কৃষ্ণাপঞ্চমীর ক্ষীয়মাণ চন্দ্র
কৃষ্ণাপঞ্চমীর ক্ষীয়মাণ চন্দ্র প্রায় মধ্যগগন অতিক্রম করিয়া গিয়াছে।
রাত্রি শেষ হইতে আর বিলম্ব নাই।
সঙ্ঘ নিস্তব্ধ, কোথাও কোনও শব্দ নাই; বুঝি ব্রাহ্মমুহূর্তের প্রতীক্ষ্ণয় নির্বাণ-সমাধিতে নিমগ্ন।
ভিক্ষু উচণ্ড স্থবিরের পরিবেণে প্রবেশ করিয়া অন্ধকারে গাত্রম্পৰ্শ করিয়া তাঁহাকে জাগরিত করিলেন। সর্পশ্বাসবৎ স্বরে তাঁহার কর্ণে বলিলেন, আমার সঙ্গে আসুন।
নিঃশব্দে দুইজনে ইতির প্রকোষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। স্নান তির্যক কাক-জ্যোৎস্না কক্ষের মসৃণ ভূমির উপর প্রতিফলিত হইতেছে। সেই অস্পষ্ট আলোকে স্থবির দেখিলেন, ইতি একটি উচ্চ পীঠিকার উপর বসিয়া আছে; আর, বেদীমূলে প্রণতি-রত উপাসকের ন্যায় নির্বাণ নতদেহে তাহার জানুর উপর মস্তক রাখিয়া স্থির হইয়া আছে। ইতির কটি হইতে ঊধ্বাঙ্গ কেবল বিস্রস্ত কেশজাল দিয়া আবৃত; শুভ্র মর্মরে রচিত মূর্তির ন্যায় তাহার যৌবন-কঠিন দেহ সগর্বে উন্নত হইয়া আছে; আর দুই চক্ষু হইতে বিজয়িনীর নির্বোধ উল্লাস ও অশু একসঙ্গে ক্ষরিত হইয়া পড়িতেছে।
স্থবির ডাকিলেন, নির্বাণ!
নির্বাণ ত্বরিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। দ্বার-সম্মুখে পিথুমিত্তকে দেখিয়া তাঁহার পদপ্রান্তে পতিত হইয়া রুদ্ধস্বরে কহিল, থের, আমি সঙ্ঘের ধর্ম হইতে বিচ্যুত হইয়াছি। আমার যথোপযুক্ত দণ্ড বিধান করুন।
স্থবির কম্পিত স্বরে কহিলেন, নির্বাণ, তোমার অপরাধ গুরু। কিন্তু আমার অপরাধ তোমার অপেক্ষাও অধিক। আমি সব জানিয়া বুঝিয়া তোমাকে সঙেঘ গ্রহণ করিয়াছিলাম বৎস!
উচণ্ডের উগ্র কণ্ঠস্বরে স্থবিরের করুণাবাণী ড়ুবিয়া গেল, তিনি কহিলেন, থের, এই পতিত ভিক্ষু নিজমুখে পাপ খ্যাপন করিয়াছে, আমরাও স্বচক্ষে উহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। এখন পাতিমোক্ষ অনুসারে উহার দণ্ডাজ্ঞা উচ্চারণ করুন।
স্থবির কোনও কথাই উচ্চারণ করিতে পারিলেন না, অপরিসীম করুণায় তাঁহার অধর থর থর কাঁপিতে লাগিল।
উচণ্ড তখন কহিলেন, উত্তম, আমি এই ভিক্ষুর উপাধ্যায় ছিলাম, আমিই তাহার দণ্ডাজ্ঞা ঘোষণা করিতেছি। ভিক্ষু, তুমি পারাজিক ও সঙ্ঘাদিশেষ পাপে অপরাধী হইয়াছ, এই জন্য তুমি সঙ্ঘ হইতে বিচ্যুত হইলে। অদ্য হইতে সঙেঘর সীমাভুক্ত ভূমির উপর বাস করিবার অধিকার তোমার রহিল না; সঙ্ঘাধিকৃত খাদ্য বা পানীয়ে তোমার অধিকার রহিল না। ইহাই তোমার দণ্ড—বহিষ্কার! তুমি এবং তোমার পাপের অংশভাগিনী বুদ্ধের পবিত্র সঙ্ঘভুক্তি হইতে নির্বাসিত হইলে।
এই দণ্ডাদেশের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা ধীরে ধীরে সকলেরই হৃদয়ঙ্গম হইল। ইহা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তবু কেহ কোনও কথা কহিল না। নির্বাণ নতমস্তকে সঙেঘর অমোঘ দণ্ডাজ্ঞা স্বীকার করিয়া লইল। স্থবিরও মৌন রহিলেন। শুধু, পঞ্চদশ বৎসর পূর্বে নির্বাণ ও ইতিকে কোলে টানিয়া লইয়া তাঁহার শীর্ণ গণ্ডে যে অশ্রুর ধারা নামিয়াছিল, এতদিন পরে আবার তাহা প্রবাহিত হইল।
ঊযালোক ফুটিবার সঙ্গে সঙ্গে ইতি ও নির্বাণ সঙ্ঘ হইতে বিদায় লইল। সঙ্ঘের পাদমূলে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া দুইজনে হাত ধরাধরি করিয়া নিরুদ্দেশের পথে বাহির হইয়া পড়িল। কোথায় যাইতেছে তাহারা জানে না; এ যাত্রা কিভাবে শেষ হইবে তাহাও অজ্ঞাত। কেবল, উভয়ের বাহু পরস্পর দৃঢ়নিবদ্ধ হইয়া আছে, দুস্তর মরু-পথের ইহাই একমাত্র পাথেয়।
যত দূর দেখা গেল, প্রাচীন নির্বাপিত চোখে স্থবির সেই দিকে চাহিয়া রহিলেন। ক্রমে সূর্য উঠিল, দূরে দুইটি কৃষ্ণ বিন্দু আলোকের ধাঁধায় মিলাইয়া গেল। স্থবির ভাবিতে লাগিলেন, এই সূর্য মধ্যকাশে উঠিবে; তৃষ্ণা-রাক্ষসী প্রতীক্ষ্ণ করিয়া আছে–
উচণ্ড আসিয়া স্থবিরের পাশে দাঁড়াইলেন, বলিলেন, থের, আপনাকে উপদেশ দিবার স্পর্ধা আমার নাই। কিন্তু গৃহীজনোচিত মমত্ব কি নির্বাণ-লিল্লু ভিক্ষুর সমুচিত?
স্থবির কহিলেন, উচণ্ড, অদৃষ্টবিড়ম্বিতের প্রতি করুণা ভিক্ষুর পক্ষে নিন্দনীয় নহে। শাক্য সকল জীবের প্রতি করুণা করিতে বলিয়াছেন।
সত্য। কিন্তু সেই মহাভিক্ষু শাক্যই পাপীর দণ্ডবিধান পাতিমোক্ষ সৃজন করিয়াছেন। দণ্ডবিধির মধ্যে করুণার স্থান কোথায়? থের, এই সঙ্ঘ কেবল বাস্তব পাষাণ দিয়া গঠিত নয়, ভিক্ষুগণের নির্মমত্বের কঠিনতর মর্মর পাষাণে নির্মিত। তাই সংসারের শত ক্লেদ-পঙ্কিলতার মধ্যে প্রকৃতির রুদ্র বিক্ষোভ উপেক্ষা করিয়া সঙ্ঘ আজিও অটল হইয়া আছে। সঙেঘর ভিত্তিমূল যদি করুণার অশ্রুপঙ্কে আর্দ্র হইয়া পড়ে, তবে ধর্ম কয় দিন থাকিবে? করুণার যূপকাষ্ঠে নীতির বলিদান কদাপি মহাভিক্ষুর অভিপ্রেত ছিল না।
স্থবির দীর্ঘকাল উত্তর দিলেন না; তারপর ক্লিষ্টস্বরে কহিলেন, উচণ্ড, মহাভিক্ষুর অভিপ্রায় বুর্জেয়। আমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত হইয়াছে; কর্তব্যজ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি।
উচণ্ড প্রশ্ন করিলেন, আপনি কি মনে করেন, পাতিমোক্ষ-মতে ভিক্ষুর দণ্ডদান অনুচিত হইয়াছে!
জানি না। বুদ্ধের ইচ্ছা দুরধিগম্য।
পাতিমোক্ষ কি বুদ্ধের ইচ্ছা নয়!
তাহাও জানি না।
উচণ্ড তখন দুই হস্ত ঊর্ধ্বে তুলিয়া আকাশ লক্ষ্য করিয়া গভীর কণ্ঠে বলিলেন, তবে বুদ্ধ নিজ ইচ্ছা জ্ঞাপন করুন। গোতম, তুমি আমাদের সংশয় নিরসন কর। তোমার অলৌকিক শক্তির বজ্রালোকে সত্য পথ দেখাইয়া দাও।
সেইদিন মধ্যাহ্নেবাতাস সহসা স্তব্ধ হইয়া গেল; কেবল প্রজ্বলিত বালুকার উপর হইতে এক প্রকার শিখাহীন অগ্নিবাষ্প নির্গত হইতে লাগিল। পঞ্চাগ্নি-পরিবেষ্টিত সঙ্ঘ যেন উগ্র তপস্যারত বিভূতিধূসর কাপালিকের ন্যায় এই বহ্নিশ্মশানে বসিয়া আছে। আকাশের একপ্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কোথাও একটি পক্ষী উড়িতেছে না। শব্দ নাই। চতুর্দিকে যেন একটা রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষ্ণ।
মধ্যাহ্ন বিগত হইল; খর্জুর বৃক্ষের ছায়া সভয়ে মূল ছাড়িয়া নির্গত হইবার উপক্রম করিল।
থের!
স্থবির অলিন্দে আসিয়া দাঁড়াইলেন। উচণ্ড নীরবে অঙ্গুলি-সঙ্কেত করিয়া দিপ্রান্ত দেখাইলেন।
তাম্রতপ্ত আকাশের এক প্রান্তে চক্রবালরেখার উপর মুষ্টিপ্রমাণ কজ্জলমসী দেখা দিয়াছে। চিনিতে বিলম্ব হইল না। পঞ্চদশ বৎসর পূর্বে এমনই মসী-চিহ্ন আকাশের ললাটে দেখা গিয়াছিল।
ভয়ার্ত কণ্ঠে উচণ্ড কহিলেন, থের, আঁধি আসিতেছে!
স্থবিরের অধর একটু নড়িল, বুদ্ধের ইচ্ছা! বুদ্ধের ইচ্ছা!
উন্মত্তের ন্যায় স্থবিরের জানু আলিঙ্গন করিয়া উচণ্ড কহিলেন, থের, তবে কি আমি কি ভুল করিয়াছি? তবে কি আমার পাপেই আজ সঙ্ঘ ধ্বংস হইবে? ইহাই কি বুদ্ধের অলৌকিক ইঙ্গিত।
দেখিতে দেখিতে আঁধি আসিয়া পড়িল। মরুভূমি ঝঞ্ঝাবিমথিত সমুদ্রের ন্যায় ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল; গাঢ় অন্ধকারে চতুর্দিক আচ্ছন্ন হইয়া গেল।
এই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে স্থবিরের কণ্ঠে উচ্চারিত হইতে লাগিল—তমসো মা জ্যোতির্গময়! তমসো মা জ্যোতির্গময়!
উচণ্ড চিৎকার করিয়া উঠলেন, আমি যাইব। তাহাদের ফিরাইয়া আনিব—তাহাদের ফিরাইয়া আনিব ক্ষিপ্তের মতো তিনি অলিন্দ হইতে নিম্নে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন; ঝড়ের হাহারবে তাঁহার চিৎকার ড়ুবিয়া গেল।
বালু ও বাতাসের দুর্মদ দুরন্ত খেলা চলিতে লাগিল। পৃথিবী প্রলয়ান্ত অন্ধকারে ছাইয়া গিয়াছে। সঙ্ঘ নিমজ্জিত হইল।
স্থবিরের শীর্ণ প্রাচীন কণ্ঠ হইতে তখনও আকুল প্রার্থনা উচ্চারিত হইতেছে; হে শাক্য, হে লোকজ্যেষ্ঠ, হে গোতম, অন্তিমকালে আমাকে চক্ষু দাও! তমসো মা জ্যোতির্গময়তমসো মা জ্যোতির্গময়—
মানবজাতির শমন-ধৃত কণ্ঠ হইতে আজিও ঐ আর্ত বাণীই নিঃসৃত হইতেছে!
১৭ অগ্রহায়ণ ১৩৪৪