মন কেমনের পালা
পুজো শেষ হয়ে গেলে যখন দীপাবলীর আলোর রেশ মিলিয়ে যেতে থাকে, ঠান্ডার আঁচল জড়িয়ে হিম ঋতুর পদধ্বনি শোনা যায়, আমার বাউল মন পরিযায়ী ডানায় ভর করে উড়ে যেতে চায় অচিনপুরের উদ্দেশ্যে! এ আমার ছোট্ট বেলাকার অনুভূতি যা আজও একই রকম তীব্র। এই হিমানী জডানো সময় বড় পিছুটানে, বড় স্মৃতিমেদুর করে তোলে! আমার যাযাবরী মনের সফর বৃত্তান্তের স্মৃতিচারণায় মন আবিল হয়ে যায়।
হেমন্তের সোনা ঝরা মাঠের স্বর্ণাভায় মন মাতাল হয়ে ওঠে। কাঁসাই চরের হাতছানিতে মন উচাটন—- ডাক দিয়ে যায় সেই ফেলে আসা কিশোরী বেলা—-“কুমু চরে যাবি?” কে যেন সুদূর পার থেকে ডাক দেয়—–
আমি রইতে নারি ঘরে
আমার মন যে কেমন করে
আমার মন লাগে না কাজে——!
অলীক যাপনে মন ফিরে চলে সেই ফেলে আসা ক্ষণে—–
কাঁসাই কূলে দুপারে দিগন্তবিস্তৃত শস্য খেত— কোথাও সবজির শ্যামলিমা কোথাও বা সর্ষের হলুদ রঙ্গের গালিচা! মাঝে বয়ে চলা কাঁসাই যেন কোন সুন্দরী ঝুমুর শিল্পী— তার চলনে ঝুমুরের ছন্দ তার কুলুকুলু ধ্বনিতে ঝুমুরের তান—- বড় মনমোহনিয়া।
নদীর ঘাটের একলা আশুদ গাছের ডালে বসা শঙ্খচিল টার ডানার কাঁপন আমার উদাসী মনকে বিবাগী করে। ঘরে মন টেকে না। নদীতীরের মনসার আটনের বেষ্টনীতে ,বিষম ঢাকির ধূমুলে,ধুনোর ধোঁয়ার সুগন্ধে হৈমন্তী বেলা যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলে। হৈমন্তী রূপকথার মায়াজালে মোহগ্রস্ত চরাচর।এ যে উৎসবের আগমনীর আহ্বান— নবান্ন ইতু টুসু মকরের আনন্দময় হাতছানি।
জঙ্গলমহলের উৎসবমুখর পরিবেশের আহ্বান শোনায় হেমন্ত—
” নাচ গান বাজনা
মকর করম বাঁধনা।”
জঙ্গলমহলের কৃষিজীবী প্রান্তিক মানুষের বড় আনন্দের সময় এ। কৃষি লক্ষ্মীর আশীর্বাদে মাঠ ফসলে উথলে ওঠে। কৃষকের মনে আনন্দের লহর— “ঠাকুর” তুলতে হবে যে!কমলা-হলুদ গাঁদা ফুলে, পাকা ধানের সোনালী রংয়ে মা লক্ষ্মীর আসন জ্বলজ্বল করতে থাকে! আকাশ প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোর রেশ ধরে উৎসব যেন এগিয়ে আসে এখানে। জীবনানন্দে ভরপুর প্রান্তিক মানুষজনের উৎসবের মরসুমে প্রারম্ভ এই হেমন্ত ঋতু তে। তাইতো হেমন্তিকার হিমেল বাতাসে ভালোবাসার উষ্ণতা খুঁজে পায় এরা। আঘুন হিমের আমেজে, সোনালী ধানের শোভায়, লক্ষ্মীইতুর ব্রত কথায় হারিয়ে যায় দুঃখ কষ্টের রেশ। বাতাসে ভাসতে থাকে মা লক্ষ্মীর আবাহন—-
” এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে।”
এই চিরন্তনী কামনা হেমন্তের হিমেল বাতাসে ভেসে বেড়ায় দূর থেকে দূরান্তে!