। এক মাস আগে, আমি তখন কিছুই না, একটা টেম্পোয় শেয়ালদা থেকে ফারনিচার তুলে টালায়

আমার বাড়িতে আসছিলুম। কম সে কম তিন জায়গায় ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়েছে। সেই সময় আমার রেশান কার্ড হারিয়ে গিয়েছিল। ঘুষ দিয়ে বের করতে হয়েছে। মালদা থেকে মেলোমশাই এসেছিলেন কিডনির অসুখ নিয়ে। কোনও হাসপাতালে সিট না পেয়ে শেষে নার্সিংহোম। আমার দিদির বড় ছেলে পাঁচটা নম্বর কম পেয়েছিল বলে ক্যালকাটা। ইউনিভারসিটিতে ভরতি করাতে পারিনি! আমার কাকা কবে রিটায়ার করেছেন। না পেনশান, না প্রভিডেন্ডফান্ড, গ্র্যাচুইটি। আমি আর আমার স্ত্রী একদিন রাত করে আমাদের আত্মীয়দের বাড়ি থেকে ফিরছি। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের সামনে পাঁচটা ছেলে আমাদের ঘিরে ধরে সব ছিনতাই করে নিলে। থানায় ডায়েরি হল। ফল শূন্য। গলার কাছে ছুরির দাগটা আজও স্মৃতি। যোগেন জুট মিলে ভালো চাকরি করত। বেকার বসে আছে। ছেলেমেয়েরা ফ্যালফ্যাল করে ঘুরছে। যোগেনের স্ত্রী স্কুলমাস্টারি করছিল লিভ ভেকেন্সিতে। মাস্টারিটা গেছে। অনেক চেষ্টা করেও পাকা চাকরি হল না। কায়দা করে বাজার পুড়িয়ে দিলে। নিত্যানন্দের দোকান পুড়ে গেল। নিত্যানন্দ এখন ভিক্ষে করছে। আজ আমি মুখ্যমন্ত্রী। আমার গাড়ির সামনে পুলিশ পাইলট ওঁয়া

ওঁয়া করে চলেছে। কোথায় কলকাতার ট্রাফিক জ্যাম। এক মাস আগের সেই পুলিশ, আজ আমার জন্যে কত তৎপর!

চেয়ারে বসলুম। চারপাশে একবার তাকালুম। প্যানেলিংকরা ঝকঝকে দেয়াল। একটা মাত্র ছবি এ ঘরে থাকবে। কার ছবি? পরে ঠিক হবে। পাবলিকের চোখে কোন মহাপুরুষ এখন সবচেয়ে। শ্রদ্ধেয়। ওই সেনশর্মা যে ফার্মকে দেবেন তাঁদের দিয়েই একটা রেটিং করাতে হবে। সেই অনুসারে ছবি হবে।

চিফ সেক্রেটারি, ডিপার্টমেন্টাল সেক্রেটারিরা একে একে এলেন। হিউম্যান সাইকোলজি আমি কিছুটা বুঝি। সেই সঙ্গে খানিকটা সিকসথ সেনসও আছে। সকলেরই চোখে-মুখে একটা ব্যঙ্গের দৃষ্টি। যেন অর্বাচীন কোনও প্রাণী দেখতে এসেছে। পোড় খাওয়া, ঝানু পলিটিশিয়ান আমি নই। সাতপুরুষে বড়লোক আর লটারি পাওয়া বড়লোকে যা তফাত—সেই তফাত আর কি। কীভাবে এদের হ্যান্ডেল করব ভাবছি। আমার টেবিলটা বিশাল। সামনে, পাশে অনেক চেয়ার। প্রত্যেকেই বসেছেন। সেই একইভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। এর আগে পশ্চিমবাংলায় কয়েকমাসের জন্যে একটি মন্ত্রিসভা হয়েছিল। এরা ভাবছেন সেইরকমই একটা কিছু হয়েছে। ভাবছেন, ওই তোমার চেয়ার। বসেছ, বোসো। হেসে নাও দুদিন বই-তো নয়, কার যে কখন সন্ধ্যা হয়।

আমি বললুম, কী দেখছেন অমন করে?

সকলেই একটু অপ্রস্তুত হলেন। চিফ সেক্রেটারি বললেন, না দেখছি, বয়েসে আপনি খুবই তরুণ। এ রাজ্যের তরুণতম মুখ্যমন্ত্রী।

আপনি কিন্তু বেশ প্রবীণ। প্রোমোশন পেতে পেতে উঠেছেন তাই না?

হ্যাঁ, সেইটাই তো নিয়ম।

আর ক-বছর?

হয়ে এল। বছরতিনেক আছে।

প্রেসিডেন্টস রুল করে না দিলে আপনার পর আমরাও আরও দু-বছর আছি।

হ্যাঁ, আপনার আশঙ্কা অমূলক নয়। প্রেসিডেন্টস রুল হয়ে যেতে পারে।

অনেকদিন হয়নি। হলে আপনাদের দাপট অনেকটা বাড়ে। অচল হয়ে আছেন অনেক দিন।

আপনি তো সবই জানেন।

শিগগির একটা কম্যুনাল রায়ট বাঁধাবার চেষ্টা হবে। ব্যাঙ্ক ডাকাতি আর খুনখারাপি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম অস্থির হবে। কী কী হবে আমি জানি। ব্যাপক লোডশেডিং হবে। লেবার ট্রাবল বাড়বে। এই রাজ্য কিছুদিনের মধ্যেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়বে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, টাইফয়েড সবই একসঙ্গে হবে। আমরা সেইভাবেই প্রস্তুত হব। দেখা যাক কী হয়! এতে আপনাদের কোনও ভূমিকা নেই। জনসাধারণেরও বিশেষ কিছু করার নেই। স্বার্থের লড়াই।

বিভাগীয় সেক্রেটারিরা চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে এলেন কর্মচারী সমিতির এক প্রধান। বেশ উদ্ধত ভাব। বসতে বলার আগেই চেয়ার সরিয়ে বসে পড়লেন এবং একটা সিগারেট ধরালেন কায়দা করে। এ ব্যবহারটা আমার পরিচিত। অসম্মান করে ব্যক্তিত্ব বাড়াবার চেষ্টা। আগের। রেজিমে এঁদের খুব দাপট ছিল।

ভদ্রলোককে ভালো করে দেখলুম। তিনিও আমাকে দেখলেন।

প্রথমে আমিই কথা বললুম, আপনার কিছু বলার আছে?

আপনি কিছু বলবেন?

এখন না পরে। বিশেষ কিছু বলার নেই, অনেক কিছু করার আছে।

কী আর করবেন? আমাদের কেউ কিছু করতে পারেনি।

তাহলে শুনুন, কোলিয়ারি দেখেছেন?

ভদ্রলোক বেশ অবাক হলেন। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সিগারেটে খুব রামটান মারছিলেন আর ফুস করে ধোঁয়া ছুড়ে দিচ্ছিলেন আমার মুখের দিকে। আমার প্রশ্ন শুনে সেই অসভ্যতা থেমে গেল।

কোলিয়ারি? হ্যাঁ, আসানসোলে একবার একটা কোলিয়ারি দেখেছিলুম।

ভালো করে দেখেননি। কয়লা তুলে নেবার পর এক একটা পিট জল আর বালি ভরে সিল করে দেওয়া হয়। একে বলে সিলিং টেকনিক। অনেক সময় বড় রকমের অ্যাকসিডেন্টের পর, যেমন চাসনালায়, ডেডবডিসমেত পিট সিল করে দেয়। এই সচিবালয়টিকে আমরা সবার আগে সিল করে দেবো।

নেতা একটু মুচকি হেসে বললেন, কাজ হবে কী করে?

বাইরে থেকে। আমরা একটা প্যারালাল সচিবালয় তৈরি করব। আপনারা মাইনে পাবেন, কিন্তু কোনও কাজ থাকবে না। গল্প করবেন, চা খাবেন। আরও অনেক চায়ের দোকান করিডরে করিডরে বসিয়ে দেবো। আমাদের মানবিকতাবোধের অভাব হবে না। কেবল সুইট পলিটিকস আর করা যাবে না। অনেক হয়েছে। এবার আপনাদের ছুটি।

ভদ্রলোক হুক করে একটা শব্দ করলেন, যার অর্থ—কত হাতি গেল তল, মশা বলে কত জল। চেয়ার সরিয়ে উঠে গেলেন। আমি ফোন তুলে নিলুম, মিস্টার সেনশর্মা, পাবলিকের পালস আর প্রেশার বোঝার কোনও যন্ত্র আছে শুনেছি আমেরিকায় আছে।

যন্ত্র নেই প্রতিষ্ঠান আছে। আসনে বসতে না বসতেই অমন উতলা কেন? অত ভয়ের কী আছে! তেমন বুঝলে নেমে দাঁড়াবেন। না গদির মোহ ধরে গেছে?

মোহনয় রোখ চেপে গেছে। হেরে যাব কেন! এখন মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই দেশসেবা করব।

এই রে ফু ধরেছে। সাত দিনের মতো ভোগাবে। দেশ সেবা করা যায় না। আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি। যাক আমি হাইড্রা মার্কেট সার্ভে এজেনসিকে পাঠাচ্ছি।

মার্কেট সার্ভে?

হ্যাঁ মার্কেট সার্ভে। নিজেদের মনে করুন, সার্ফ কি রিমা কি ডেট কি রিন।

সে কী মশাই?

ওই হল। হাইড্রাকে পাঠাচ্ছি।

ফোন ডিসকানেক্ট করে কমিশনার অফ পুলিশকে চাইব, ঘরে ঢুকলেন লম্বা ছিপছিপে এক ভদ্রলোক।

আমি আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারি স্যার। আমাকে ব্যবহার করুন। কী লাইন চাই? কার লাইন? রিসিভার ফেলে দিয়ে বললুম, বসুন আপনি। কী নাম আপনার?

ভদ্রলোক বসলেন না। নাম বললেন, বিকাশ ভট্টাচার্য। আমাকে খানিকটা অতীত শুনিয়ে দিলেন। এই ঘর। এই চেয়ার। সব ইতিহাস। ভদ্রলোকের পান খাওয়া অভ্যাস। তখনও অল্প একটু মুখে আছে। নাড়াচাড়া করছিলেন। তবে কোনও চ্যাকর-চাকর শব্দ হচ্ছিল না। এই ঘরে কত বড় বড় নাটক হয়ে গেছে। প্রফুল্ল ঘোষ, বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখার্জি, সিদ্ধার্থশঙ্কর, জ্যোতি বসু। সব বলে বললেন, আপনাদের অবশ্য কোনও অতীত নেই। পড়ে পাওয়া সাতগন্ডা! আমার মুখের স্যার তেমন আগঢ়াক নেই। যা আসে তাই বলে ফেলি। তবে সত্য বলি।

আমি হাঁ হয়ে বসে রইলুম। তিনি দরজা ঠেলে চলে গেলেন।

কমিশনার এলেন। পুলিশ দপ্তরটা আমার। মুখ্যমন্ত্রীরা এই দপ্তরটা সাধারণত নিজের হাতেই রাখেন। আমি বেশ একটু রেগেই ছিলাম, আপনাকে ডাকতে হল? আপনার উচিত ছিল না নিজে আসার।

আমি জানি এস পি আসছেন। আমি নিজে একটা ঝামেলায় আটকে ছিলুম। কলেজ স্ট্রিটে খুব ঝামেলা হয়ে গেছে। এখনও বাসট্রাম বন্ধ।

কলেজ স্ট্রিটে আবার কী ঝামেলা হল?

ও কিছু নয়, রুটিন ব্যাপার। দুই ছাত্র সংসদে মারামারি। আজ ব্যাপারটাকে একটু গুরুপাক করে ফেলেছে। দু-তিন রাউন্ড গুলি চালাতে হয়েছে। দু-একটা মরেছে মনে হয়।

এ আপনি কীভাবে কথা বলছেন। এলিয়ে এলিয়ে। দু-একটা মরেছে। সঠিক সংখ্যা বলুন।

ও আপনি নতুন তাই বোধহয় জানেন না, ইউনিভারসিটি পাড়ায় আমরা মৃত্যুর হিসেব রাখি না। ইন সেভেনটিজ আমরা এত ছাত্র মেরেছি যে ছাত্র আর ছারপোকা এক হয়ে গেছে।

চেয়ারে বিশাল চেহারা এলিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বসেছেন। অসভ্যতাই বলা চলে। একটু কড়কে দেওয়া যায় কি না জানি না। অভিজ্ঞতা এত কম আমার।

প্রশ্ন করলুম, শহরের অবস্থা কী?

থমথমে।

থমথমে কেন?

বুঝতেই পারছেন। পলিটিক্যাল ঘুঘুরা নির্বাচনের রায়ে খুব একটা খুশিনয়। হিট ব্যাক একটা হবেই। পিডিএফ প্রথম ইউএফ-এর কথা মনে পড়ে। কাল আবার ময়দানে দুটো বড় দলের খেলা আছে। কমিউনাল ভায়োলেন্সের সম্ভাবনায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তারপরেই। আসছে পরব। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন?

আপনি কলকাতার সমস্ত ওয়ার্ডের মাস্তানদের মিসায় অ্যারেস্ট করুন। দ্যাট ইউ ক্যান।

না, আই ক্যান নট। এখন যা অবস্থা, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। আপনার জেলখানায় জায়গা নেই। তা ছাড়া কোনও মাস্তানই ফ্রি নেই। সবাই লিঙ্কড আপ। অন দি পে রোল অফ পলিটিক্যাল পার্টিজ, বিজনেস হাউসেস অ্যান্ড আদারস।

তা হলে আমরা হেল্পলেস?

অনেকটা তাই। প্যারালাল অর্থনীতির মতো প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশান তৈরি হয়েছে।

তা হলে আপনারা কী করতে আছেন?

ফসলের মাঠে কাকতাড়ুয়া কী করতে থাকে? কোনও কাক ভয় পেল তো পেল, না পেলে হাঁড়ির মাথায় বসে পায়খানা করে দিয়ে গেল।

বিজনেস হাউস, পলিটিক্যাল পার্টিস যদি পারচেজ করতে পারে, আমরা কেন পারব না! শ খানেক কি শ-দুই মাস্তানের দাম কত?

অনেক অনেক অনেক। ফ্যাবুলাস অ্যামাউন্ট। বাপ কখনও ছেলেকে পারচেজ করতে পারে? আইদার তাকে ভালোবাসতে হবে অর তাকে শাসন করতে হবে। আপনাদের ভূমিকা বাপের ভূমিকা। গত পঞ্চাশ বছরের ইউডালজেনসে সব ভেটকে গেছে। এখন আর কোনও উপায় নেই। নাথিং ডুইং।

আপনারা এই কথা বলছেন?

আপনারাই বা কী কথা বলে এসেছেন এতকাল। ওপর দিকে থুতু ছেটালে নিজের গায়েই এসে পড়ে। দেন ডোন্ট স্পিট। সোয়ালো। আমাদের এই ইউনিফর্ম আছে, কোমরে একটা করে জং ধরা পিস্তল আছে। এ দিয়ে মডার্ন ক্রিমিনালদের আমরা কী করব? তেড়ে পেটাতে গেলে চিফ মিনিস্টার বলবেন, এ আপনি কী করলেন, এটা স্বাধীন দেশ, উগান্ডা, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া নয়, প্রিটোরিয়া নয়। ফলে আমরা সব সাক্ষীগোপাল।

এ তো মহা মুশকিল! রাজ্য চালাব কী করে?

চালাবেন না। শুধু বক্তৃতা দিয়ে যান আর বিদেশ ভ্রমণ করুন। স্টেট নামক লটারিটা যখন পেয়ে গেছেন যে কদিন আছেন, আখের গুছিয়ে নিন।

সিনিয়ার পুলিশ অফিসার হয়ে এই সব কথা বলছেন?

আপনি তো জানেন সব। আমি শুধু বলেছি। আপনি তো আর নাবালক নন। আর দিন কয়েকের মধ্যেই তো আপনি বিক্রি হয়ে যাবেন।

বিক্রি হয়ে যাব মানে?

নিলাম হয়ে যাবেন। হায়েস্ট বিডার এসে আপনাকে কিনে নেবে। আগেও তাই হয়েছে। এখনও তাই হবে। দামটা কেবল মনে মনে হিসেব করে রাখুন। মিনিমাম কত আপনি আশা করেন।

আপনাকে ট্রানসফার করতে ইচ্ছে করছে।

করবেই, কারণ ওইটুকুই আপনার ক্ষমতা। একদা আমাদের দেশে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যিনি জামা পালটাবার মতো রোজ মন্ত্রী পালটাতেন আর অফিসারদের বদলি করতেন। তারপর। তারপর আপনি জানেন।

আমি একটু থমকে গেলুম। সেই প্রধানমন্ত্রী কেন, আরও অনেক প্রধানমন্ত্রীর কথা মনে পড়ে গেল। সকলেই চেলাচামুন্ডা পরিবৃত হয়ে রাজত্ব করে গেছেন। একার জোরে সিংহাসনে বসে থাকা যায় না। গণতন্ত্রের এই এক দোষ। কোটি মানুষের মন জুগিয়ে চলতে হবে। চেলারা ডোবালে ডুববে। ভাসালে ভাসবে। প্রবীণ এই অফিসারকে চটালে চলবে না। সারেন্ডার করলুম। বললুম, আপনি তো অনেক কিছু জানেন। অভিজ্ঞ মানুষ। বলতে পারেন, আমাদের পরমায়ু কত দিন?

বেশি দিন নয়। দেখছেন না, তাই তেমন গা করছি না। এই টেবিল, এই চেয়ার সাধ্য-সাধনার জিনিস। আপনি বসে আছেন, মনে হচ্ছে পাখির ডালে বসা। এখনি উড়ে যেতে হবে।

সরে বসব?

না, না, সেটা আবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। যদ্দিন পারেন অস্বস্তি হলেও বসে থাকুন।

কিছু করা যায় না?

আপনাদের ক্যাডার আছে? হয় গুন্ডা না হয় ক্যাডার, যে-কোনও একটা চাই।

আজকাল বিয়েবাড়ি যেমন ক্যাটারিং এজেনসি সামলায়, সেইরকম ক্যাডার সাপ্লাইয়ের জন্যে কোনও এজেনসি নেই?

ক্যাডার আপনার ভিয়েন করে করতে হয়। ও কেউ সাপ্লাই করতে পারে না। ওসব চিন্তা ছাড়ুন। ভগবানকে ডাকুন।

কমিশনার চলে গেলেন। ঘরে আদুরে চেহারার এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। বগলে অনেক ফাইলপত্র।

আপনি কে?

ইনফরমেশান অ্যান্ড পাবলিক রিলেশানস-এর সেক্রেটারি।

বসুন।

আজকের পেপার কাটিংস। দেখবেন তো?

কী লিখছে?

বেশ সব ড্যামেজিং কথাবার্তা আছে। আপনাদের ফেভারে কেউ তেমন লেখেনি।

বয়ে গেল।

বয়ে গেল কী স্যার! এমন কোনও সরকার নেই যাঁরা প্রেসকে ভয় পান না। পাওয়ারফুল মিডিয়া। একটা কাজ তো আপনাদের বলছে, ডেবরিজ সরকার। ভাঙা ইটপাটকেল দিয়ে তৈরি।

প্রতিবাদ করুন। এডিটরের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুন।

তা হয় না। প্রথম দিন থেকেই মামলা-মোকর্দমা। সেটা তো ঠিক হবে না। এখন তো আপনাদের ইমেজ বিলডিং-এর সময়।

তা হলে এডিটরকে ডেকে মেঠাইমন্ডা খাওয়ান।

আমাদের তো এক কাপ চা আর গুনে ঠিক দুটো কাজুবাদাম ছাড়া আর তো কিছু খাওয়াবার সংস্থান নেই। আমি পেপার ক্লিপিংসগুলো রেখে যাই, সময় মতো দেখবেন।

দেখে কী হবে? কিছু তো করার উপায় নেই।

নিজেদের সংশোধন করতে পারবেন। আর একটু স্মার্ট হতে পারবেন। একটা বাংলা কাগজ তো আপনাদের এলেবেলে সরকার বলেছে।

তাতে আপনার কী? আপনার খুব আনন্দ হয়েছে মনে হচ্ছে?

আমার আনন্দ হবে কেন। খুব দুঃখ হয়েছে। আপনার ওই চেয়ারে কারা বসে গেছেন জানেন? ডক্টর রায়, জ্যোতি বসু।

সবাই তো আর চিরদিন থাকেন না। আজ আমরা এসেছি। আপনি একটা বড় করে প্রেস কনফারেনস ডাকুন।

কনফারেনস ডেকে কী হবে। আপনাদের তো কোনও কর্ম পরিকল্পনা নেই।

আপনি আমাদের স্টেট লটারির ডিরেকটারকে ডেকে পাঠান। বলুন সি এম চাইছেন ওই ড্রাম ঘুরিয়ে ফাস্ট সেকেন্ড থার্ড নয়, দেশের মানুষের কাছ থেকে জনগণের কাছ থেকে দেশ গঠনের পরিকল্পনা চেয়ে পাঠাতে। প্রতি সপ্তাহে বেস্ট পরিকল্পনাদাতাকে ফার্স্ট প্রাইজ দেওয়া হবে।

লটারির ডিরেকটার কী করবেন? লটারি স্টেটের একটা বড় ইনকাম। সেটাকে বন্ধ করলে কর্মচারীদের মাইনে বন্ধ হয়ে যাবে। হাজার হাজার লটারির টিকিট বিক্রি হবে কী করে? না না, আপনার মাথায় এখনও তেমন কিছু আসছে না। আপনি আরও একটু ভাবুন। আপনার মন্ত্রীদের নিয়ে বসে আগে একটা এ ক্লাস পরিকল্পনা তৈরি করুন। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিভি আর রেডিয়োতে ঠেসে কিছু ভাষণ দিন। আপনার ভাষণ আমি শুনিনি, কেমন আসে? জ্যোতিবাবুর মতো হয়?

কীসে আর কীসে। চাঁদে আর চাঁদমালায়। আমি ওই থেমে থেমে কোঁত পেড়ে পেড়ে কিছুটা বলতে পারি। তাও আবার সব গুলিয়ে যায়। শুরু করলুম দেশ দিয়ে শেষ হল কড়া পাক সন্দেশে।

কী করে পাওয়ারে এলেন স্যার?

কে জানে? কে আমার এই সর্বনাশ করলে?

ভদ্রলোক কী একটা চিবোতে চিবোতে সুখী হংসের মতো চলে গেলেন। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। আমার দপ্তর আমার সঙ্গে তেমন সহযোগিতা করবে না। কেন করবে! আমি যখন সাধারণ মানুষ ছিলুম, মন দিয়ে গোটা কাগজটা পড়তুম। তখন প্রায়ই মুখ্যমন্ত্রীদের আক্ষেপ শুনেছি, পুলিশ সহযোগিতা করছে না, সচিবালয়ের কর্মীরা অগ্রগতির কাছা টেনে। ধরছে। তখন ওই সব বিলাপ চোখ এড়িয়ে চলে যেত। অনেক সময় খুশিই হতুম। নীচের তলার মানুষের ওপরতলার মানুষের ওপর একটা রাগ থেকেই থাকে। ওঁয়া ওঁয়া করে রাস্তা দিয়ে ছুটছে বিলিতি গাড়ি চেপে। তখন আমি ছিলুম নীচের তলার প্রতিনিধি। এখন আমি হঠাৎ ওপর তলার হয়ে গেছি। হলে কী হবে। ভেতরে বসে আছে তো সেই নীচু তলার মন।

আমার পিএ এসে টেবিলে একটা চিরকুট রাখলেন। আমি ভুরু কুঁচকে তাকালুম।

এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

কী ব্যাপারে?

বলতে চাইছেন না। অনেকবার প্রশ্ন করেছি, বলছেন পার্সোন্যাল। আপনার শিক্ষক ছিলেন।

আমার শিক্ষক ছিলেন! বেশ আসতে দিন।

দরজার দিকে তাকিয়ে রইলুম। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের অনেক কায়দা। একপাশে কনফারেন্স রুম। আর একপাশে সেক্রেটারির ঘর। আর একপাশে প্যাসেজ। গোটা তিনেক দরজা। কোন দরজা দিয়ে ঢুকবেন কে জানে। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলেন নীলকমলবাবু। নীলকমল বোস। একসময় আমার কলেজে ইংরেজির নামকরা অধ্যাপক ছিলেন। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম, আসুন স্যার।

তোমার কাছে আসা খুব সহজ নয়। জনসাধারণের কাছ থেকে কত দূরে সরে গেছ? অ্যাঁ! এই তোমার ঘর?

আজ্ঞে হ্যাঁ। এইরকম ঘরেই আমাদের বসতে হয়। সেইটাই নাকি নিয়ম।

এক সময় আমি তোমার শিক্ষক ছিলুম। তোমার জীবনের অনেকটা সময় তুমি আমার সঙ্গে কাটিয়েছ। আমার গোটা বাড়ির এরিয়া বোধহয় অ্যাতোটা হবে না। অ্যাাঁ, কী লাক্সারির মধ্যে আছ? এর মধ্যে থেকে জনসেবা করবে? মূখ।

আপনি আগে বসুন।

হ্যাঁ বসব তো বটেই। কাগজে তোমার নাম দেখে আর সামান্য যেটুকু পরিচয় বেরিয়েছিল সেইটুকু পড়ে, মনে হল তুমি কলেজে আমার ছাত্র ছিলে। এই বয়েসে তোমাদের এই অদ্ভুত অমানুষিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা ঠেঙিয়ে আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাতে আসিনি। আমি তোমার কাছে কাঁদতে এসেছি।

কেন স্যার। এই আনন্দের দিনে কাঁদতে এলেন কেন? আমি কি তাহলে আরও খারাপ হয়ে গেলুম।

আজকাল তো আর ভালোমন্দের পুরোনো বিচার-পদ্ধতি অচল। যে যত বড় দুশ্চরিত্র সে তত বড় বীর। যে যত বড় চোর সে তত বড় দেশসেবক। যদুবংশের এই শেষ পরিণতিতে তোমার কাছে চোখের জল ফেলতে আসিনি। আমি তোমাকে জানাতে এসেছি আর কতকাল সহ্য করা যায়?

কী সহ্য?

অসহ্য অবস্থা।

আপনি আমাকে বলুন। টাকা-পয়সার কোনও অসুবিধে থাকলে বলুন। আমার অনেক ফান্ড আছে। আপনাকে আমি না হয় একটা অ্যাডভাইসারের চাকরি করে দিচ্ছি, এডুকেশান। সেক্রেটারির সঙ্গে আলোচনা করে।

ছিঃ ছিঃ ছিঃ, আমি তোমার কাছে ভিক্ষে চাইতে আসিনি বাবা। আমি সেই জেনারেশানের যে সময় শিক্ষকরা শিক্ষকই ছিলেন, ডাক্তাররা ডাক্তারই ছিলেন, ছাত্ররা ছাত্রই ছিল। অভাব আমাদের কী করবে। তুমি? তুমি কি মহাভারত পড়েছিলে? না, সময় হয়নি।

অল্প অল্প খামচা খামচা পড়া আছে।

যাক না পড়ে ভালোই করেছ। এক একটা লক্ষণ মিলে যেত, আর ভয়ে আঁতকে উঠতে। সময়

পেলে তুমি শুধু ওই জায়গাটা পড়ে নিও, মুষলপর্ব। বিশ্বামিত্র, কশ্ব আর নারদ দ্বারকাধামে এসেছেন। অনেকদিন শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পাননি। তাই এসেছেন দেখা করতে। সারণ আর অন্যান্য বীরেরা তাঁদের দর্শন করে গেলেন। তাঁরা করলেন কি, শাম্বকে স্ত্রীলোক সাজিয়ে সেই মানী মুনিদের সামনে হাজির করে বললেন, ইনি অমিত বলশালী বর পত্নী। আপনারা ত্রিকালজ্ঞ ঋষি, এখন বলুন এর গর্ভে কী জন্মাবে, পুত্র না কন্যা?

ব্যাপারটা একবার বোঝে। জানে ঋষিরা ত্রিকালজ্ঞ। মুখে বলছে, আপনারা ত্রিকালজ্ঞ। আবার শাম্বকে মেয়ে সাজিয়ে এই অশ্লীল প্রশ্ন। শাম্ব কে? না স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের পুত্র। অপমানিত মুনিরা। তখন বললেন, রে বক্রস্বভাব, ক্রোধী, দুরাচার যাদবকুমার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই পুত্র শাম্ব এক ভয়ংকর লৌহঘটিত মুষল প্রসব করবে, যার দ্বারা সমগ্র বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশবিনষ্ট হবে। কেবল। বলরাম আর শ্রীকৃষ্ণ সেই সর্বনাশ থেকে রেহাই পাবেন। শ্রীমান বলরাম দেহত্যাগ করে সমুদ্রে প্রবেশ করবেন আর জরা নামক জনৈক ব্যাধ ভূতলে শায়িত মহাত্মা কৃষ্ণকে বাণ মেরে নিহত করবে।

তুমি ওই মুষল পর্বটা দয়া করে পড়ে নিও।

কেন বলুন তো?

শোনো, স্বাধীনতা আন্দোলনের পিরিয়ডটা যদি কুরুক্ষেত্র পর্ব হয় তাহলে তোমাদের এই কালটা হল মুষল পর্ব।

ব্যজায়ন্ত খরা গোষু করোদশ্বরীষু চ।
শুনীষ্বপি বিড়ালাশ্চ মূষিকা নকুলীষু চ।

স্যার আমি তো তেমন সংস্কৃত জানি না।

না জানাই ভালো। ডেড ল্যাঙ্গোয়েজ। অক্সফোর্ডের সায়েবরা জানুক, জার্মানরা জানুক। জানুক আমেরিকানরা। মানেটা বড় সুন্দর। ঠিক এখনকার মতো, গাভীর গর্ভে গর্দভ, অশ্বতরীর গর্ভে হস্তিশাবক, কুক্কুরীর গর্ভে বিড়াল ও নকুলীর গর্ভে মূষিক জন্মাবে। এখন যা হচ্ছে। মানুষের গর্ভে মানুষ আর জন্মাচ্ছে না।

মাস্টারমশায় উঠে দাঁড়ালেন। বিচলিত মনে হচ্ছে। অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। অসাধারণ বলিয়ে-কইয়ে ছিলেন। তিনি ঘরময় পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলেন।

নাপত্রপন্ত পাপানি কুর্বন্তো বৃষ্ণয়স্তদা।
প্রাদ্বিষণ ব্রাহ্মণাংশ্চাপি পিতৃন দেবাংস্তথৈব।

বৃষ্ণিবংশধরগণ সেই সময় পাপকার্য করেও লজ্জিত হত না আর ব্রাহ্মণ দেখলেই জ্বলে উঠত, পিতৃপুরুষ আর দেবতারা ভেসে গেলেন। স্ত্রীলোকেরা স্বামীদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিত আর। স্বামীরা স্ত্রীদের লঙ্ঘন করে ব্যভিচারের স্রোত বইয়ে দিত।

মাস্টারমশাইকে ধরে চেয়ারে বসালুম। আগের চেয়ে অনেক শীর্ণ হয়েছেন। শরীর কাঁপছে।

আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি মাস্টারমশাই? খুলে বলুন না।

তুমি আমার জন্যে কিছুই করতে পারো না।

বৃদ্ধ মানুষটির ওপর এইবার আমার রাগ হচ্ছে। আমার মুখ্যমন্ত্রীত্ব জেগে উঠছে।

তা হলে এলেন কেন?

একটু জোরেই বলে ফেলেছি। অসহায় মানুষটি আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন। সেই তীব্র উজ্জ্বল চোখ আর নেই। সাদা ঘোলাটে মৃত চোখ। তলার পাতা ভিজে ভিজে। আবেগে প্রায় রুদ্ধকণ্ঠ।

আমি যে তোমাকে বলতে পারছিনা বাবা। বড় লজ্জার ব্যাপার। বড় হীন ব্যাপার। তুমি বরং আজকের বাংলা কাগজটা আনাও।

আমার ইন্ডিকেটার ল্যাম্প জ্বেলে পি একে ডেকে কাগজটা আনালুম। মাস্টারমশাই হাতে নিয়ে পাতা উলটে একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এই জায়গাটা পড়ো।

আমি পড়ছি। তিনি মাথা নীচু করে বসে আছেন।

ঘটনাটা পড়ে আমার শরীরই কেমন যেন করে উঠল। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির চারপাশে চোলাই আর সাট্টার ডেন গজিয়ে উঠেছে। তিনি প্রায়ই যাবতীয় অসামাজিক কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতেন। শিক্ষক-মানুষ চোখের সামনে যুবসমাজের এই অবক্ষয় সহ্য করতে পারতেন না। এই নিয়েই অশান্তি বাড়ছিল। গতকাল একদল দুবৃত্ত মাস্টারমশাইয়ের নাতনি যখন স্কুল থেকে ফিরছিল তখন সবাই মিলে তাকে তুলে নিয়ে যায় ওই পাড়ারই বহুকালের পুরোনো এক

পরিত্যক্ত বাড়িতে। সেখানে পর পর সাতজন তাকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। মেয়েটি হাসপাতালে।

থানায় ডায়েরি করেছেন?

নিলে না। আমাকে বোঝালে, আপনি জ্ঞানী-গুণী মানুষ। যত লোক জানাজানি হবে ততই আপনার অপমান। গুয়ের গামলায় ইট মারলে নিজের গায়েই ছিটকে আসে। এরপর আমার আর কী বলার থাকতে পারে, তুমিই বলো।

আমি গুম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বললুম, মাস্টারমশাই আপনি বাড়ি যান। দেখি আমি কী করতে পারি।

কমিশনারকে আবার ডেকে পাঠালুম, কাগজটা সামনে ফেলে দিয়ে বললুম, দেখেছেন খবরটা?

এক নজরে খবরটা দেখে বললেন, হ্যাঁ, কী হয়েছে? নাথিং নিউ।

কিছু করা যাবে না?

এ তো একটা। এইরকম শত শত ঘটনা ঘটছে। কটা রিপোর্টেড হয়? কাগজ এ সব ফলাও করে লেখে লোকে পড়তে মজা পায় বলে। এ আগেও হত। এখনও হয়। ভবিষ্যতেও হবে। এ সব মহাভারতের কাল থেকেই ভারতে হয়ে আসছে।

আবার মহাভারত?

হ্যাঁ মহাভারত। ওইটাই তো আমাদের জেনুইন, অথেন্টিক হিস্ট্রি। যদুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পর মহাতেজা অর্জুন বৃষ্ণিবংশীয় শোকার্ত রমণীদের নিয়ে দ্বারকা থেকে ফিরছেন। অনেকদিন চলার পর তাঁরা এসে হাজির হলেন পঞ্চনদ দেশে। পঞ্চনদের শস্যসমৃদ্ধ একটি অঞ্চলে অর্জুন সেই রমণীকুলকে নিয়ে তাঁবু ফেললেন। বিশ্রাম করবেন। আর ওদিকে কী হল, একদল যুবক মহাভারতকার যাদের দস্যু বলেছেন, তাদের নোলায় জল এসে গেল। গাদা গাদা সুন্দরী বিধবা আর তাদের রক্ষক হল একজনমাত্র পুরুষ। তারা সেই তাঁবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সুন্দরীদের। হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে যে যেদিকে পারল ছুটল। অর্জুন কাকে আটকাবেন। সেই কবে কুরুক্ষেত্র হয়ে গেছে। ধনুর্বিদ্যা ভুলে বসে আছেন। বিশাল গান্ডীবে গুণ পরাতেই দম বেরিয়ে যাবার অবস্থা। যাই হোক গুণ পরাতে পরাতেই তাঁর তর্জনগর্জন চলেছে, রে অধার্মিক পাপিষ্ঠ, যদি বাঁচার সাধ থাকে, তবে ব্যাটারা পালা, তা না হলে এখনই বাণ মেরে সব ছিন্নভিন্ন করে দেব। মুখে বলছেন বটে ওদিকে গুণ পরাতে গিয়েই বুঝতে পেরেছেন যুদ্ধ করার দম আর নেই। অস্ত্রশস্ত্রের কথা চিন্তা করার চেষ্টা করলেন, সব ভুলে মেরে দিয়েছেন। বাণের পর বাণ চালালেন। সবই ভোঁতা। লক্ষ্যেরও ঠিক নেই। অর্জুনের চোখের সামনে দস্যুরা মেয়েদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল। তারপর কী করলে, সে তো আপনি রোজ কাগজেই দেখছেন।

অনেকদিন পরে বীর অর্জুন গেছেন সত্যনিষ্ঠ বেদব্যাসের আশ্রমে, অর্থাৎ মহাভারতকারের কাছে। পঞ্চনদ দেশের সেই ঘটনা তখন দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে আছে মনে। ম্লান বিষণ্ণ অর্জুনকে দেখে ব্যাসদেব প্রশ্ন করলেন, হে পৃথানন্দ, তোমার কী হয়েছে বাবা? তোমাকে এমন। শ্রীহীন দেখছি কেন? অর্জুন তখন সব বললেন। আমি কুরুক্ষেত্রের অমিততেজা বীর অর্জুন, আমার চোখের সামনে বিধবা রমণীদের ওপর বলাৎকার। আমার মৃত্যুই এখন শ্রেয়। ব্যাসদেব বললেন, আরে অর্জুন তুমি ভেতরের রহস্যটা জানো না? তোমার বীরত্ব কমেনি। আসল। ব্যাপারটা হল, ওই স্ত্রীগণ পূর্বজন্মে অপ্সরা ছিলেন। অষ্টাবক্র মুনির রূপ দেখে উপহাস। করেছিলেন। মুনি শাপ দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা মানবী হয়ে জন্মাবে, দস্যুদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে উদ্ধার পাবে। ওই শাপের ফলেই তোমার বল কমে গিয়েছিল।

এইবার প্রেজেন্ট কনটেক্সটে চলে আসুন। ওইসব চোলাইখেকো, সাট্টা-প্লেয়াররা হল অষ্টাবক্র মুনি। তাদের উপহাস করেছেন অপ্সরা। ফল এ জন্মেই মিলেছে। ধর্ষিতা। উদ্ধার।

ওদের আপনি অষ্টাবক্র মুনির সঙ্গে তুলনা করছেন?

বাঃ, অ্যাডভান্সড থিওরিটা কী? স্বামীজি বলে গেছেন, বহুরূপে সমুখে তোমার। সবাই ঈশ্বর।

আরে মশাই আমার মাস্টারমশাইয়ের স্কুলে পড়া নাতনি। মহাভারত না আওড়ে কালপ্রিটদের। ধরার ব্যবস্থা করুন। লোকাল থানা ডায়েরি নেয়নি।

নেবে না তো। এসব কেসকে আমরা মনে করি সভ্যতার অগ্রগতি। আমেরিকায় সেকেন্ডে একটা করে রেপ হয়।

আমেরিকার খারাপটা নিলেন। আমেরিকা ভালোটি চোখে পড়ল না? তারা যে চাঁদে চলে গেল!

পয়সা থাকলে হিল্লি-দিল্লি মানুষ অনেক জায়গায় যেতে পারে। দিন না আমাকে একটা রকেটে ভরে। দেখুন না, আমিও চাঁদে চলে গেছি।

এ কেসটার আপনারা কিছু করতে পারবেন না তাহলে?

ব্রাহ্মণের ছেলে কেন মিথ্যে কথা বলব, এসব কেসে কিছু করা যায় না। কেন যায় না শুনবেন? প্রথম হল পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স। দ্বিতীয় হল, সাক্ষী পাওয়া যায় না। কে সাক্ষী দেবে? কেউ দেবে না। সকলেরই প্রাণের ভয় আছে। ওই যে মনে আছে, বেশ কিছুকাল আগে একটা ছেলে অন্ধকারে একটা মেয়ের গায়ে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছিল, মেয়েটা পুড়ে মারা গেল। কী হল? সাক্ষীর অভাবে দুষ্কৃতকারীরা ছাড়া পেয়ে গেল। ওদিকে দেখুন অত বড় একটা কেসে পুত্রবধূকে মেরে বিছানায় মুড়ে খাটের তলায় রেখে দিয়েছিল। কেস চলে চলে ফাঁসির হুকুম হল। আপিলে সুপ্রিম কোর্ট বললেন, কেউ তো মারতে দেখেনি। যাবজ্জীবন হয়ে গেল। ওই যে আর এক পুত্রবধূ, লস্যির সঙ্গে পারা। কী হল। হয় না, বুঝেছেন, অপরাধ প্রমাণ করা যায় না। অসম্ভব। তবে আপনি এই কেসে ইন্টারেস্টেড। আমরা সাধারণত যা করি, তাই করব। একটা নিরীহ ছেলেকে পাড়া থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে দেব। আধমরা করে সারা জীবনের মতো পঙ্গু করে দেব।

আপনারা ওই সাট্টা আর চোলাইয়ের ডেনগুলো ভেঙে দিন না। সেটা তো পারেন।

ওসব লাইনে কেন ভাবছেন? ডেস্ট্রাকটিভ লাইনে? কিছু ছেলে করে খাচ্ছে, সহ্য হচ্ছে না। আপনার? পারবেন বেকারদের চাকরি দিতে? পারবেন না। কলকারখানা, মিলফিল সব বন্ধ। জানেন তো দিনকাল খুব খারাপ। বেশি ঠ্যাঙাঠেঙি করতে গেলেই মেহতা কেস। নিশ্চয় ভোলা সম্ভব হয়নি আপনারও। কীভাবে ভদ্রলোককে মেরেছিল! আমি মাঝে মাঝে রাতে ভাবি, আর দুঃস্বপ্নে আঁতকে আঁতকে উঠি। আমি সেই ডেডবডি দেখেছিলুম। উঃ, সে দৃশ্য ভাবা যায় না। চোখ দুটো জ্যান্ত অবস্থায় খাবলে তুলে নিয়েছে। একটা একটা করে হাত কেটে নিয়েছে। শেষ বোধহয় পুরুষাঙ্গ। না আমি উঠি।

উঠি কী? এই কেসটার একটা কিছু করতেই হবে।

কী করব? কিছু করার নেই।

আমি দেখছি, আপনার জন্যেই আমার মন্ত্রিসভা ভেঙে যাবে।

শুনুন এই রাজ্যে কী কী আপনি বন্ধ করতে পারবেন না বলুন তো, চোলাই, সাট্টা, জুয়া, ছিনতাই, রেপ, ডাকাতি, ওয়াগন ব্রেকিং, মাল পাচার, কয়লা চুরি, ভেজাল, ছাত্রবিক্ষোভ, শিক্ষক। ধর্মঘট, কলকারখানা বন্ধ, মিছিল, টিকেটলেস ট্রাভেলিং, দেহব্যবসা, মদ্যপান, দলীয় সঙ্ঘর্ষ,। ফুটপাথ দখল, যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি। আরও সব আছে, আমার মনে পড়ছেনা। এই কয়েকটা ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে দেশ সেবা চালিয়ে যান।

আমি হাঁ করে বসে রইলুম। ভদ্রলোক চলে গেলেন। পি এ এসে বললেন, টেলিভিশান এসেছে।

টেলিভিশান কী করব আমি! এই ঘরে টেলিভিশান ঢোকাবেন না।

টেলিভিশান নয়, টেলিভিশনের লোকজন। সামনে বিশাল এক পরব আসছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্যে ছোট্ট একটা ভাষণ দিতে হবে স্যার।

লটবহর ঘরে ঢুকে পড়ল। টপাটপ চড়া চড়া আলো ফিট করে ফেলল। গলায় একটা স্পিকার ফিট করে দিল। বেশ স্মার্ট একটি ছেলে এদিকে-ওদিকে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। ক্যামেরায় আর একজন। লম্বা লম্বা চুল। মনে হচ্ছে ক্যামেরার দাড়ি বেরিয়েছে। স্মার্ট ছেলেটি বললে, দু একটা কথা বলুন স্যার, আমি-একটু অডিওটা টেস্ট করে নি।

আমি বললুম, আজ শুক্রবার। আমার নাম হযবরল। হারাধনের দশটি ছেলে।

ব্যস ব্যস। অল রাইট। আমি স্যার হাতের ইশারা করলেই শুরু করবেন।

চড়া আলোয় আমার চোখ ছোট হয়ে আসছে। অথচ দর্শকদের দিকে বড় বড় চোখে তাকাতে হবে। সেইটাই নিয়ম। ছেলেটি হাত নাড়ল। কয়েক সেকেন্ড আমি কিছু বলতে পারলুম না। ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেছি। কী বলতে হয়! শেষে বললুম, পশ্চিমবাংলার জনগণ, আপনাদের কাছে নিবেদন, বড় একটি উৎসব আসছে। উৎসব মানেই আতঙ্ক, যেমন আপনাদের ফুটবল আমাদের কাছে এক আতঙ্ক, পরীক্ষা এক আতঙ্ক। আসন্ন উৎসবে আপনারা দয়া করে শান্ত। থাকবেন, কেমন লক্ষ্মী ভাই আমার। সকলকে বুকে টেনে নিন, কাছে টেনে নিন। আমরা এক। সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছি। কবেই বা আমাদের সঙ্কট ছিল না? ছেচল্লিশ থেকেই শুরু হয়েছে। এক যায় তো আর এক আসে। যেই জয়বাংলা কমল তো এসে গেল আন্ত্রিক। তেলের দাম কমে তো চিনির দাম বাড়ে। বাস বাড়ে তো রাস্তা কমে। রাস্তা বড় হয় তো পথচলার নিরাপত্তা কমে। যেমন ধরুন বি টি রোড। যেই বিশাল চওড়া হল রোজ অ্যাকসিডেন্ট। আমরা, মানে মন্ত্রীরা বেশ অস্থির হয়ে আছি। কোনওভাবেই কিছু সামলাতে পারছি না। আপনারা ভাই হয়ে ভাইয়ের বুকে ছুরি বসাবেন না। আমাদের এই দেশ রামমোহন রায়ের দেশ, রামকৃষ্ণের দেশ, বিবেকানন্দের দেশ, রবীন্দ্রনাথের দেশ। আমাদের বুঝেসুঝে চলতে হবে ভাই। দয়া করে শান্তি বজায় রাখুন। বেশ আনন্দে সংসারযাত্রা নির্বাহ করুন। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের বেশি বাড়াবাড়ি মানায় । ভগবানের নাম নিয়ে, আল্লার নাম নিয়ে, যিশুর নাম নিয়ে সব ছেলেমেয়ে মানুষ করুন। আমরা মানুষ চাই। মোষের খাটাল চাই না। জয় হিন্দ।

টিভির ছেলেটি বললে, বেশ একটু নতুন ধরনের হল। খোলামেলা। মুখ্যমন্ত্রীরা সাধারণত এইভাবে বলেন না।

ছেলেটি তার-ফার গুটিয়ে, লটবহর নিয়ে চলে যেতেই হঠাৎ নুতন এক চৈতন্যের উদয় হল। এই যে চেয়ার, যে চেয়ারে আমি বসে আছি, এখানে আমার আগে, তার আগে, তারও আগে যাঁরা। বসে গেছেন সকলেই ছিলেন মহা মহারথী। তাঁদের দল ছিল, অভিজ্ঞতা ছিল। ওই পথে তো আমার যাবার উপায় নেই। আমি যদি একটা অন্য রাস্তা ধরি। চার্লি চ্যাপলিন, পিটার সেলার, ড্যানি কে? কেমন হয়। ভাঁড়কে লোকে পছন্দ করে। যেমন পছন্দ করে অভিনেতাকে। অমিতাভ বচ্চন, সুনীল ডাট, বৈজয়ন্তীমালা। উত্তমকুমার বেঁচে থাকলে অবশ্যই একালের হিড়িকে মুখ্যমন্ত্রী হতেন।

পি এস কে ডেকে জিগ্যেস করলুম, আমি কি একা একা বাইরে একটু বেড়িয়ে আসতে পারি? মাথাটা জ্যাম হয়ে গেছে।

পাগল হয়েছেন স্যার! কোনওদিন দেখেছেন লোমলা ফুটফুটে বিলিতি কুকুর নেড়ি কুকুরের মতো একা একা রাস্তায় ঘুরছে। এইটুকু স্যাক্রিফাইস আপনাকে করতেই হবে। আপনি হলেন চেনে বাঁধা ভি আই পি।

কর্মীদের প্রতিনিধিরা এইসময় হইহই করে ঢুকে পড়লেন। বেশ একটু রাগ রাগ মুখ। আমি বলার আগেই যে যার চেয়ারে বসে পড়লেন। নেতা কোনও ভূমিকা না করেই বললেন, আমাদের মাইনে বাড়াতে হবে।

মাইনে বাড়াতে হবে মানে? সরকারি কর্মচারীদের মাইনে বাড়ে নাকি? পশ্চিমবঙ্গ সরকারে মাইনে বাড়ে না। সরকারি চাকরি তো ঠিক চাকরি নয়, দেশসেবা।

দেখুন ওসব তাপ্পি আমরা আর শুনছি না। দ্রব্যমূল্য সাঙ্তিক বেড়ে গেছে। আমাদের সংসার চলছে না।

স্বার্থপরের মতো, আপনারা শুধু আপনাদের কথাই ভাবছেন, দেশের সাধারণ মানুষের কথা। ভাবুন, যাদের কোনও স্থায়ী রোজগার নেই। মাসে হয়তো একশো কি দেড়শো টাকা রোজগার করে। দু-বেলা মোটা ডালভাতই জোটাতে পারে না। তাদের কথা ভাবার সময় এসেছে।

বাঃ, আপনি দেখছি বেশ তৈরি হয়ে গেছেন। সেই পুরোনো সুর। পুরোনো কথা।

কই আপনারা তো আগের মিনিস্ট্রিতে একটাও কথা বলেননি। বেশ শান্ত ছিলেন।

সে ছিল আমাদের মিনিস্ট্রি। একটু আগে আপনি আমাদের ভয় দেখিয়েছেন। আমাদের আন্দোলনের পথে ঠেলে দেবেন না। তাহলে কিন্তু সব অচল হয়ে যাবে।

যায় যাবে। আমার কাঁচকলা।

আপনি তাহলে লড়াইয়ের পথ বেছে নিলেন।

অফকোর্স। আপনারাই তো আমাকে শিখিয়েছেন। আপনাদের মিছিল আমি দেখেছি। চিৎকার করতে করতে চলেছেন, লড়াই, লড়াই, লড়াই। এ লড়াই বাঁচার লড়াই।

সেনশর্মা সোনার চশমা পরে এসেছেন। গায়ে বিলিতি গন্ধ। আমি আছি। আমার ক্যাবিনেটের আরও কয়েকজন আছেন। পুরো ক্যাবিনেটটা নেই। বেশকিছু কিছু সদস্য ক্ষমতার আরকে বেগোড়বাঁই হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বাড়িতে ফাঁট দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্রীড়ামন্ত্রী এসে দুঃখ করছিল, আমার বউ দুম করে লালবাজার থেকে এক টুকরো মার্বেল পাথরে আমার নাম খোদাই করে এনেছে, তলায় লেখা, ক্রীড়ামন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ। যখন ঝোঁকের মাথায় করাতে দিয়েছিল, তখন খেয়াল ছিল না লাগাবে কোথায়। এখন বিপদে পড়ে গেছে। আমার তো নিজের বাড়ি নেই। শেষে মিস্ত্রি ডাকিয়ে আমাদের শোবার ঘরের বাইরের দেয়ালে লাগিয়েছে। ব্যাপারটা একটু হাস্যকরই হয়ে গেল। তা আর কী করা যাবে! আপনি আমাকে এমন এক বিভাগ দিলেন, পাঁচ বছর কেন, পনেরো বছরেও বাড়ি করা যাবে কি না সন্দেহ। আবগারি। বিভাগটা আমাকে দিন না। তবু দুটো পয়সার মুখ দেখা যেত। আমি কথা দিচ্ছি, ওই বিভাগটা আমার হাতে দিলে আমি জনগণের অ্যায়সা সেবা করব যে সকাল-সন্ধে কেউ আর উঠতে পারবে না। সবাই গড়াগড়ি যাবে। ঘরে ঘরে আমি চোলাই যন্ত্র চালু করে দোবো। পাড়ায় পাড়ায়। ভাটিখানা। মোড়ে মোড়ে বিয়ার পাব। একবিংশ শতাব্দীতে চা আমি অচল করে দোবো।

আমি কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলুম। রোগে ধরেছে। টাকা-ব্যামো। আমাদের অবশ্য ঘরে ঘরে জিমনাসিয়াম করার একটা পরিকল্পনা আছে। প্রত্যেক বাড়িতে ফ্রি একসেট ডাম্বেল, বারবেল আর রোমান রিং দেওয়া হবে। লাফাবার দড়ি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের শরীরের দিকে নজর দিলে অন্যের দিকে নজর দেবার আর সময় পাবে না। দেহনেশায় সব কুঁদ হয়ে থাকবে। সংশয়ের একটা প্রশ্নই উঠেছে, বধূনির্যাতন বাড়বে কি না! ডাম্বেল দিয়ে দাঁতের গোড়া ভাঙল, কী রোমান রিং-এ দুটো পা গলিয়ে দিয়ে বউকে ঝুলিয়ে রেখে কীর্তন শুরু করল, ও বউ তোর বাপের কাছ থেকে আরও দশ হাজার নিয়ে আয়। স্বামী গাইবে আখর দিয়ে, সখি গো, তোর এ কষ্ট সয় না প্রাণে, নিয়ে আয় নিয়ে আয়, সোনাদানা যা পারিস নিয়ে আয়, নিয়ে আয়। সেনশর্মা বললেন, মনে করুন, আপনারা একটা ম্যাগাজিন। টকিং ম্যাগাজিন। এটা তো ঠিক, কথা বলা ছাড়া আপনাদের আর কোনও কাজ নেই। পাঁচটা বছর চুটিয়ে কথা বলে যাবেন। তেড়ে বক্তৃতা দিয়ে যাবেন। একটা ম্যাগাজিনের সাকুলেশান বাড়ে কীভাবে? বলুন, সবাই ভেবে ভেবে বলুন।

ভালো গল্প চাই।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। ভালো গল্প শোনান দেশের মানুষকে। এই হবে, সেই হবে। হাতি হবে, ঘোড়া হবে। বেকার চাকরি পাবে। মানুষ ভালো খেতে পাবে। পরতে পাবে। ট্রাম পাবে। বাস পাবে। ইচ্ছাপূরণের গল্প শোনান।

ধারাবাহিক উপন্যাস চাই।

রাইট। তার মানে সব কিছুই ক্রমশ করে রাখা। আগামী সংখ্যায় দেখুন। কোনও কিছু শেষ করবেন না। শেষ বলে দেবেন না। বানিয়ে বানিয়ে চলুন। মোক্ষম এক একটা ইস্যু ধরে তালগোল পাকিয়ে রাখুন। যেমন কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক। ধারাবাহিক উপন্যাস। আপনারা আসার আগে এক মন্ত্রী ফারাক্কার জল নিয়ে উপন্যাস শুরু করেছিলেন। এদিকে গোর্খাল্যান্ড একসময় ধারাবাহিক উপন্যাস হয়ে উঠেছিল। ওদিকে পঞ্জাব, শ্রীলঙ্কা।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি চাই।

অফকোর্স চাই। আমেরিকা এই ব্যাপারে আপনাদের অনবরত সাহায্য করবে। থার্ড ওয়ার্ল্ডে যেই নাক গলাবে কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের সামনে বোমা ফাটাবেন। কুশপুত্তলিকা দাহ করবেন। অবশ্য তার আগে ঠিক করে নিন নিজেদের ভেতর, আপনারা রাশিয়ান না আমেরিকান।

রাশিয়ান, আমেরিকান মানে? আমরা তো ভারতীয়।

ধুস, আমরা আবার কবে ভারতীয় হলুম মশাই? ভারতীয় হলে ভারতের এই অবস্থা হয়! থার্ড ওয়ার্ল্ডের ফাদার হয় রাশিয়া না হয় আমেরিকা। রাশিয়া হওয়াই ভালো। পশ্চিমবাংলার মানুষ রাশিয়াটা ভালো খায়। একটা বিপ্লব বিপ্লব গন্ধ আছে।

এরপর কবিতা চাই।

কবিতা তো চাই-ই। শব্দ থাকবে, মানে থাকবে না। খুব নামি এক মুখ্যমন্ত্রী কোনওদিন সেনটেন্স কমপ্লিট করতেন না। সবচেয়ে বড় কবি হলেন সবচেয়ে বড় স্টেটসম্যান, সবচেয়ে বড় স্টেটসম্যান হলেন সবচেয়ে বড় কবি। তিনি সব কিছু কবিতার মতো, লেজঝোলা করে রাখতেন। যে পারো বুঝে নাও।

একটু সেক্স চাই। একটু ভায়োলেন্স চাই।

অবশ্যই চাই; তবে নর্মাল সেক্স নয়। পারভারসান। পারভারসান কাকে বলে জানেন?

আপনার মুখেই শুনি।

হিন্দি ছবি যে-দেশের এত বড় সম্পদ, সে দেশের মানুষকে পারভারসান আর ভায়োলেন্স বোঝাতে হবে? ধরুন কেউ নেচে নেচে, কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে গান গায়। কোনও মহিলা শিল্পী। খুব হইচই বাঁধিয়ে দিল। অপসংস্কৃতি বলে শোরগোল তুলে দিন। ব্যস! কাজ হয়ে গেল। সমস্ত দেশের দৃষ্টি চলে গেল সেই শিল্পীর দিকে। তাঁর গান নয় তাঁর শরীরটাকে আন্ডারলাইন করে দিলেন। এইবার হঠাৎ বলুন, না না, ওটা অপসংস্কৃতি নয়, ভারতীয় সংস্কৃতি। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কাতারে কাতারে ছুটল তাঁর অনুষ্ঠান শুনতে। একে বলে চাঁদে কলঙ্কলেপন টেকনিক। মাঝে মাঝে অশ্লীল সিনেমার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবেন; কিন্তু বন্ধ করবেন না। সিনেমার পোস্টারে নায়িকার উন্মোচিত বুকে কালো রঙের পোঁচড়া টেনে দেবেন। অতীতে এক সম্পাদক ছিলেন, তিনি এক ঢিলে দু-পাখি মারতেন। তাঁর কাগজে আলাদা একটা বিভাগ ছিল, সাহিত্যে অশ্লীলতা। বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত গল্প, উপন্যাসের অশ্লীল অংশ তুলে তুলে দিয়ে মন্তব্য লিখতেন, বাংলা সাহিত্যে আজকাল এইসব অপকর্ম চলেছে। ওই বিভাগটি পড়ার জন্যেই। কাগজের কাটতি বেড়ে যেত। খুঁজে খুঁজে হরেকরকম সমস্যা বের করুন। আসল সমস্যা নয়, নকল সমস্যা। সেইসব সমস্যা নিয়ে বিশাল শোরগোল তুলে দিন। দেশকে সবসময় একটা আন্দোলনের অবস্থায় ফেলে রাখুন। মানুষ সুস্থির হলেই মাথা ঘামাবার অবকাশ পেয়ে যাবে। তখনই হিসাব মেলাতে বসে যাবে, কী দেবার কথা ছিল, কী দিলেন, কী দিলেন না। সব ব্যাপারে মানুষকে একেবারে জেরবার করে রাখুন। কারুকে মাথা তুলতে দেবেন না। জানেন তো ইংরেজিতে একটা কথা আছে, গিভ দেম অ্যান ইঞ্চ, দে উইল আস্ক ফর অ্যান এল। যেই এক ইঞ্চি দিলেন, অমনি পরমুহূর্তে চেয়ে বসবে এক বিঘত। মানুষকে প্রথমে একেবারে ল্যাঙটা করে দিন; তারপর এগিয়ে দিন একটা বাঁদিপোতার গামছা। আমার এক রিলেটিভের একবার। পকেটমার হয়ে গেল। প্রায় হাজারখানেক টাকা চোট। ভীষণ মন খারাপ। পকেটমারকে। গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিলে। হঠাৎ একদিন ডাকে একটা রেলের মান্থলি এল। পকেটমার মান্থলিটি ফিরিয়ে দিয়েছে। সেই পকেটমারের প্রশংসায়, সততায় আমার আত্মীয়টি একেবার পঞ্চমুখ। উচ্ছাসের বশে ভদ্রলোক এমন কথাও বললেন, এইসব মানুষ আছে বলেই দেশটা এখনও তলিয়ে যায়নি।

মানুষকে কীভাবে, কতভাবে জেরবার করা যায়?

অনেক উপায় আছে। সপ্তাহে একদিন, দেড়দিন পানীয় জল বন্ধ করে দিন। মানুষকে প্রচণ্ড গরমে শুটকি মাছ হতে দিন। থেকে থেকে লোডশেডিং করে দিন; বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের। পরীক্ষার সময়। যানবাহনের সংখ্যা আরও কমিয়ে দিন। চারপাশে ভ্যাট ভ্যাট নর্দমা আর পচা কাদার কেয়ারি করে দিন। মানুষ এক পা এগোতে যেন বাপের নাম ভুলে যায়। রাতে রাস্তায় একবিন্দু আলো যেন না থাকে। রাস্তার চতুর্দিকে বড় বড় গর্ত খুঁড়ে রাখুন। পাবলিক সার্ভিস শব্দটা ডিকশনারি থেকে মুছে দিন। রাজপথে বিশাল বিশাল জ্যাম তৈরি করুন। পুলিশ আর হোমগার্ডকে এমন ট্রেনিং দিন, একজন বলবে আয়, আর একজন বলবে আসিস না।

হঠাৎ আমার পি-এ ঘরে ঢুকে পড়ল, স্যার ফিনান্সের একজন পিওন আপনাদের কী বলতে এসেছে।

আমাদের এখন জরুরি মিটিং হচ্ছে। আপনার বুদ্ধিশুদ্ধি কি লোপ পেয়ে গেল?

ব্যাপারটা খুব সাঙ্ঘাতিক।

নিয়ে আসুন।

বোকাবোকা চেহারার একটি লোক ঘরে ঢুকে বললে, আপনাদের এক মন্ত্রী একটা গর্তে পড়ে আছে।

গর্তে পড়ে আছে? মন্ত্রী কি ইঁদুর! বাজে কথা বলার জায়গা পাওনি?

মাইরি বলছি। মা কালীর দিব্যি।

এ কে রে? দিব্যিটিব্যি করছে। কোন মন্ত্রী?

তা বলতে পারব না, আপনারা তো সব নতুন। চেহারাটা মোটা মতন। চোখে চশমা।

অ্যাঁ, সে তাহলে আমাদের পূর্তমন্ত্রী। মরেছে, গর্তট দেখতে গিয়ে পা সিলিপ করে পড়ে গেছে।

না না সিলিপ করে নিজে থেকে পড়েনি। পাবলিক ফেলে দিয়ে ঘিরে রেখেছে। সে খুব তামাশা হচ্ছে। স্যার যেই ওঠার চেষ্টা করছেন, পাবলিকে পেঁদিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।

আমারও এক সময় খুব মাইরি বলার অভ্যাস ছিল। রকে বসেছি, চায়ের দোকানে বসেছি, আলুর চপ খেয়েছি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, মাইরি। পরে সামলে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীসুলভ একটা হুঙ্কার ছাড়লুম, অ্যায়, একে বের করে দাও। লোকটা কথা বলতে শেখেনি।

লোকটি অবাক হয়ে বললে, জনগণ এইভাবেই কথা বলে, আর আপনারা তো জনগণেরই সরকার!

না, আমরা জনগণের সরকার নই।

লোকটি তবু বললে, যাঃ মাইরি।

চলে যাচ্ছিল, ডেকে জিগ্যেস করলুম, কোন রাস্তায় পড়ে আছে?

ওস্তাগার লেনে।

ওখানে কী করতে গিয়ে মরেছে কে জানে! মরার আর জায়গা পেলে না। পি-এ কে বললুম, ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টার। সঙ্গে সঙ্গে লাইনে ভদ্রলোক এসে গেলেন, প্রথমে তো বুঝতেই পারেন না। কেবল বলেন, গর্তে মোষ পড়েছে তো কী হয়েছে স্যার। ও খাটালের লোকেরা। দড়িটড়ি বেঁধে চাগাড় দিয়ে তুলে নেবে।

এক দাবড়ানি দিয়ে বললুম, ধুর মশাই, কানের মাথা খেয়েছেন। গর্তে মোষ নয় মন্ত্রী পড়েছেন। আপনাদের পূর্তমন্ত্রী। ভদ্রলোক আক্ষেপ করে বললেন, এই সবে নতুন নতুন মন্ত্রী হয়েছেন। ভালো করে হাঁটতে শেখেননি। কলকাতায় পথচলা কি অতই সহজ রে বাবা! তেনজিং নোরগের মতো লোক আসতে ভয় পেত।

আমাদের ক্যাবিনেট ভেঙে গেল। আমার কলিগরা বললেন, চলুন স্যার, আমরা সবাই একবার যাই।

মন্ত্রী গর্তে পড়লে মুখ্যমন্ত্রীরা আগে কখনও গেছেন? নজির দেখাতে পারবেন?

কী আশ্চর্য! আগে কোনও মন্ত্রী তো গর্তে পড়েননি এভাবে। দিস ইজ দি ফার্স্ট কেস। নজির থাকবেটা কী করে! একবার এক মন্ত্রীর কানটা, বস্তির এক মেয়ে কামড়ে ছিঁড়ে নেবার চেষ্টা করেছিল। তাও সবটা পারেনি। আর বয়স্কা মহিলারা মুড়োঝাঁটা জলে ভিজিয়ে সপাসপ মেরেছিল। মন্ত্রী প্রথমে রেগে গিয়েছিলেন। তারপর খুব খুশি হয়েছিলেন।

খুশি হয়েছিলেন কেন?

ওই যে নিরক্ষর স্বাক্ষর হয়েছে। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের দ্বিতীয়ভাগ পড়েছে বলেই না ভুবনের মতো মাসির কান কামড়েছে। খালি লিঙ্গ জ্ঞানটা ছিল না। তারপরেই তো বিদ্যাসাগর পুরস্কার চালু হল!

এই ঘটনার পর আমরা কী পুরস্কার চালু করব?

বাবা বৈদ্যনাথ পুরস্কার। বৈদ্যনাথ ধামে গিয়ে দেখবেন শিবলিঙ্গ মাটির ভেতর রাবণরাজার থাবড়া খেয়ে দশ হাত ঢুকে গেছেন। আমরা বৈদ্যনাথ পুরস্কার চালু করতে পারি। এপিকধর্মী উপন্যাসের জন্যে।

এপিক। এপিক লেখার মতো সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে আছে? ওই তো সব সাহিত্যের ছিরি! বড়গল্পকে টেনে বাড়িয়ে উপন্যাস বলে চালায়। এপিক লেখার মতো সব কবজির জোর আছে নাকি!

আমরা বেদব্যাসকে পঙ্গুমাস অ্যাওয়ার্ড দিয়ে স্টার্ট করব।

হ্যাঁ, তা অবশ্য করতে পারি। একটা ভালো উদাহরণ হয়ে থাকবে। প্রবলেম হল পুরস্কারটা নেবে কে?

কেন? আমরা তাঁর বংশধরকে খুঁজে বের করব। বংশ লোপাট হয়ে যায়নি তো!

আমি সেনশর্মার দিকে তাকিয়ে বললুম, কী মশাই! আপনাদের মডার্ন ম্যানেজমেন্ট টেকনিকে একেই তো বলে ব্রেন-স্টর্মিং। মাথা থেকে কীরকম সব বেরোচ্ছে। মণিমাণিক্য। এরপর আমরা বাল্মীকিকে, তারপর শ্রীকৃষ্ণকে গীতা লেখার জন্যে বৈদ্যনাথ পুরস্কার দেব। একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার করে ছাড়ব।

সেক্রেটারি কানে কানে বললে, স্যার পূর্তমন্ত্রী গর্তে পড়ে আছেন।

ওঁয়া ওঁয়া করে আমার গাড়ি ছুটল। গাড়িতে আমার পাশে বসেছিলেন পুরমন্ত্রী। জিগ্যেস করলুম, এই শহরের মেয়র কোথায়?

তাঁর তো সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরে এসেই ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়া হয়েছে।

সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলেন কেন?

শহর কী করে সাজাতে হয় দেখার জন্যে।

নিজের পয়সায়?

না না, পাবলিকের পয়সায়।

বেশ আছে সব।

না না, ও বলবেন না। এরপর তো আমাকেও যেতে হবে।

কোথায় যাবেন?

এই তো সামনের মাসে আমি ইউরোপের সবকটা বড় বড় শহর ঘুরে ঘুরে দেখব।

কী দেখবেন?

ইউরিন্যাল। কলকাতার পেচ্ছাপ-সমস্যার একটা পজেটিভ সমাধান চাই। সেদিন কাগজে চিঠিপত্র বিভাগে সব চিঠি লিখেছে মেয়েরা। দামড়ারা অসভ্যের মতো চৌরঙ্গি ফ্লাড করে দিচ্ছে।

পাঁচ আইনে কয়েকটাকে তো প্যাঁচ মারলেই হয়। এই সামান্য কারণে সাধারণের অর্থে ইউরোপ!

আপনি তো নেগেটিভ সলিউশানের কথা বলছেন। পজেটিভ সলিউশান হল, করো। যত খুশি, যেখানে খুশি করো, কিন্তু জনগণমূত্র ধারণের জন্যে প্রশাসন পিছপা নয়। চ্যালেঞ্জ। প্রয়োজন। হলে মূত্রমন্ত্রীর পদ তৈরি হবে।

সলিউশানটা কী?

সেইটেই তো শিখে আসব। ধরুন, এমন কোনও ইলেকট্রনিক সিস্টেম, যেখানেই করুন একটা ইলেকট্রনিক চোঙা মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এসে সামনে দুলবে আর বিপবিপ শব্দ করবে।

মাথাটা গেছে। তা ইলেকট্রনিক্সের কথা যখন ভাবছেন, তখন ইলেকট্রনিক্সের দেশ জাপানে। যান।

ইউরোপে যাবার আর একটা কারণও আছে, যদি আবর্জনাভুক কোনও প্রাণীর সন্ধান পাই।

মানে? সে আবার কী?

কিছু মনে করবেন না স্যার! আপনার জেনারেল নলেজ থোড়া কম আছে। আমি সব বিদেশি ম্যাগাজিন-উগ্যাজিন পড়ি। জাপানে এক ধরনের ব্যাকটিরিয়া আবিষ্কার হয়েছে, যারা পেট্রোলিয়াম জেলি খায়। পেট্রোলিয়াম জেলিতে খুব প্রোটিন থাকে। সেই প্রোটিন খেয়ে ব্যাকটিরিয়াগুলোও সব মোটামোটা প্রোটিনের দানা হয়ে যায়। প্রথমে জাপান ভেবেছিল ওই প্রেট্রো-প্রোটিন মানুষকে খাওয়াবে। কিন্তু ভীষণ গন্ধ। তখন করলে কি সীলমাছকে খাওয়াতে লাগল। সেই প্রোটিন খেয়ে সীলগুলো সব হয়ে গেল হাতির মতো। এইবার সেই হাতিসীল খেয়ে জাপানি ছেলেমেয়েরা ফুটবল। জানেন তো, নেসাসিটি ইজ দি মাদার অফ ইনভেনশান। আবার, হোয়্যার দেয়ার ইজ এ উইল, দেয়ার ইজ এ ওয়ে। উইপোকা কাঠ খায়। পঙ্গপাল ফসল খায়। পিপীলিকাভুক পিপীলিকা খায়, ব্যাঙ মশা খায়, সাপে ব্যাঙ খায়, বেজিতে সাপ খায়…

বাঘ, বাঘ, বাঘে মানুষ খায়। বাঘকে কে খায়!

আপনি রেগে যাবেন না। বায়োলজি দিয়ে আজকাল কেলেঙ্কারি করে ছেড়ে দিচ্ছে। আমি বায়োজেনেসিস নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করব। তারপর বায়োমের সন্ধান করব। এমন কোনও প্রাণী অবশ্যই আছে যারা হাঁউহাঁউ করে আবর্জনা খায়। শকুন হল পাখি। আমি চাই চতুষ্পদ আর ফাস্ট ইটার। নিমেষে মনুমেন্টের তলার ভাগাড় খেয়ে ফেলবে। দু-ঘণ্টায় কলেজ স্ট্রিট, মেছোবাজার সাফ। বায়োডিগ্রেডেবল খুঁজব। বায়োডেস্ট্রাকটিবল। আমার মাথায় নানা পরিকল্পনা একেবারে সুতলির মতো জট পাকিয়ে আসে। পাঁকের মতো ভ্যাড়-ভ্যাড় করছে। ইয়োরোপের মাটিতে প্লেন যেই টাচডাউন করবে, ছুটে বেরিয়ে যাব। ধর-ধর করে ছুটব। পরিকল্পনা ধরো। বিজ্ঞানী ধরো। আর সেই সঙ্গে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা। পশ্চিমবাংলার ইমেজ তৈরি করব।

দুটো জিনিস ভুল করলেন।

এখন ভুলে গেলেও, ওখানে গিয়ে মনে পড়ে যাবে। জলবায়ুর একটা গুণ আছে তো! এই ভ্যাপসা ভাদ্দরের গরম তো সেখানে নেই।

দুটো জিনিস, এখান থেকেই মনে রেখে যেতে হবে। এক, আপনি সে দেশের ভাষা জানেন না…।

আমি দোভাষী নেব।

দুই, আপনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নন, রাজ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবাংলার বিদেশে কোনও ইমেজ হয় না। ইমেজ হল ভারতের।

ইমেজ তো কারুর মনোপলি হতে পারে না। আমি পশ্চিমবাংলার ইমেজই বাড়িয়ে আসব। কবিতা দিয়ে শুরু করব, ইচ অ্যান্ড এভরি বক্তৃতা, বাম হাতে যার কমলার ফুল, ডাহিনে মধুকমালা, ভালে কাঞ্চন শৃঙ্গমুকুট, কিরণে ভুবন আলা।

আমার মনে হচ্ছে আপনার হয়তো ভুল হচ্ছে। ডান হাতে যার…।

আপনি আমার ফাইলটা, বিদেশ যাবার ফাইলটা সই করে ছেড়ে দিন, হাত-পা আমি সব ঠিক। করে নেব। কতকাল আগের পড়া। সাঙ্ঘাতিক মেমারি বলে এখনও মনে আছে।

আমার গাড়ির পেছনে ঘণ্টা বাজিয়ে দমকল আসছে। আমার গাড়ি চলেছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। সামনে পুলিশ পাইলটের ওয়া ওয়া। ফায়ার বিগ্রেড আসছে ঝড়ের বেগে। চেষ্টা করছে আমাদের ওভারটেক করতে। সাধারণ মানুষের গাড়ি হলে রাস্তার একেবারে বাঁ-ধারে সরে যেতে হত। ফায়ার ব্রিগেড আর অ্যাম্বুলেন্স সবার আগে যাবে। সেইটাই নিয়ম। আমার ড্রাইভারকে বললুম; বাঁ-দিকে পাশ করে, ফায়ার ব্রিগেডকে যেতে দাও।

আপনার কথায় হবে না স্যার। পাইলট আমাকে যেভাবে চালাবে আমি সেইভাবে চলব।

আরে মূখ ওটা দমকল। দমকল সবার আগে যায়।

আমি মূখ হতে পারি স্যার; কিন্তু আপনি হলেন মূখমন্ত্রী।

মূর্খ বললে না মুখ্যই বললে কে জানে! বেশি ঘাঁটাবার সাহস হল না। মুখ্য বলে দমকলের প্রবল ঘণ্টাখানির বিরাম নেই। আসলে দমকলের ঘণ্টা যে বাজায় তার পুরোহিতের মতো অভ্যাস। অক্লেশে, না থেমে নেড়ে যায়। বেশ বুঝতে পারছি, ভীষণ একটা প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দিয়েছে—দমকল আগে যাবে, না মুখ্যমন্ত্রী? এখন গাড়ি থামিয়ে ম্যানুয়াল দেখতে পারলে ভালো হয়। সামনে দেখতে পাচ্ছি আমার পুলিশ পাইলট মনের আনন্দে ভরর ভরর চলেছে। তারও ওঁয়া ওঁয়া অভ্যাস। এই হয়তো করে আসছে গত দশ বছর। আমি অসহায়। গাড়িও আমার নয়, ড্রাইভারও আমার নয়। তবু বললুম, বাঁ-দিক করো।

ড্রাইভার বললে, আপনার কথা শুনে এই বাজারে চাকরিটা খোয়াতে চাই না স্যার।

এইরকম পরিস্থিতিতে যে যত দরেরই মানুষ হোক, তার বলা উচিত, লে হালুয়া।

যাক, আমরা ওস্তাগার লেনে এসে গেলুম। বেশ বুঝতে পারছি, এরই মধ্যে আমার ভেতর বেশ একটা অহঙ্কারের ভাব এসে গেছে। গাড়ি থেকে নামতেই ইচ্ছে করছে না। যতই হোক আমি একটা মুখ্যমন্ত্রী। এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে আমার কি আসা উচিত।

ব্যাপারটা যত ছোট ভেবেছিলুম তত ছোট নয়। মাইক লাগিয়েছে। কান ফাটানো সুরে গান বাজছে, দিল তোড়োনা।

একটা বাচ্চার কী আনন্দ। সে বলছে, একটা মোটামতো লোককে, গাড়ায় ফেলে মুস্তাফিরা খুব রগড়াচ্ছে। লোকটা না আপন মনে বসে বসে চুরুট খাচ্ছে। একটা ল্যাবা মতো লোক। একালের ছেলে। তার হাবভাব, কথাবার্তাই অন্যরকম। কোথা থেকে একটা ফেরিওলা এসে গেছে। তার। লাঠির মাথায় বাঁধা লাল-হলুদ ফিতে। ঝুলছে সেফটিপিনের পাতা, কাপড় শুকোতে দেবার ক্লিপ। হজমিওলা এসে গেছে। মাঝে মাঝে চেল্লাচ্ছে, হজমাহজম। ওদিকে গান পালটে গেছে, হালুয়াবালা আ গয়া—আমাকে বলছে নাকি! মনে হচ্ছে উৎসব। রামনবমী কি তালনবমী। যা হয় একটা কিছু।

ওস্তাগার লেনকে আর রাস্তা বলা যায় না। বাঁ-দিকে বিশাল একখানা খুঁড়ে রেখেছে। সমস্ত মাটি ডান দিকে তুলে পাহাড়। বাঁ দিকের বাড়ির সামনে সামনে একফালি কাঠ পাতা। সেই কাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে এসে পাহাড়ে উঠে স্লিপ খেতে খেতে বড় রাস্তায় আসতে হবে। আর ডান দিকের বাড়ি থেকে যারা বেরোবে তারা ওই মাটির পাহাড় বাড়ির দেয়াল আর প্রাচীন নর্দমার। মাঝখানে, মহাপ্রস্থানের পথের মতো একফালি সঁড়িপথ পাবে। সেই পথের জায়গায় জায়গায় আবার বাঙালির বড় আদরের আস্তাকুড়। সেই আঁস্তাকুড়ের একটার ওপর কে আবার নির্লজ্জের মতো একটি ব্যবহার করা স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলে গেছে।

রাস্তার মুখে টিবিটার মাথায় উঠে আমি সব দেখছি। ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। মেয়েমদ্দা সব মজা দেখছে। পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড সব থমকে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পাচ্ছি, অনেক দূরে গর্তের মধ্যে, সাদা মতো কী একটা প্রাণীনড়াচড়া করছে। আমার সামনে দুজন দাঁড়িয়েছিল সভাসমিতিতে যাদের আমরা খুব খাতির করে বলি, বন্ধুগণ। একজন আর। একজনকে দেখাচ্ছে, ওই দ্যাখ মন্ত্রী বটেক। আমার ভীষণ রাগ হল। গত চল্লিশ বছরে মন্ত্রীদের মানসম্মান কোথায় নেমে এসেছে।

আমার পাশে কমিশনার, ওপাশে ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টার। ডিরেক্টারকে বললুম, দাঁড়িয়ে না থেকে দড়ি ফেলে পাতকো থেকে বালতি তোলার মতো করে ওই ব্যারেলটাকে তুলুন। আমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। আমাকে একেবারে বেইজ্জত করে ছেড়ে দিলে। কাতারে কাতারে লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছে। ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে। আমি দেখছি এই পূর্তমন্ত্রীরা হল। সবচেয়ে গোলমেলে জীব। অনেক আগে এক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর চিতাভস্ম ভরা হাঁড়ি মাথায় নিয়ে নেচেছিলেন। সাংবাদিকদের বেশ্যা বলেছিলেন। সে এক সাঙ্ঘাতিক এমব্যারাসমেন্ট।

ডিরেক্টার বললেন, পাবলিককে তো ডিল করেননি। তুলতে না দিলে তোলা যাবে না।

কমিশনারকে বললুম, ফোর্স দিয়ে সব হঠান। না সেটাও পারবেন না?

ভদ্রলোক এই সঙ্কটেও এক মুখ হেসে বললেন, না স্যার, পারা যাবে না। ওই গর্তে যিনি পড়ে আছেন তাঁর স্বার্থেই পারা যাবে না। ওই মাটির ডাঁই ভেঙে, ধসে ভেতরে পড়ে গেলে জীবন্ত সমাধি। আপনাদের মশাই আচ্ছা ব্ল্যাকমেল করেছে। এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা। পেছলেও নিবংশের ব্যাটা।

ওসব প্রবাদ ছাড়ুন। কী করা যায় ভাবুন।

আপনি নেতা। আপনি মুখ্যমন্ত্রী। আপনার ভাবমূর্তি দিয়ে জনতাকে শান্ত করুন। একটা মধ্যস্থতায় আসুন।

এই গর্ত কে খুঁড়েছে? কেন খুঁড়েছে? কার হুকুমে খুঁড়েছে?

হাঃ হাঃ, সেই ছেলেবেলায় পড়া একটা বইয়ের কথা মনে পড়ছে কে কী কেন কবে কোথায়। কলকাতার গর্ত-পলিটিক্স আপনি জানেন না!

ঠিক আছে, ডাকুন গর্তে মন্ত্রী ফেলার পাণ্ডাদের। বলুন আমি মুখ্যমন্ত্রী।

প্রবীণ, নবীনে একটি দল এগিয়ে এল। তার মধ্যে বেশ তালেবর একটি ছোকরা বললে, নমস্কার স্যার।

তোমরা এমন একটা কাজ করলে কেন? আমরা তোমাদেরই রায়ে সবে এসে ক্ষমতায় বসেছি। তোমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন আমাদের হাতে। তোমরা আমাদের একজন মন্ত্রীকে দুম করে গর্তে ফেলে দিলে!

মা কালী, অন গড আমরা ফেলিনি। নিজেই পড়ে গেলেন। আমরা এটা অন্যায় করেছি, ভদ্রলোককে তুলিনি। যেই বললেন, আমি পূর্তমন্ত্রী, সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললুম, থাক শালা পড়ে।

ছেলেটি জিভ কেটে বলে, সরি স্যার।

পড়ে থাকবে কেন?

আপনি বলুন, ছমাস হয়ে গেল, রাস্তাটা এইভাবে পড়ে আছে। এর মধ্যে পাড়ায় সাত-সাতটা বিয়ে হয়েছে। কোনও গাড়ি ঢুকতে পারে না। মানুষ হাঁটতে পারে না। বরকে চ্যাংদোলা করে আনতে হয়। বরবউ গাঁটছড়া বাঁধা অবস্থায় পাশাপাশি হাঁটতে পারে না। সেদিন একটা বাচ্চা মেয়ে উলটে পড়ে হাসপাতালে গেছে। ডাক্তারবাবুরা আসতে পারে না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছমাস গৃহবন্দি। আপনিই বলুন, আর আমরা কত সহ্য করব! আমরা আমাদের কাউন্সিলারকে বললুম। বললেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে গিয়ে বলো, যিনি কলকাতার পাতাল প্রবেশের ব্যবস্থা করে গেছেন। আপনিই বলুন, কোথায় পাতাল রেল আর কোথায় আমাদের ওস্তাগার লেন। যা-তা। বললে ভালো লাগে!

এখন তাহলে ভদ্রলোককে তোলা যাক।

না স্যার, ফাঁদে বাঘ যখন একবার পড়েছে সহজে আমরা ছাড়ব না। আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক।

জনতা চিৎকার ছাড়ল, হ্যাঁ হ্যাঁ, হেস্তনেস্ত। মামার বাড়ি! আলো নেই, জল নেই, রাস্তা নেই, চাকরি নেই, থাকার মধ্যে আছে নির্বাচন আর অপদার্থ মন্ত্রী। যেটা পড়েছে সেটার সাইজ দেখেছিস মাইরি!

বেসুরো বলছে, বেসুরো।

আপনারা আমাদের কেন তিরস্কার করছেন ভাই? এ তো আগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের কাজ।

হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাদের ওই ছলনায় আর ভুলছি না। যেই আসে সেই পেছনটা দেখায়। আমরা আর। পেছন দেখতে রাজি নই। আমরা সামনেটা দেখতে চাই। বাস, মিনিবাস, লরি, ঠ্যালা, রিকশা, গাজ্ঞা রাস্তায় হাঁটে কার বাপের সাধ্যি! এ ওকে ওভারটেক করছে, ও একে ওভারটেক। মোড়ে মোড়ে পুলিশ বাঁকা-শ্যাম। আর আমরা চাকার তলায় পড়ে মরছি। কেন মশাই! কেন কলকাতার ফুটপাথ দানখয়রাত করে দিয়েছেন? কেন শহরের রাস্তায় সবসময় লরি চলার পারমিশান। দিয়েছেন। কেন কেন কেন?

এ সব আগের কাজ।

চোপ। আপনাদের কোনও কথা শুনব না। যত সব ফালতু। কেবল বাতেলা। আমরা যেন ভেসে এসেছি বানের জলে। সারা দেশটাকে মেরে ফাঁক করে দিল শালা উদয়াস্ত নরক যন্ত্রণা। এর। একটা বিহিত চাই।

হবে হবে। ধীরে ধীরে হবে।

আর কত ধীর মাইরি। হাফ সেঞ্চুরি তো হয়ে গেল।

তাহলে তুলতে দেবেন না।

না। পারলে আপনাকেও ফেলে দেব। আমরা এখন ডেসপারেট।

কে খুঁড়ে গেছে?

কোন শালা খুঁড়েছে কে জানে? আপনাদের তো অনেক শালা-সম্বন্ধি।

এই সময়টায় আমি ক্যাডারদের অভাব ভীষণভাবে বোধ করছি। ক্যাডার ছাড়া দেশ শাসন করা সম্ভব নয়। ধর্মগুরুরা যেমন দীক্ষা দিয়ে শিষ্যসামন্ত তৈরি করেন, রাজনীতিগুরুদেরও তেমনি ক্যাডারের চাষ করা উচিত সবার আগে। এরা আমার দলের হলে বলত, গর্ত খুঁড়েছিস, বেশ করেছিস। রক্তগঙ্গা বইয়েছিস বেশ করেছিস। কলকাতায় ঘুঘু চরিয়েছিস, বেশ করেছিস। গ্রামের মানুষ আধমরা, ঠিক করেছিস। সব ধুকতে ধুকতে খাবি খেতে খেতেও বলত, আহ, বেশ, বেশ, বেশ! কীর্তনের আসর। মূল গায়েন সিল্কের পাঞ্জাবি পরে। গলায় দু-পাট লুতুরপুতুর চাদর। ঘি মাখন খাওয়া শরীর আর দোহাররা সব কৃশকায়, চোখ বসা, চোয়াল ওঠা। ধুকতে ধুকতে বলছে, রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা।

একটু বল সঞ্চয় করে বললুম, আমি লিখে দিয়ে যাচ্ছি, কাগজ আনুন, তিন ঘণ্টার মধ্যে এই রাস্তা চৌরসের কাজ শুরু হবে।

একটু প্রবীণ যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যস্থতায় একটা রফা হল। একজন জিগ্যেস করলেন, আপনারা কোন দল? ডান না বাঁ। রাশিয়া না আমেরিকা?

আমরা সম্পূর্ণ একটা নতুন দল।

আচ্ছা! নতুন সাবান। কেমন ফ্যানা হয়? খুব ফ্যানা!

বাবা! দেশের কী অবস্থা! কেউ গান দিয়ে বলছে হালুয়াবালা। কেউ বলছে সাবান। যাক, দমকল পূর্তমন্ত্রীকে তুলল! কাদাটাদা মেখে সে একরকম হয়েছেন। আড়ালে এনে প্রায় ধমকের সুরে বললুম, এখানে মরতে এসেছিলেন কেন?

ভদ্রলোকের প্রায় কাঁদো-কাঁদো সুর, আর বলেন কেন, আমার বউয়ের ফোল্ডিংছাতা।

তার মানে!

মানে এই রাস্তার বত্রিশ নম্বর বাড়িতে আমার মিসেসের এক বান্ধবী থাকে। কাল এসেছিল বেড়াতে। ভুলে ফেলে গেছে। আমাকে বললে, তুমি যাবার পথে ছাতাটা টুক করে তুলে নিও।

আর আপনি মন্ত্রী হয়ে বউয়ের কথায় নেচে নেচে স্ট্যাটাস-ফ্যাটাস ভুলে ছাতা আনতে ছুটলেন। ওই জন্যে বলে জাত বড়লোক আর লটারি পাওয়া বড়লোক। বুঝলেন, আমাদের জাতমন্ত্রী হতে জীবন ঘুচে যাবে। দেখুন তো আপনাদের জন্যে কী হেনস্তা।

আমরা গাড়িতে উঠছি। চারপাশে লোকে লোকারণ্য। হাসছে। টিটকিরি দিচ্ছে। সময়টা দুপুর। কিছু অলস বারাঙ্গনা মজা দেখতে এসেছিল। একজন বলে উঠল, কি লো সই! শেষে গর্তেই ঢুকে গেল।

লজ্জায় একেবারে অধোবদন। পাইলটের ওঁয়া ওঁয়া। দমকলের ঘণ্টি। জনগণের হাসি, তামাশা। আমার পাশে পুরমন্ত্রী। বললুম, তিনঘণ্টার মধ্যে, রাস্তা বোজাবার কাজ শুরু করতে হবে।

আপনি যেমন, চুক্তির ডেফিনিশান কী? যাহা ভঙ্গ করিতে হয়, তাহাই চুক্তি। যাহা বন্ধ করিতে হয় তাহাই কারখানা, যাহা দখল করিতে হয় তাহাই ফুটপাথ।

হাইড্রা এজেন্সির রবিশঙ্কর এলেন। হাতে ব্রিফকেস। মুখে তেমন হাসি নেই।

আমরা তো আপনাদের মার্কেট রেটিং সার্ভে করালুম। খুবই বাজে অবস্থা। যাচ্ছেতাই বলা চলে। আপনারা না দিশি বিস্কুট না বিলিতি বিস্কুট।

তার মানে?

মানে কী উচ্চসমাজ, কী নিম্নসমাজ কেউই আপনাদের চাইছে না। এই দেখুন হরিপালে এক ক্ষেতমজুরকে জিগ্যেস করা হয়েছিল। এই যে নতুন মন্ত্রিসভা হল, আপনাদের মনে কেমন আশা জাগছে? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, যারাই আসুক সব ব্যাটাই হারামজাদা। শ্রীপুরের এক শিক্ষককে। জিগ্যেস করা হল। তিনি বললেন, নতুন মন্ত্রিসভা। ও তো সব আকাটের দল। বামুনগাছির এক ছাত্রকে জিগ্যেস করা হল, বললে, ওল্ড ওয়াইন ইন এ নিউ বটল। কলকাতার এক ব্যবসায়ীকে জিগ্যেস করা হল, বললে, মোশা, যে মালই আসুক, আমাদের কবজায়। ব্যবসা আমাদের রাস্তা আমাদের, কলকাতার বিলকুল প্রপার্টি আমাদের, ফুটপাথ আমাদের, গঙ্গামাঈ আমাদের, পার্ক আমাদের, সোব-সোব আমাদের। এক গৃহবধূকে জিগ্যেস করা হল। তিনি বললেন, কবে সরষের তেলের দাম পঞ্চাশে ওঠে দেখব। হাঁড়ি তো প্রায় সিকেয় উঠল। বর্ধমানে এক বৃদ্ধকে জিগ্যেস। করা হল, তিনি বললেন, এদেশে মন্ত্রীটন্ত্রী আছে? আইন-আদালত আছে? আমি তো জানি, মাস্তান ছাড়া এদেশে কিছু নেই। সার্ভের ফলাফল খুব খারাপ। খুবই খারাপ।

আমাদের ইমেজ খারাপ নয়। আমাদের বাজার আগে থেকেই খারাপ করে রেখে গেছে। কীরকম জানেন, যত ভালোই চানাচুর হোক, লোকের ধারণা চানাচুরে অম্বল হয়। যেমন সিফিলিটিক। পিতামাতার সন্তান বিকলাঙ্গ হতে পারে, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে।

সে আপনি যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন; আপনাদের মার্কেট ভালো নয়। যে কোনওদিন আপনারা পড়ে যাবেন। আমরা আরও সাম্রতিক খবর পেয়েছি, ধীরে ধীরে সব অচল হয়ে যাবে। ডার্ক ফোর্সের্স চারিদিকে মাথা তুলছে। বাজার থেকে অর্ধেক জিনিস উধাও। ল অ্যান্ড অর্ডার নেই বললেই চলে।

আপনার মতে আমাদের কী করা উচিত!

দেখুন যে দেশের যা। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ছাড়া খেলার কথা ভাবা যায়?

না।

সেইরকম কংগ্রেস কমিউনিস্ট ছাড়া রাজনীতির কথা ভাবা যায় না। এই যে দেখুন নতুন নতুন সব দল হল, কংগ্রেস (স), বাংলা কংগ্রেস, প্রণব কংগ্রেস, কোনও কিছু ধোপে টিকল? পাবলিক নিল না। পার্টি অনেকটা প্রোডাক্টের মতো। শুকনো মটর শুটি, স্যুপ পাউডার, গুঁড়ো পেঁয়াজ রসুন, পাউডার, রসুন গুলি এদেশে চলেনি। এদেশের লোক জলেই জলশৌচ করবে, টিস্যু পেপার ব্যবহার করবে কেন। আপনারা যে কোনও একটা দলের সঙ্গে মার্জ করে যান।

কোনও দলই তো নেই। সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের যেমন উত্তরাধিকারী নেই, বিদ্যাসাগরের ছেলে যেমন বিদ্যাসাগর হলেন না, তেমনি বিধান রায়, জ্যোতি বসু, নেহরু কারোরই আর দ্বিতীয় নেই। কোথায় যাব! কার কাছে যাব! বনেদি বাড়ির মতো বনেদি পার্টিও সব নষ্ট হয়ে গেল। মন্দিরে আর মাধব নেই আমরা পোদোর দল শাঁখ ফুঁকছি।

সেইটাই যদি বুঝে থাকেন, তাহলে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন কেন? আপনাদের যা অবস্থা চুরিও করতে পারবেন না, দেশসেবাও করতে পারবেন না, কারণ আপনাদের সে সংগঠন নেই। আমরা সাধারণত আমাদের ক্লায়েন্টদের হতাশ করি না। কিন্তু কী করব, আপনাদের কোনও ইমেজ নেই।

রবিশঙ্কর ব্রিফকেস গুটিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। আর তিন দিন পরেই বিধানসভার অধিবেশন শুরু হবে। এই তিনদিনের মধ্যেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বিরোধীরাও আমাদের মতোইছত্রভঙ্গ। রাতে আমার স্ত্রীকে বললুম, জানো আমি পদত্যাগ করছি।

বিশ্বাস করলেন না। বললে, যাঃ সবেতেই তোমার ইয়ারকি। আমেরিকা থেকে বলুমাসিরা আসছে তোমাকে সংবর্ধনা জানাতে। তোমার মুখ-চোখও মুখ্যমন্ত্রীর মতো হয়ে আসছে। পদত্যাগ করবে মানে! আমার অত বড় বড় চুল কেটে আধ হাত করে দিলুম। সে কি পদত্যাগ করার জন্যে?

বিশ্বাস করো, ভীষণ আত্মগ্লানিতে ভুগছি। এভাবে হয় না।

আত্ম-ফাত্মা ফেলে দাও। রাজনীতিতে আত্মা নেই। তুমি দেশ দেশ করে অত ভেবোনা তো। বিদেশের কথা ভাবো।

জানো, আমি আজকাল খেতে বসে চাষবাসের কথা ভাবি। জামাকাপড় পরার সময় টেক্সটাইল মিলের কথা ভাবি। দুধ খাবার সময় হরিণঘাটার কথা ভাবি। আলোর সুইচে হাত দেবার সময় ব্যান্ডেলের কথা ভাবি। যা করতে যাই পুরো পটভূমিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে আর আমি কেমন যেন সিক হয়ে পড়ি। কোথাও কোনও কাজ হচ্ছে না। চড়া রোদ দেখলে মনে হয়, এই রে খরা এসে গেল! কালো মেঘ দেখলে মনে হয় বন্যা।

তুমি অ্যামেচার, এখনও অ্যামেচার। প্রোফেশনাল হবার চেষ্টা করো।

ঘুম আর আসে না। একটু তন্দ্রার মতো আসে, ছ্যাঁক করে ভেঙে যায়। ওইটুকুর মধ্যেই ঘেঁড়া ছেড়া স্বপ্ন। মাস্টারমশাই সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। চোখদুটো যেন জ্বলছে। হাতে একটা। কাগজ। কণ্ঠে তিরস্কার, কিছুই করতে পারলে না। আমার নাতনিটা আত্মহত্যা করল। গঙ্গার ধারে এক বৃদ্ধা বসে আছেন, সামনে একটা ভাঙা অ্যালুমিনিয়ামের থালা। এ কি মা! তুমি ভিক্ষা করছ? ঝাপসা চশমাপরা চোখ তুলে বললেন, ভিক্ষান্ন, প্রায়োপবেশন এই তো এ-দেশের ভাগ্য।

রাইটার্স বিল্ডিং-এ ঢুকেছি! কেউ কোথাও নেই। খাঁচা লিফটের কাছে একটি মাত্র আলো জ্বলছে। দাঁড়ানো মাত্রই ওপর থেকে লিফট নেমে এল। ধুতি আর শার্ট পরা, লম্বা-চওড়া একজন ভদ্রলোক দরজা খুলে ডাকলেন, চলে এসো, কুইক। খুব চেনা। খুবই চেনা। ডক্টর রায়। আপনি? তুমি কে? আমি পলিটিক্যাল পেশেন্ট। হার্টটা ঠিক রাখা। আজকাল সব হার্টলেস পলিটিকস করে। আমার সেই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে ঠান্ডা মেশিনের শব্দ। যেন কোনও ব্রঙ্কাইটিসের রুগি নিশ্বাস ফেলছে। অসম্ভব ঠান্ডা। একটি মাত্র আলো জ্বলছে। আমার চেয়ারটা হয়ে গেছে বিশাল বড়। আর তেমনি উঁচু। আকৃতি দেখে ভয় পেয়ে গেলুম। ভয়ে ভয়ে এগোচ্ছি। চেয়ারে কুণ্ডলী পাকিয়ে কী একটা শুয়ে আছে। লাল রঙের বিশাল এক সাপ। আমি কাছে যেতেই সাপটার অলস মাথা উঁচু হল। অবিকল মানুষের মতো দুটো চোখ। হাসছে। লিকলিকে চেরা জিভ বেরিয়ে এল। আবার ঢুকে গেল। সাপ হাসছে।

ঘুম ভেঙে গেল। ফোন বাজছে।

হ্যালো।

ওপাশে একটা চাপাকান্নার শব্দ।

হ্যালো।

আমি মিসেস বুবনা।

কী হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন?

কাল রাতে মিস্টার বুবনাকে কে বা কারা খুন করে গেছে।

সে কী? আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি পাশের ঘরে ছিলুম। কিছু টের পাইনি।

পুলিশকে ইনফর্ম করেছেন?

সবার আগে আপনাকে জানালুম।

আপনার কাকে সন্দেহ?

ওর ভাইকে সন্দেহ হচ্ছে। গঙ্গাবতার বুবনা।

কারণ? খুনের একটা কারণ থাকবে তো!

গঙ্গাবতার চাইছে পশ্চিমবাংলার অর্থনীতি, ল অ্যান্ড অর্ডার, প্রশাসন—সব একসঙ্গে ভেঙে পড়ুক। লোকটা নামকরা ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার, স্মাগলার। ও সমস্ত ট্রেডারদের নিয়ে পরশু একটা মিটিং করেছিল। সেই মিটিং হয়েছিল গভীর রাতে পার্ক-এ। সেখানে আপনার ক্যাবিনেটের বেশ কিছু মন্ত্রী ছিল। আমার যতদূর মনে হচ্ছে আপনার বেশ কিছু মন্ত্রী বিক্রি হয়ে গেছে। গঙ্গাবতার কিনে নিয়েছে। আলাদা একটা দলও তৈরি হয়েছে তলায় তলায়।

তারা কী করতে চায়?

আপনাকে ফেলে দিতে চায়। বিধানসভায় আপনি সাপোর্ট হারিয়েছেন, এই বলে রাজ্যপালের কাছে একটা আবেদন যাচ্ছে। এই নিয়ে আমার স্বামী কাল পর্যন্ত খুব চিন্তিত ছিলেন। গতকাল সকালে আমাদের প্রতিষ্ঠানে ইনকামট্যাক্স রেড-ও হয়ে গেছে। আপনি জানেন না?

কই না তো!

আমাদের সব নিয়ে চলে গেছে।

সে কী মিস্টার বুবনা তো আমাকে একটা ফোন করতে পারতেন!

কী করে করবেন? টেলিফোনে হাত দেবার উপায় ছিল না।

তা হলে?

তা হলে আর কী, আপনারও কপাল পুড়ল। আমারও কপাল পুড়ল। বুবনা লোকটার খুব প্রেম ছিল। আমাকে বস্তি থেকে রাজপ্রাসাদে তুলে এনেছিল। মিসেস বুবনার গলা ধরে এল।

আমি যাব?

নানা। এখনও হয়তো আপনার চান্স আছে, তা-ও যাবে। আপনি পাওয়ারে থাকলে আমার হয়তো সুবিধে হবে।

গুম মেরে বসে আছি। কাগজ এল। বুবনার খুনের ব্যাপারটা কাগজ মিস করে গেছে। তার বদলে বিশাল খবর—আগুনে মল্লিকবাজার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কীরকম হল! আমাকে তো কেউ জানাল না। আমি এই স্টেটের সি. এম.! আমি জানলুম না। খিদিরপুর রোডে গভীর রাতে একটা লরি কলকাতার এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর গাড়ি চুরমার করে দিয়ে সরে পড়েছে। ব্যবসায়ী ও তাঁর ড্রাইভার দুজনেই মৃত। এ মনে হয় বুবনা কানেকশান। কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে রে বাবা!

আমার স্ত্রী বললে, কাল রাতে তোমাকে বলেছিলুম ছেড়োনা; আজ বলছি ছেড়ে দাও। পলিটিকস হল বিগ মানি আর বিগ ইন্টারেস্টের খেলা। ও আমাদের পোষাবে না। আমাদের সেই সাবেক ফরেন বুকস আর পিরিয়ডিক্যালসের ব্যবসাই ভালো। আমি সেই অফিসে অফিসে বই। আর ম্যাগাজিন দিয়ে বেড়াতুম, তাতে তোমার অনেক শান্তি ছিল। খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হল তাঁতির হেলে গরু কিনে।

আমি হাসলুম। মানুষের লোভ। ইংরেজ আমলে কিছু শৌখিন বাঙালি পলিটিশিয়ান ছিলেন। কেউ আইনজীবী, কেউ বুদ্ধিজীবী। কেউ ধনী জমিদার। সাহস করে দুটো কথা বলতে পারলেই বীর স্বদেশী। ক্লাসে বক্তৃতা আর মাঠে বক্তৃতায় অনেক তফাত। সারা দেশটা তখন ইংরেজের ক্লাসরুম। শাসনযন্ত্রের হাতল তাদের হাতে। আক্রমণের লক্ষ্যস্থল একটাই ইংরেজশাসন। পকেটমারকে মারার মতো একটা ঘুসি মেরে আসতে পারলেই হয়ে গেল। বিরাট কাজ। জেল খেটে আসতে পারলে তো কথাই নেই। বাঙালি কেন ভারতীয়রা যেই চেয়ারে বসল, দেখা গেল চরিত্রে মাল-মশলা কিছুই নেই। শাসন একটা ধারালো জিনিস। প্রয়োজনে কাটতে হবে। এমুখে, ওমুখে। তখন ছিল একটা শত্রু, এখন শত শত্রু। এ দেশ আর কেউ নেবে না; আমরাই একে শতছিন্ন করব, নিংড়োব, চটকাব। কেটলিতে যখন জল ফোটে তখন জলের একটি বিন্দু সুস্থির থাকতে পারে না। এ দেশের জনজীবনেরও সেই একই অবস্থা। প্রতিটি প্রাণীই অস্থির।

ঠিক দশটার সময় রাইটার্সে পৌঁছে গেলুম। মন্ত্রীদের জন্যে আলাদা যে ভি আই পি লিফট হয়েছে, সেই লিফটে আর গেলুম না। বড় লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালুম। এই লিফট কাল রাতে আমার স্বপ্নে ডক্টর রায় চালাচ্ছিলেন। ঘরে এসে নিজের চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইলুম বেশ কিছুক্ষণ। কাল রাতে এই চেয়ারে একটা সাপ শুয়েছিল। চেয়ারটা যেন অল্প অল্প দুলছে। বলতে চাইছে, ছোড়ড়া মায়া, প্রেমনগরকা।

হঠাৎ পেছন দিক থেকে আমার পি-এ বললেন, চেয়ারটায় কোনও গোলমাল আছে স্যার? এনিথিং রং? মিস্ত্রি ডাকব?

কোনও গোলমালই নেই, ভারী সুন্দর চেয়ার। কিন্তু বসা যায় না। সাঙ্তিক অস্বস্তি হয়। আনকমফর্টেবল।

আপনার চেহারার তুলনায় সামান্য বড়। এই যা।

চেয়ারে বসার আগে, একবার ভালো করে দেখে নিলুম। সত্যিই কিছু শুয়ে আছে কি না!

মিঃ সেনশর্মা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

পাঠিয়ে দিন।

ভদ্রলোককে আজ তাজা ফুলকপির মতো দেখাচ্ছে। চেয়ার টেনে বসলেন। বেশ কিন্তু কিন্তু গলায় বললেন, চিফ মিনিস্টার স্যার! এই ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তো আপনার সঙ্গে খুব একটা কো অপারেট করছে বলে মনে হয় না।

কেন? আপনার এই সন্দেহের কারণ?

বাজার থেকে অত্যাবশ্যকীয় সমস্ত পণ্য উধাও হয়ে গেছে। তেল নেই। কেরোসিন নেই। ডাল নেই। তিনের-চার ভাগ ওষুধ নেই। তরিতরকারি নেই। ডিপোয় দুধ নেই। বেবিফুড নেই। সাবান নেই। কাপড়কাচার সোডা নেই। সবচেয়ে ফানি নুন নেই। ধরা যেতে পারে মোটামুটি সবই নেই।

রাজনীতির দাবাখেলায় এটা খুব পুরোনো চাল। বেশিদিন স্থায়ী হয় না। পালটা চালে আমরা কিস্তিমাত করে দেব। আগের মিনিস্ট্রিতেও ব্যবসাদাররা এই চাল চেলেছিল।

তাদের লোকবল ছিল। ক্যাডারবল ছিল। প্রতিটি বাজারের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্লোগান দিয়ে, ডেমনস্ট্রেশান করে বিলকুল নর্মাল করে দিয়েছিল। আপনাদের তো কিছুই নেই। লাখ দেড়েক লোকের মিছিল বের করতে পারবেন?

জনমানসে এখনও ওইসবের কোনও ইমপ্যাক্ট আছে বলে আপনি মনে করেন? আপনি কি মনে করেন ডেমনস্ট্রেশানে দাম কমে? আপনার সেই দমদম দাওয়াই-এর কথা মনে আছে? কী হয়েছিল মনে আছে?

আমি পাবলিক রিলেশানস, পাবলিসিটি লাইনের টপ কনসালট্যান্ট, আমার কাছে যে কোনও ক্যামপেনেরই দাম আছে।

ক্যামপেন-ফ্যামপেন অল বোগাস। যা এফেকটিভ, তা হল পাইয়ে দেওয়া। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি।

বন্ধ ঘরে বসেও শুনতে পাচ্ছি, বাইরে একটা তাণ্ডব হচ্ছে। পি-এ কে ডাকলুম, কী হচ্ছে বাইরে?

ও আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন স্যার। আজ আপনার কর্মচারীরা কালা দিবস পালন করছে। সব ব্যাজ পরে আপনার ঘরের সামনে এসে শ্লোগান দিচ্ছে।

দাবি?

ওই তো একটাই দাবি, মাইনে বাড়াও। কাজের ঘণ্টা কমাও। পাঁচদিনে সপ্তাহ করো।

দু-নম্বর ইউনিয়নের নেতাদের ডেকে পাঠান তো। এক নম্বর দীর্ঘকাল ডাণ্ডা ঘুরিয়েছে। দুইকে এবার মদত দিয়ে দেখা যাক।

দুই তো তেমন পাওয়ারফুল নয়।

আপনি আপনি কি আর পাওয়ার ফুল হয়। ফুল গাছে সার দিতে হয়। হ্যাঁ, মিঃ সেনশর্মা বলুন।

কী আর বলব? আপনাকে তো দেখছি একেবারে জেরবার করে মারলে। ঘরে-বাইরে শত্রু। যাক, সেই সংবর্ধনার একটা প্ল্যান ছকে ফেলেছি।

কার সংবর্ধনা!

ভুলে গেলেন? আপনার।

নিজেকে নিজে কেউ সংবর্ধনা দেয়? জনগণ যদি দেয়, যাব, মালা পরব।

জনগণের দায় পড়েছে! নিজেরাই নিজেকে দেয়। আপনারা বিজ্ঞানীও নন, শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিকও নন, সঙ্গীতশিল্পীও নন। শুনুন অনুষ্ঠান হবে সল্টলেক স্টেডিয়ামে। বম্বের সমস্ত টপ আর্টিস্টকে আনা হবে। একালের লাস্যময়ী নায়িকা ধীরাকুমারী নেচে নেচে আপনাকে মালা পরাবে। মালা পরাবে টপ নায়ক উজ্জ্বলকুমার। সাতজন নায়িকা ও সাতজন নায়ক একসঙ্গে ব্রেক ড্যান্স দেখাবে। গান গাইবে বিখ্যাত প্লেব্যাক সিঙ্গার জুলজুলকুমার। এমন একটা অনুষ্ঠানের প্ল্যান করেছি, যা লাস্ট হান্ড্রেড ইয়ারসে হয়নি। বাজেট বিশ থেকে তিরিশ লাখ টাকা।

কে দেবে?

কেন, পার্টি ইন পাওয়ারকে যাঁরা টাকা দেন তাঁরাই দেবেন।

আমার পেছনে কেউ নেই।

পেছনে কেউ না থাকলে তো মারা পড়বেন। আপনাদের পেছনটাই তো সব।

পি এ এসে জানালেন, গঙ্গাবতার বুবনা এসেছে দেখা করতে। নাম শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। মিঃ সেনশর্মা সংবর্ধনার ব্যাপারটা আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি।

থ্যাঙ্কস।

মিঃ সেনশর্মা বেরিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকল গঙ্গাবতার। লোকটিকে ভালো করে দেখে নিলুম। ভারী সুন্দর দেখতে। সাধারণত এই কমিউনিটির ছেলেদের এত ভালো দেখতে হয় না। মোটা হয়ে একটা কিম্ভুতকিমাকার দেখতে হয়ে যায়।

নমস্কার।

নমস্কার। বসুন।

দাদাকে মার্ডার করেছে। শুনেছেন তো?

শুনেছি।

আপনাদের কিছু অসুবিধে হয়ে গেল। ভাববেন না, আমি আছি।

ভালো কথা। কিন্তু পুলিশ কি আপনাকে ছেড়ে দেবে?

দাদার বাঙালি বউটা কিছু ঝামেলা করবে; তবে সুবিধে করতে পারবে না।

আমার কাছে কেন এলেন?

সাপোর্ট দিতে।

শুধু শুধু?

আমাদের বিজনেস কমিউনিটিকে তো চেনেন। আমরা গিভ অ্যান্ড টেকে বিশ্বাস করি। দ্যাট ইজ বিজনেস।

কী গিভ করতে হবে?

মল্লিকবাজারটা আমাকে লিখে দিতে হবে। আমি ডেভেলাপ করব। ফ্যানসি বাজারের মতো একটা ফরেন গুডসের বাজার করব। ফুললি এয়ারকন্ডিশানড। মাল্টিস্টোরিড। অনেক অ্যাপার্টমেন্ট বেরোবে। আর একটা করতে হবে, প্রাইস কন্ট্রোল করা চলবে না। কনজিউমারদের নিয়ে আমরা একটু খেলা করব। অনেকদিন আমরা কিছু করিনি। সেই সেনসাহেবের আমলে যা হয়ে গেছে। আমরা আপনাদের ফান্ডে ভালোই দেব।

আপনার কথা শুনতে একদম ভালো লাগছে না। একেবারে না।

দাদার কথা তো শুনতে ভালোই লাগছিল।

দাদা এইরকম সব সাঙ্তিক প্রস্তাব আনেননি।

আপনারা বেশিদিন চালাতে পারবেন না। মওকা যখন এসে গেছে, কুইক কিছু মানি করে নিন। বাঙালিরা খুব বোকা। দুনিয়া মানে টাকা। মানি, মানি। আপনাকে আমি রোলান্ড রোডে ফাসক্লাশ ছোট্ট একটা বাংলো দিয়ে দেব। উইথ লন, অ্যান্ড ফ্লাওয়ার গার্ডেন। একটা এয়ার কন্ডিশানড গাড়ি দিয়ে দেব। ব্যাঙ্কে এত টাকা ফিকসড করে দেব, কী রেস্ট অফ ইওর লাইফ আপনি স্কচ খেতে পারবেন। আপনি তো স্বদেশী বন্দেমাতরম নন। লাক ফেভার করেছে, আয়সি চলে এসেছেন। দাদা অবশ্য খুব হেল্প করেছে। এ তো ওনার মিনিস্ট্রি। দাদার অ্যাকাউন্ট ক্লোজড। এবার আমার অ্যাকাউন্ট খুলতে চাই। দেশ আপনারও নয়, আমারও নয়। আমরা জাস্ট প্লেয়ার। থোড়া দিন খেলে চলে যাব প্যাভেলিয়ানে। আমি আপনার ওয়াইফকে বেশ কিছু জুয়েলারি দিয়ে দেব। ডায়মন্ড। রুবি। টোপাজ।

আপনি আসুন।

শুধু হাতে। এম্পটি হ্যান্ড!

ধরে নিন তাই।

আই রিমাইন্ড ইউ ওই চেয়ারটা আমার ফ্যামিলির। আপনাকে বসতে দিয়েছি। উইকেটের মাথার ওপর বেল থাকে জানেন তো। আপনারা সেই বেল, আমরা হলুম ফাস্ট বোলার। কয়েক ওভার খেলার সুযোগ দেব। ভারতবর্ষ আপনারা চালাচ্ছেন না, চালাচ্ছে বিজনেস হাউস। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। ওই চেয়ার আমাদের।

আপনি আসুন।

বুবনা বেরিয়ে যাচ্ছিল। একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলুম, দাদাকে মারলেন কেন? আপনাদের কমিউনিটিতে তো মার্ডার ছিল না। বুবনা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, কে বলেছে, আমি মেরেছি। আমরা ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় হিট করি। আমি সতেরোবার ফরেন গেছি। আই নো দি আর্ট! মার্ডার যেই করুক, জেনে রাখুন কনভিকটেড হবে দাদার বাঙালি বউ। প্লেন অ্যান্ড সিম্পল। আচ্ছা। গুড বাই।

বুবনা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন চেম্বার অফ কমার্সের সুলক্ষণ জৈন।

বসুন।

আমি খুবই কম সময় নেব। আমার একটা রিকোয়েস্ট, প্লিজ ডু আস এ ফেভার। আমার কয়েকটা সিক ইন্ড্রাস্ট্রিকে এই স্টেট থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

কেন?

এখানে হবে না। আপনাদের তিনটি পাওয়ার প্ল্যান্ট ভেঙে পড়ে গেছে। এক একটা এরিয়ায় ফর্টি এইট আওয়ার্স, ফিফটি টু আওয়ার্স লোডশেডিং। ইনহিউম্যান অবস্থা।

কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা পাওয়ার পজিশান ঠিক করে ফেলব।

পারবেন না। পাওয়ার, ট্রান্সপোর্ট, ইরিগেশান খুব সহজেই স্যাবোটেজ করা যায়। আর তাই হচ্ছেও। আগেও হয়েছে। এখন আরও বেশি হচ্ছে। আপনি জেনে রাখুন, এই স্টেটের মানুষ, স্টেটের স্বার্থ দেখে না, নিজেদের স্বার্থ দেখে। এখানে কিছু করা যাবে না। প্ল্যান্ট অ্যান্ড মেশিনারি যেখানে যা আছে আমাদের নিয়ে যাবার অনুমতি দিন, অ্যান্ড ফর দ্যাট আমরা আপনাকে, আই মিন আপনার ছেলেকে ব্যাঙ্গালোরে একটা ইন্ডাস্ট্রি করে দিচ্ছি। রেস্ট অফ হিজ লাইফ…!

আই অ্যাম সরি মিঃ জৈন, আমার কোনও ছেলে নেই।

সো সরি। বেশ আপনার স্ত্রীকে করে দিচ্ছি।

ইন্ডাস্ট্রি তুলে নিয়ে যাবার অনুমতি আমি দিতে পারব না।

ডোন্ট বি এ ফুল।

আমরা টেকওভার করব।

কত জায়গায় কত লস দেবেন! আপনার স্টেট তো ওভার ড্রাফটে চলছে। এরপর কর্মচারীদের মাইনে দেবেন কী করে! আপনি ভেবে দেখুন। তা না হলে সাতটা ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা ক্লোজার ডিক্লেয়ার করব। তার ফলটা কী হবে বুঝতে পারছেন?

জৈন চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আই জি-রে ফোন। আপনাকে একটা বাজে খবর শোনাই, চকমুকুন্দপুরে তিনটে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। ধরা যেতে পারে মৃতের সংখ্যা শ দুই। শিশু আছে, নারী আছে।

কারণ?

ল্যান্ডলর্ডরা জমি দখল করছে। আগের বার যাঁরা বসিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মুরুব্বিরা নেই।

আপনি কিছু করুন।

কী করে করব, এর মধ্যে তো আপনার মন্ত্রী রয়েছেন।

আই সি।

আবার ফোন, উত্তরবঙ্গের ডি. এম। কাল রাতে তিস্তার বাঁধ কেটে দিয়েছে। তিন হাজার একর জলের তলায়।

বাঃ, শুভ সংবাদ। কিছু একটা করুন।

কী করে করব! এখানে ইরিগেশান ইঞ্জিনিয়াররা গণছুটি নিয়ে বসে আছে।

টার্মিনেট অল সার্ভিস, অ্যাপয়েন্ট নিউ ইঞ্জিনিয়ারস।

ভদ্রলোক হাসলেন। আবার ফোন, বডিগার্ডর্স লাইনে দু-দল পুলিশে সশস্ত্র লড়াই। একজন অফিসারসহ তিনজন শেষ। আবার ফোন, দমদমের কাছে রেলের ওভারব্রিজ খুলে পড়ে গেছে। লাইন মালার মতো ঝুলছে।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম। চেয়ারটার দিকে তাকালুম একবার। দুলছে। যেন বলতে চাইছে, হুঁ হুঁ!

আমার কালো অ্যামবাসাডার রাজভবনের গেট পেরিয়ে ঢুকছে। আজ আর আমার পাশে আমার স্ত্রী নেই। আজ আর আমার বুকটা ধক করে উঠল না। জিভের তলায় সরবিট্রেট রাখতে হল না। চাকার তলায় মোরামের ঘসঘস শব্দ। রাজ্যপালের অফিসে ঢুকে চমকে উঠলুম। আমার সেই গর্তে পড়া পূর্তমন্ত্রী ও গঙ্গাবতার বুবনা ওয়েটিং রুমের সুদৃশ্য সোফায় বসে আছেন পাশাপাশি। দু-তরফের দৃষ্টি পরস্পরের লগ্ন হয়ে থমকে রইল কিছুক্ষণ। বুবনা হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার ভঙ্গিতে বললেন, আইয়ে আইয়ে, মিট আওয়ার নিউ চিফ মিনিস্টার। বুবনার হাতে লম্বা একটা কাগজ। ওদিকে রাজ্যপাল ঢুকছে ধীর পায়ে, ওয়েল কাম, ওয়েলকাম। বুবনার হাতে অনাস্থার চিঠি, দলত্যাগী মন্ত্রীদের লিস্ট। আমার হাতে রেজিগনেশান লেটার। কোনটা আগে জমা পড়বে! রাজ্যপাল দুদিকে দু-হাত মেলে বললেন, নো প্রবলেম, আই হ্যাভ টু হ্যান্ডস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress