এক তোড়া গোলাপ
আজ জাজ সাহেব দুটো গোলাপের জায়গায় এক তোড়া গোলাপ পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। শুটকো লোকটা সাইকেলে করে গোলাপ নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে তিনিও একই সঙ্গে রিকশা করে উপস্থিত হয়েছেন। গোলাপগুলো তিনি নিজেও আনতে পারতেন, তা আনেন নি।
বসার ঘরে ঢোকার মুখে আমার সঙ্গে দেখা। তিনি উজ্জ্বল চোখে বললেন, এগারোটা গোলাপ এনেছে এগার ভ্যারাইটির।
আমি শুকনো গলায় বললাম, ও।
তুমি বোধহয় গোলাপ পছন্দ কর না?
জ্বি না। কোন কাজে আসে না, তাই পছন্দ করি না।
কাজে আসে না বলতে কী মিন করছ?
কুমড়ো ফুলের কথাই ধরুন। দেখতে সুন্দর। একে বড়া বানিয়েও খাওয়া যায়। গোলাপের নিশ্চয়ই বড়া হয় না। না-কি হয়?
তুমি কি ঠাট্টা করছ?
জ্বি না। ঠাট্টা করব কেন? আপনি বসুন, আমি ভেতরে খবর দিচ্ছি।
আমি বসার ঘরে ভদ্রলোককে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। কাউকে কিছু বললাম না। ব্যাটা থাকুক খানিকক্ষণ একা বসে। এক সময় বিরক্ত হয়ে নিজেই উঠে চলে যাবে।
জাজ সাহেবকে বসিয়ে রেখে আমি বেশ সময় নিয়ে চা খেলাম। মীরার সঙ্গে ঝগড়া করলাম। মীরার এখন ঝগড়া-রোগ হয়েছে। সবার সঙ্গেই ঝগড়া করছে। প্রেমে পড়লে মেয়েরা কি ঝগড়াটে স্বভাবের হয়? মীরার এবারের প্রেম বেশ জটিল বলেই মনে হচ্ছে। ঐ ছোকরা বাড়ির সামনের রাস্তাতেই আস্তানা গেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। সিগারেট হাতে সব সময় আছে। আমি খানিকটা খোঁজ-খবর নিয়েছি। জানলাম, সে রেডিও মেকানিক। এই নিয়ে কথা বলতে গিয়েই আপত্তি। আমি শুধু বলেছিলাম তোর ঐ খাতিরের মানুষটা রেডিও মেকানিক।
মীরা চোখ সরু করে বলল, তাতে অসুবিধা কি?
বখাটে ছেলেরা যারা কাজ-টাজ জোটাতে পারে না তারা শেষ বয়সে রেডিও মেকানিক হয়। একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে বসে থাকে।
স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে থাকলে তোর কি অসুবিধা?
আমার কোনোই অসুবিধা নেই। তোর অসুবিধা। যখন তখন তোর মাথায় স্ক্রু টাইট দিয়ে দেবে।
দিক।
আমার তো মনে হয় এখনি অনেকখানি টাইট দিয়ে দিয়েছে। আরো বেশি টাইট দিলে পাঁচ কেটে যাবার সম্ভাবনা।
আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। দয়া করে নিজেকে নিয়ে ভাব।
আচ্ছা। পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করলে টাকা-পয়সা নিয়ে পালাবি। তোর মেকানিক ব্যাটার হাতে একটা পয়সা নেই বলে আমার ধারণা। ঐদিন দেখলাম বাকিতে সিগারেট কেনার চেষ্টা করছে, দোকানদার দিচ্ছে না।
প্লিজ, তুই দয়া করে আমার সামনে থেকে যা।
আমি বসার ঘরে চলে এসে অবাক হওয়া গলায় জাজ সাহেবকে বললাম–আরে আপনি কখন এসেছেন?
ভদ্রলোক রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, তোমার সামনেই তো ঢুকলাম।
সরি, লক্ষ করি নি।
লক্ষ করি নি মানে?
বাসায় অনেক রকম ঝামেলা–মাথা ইয়ে হয়ে আছে……
জাজ সাহেবের রাগ সঙ্গে সঙ্গে কমে গেল। রাগের জায়গায় চলে এল কৌতূহল। তিনি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ঐ নার্স মেয়ে কোনো সমস্যা করছে না-কি? কেইস করে দেয় নি তো?
জ্বি না। অন্য সমস্যা।
জাজ সাহেবের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া সরে গেল। তিনি হৃষ্ট গলায় বললেন আর কেইস যদি করেও মজা বুঝিয়ে দেব। বারো হাত কাঁকুড়ের পনের হাত বিচি দেখিয়ে দেব।
কেইস-ফেইস করবে না। ভদ্রমহিলার কোনো ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। কেইস করবে কি? খুবই চিন্তার মধ্যে আছি।
চিন্তার কী আছে? ট্রেস না পাওয়া গেলে তো ভালো কথা।
উনার মেয়েটা এখানে আছে—এই এক সমস্যা।
মেয়েটাকে এখনো নিয়ে যায় নি? বল কি! নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে। তুমি এক কাজ করমেয়েটাকে ওর কোনো আত্মীয়-বাড়িতে ফেলে দিয়ে আস। দেরি করবে না। করলে পরে পস্তাতে হবে।
দেখি।
না–দেখাদেখি না। যা করার এক্ষুনি কর। আমি এখন উঠি, দেখি বিকেলে খোঁজ নেব।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলে টুকু।
চিন্তার কিছু নেই। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে লাভ হয় না। ভরসা রাখতে হয় বুদ্ধি ও বিবেচনার উপর।
তাও ঠিক। আপনি তাহলে চলে যান, আমি দেখি কী করা যায়।
জাজ সাহেব চলে গেলেন। হঠাৎ লক্ষ করলাম, রাগে আমার শরীর কাঁপছে।
আজ সকাল থেকেই কেন জানি রাগ লাগছে। কোনোই কারণ নেই, তবু রাগ লাগছে। বাসার পরিস্থিতি ভালো। আনন্দময়। গত পরশু ছোট চাচা সবাইকে মহিলা সমিতিতে নাটক দেখিয়ে আনলেন। নাটক দেখে ফেরার পথে ঘোষণা করেছেন, আরেকটি গাড়ি কিলবেন। একটা গাড়িতে অসুবিধা হচ্ছে, দুটা হলে ভালো। একটা থাকবে ফ্যামিলির প্রয়োজনে, অন্যটি নিজের।
বড় চাচার মনও খুব উক্ষুণ্ণ। তিনি আরেকজন সাধুর খোঁজ পেয়েছেন। যিনি দিনরাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বিশ ঘন্টাই গাছে উঠে বসে থাকেন। গেছো ব্যাঙ-এর মতো গেছে সাধু। এই সাধুনা-কি গত পাঁচ বছর ধরে মৌনব্রত পালন করছেন। দিন সাতেক হলো মৌনব্রতের কাল শেষ হয়েছে। এখন এর-তার সঙ্গে দু একটা কথা বলছেন। সেসব কথার বেশিরভাগই বোঝা যায় না।
আমি সহজ ভঙ্গিতে বলেছিলাম, গাছে থাকতে থাকতে বাঁদর হয়ে যায় নি তো? বাঁদরের ভাষায় কথা বলছে বলেই হয়ত সাধারণ পাবলিক বুঝতে পারছে না।
আমার কথায় সবাই হাসল; এমন কি বড় চাচাও হাসলেন। শুধু বড় চাচী হাসলেন না। তাঁর মনটা এখন খুব অস্থির। অস্থিরতার কারণ হচ্ছে তিনি আমেরিকা চলে যাবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমরা কেউ কোনো উৎসাহ দেখাচ্ছি না, কারণ বড় চাচার শরীর ভালো না। এদিকে চাচীর কোনো লক্ষ নেই। তাঁর কথাবার্তায় বার-বার আমেরিকা প্রসঙ্গ চলে আসছে। মেয়েদের কথা টেনে নিয়ে এসে বলছেন, না জানি ওরা কী কষ্ট করছে। এক হাতে সব করতে হয়। বাচ্চা দুটি হয়েছে মহাদুষ্ট। ছোটটা একবার ওভেনের দরজা খুলে চুপচাপ ভেতরে বসে ছিল। কেউ সুইচ টিপে দিলে কী অবস্থা হত ভেবে দেখ। ওদেরকে একা সামলানো কি সহজ কথা। ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে যায়।
আমরা বুঝতে পারি এসব হচ্ছে বড় চাচীর প্রস্তাবনা। তিনি চাচ্ছেন, আমরা বলি–আপনি চলে যান।
আমরা ভুলেও তা বলছি না। বড় চাচার শরীর খানিকটা খারাপ হলে হয়ত বলতাম, কিন্তু তাঁর শরীর অনেকখানিই খারাপ। গাছে চড়া সাধুর সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে সারাক্ষণ ঝিম ধরে আছেন। সারাক্ষণ বসে থাকেন। শুতে পারেন না। বিছানায় গেলেই নাকি পেটে গ্যাস হয়। এই অবস্থায় তাঁকে ফেলে চলে যাবার কথা তিনি ভাবেন কী করে কে জানে।
এর মধ্যে মেজো মেয়ের চিঠি পেয়ে চাচী আরো অস্থির হলেন। ওদের না-কি খুব। সমস্যা হচ্ছে। ছোট বাচ্চাটি সিঁড়ি থেকে পা মচকে ফেলেছে। বড় চাচী আমাদের সবাইকে কয়েকবার করে বলে ফেললেন–
আরেকটু হলে হাত-পা ভাঙত। মাথায় চোট পেত। কে জানে হয়ত পেয়েছে, আমাকে জানাচ্ছেনা। আসবার আগে এত করে বলে এলাম সিঁড়িগুলোতে বেড়া লাগিয়ে দিতে, নিশ্চয়ই লাগায় নি। আমেরিকাতে সিঁড়ি আটকানোর জন্যে প্রটেকটিভ ব্যবস্থা আছে। বিশ ত্রিশ ডলারে পাওয়া যায়। বাচ্চারা তখন আর সিঁড়ি ডিঙাতে পারে না। ঐ ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে নি। আর করবেই বা কিভাবে? সে একা মানুষ, কদিক সামলাবে?
আমার মা বড় চাচীকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন যাতে মাসখানিক অন্তত থাকেন। এক জন অসুস্থ মানুষকে এই অবস্থায় ফেলে চলে যাওয়া যে অন্যায় এটা বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। বড় চাচী বললেন, আমি কি বুঝি না? তুমি কি ভাব চলে যাবার কথা ভাবতে আমার ভালো লাগছে? কিন্তু উপায় কি?
উপায় আছে। ওরা ওদের ব্যবস্থা করবে।
কী করে করবে? দেশে এক জন বিপদে পড়লে দশজন এগিয়ে আসেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবওখানে এইসব কোথায়?
জুন মাসের শেষের দিকের এক বৃহস্পতিবারে বড় চাচীর টিকিট কনফার্ম করা হল। সেই দিনই রাত দশটায় আমি তাঁকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবার দায়িত্ব পেলাম। বাসার সামনে একটা বেবিটেক্সি নিয়ে আসা হল।
বড় চাচী বেবিটেক্সি দেখে শুকনো গলায় বললেন, বেবিটেক্সি কেন? গাড়ি কোথায়? গাড়ি কোথায় আমরা কেউই জানি না। ছোট চাচা গাড়ি নিয়ে সেই সকালে বের হয়েছেন, এখনও ফেরেন নি। যদিও তিনি ভালো করেই জানেন আর্জ বড় চাচীর চলে যাবার দিন।
বড় চাচী বললেন, এয়ারপোর্টে কে কে যাচ্ছে? একটা বেবিটেক্সিতে হবে?
আমি বললাম, হবে, আমি ছাড়া আর কেউ যাবে না।
তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, যাচ্ছে না কেন?
যাবার দরকার কি? এত রাতে খামাকা কষ্ট। গাড়ি থাকলেও একটা কথা ছিল। দেরি করে লাভ নেই, উঠে পড়ুন।
যথারীতি অত্যন্ত করুণ একটা বিদায়-দৃশ্যের অভিনয় হল। তিনি বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। জড়ানো গলায় বললেন ওদের কাছে দুতিন সপ্তাহ থেকে চলে আসব, আর যাব না। ভালো লাগে না। বাকি জীবনটা দেশেই কাটাব। উনারও শরীর খারাপ হয়েছে, সেবাযত্ন দরকার।
বড় চাচীর এ ধরনের কথার কোনোই গুরুত্ব নেই। প্রতিবারেই যাবার সময় এসব বলেন।
এয়ারপোর্টে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসালেন। এমন এক দৃশ্যের অবতারণা হল যে, চারদিকে লোক জমে গেল।
ও টুকু রে, যত ঝামেলা শুধু তোর উপর দিয়ে যায়। তোর জন্যে আমার বড় কষ্ট হয় রে টুকু। দেখি তোর জন্যে কিছু করা যায় কি-না। জামাইকে বললে সে একটা ব্যবস্থা করবে। অনেক কংগ্রেসম্যানকে সে চিনে। ওদের কাছে ইমিগ্রেশনের কথা বললেই করে দেবে। তুই বায়োডাটা পাঠিয়ে দিস।
বাসায় ফিরতে রাত দুটো বাজল। এসে শুনলাম, বড় চাচার অবস্থা খুবই খারাপ। লক্ষণ দেখে মনে হয়, মাইন্ড স্ট্রোক জাতীয় কিছু হয়েছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। খুব ঘাম হচ্ছে। পানির পিপাসা হচ্ছে। হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। হাসপাতালে নেবার কথা উঠতে আতঙ্কে অস্থির হচ্ছেন।
অস্পষ্ট গলায় বলছেন, না, না।
পাড়ার ডাক্তার বললেন, হাসপাতালের কথায় ইমোশনালি আপসেট হয়ে যাচ্ছে। এতে আরো খারাপ হবে। আপনারা আমার উপর ভরসা রাখুন। আমি একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। আপনারা এক জন হাইস্পেশালিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
আমার বাবা খুবই ভীতু ধরনের মানুষ। তিনি থর থর করে কাঁপছেন। প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, বাঁচবে তো ডাক্তার সাহেব?
হ্যাঁ, বাঁচবেন। আমার তো মনে হয় ভালো ঘুম হলে দেখা যাবে শরীর ঝরঝরে হয়ে উঠেছে। হার্টের কোনো অসুখ বলে আমার মনে হচ্ছে না, যদিও সিম্পটমস্ সব এক। আমার মনে হচ্ছে, অসুখটা মানসিক। ভালোমতো বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে।
অভিজ্ঞ ডাক্তাররাও মাঝে-মাঝে খুব অনভিজ্ঞের মতো করেন। বড় চাচার ওটা ছিল বড় ধরনের একটা এ্যাটাক। তাঁকে সময়মতো হাসপাতালে না নেয়ার কারণেই হয়ত শরীরের ডান দিকটা অচল হয়ে গেল। প্যারালিসিস। ডাক্তাররা খুব সান্ত্বনা দিলেন। ওটা কিছুই না। কমপ্লিট বেডরেস্ট। তারপর কিছু লাইট এক্সারসাইজ। এর বেশি কিছু লাগবে না। নাথিং।
সপ্তাহখানিকের বেশি রেস্ট নেয়া হল, লাইট এক্সারসাইজ করা হল; লাভ কিছু। হল না। অবশ হয়ে-যাওয়া অঙ্গে কোনো সাড়া ফিরে এল না। শুধু সন্ন্যাসী ভোলাবাবু ঘোষণা করলেন-কর্দমমান দিলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। নয়টা চলমান জলধারায় নির্মিত ঘাটের কাদার সঙ্গে নয় বদ্ধ জলাধারের ঘাটের কাদা মিশিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে কলাগাছের ভেতরের শাঁস। অশোক গাছের পাতার রস এবং অৰ্জুন গাছের ছাল সিদ্ধ পানিও মেশাতে হবে। ঐ জিনিস রোগীর সারা গায়ে মাখিয়ে রোগীকে সারাদিন রোদে শুইয়ে রাখতে হবে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, এতেই কাজ হবে।
অবশ্যই হবে। দ্রব্যগুণ আছে। ওতেই হবে।
কোনো মন্ত্রফন্ত্র নেই?
আছে। মন্ত্ৰও আছে। আপনারা মুসলমান মানুষ। আপনারা তো আর মন্ত্র পড়বেন না। আপনাদের জন্য শুধু দ্রব্যগুণ।
ঠিক আছে। আপনি আপনার কর্দমানের ব্যবস্থা করুন। হলে তো ভালো। টাকাপয়সা কেমন খরচ হবে?
টাকা-পয়সা খরচের জায়গা কোথায়? আমাকে গাঁজা কেনার কিছু দিলেই হবে। আর কিছু লাগবে না-ও, আর মাটির একটি গামলা।
ভোলাবাবু কৰ্দমস্নানের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। আমরা সবাই মোটামুটি খানিকটা উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। যেদিন কর্দমমান হবে তার আগের দিন বড় চাচার ছোট মেয়েটার চিঠি এসে উপস্থিত। দীর্ঘ চিঠি। পুরো চিঠি ইংরেজিতে লেখা। বাংলা অনুবাদ অনেকটা এরকম হবে–
বাবা,
আমার আদর ও ভালবাসা নাও। গত পরশু মা এসে পৌঁছেছেন। তাঁর কাছে শুনলাম, তোমার শরীর ভালো না। তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে মা চলে আসবেন, কল্পনাও করি নি। তোমরাই বা কী মনে করে তাঁকে ছাড়লে?
আমার এখানে এসে তিনি নানান রকমের সমস্যার সৃষ্টি করেন। যেমন সবার সব ব্যাপারে নাক গলানো। যেখানে তাঁর কথা বলার কিছু নেই, সেখানেও তিনি কথা বলবেন। যা শোর না তাও তিনি শুনবেন। আমি আমার বরের সঙ্গে কী কথা বলছি, তা শোনার জন্যে আড়ি পাবেন।
আমি জানি এসব তিনি করেছেন আমার মঙ্গলের জন্য। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এতে তেমন কোনো মঙ্গল হচ্ছে না। বরং অমঙ্গল হচ্ছে। তোমাদের জামাই পুরো ব্যাপারটায় খুব সঙ্গত কারণেই বিরক্ত হচ্ছে। তোমাকে আমি জানাতে চাই নি। তবু বাধ্য হয়ে জানাচ্ছি মা গত বছর হিউম্যান রাইটস এবং দেশের নারী সংঘের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন যে, আমার স্বামী আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। কী ভয়াবহ কথা চিন্তা করে দেখ। সেখান থেকে তদন্তের জন্যে লোক এসে উপস্থিত।
তোমাদের জামাই লজ্জায় এবং দুঃখে প্রায় পাগল হয়ে গেছে। সব পরিবারেই ঝগড়া হয়। ও যেমন চিৎকার করে, আমিও করি। এর মানে নারী নির্যাতন নয়। আমরা সুখেই আছি। ছোটখাট সমস্যা আমাদের অবশ্য আছে। তবে তা আমরা নিজেরাই দূর করব। মার হস্তক্ষেপ ছাড়াই করব।
মাকে আমরা দেশে ফেরত পাঠাতে চাই। তোমার চিকিৎসা ও সেবা-যত্নের জন্যেও তাঁর থাকা দরকার। আমরা খুব চেষ্টা করছি দ্রুত মার টিকিটের ব্যবস্থা করতে। বাবা, এই চিঠির বিষয়বস্তু মা না জানলে ভালো হয়। জানলে তিনি কষ্ট পাবেন।
বড় চাচার কর্দমস্নান শুরু হল।
বেশ উত্তেজক দৃশ্য। লরেটা পর্যন্ত স্কুলে যায় নি। আমার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে।
বড় চাচাকে একটি চাটাইয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার পাশে মাটির গামলা ভর্তি কাদা ভোলাবাবু ডাল ঘোঁটার ঘুঁটনিতে প্রবল বেগে কাদা খুঁটছেন। কাদা মন্থর করে মাখনের মতো কিছু তুলতে চান কিনা কে জানে।
মীরা বলল, সন্ন্যাসী চাচা, এরকম করছেন কেন?
ভোলাবাবু মধুর স্বরে বললেন, কাদা মিহি বানাচ্ছি মা জননী। তাই নিয়ম।
ভোলাবাবু আমাকে ভাই ডাকলেও মীরাকে মা ডাকেন। আর মাকেও মা ডাকেন। বেলানটার দিকে ভোলাবাবুবললেন, এইবার কর্দমস্নান শুরু হবে। নটা পাঁচ মিনিটে লগ্ন শুভ। যদিও কেউ ছবি তুলতে চান ছবি তুলেন।
ঘরে ফিল্ম ছিল না একজন দৌড়ে গিয়ে ফিল্ম আনল। সেই ফিল্মে ছবি তোলা হল।
কর্দমমানের ফল হাতে হাতে পাওয়া গেল। স্নান শেষ হবার পর গোসল দেয়া হল। গোসলের পর দেখা গেল বড় চাচার শরীরের বাঁ অংশটাও এখন অচল। পুরো প্যারালিসিস।
ভোলাবাবু শীতল গলায় বললেন, সবই ভগবানের লীলা! আমাকে গরম এককাপ চা দিতে বলুন তো। কাদা ঘেঁটে ঠাণ্ডা লেগে গেছে।