মনসা পূজার লোকাচার ও ঝাঁপান উৎসব
বর্ষাকালে মনসা পূজা ও মনসামঙ্গল গান পল্লীবাংলার এক অতি পরিচিত উৎসব! সারা বর্ষাকাল জুড়েই মা মনসার আরাধনার আয়োজন।
সাপের কামড়ে মৃত্যু ঘটা খুবই সাধারণ ঘটনা এ সময়। কিন্তু বাঙালিরা এই ঘটনাতেও পজিটিভ এনার্জি খুঁজে বের করেছে। এবং সাবধানতা অবলম্বন করে নাগ দেবী মা মনসার আরাধনার মধ্য দিয়ে সমাজকে সচেতন করে তুলেছে। যেমন শাক পূজা— শ্রাবণ মাসের মঙ্গলবার ধরে এই পূজা হয় যা মনসার পূজার সূচনা। জন্মাষ্টমীর আগে খই ধারা ও তার আগে শাক পূজা।
ভাদ্র সংক্রান্তিতে যে রান্না পূজা হয় তা মা মনসার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই। কোন কোন জায়গায় শ্রাবণ সংক্রান্তিতে ও রান্না পূজা হয়। বাংলার রান্না পূজার লোকাচার বড়ই মনোলোভা। প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে প্রকৃতিকে ভালোবেসে দিনযাপনের অংশীদার করে নেয়ার উৎসব এই পূজো গুলো।
পল্লী বাংলায় মনসা পূজো সাধারণত হয় কোন মনসার আটনে বা থানে কিংবা কারোর বাড়ির তুলসী মঞ্চ লাগোয়া সিজ মনসার গাছে। এই মনসা গাছ খুবই উপকারী ঔষধি বৃক্ষ। শোলার মালা ও সিঁদুর চন্দনচর্চিত মনসা গাছ মা মনসার প্রতিক।” খই ধারা” অর্থাৎ নাগপঞ্চমীর দিন মা মনসার আরাধনা— মুড়ি মুড়কি খই ছোলা বাদাম ভাজা এই পূজার প্রধান নৈবেদ্য! কাঁচা দুধ ও কলা তো মনসা পূজার আবশ্যিক উপকরণ!এ ছাড়াও মা মনসা আটনের চিডে গুড়ের নৈবেদ্য সাধারণ উপকরণ।
শ্রাবণ-ভাদ্র সংক্রান্তিতে অরন্ধন বা রান্নাপূজা মা মনসা কে সন্তুষ্ট করার এক প্রধান উৎসব। বাঁকুড়া পুরুলিয়াতে এই রান্না পূজাতে সজনে শাক ভাজা আমডা টক .চুনোমাছের ঝাল অবশ্যই রাখতে হয়।
পশ্চিম মেদিনীপুরের রন্ধনে নটে শাকের টক চুনো মাছের ঝাল অবশ্যই উৎসর্গ করতে হয়।
পশ্চিম মেদিনীপুরে রান্না শেষে কাঁঠাল পাতা তে পিঁপডের সারীকে খাবার উৎসর্গ করতে হয়।
পরদিন অরন্ধন।উনুনে মনসা ডাল দিয়ে পুজো করা হয়। অরন্ধনে পাড়া-প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করা হয় সাথে সাথে গৃহস্থের চাষে অংশগ্রহণকারীদের ভুরিভোজে আপ্যায়ন করা হয়।
মানব মনে আনন্দ উৎসব কোন উপাদানের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে মানবমনের উৎসাহ ঐকান্তিকতার ওপর।এই উৎসব গুলি মানুষের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।
মনসা পূজার উৎসব পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলাদেশেও সমান ভাবে পালিত হয়। বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল গান পুরো শ্রাবণ মাস জুড়ে গাওয়া হয় একজন মূল গায়েন গান শুরু করেন বাকিরা দোহার কি করেন ধ্রুব পদ গেয়ে।
সারাদুপুর মুখরিত থাকে এই মনসামঙ্গল গানে।
গানের শেষে মনসা ঘটে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ বিতরণ হয়।
মনসা পূজার আর এক বিশেষ উৎসব হলো ঝাঁপান। মা মনসার বাহন সাপদের নিয়ে খেলা দেখানো হয় এই উৎসবেষ এটি প্রতিযোগিতার মত। দুদলে ভাগ হয়ে বেদেরা এই খেলা দেখান।ছই খোলা গরুর গাড়ির ওপর সাপের ঝাঁপি নিয়ে থাকেন বেদেরা। ওই গাড়ি মানুষের টেনে নিয়ে আটনের সামনে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় প্রতিযোগিতা। বেদেদের গানে তুমরি বাঁশির সুরে, বিষম ঢাকের বোলে পুরো আটন উৎসব মুখর হয়ে ওঠে।
বর্তমানে এই ঝাঁপান উৎসব প্রায় হয় না বললেই চলে। সভ্যতার,নাগরিকতার ছোঁয়ায় এই লোক উৎসব গুলি প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে!