Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বেলা আন্দাজ সাড়ে চার। লাইব্রেরি-ঘরে বসিয়া যদুনাথ একটি জ্যোতিষের বই দেখিতেছেন; নন্দা চায়ের সরঞ্জাম লইয়া চা প্রস্তুত করিতেছে। নন্দার মুখখানি গম্ভীর, একটু শঙ্কিত। এক পেয়ালা চা ঢালিয়া সে যদুনাথের সম্মুখে ধরিল।

দাদু, তোমার চা।

যদুনাথ বই সরাইয়া রাখিয়া চা লইলেন, কথাচ্ছলে বলিলেন

আজ একাদশী কিনা, বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। মন্মথ কোথায়?

দাদা কি জানি কোথায় বেরুল।

আর দিবাকর?

বোধ হয় নিজের ঘরে আছেন। ডেকে পাঠাব?

না, দরকার কিছু নেই। ছেলেটার ওপর আমার ভারি মায়া পড়ে গেছে। বড় ভাল ছেলে।

নন্দা একটু হাসিয়া বলিল—মেষ কিনা, তাই তোমার মায়া পড়েছে।

যদুনাথ বলিলেন-না না, সত্যি ভাল ছেলে। তোর ভাল লাগে না?

নন্দা প্রশ্নটা এড়াইয়া গেল। বলিল—দাদা ওঁকে পছন্দ করে না।

যদুনাথের মুখ গম্ভীর হইল। বলিলেন, সে আমি জানি। কিন্তু ওর সঙ্গে কোনও রকম অসদ্ব্যবহার করে না তো?

নন্দা বলিল—না। দাদা ওঁকে এড়িয়ে চলে, উনিও দাদাকে এড়িয়ে চলেন। দাদু, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব।

কি কথা?

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া নন্দা আস্তে আস্তে বলিল—মনে করো, একজন অপরাধ করার পর তার অনুতাপ হয়েছে, আর সে অপরাধ করতে চায় না। তবু কি তাকে শাস্তি দিতে হবে?

যদুনাথ তীক্ষ্ণ সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাহার পানে চাহিলেন

হঠাৎ একথা কেন? নন্দা

হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—অমনি। জানবার কৌতূহল হল, তাই জিগ্যেস করছি।

যদুনাথ গম্ভীর মুখে বলিলেন-নন্দা, বড় কঠিন প্রশ্ন করেছ; একেবারে দণ্ডনীতির গোড়ার কথা! দ্যাখ, মানুষ যখন অপরাধ করে তখন তার ফলে কারুর না কারুর অনিষ্ট হয়, সমাজের ক্ষতি হয়। অনুতাপ খুব ভাল জিনিস, কিন্তু অনুতাপে তো ক্ষতিপূরণ হয় না। মানুষ যেকাজ করেছে। তার ফল—ভাল হোক মন্দ হোক—তাকে ভোগ করতে হবে। এটা শুধু মানুষের আইন নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আইন। আগুনে যে হাত দিয়েছে তার হাত পুড়বে, হাজার অনুতাপেও তার জ্বলুনি কমবে না। কেমন, বুঝতে পারছ?

পারছি।

এই হচ্ছে অনাদি নিয়ম। মানুষ তার সমাজব্যবস্থায় এই নিয়ম মেনে নিয়েছে। না মেনে উপায় নেই, না মানলে সমাজ একদিনও চলবে না। পাপ যে করেছে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অপরাধীকে দণ্ডভোগ করতে হবে।

কিন্তু অনুতাপ

অনুতাপ ভাল; যার অনুতাপ হয়েছে তাকে আমরা স্নেহের চক্ষে সহানুভূতির চক্ষে দেখব, কিন্তু তার প্রাপ্য দণ্ড থেকে তাকে নিষ্কৃতি দেবার অধিকার আমাদের নেই। দণ্ড ভোগ করে তবে সে কর্মফলের হাত থেকে মুক্তি পাবে, তার দাঁড়িপাল্লা আবার সমান হবে।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নন্দা ভয়ে ভয়ে বলিল—আচ্ছা দাদু, মনে কর—মনে কর দাদা যদি কোনও অপরাধ করে থাকে

যদুনাথ চমকিয়া বলিলেন—দাদা-মন্মথ!

নন্দা বলিল—না না, আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি। মনে কর দাদা যদি কোনও অপরাধ করে, কিন্তু তারপর অনুতপ্ত হয়, তবু কি তুমি তাকে শাস্তি দেবে? জেলে পাঠাবে?

যদুনাথ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন—

মন্মথ যদি জেলে যাবার মতো অপরাধ করে তাহলে আমি তাকে জেলে পাঠাব। আমার বুক ভেঙে যাবে, তবু তাকে জেলে পাঠাব। না, একটা কথা জেনে রাখো। ন্যায় অন্যায় বোধ যদি না থাকে তাহলে জীবনে কিছুরই কোনও মূল্য থাকে না; জীবনটাই খেলো হয়ে যায়। আমি জীবনে অনেক দাগা পেয়েছি, অনেক জিনিস হারিয়েছি। তোমাদের মা-বাবা, তোমাদের ঠাকুরমা-সবই একে একে আমাকে ছেড়ে গেছেন। কিন্তু তবু আমি মনের জোর হারাইনি। শেষ পর্যন্ত সবই যদি যায়, তবু ন্যায়ধর্মকে আঁকড়ে থাকব। ওই আমার শেষ সম্বল।

শুনিতে শুনিতে নন্দার চোখে জল আসিয়াছিল; সে আঁচল দিয়া চোখ মুছিল।

.

দ্বিতলে দিবাকরের ঘর। দিবাকর নিজের বিছানায় চিৎ হইয়া শুইয়া আছে। নন্দার যে ফটোখানা সে চুরি করিয়াছিল, তাহাই ডান হাতের বুকের উপর ধরিয়া একদৃষ্টে তাহার পানে চাহিয়া আছে। ক্রমে তাহার ক্লান্ত চক্ষু মুদিয়া আসিল, ছবিখানা হাত হইতে খসিয়া বুকের উপর পড়িয়া রহিল! তন্দ্রার মধ্যে সে একবার অস্ফুট স্বরে বলিল—না না, নন্দা-তা হয় না।

নন্দা আসিয়া ধীরে ধীরে তাহার শয্যাপাশে দাঁড়াইল, করুণ-মধুর নয়নে তাহার পানে চাহিয়া রহিল। দিবাকরের বুকের উপর উল্টানো ছবিটা তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। কার ছবি?

নন্দার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে অতি লঘু হস্তে ছবিখানা দিবাকরের বুকের উপর হইতে তুলিয়া লইল। সঙ্গে সঙ্গে দিবাকরের চটকা ভাঙিয়া গেল, সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল।

নন্দা!

নিজের মুখে নন্দার নাম শুনিয়া সে নিজেই থতমত খাইয়া গেল। নন্দা ছবিটা দেখিয়া হাসিমুখ তুলিল।

হ্যাঁ, নন্দা। চণ্ডীদাস কি বলেছেন জানো?

দিবাকর শয্যা হইতে নামিয়া দাঁড়াইল।

চণ্ডীদাস?

নন্দা বলিল—হ্যাঁ গো, কবি চণ্ডীদাস, রজকিনী রামীর চণ্ডীদাস। গান শোনোনি? চণ্ডীদাস কয়, আপন স্বভাব ছাড়িতে না পারে চোরা।

দিবাকর অবরুদ্ধস্বরে বলিল—নন্দা, আমি

নন্দা বলিল—কখন ছবিটা চুরি করলে? উঃ, কি সাংঘাতিক চোর তুমি! আমার চোখের সামনে চুরি করলে তবু দেখতে পেলাম না!

দিবাকর আর্তস্বরে বলিল—নন্দা, কেন তুমি জানলে? আমি বলতে চাইনি

কিন্তু এখন তো ধরা পড়ে গেছ। এখন কি করবে?

কি করব! আমি চোর—দাগী আসামী

মুহূর্তে নন্দার মুখ গম্ভীর হইল; সে দিবাকরের মুখের উপর অপ্রগলভ চক্ষু রাখিয়া ধীরে ধীরে বলিল

তুমি চোর, তুমি দাগী আসামী; আচ্ছা বেশ, কিন্তু আমি তবে কি? চোরের বোন। তফাত কতখানি? আমি কোন অধিকারে তোমাকে নিচু নজরে দেখব।

না না, সে অন্য কথা। মন্মথবাবু প্রকৃতিস্থ নয়, তিনি কি করছেন তা নিজেই জানেন না। কিন্তু আমি যে সাদা চোখে জেনে শুনে অপরাধ করেছি

কিন্তু এখন তো তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ।

তা পেরেছি, কিন্তু নিজের অতীতকে ভুলতে পারছি কই? অতীতের দেনা যতক্ষণ না শোধ করছি ততক্ষণ যে আমার নিষ্কৃতি নেই, নন্দা।

অতীতের দেনা?

যা করেছি তার ফল ভোগ করতে হবে না? পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না?

নন্দার মুখ পাণ্ডুর হইল; দাদুও তো ওই কথাই বলিয়াছিলেন। সে স্খলিতস্বরে বলিল—প্রায়শ্চিত্ত! কী প্রায়শ্চিত্ত! কি করতে চাও তুমি?

দিবাকর একবার কপালের উপর দিয়া করতল সঞ্চালিত করিল—

তা এখনও ঠিক জানি না। কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, না করলে শান্তি নেই। নন্দা, আর আমি এখানে থাকব না, চলে যাব।

নন্দা ব্যাকুলকণ্ঠে বলিল—কেন! কেন! তার কি দরকার।

দিবাকর বলিল—আমার দরকার আছে। তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া আমার প্রায়শ্চিত্তের প্রথম পর্ব।

নন্দার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। তাহা দেখিয়া দিবাকর তাহার আরও কাছে আসিয়া মিনতির সুরে বলিল–কেঁদো না, নন্দা। আমাকে হাসিমুখে যেতে দাও

নন্দা গিয়া দরজায় পিঠ দিয়া দাঁড়াইল।

না, তুমি যেতে পাবে না।

দিবাকর কাছে গিয়া ধীর স্বরে বলিল—না, আমার মন বড় দুর্বল, আমাকে প্রলোভন দেখিও। তুমি আমাকে মানুষ তৈরি করেছ, তুমি আমার পথ আগলে দাঁড়িও না, আমাকে মনুষ্যত্বের পথে হাঁটতে দাও। নন্দা, আমার কথা শোনো।

দিবাকর আঙুল দিয়া নন্দার চিবুক তুলিয়া ধরিল।

নন্দা অশ্রুপ্লাবিত চক্ষে বলিল—চলে যাবে?

দিবাকর বলিল—আবার আমি ফিরে আসব। যেদিন আমার ঋণ শোধ হবে সেইদিন আমি তোমার কাছে ফিরে আসব।

আসবে?

আসব, শপথ করছি। কিন্তু তুমিও একটা শপথ কর। তুমি আমাকে সাহায্য করবে, আমার প্রায়শ্চিত্ত যাতে পূর্ণ হয় তার চেষ্টা করবে। তুমি সাহায্য না করলে আমি যে কিছুই পারব না, নন্দা। বল, সাহায্য করবে।

কান্নায় বুজিয়া যাওয়া স্বরে নন্দা বলিল-করব।

দিবাকর তখন নন্দার হাত ধরিয়া পাশে সরাইয়া দিল। বলিল—এবার আমি হালকা মনে যেতে পারব।—চললাম নন্দা, আবার দেখা হবে।

দিবাকর চলিয়া গেল। অশ্রুবাষ্পের ভিতর দিয়া নন্দা যেন দেখিতে পাইল, দিবাকর চলিয়া যাইতেছে; সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিল; হল-ঘর পার হইয়া বাগানের পথ দিয়া চলিয়াছে; ফটক উত্তীর্ণ হইয়া রাস্তায় নামিল; ঘনায়মান সন্ধ্যায় নগরের জনসমুদ্রে মিলাইয়া গেল।

.

রাত্রি আন্দাজ আটটা। লিলির ড্রয়িংরুম। লিলি সোফায় বসিয়া আছে, আর মন্মথ নতজানু অবস্থায় তাহার দিকে ঝুঁকিয়া তাহার একটা হাত চাপিয়া ধরিয়াছে। মানুষ যে অবস্থায় কাণ্ডজ্ঞান হারাইয়া প্রবৃত্তির খরস্রোতে ঝাঁপাইয়া পড়ে মন্মথর সেই অবস্থা। সে উন্মাদনার ঝোঁকে বলিতেছে—লিলি, আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে চাই—তোমাকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব।

পুরুষকে প্রলুব্ধ করার কলাবিদ্যায় লিলি সুনিপুণা; কতখানি আকর্ষণ করিয়া কখন ঢিলা দিতে হয় তাহা তাহার নখাগ্রে। সে বঙ্কিম ভঙ্গি করিয়া ঠোঁটের কোণে হাসিল

সবাই ঐ কথা বলে! ও তোমাদের মুখের কথা।

মুখের কথা! লিলি, তুমি জানো না, তোমার জন্যে আমি নিজের বোনের গয়না চুরি করেছিলাম। তোমার জন্যে আমি কী না পারি! যদি হৃদয় খুলে দেখাতে পারতাম তাহলে বুঝতে।

পুরুষের হৃদয় নেই, শুধু ছলনা।

লিলি হঠাৎ উঠিয়া ব্যাল্কনিতে গিয়া দাঁড়াইল। নীচে অন্ধকার বাগান; লিলি রেলিংয়ের উপর কনুই রাখিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। মন্মথ আসিয়া তাহার পাশে দাঁড়াইল। কিন্তু কেহই জানিতে পারিল না যে ঠিক ব্যালকনির নীচে অন্ধকারে দিবাকর দাঁড়াইয়া আছে।

মন্মথ ব্যগ্রস্বরে বলিল—লিলি, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। তোমার জন্যে আমি আগুনে ঝাঁপ দিতে পারি, মানুষ খুন করতে পারি

লিলি বলিল-ওসব কিছুই করবার দরকার নেই। তুমি আমাকে ভালবাসে কিনা খুব সহজে প্রমাণ করতে পারে।

মন্মথ সাগ্রহে বলিল—কি করব বল?

কিন্তু সে তুমি পারবে না।

একবার বলে দ্যাখো পারি কিনা। একবার মুখ ফুটে বল, লিলি।

লিলি গম্ভীর মুখে মন্মথর দিকে ফিরিল—

তুমি একবার বলেছিলে তোমার বাড়িতে একটি সুন্দর রুবি আছে; যদি সেই রুবি আমাকে এনে দিতে পারো, তবেই বুঝব তুমি আমায় ভালবাস।

মন্মথর মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল।

রুবি—সূর্যমণি! কিন্তু সে যে—সে যে আমাদের ঠাকুর, দাদু রোজ তার পুজো করেন—

লিলি মুখ বাঁকাইয়া বলিল—আমি জানতাম তুমি পারবে না। তুমি কেবল মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলতে পার।—সর, পথ ছাড়ো।

লিলি আবার কক্ষে ফিরিয়া যাইবার উপক্ৰম করিল, কিন্তু মন্মথ হাত দিয়া তাহার পথ আগলাইয়া রহিল।

লিলি, আমার একটা কথা শোনো

আর কি শুনব? তোমার প্রেমের দৌড় বুঝতে পেরেছি। তোমার চেয়ে দাশুবাবু ফটিকবাবু ভাল, তারা অন্তত কৃপণ নয়।

মন্মথর মনে যেটুকু দ্বিধা ছিল দাশু ফটিকের উল্লেখে তাহা দূর হইল। সে তীব্র জ্বরাক্রান্ত চোখে চাহিয়া লিলির দুই কাঁধের উপর হাত রাখিল।

লিলি, আমি যদি সূর্যমণি এনে তোমায় দিই, তাহলে তুমি আমার হবে?

তাহলে বুঝব তুমি আমায় সত্যিই ভালবাস।

আর তুমি? তুমি আমায় ভালবাস না?

লিলি লজ্জাভিনয় করিয়া বলিল—সে কথা মেয়েরা কি মুখ ফুটে বলতে পারে?

মন্মথ গাঢ়স্বরে বলিল—লিলি, চল দুজনে পালিয়ে যাই। আমি সূর্যমণি চুরি করে আনব, তারপর দুজনে পালিয়ে গিয়ে নির্জনে বাস করব; কেউ জানবে না, শুধু তুমি আর আমি। —

ডার্লিং!

ডার্লিং! আজ রাত্রে আমি আসব—দুপুর রাত্রে আসব–সূর্যমণি নিয়ে আসব যেমন করে পারি। তুমি আমার জন্যে রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা কোরো।

আমি সারা রাত তোমার পথ চেয়ে থাকব।

বাহুতে বাহু শৃঙ্খলিত করিয়া দুজনে আবার ঘরে ফিরিয়া গেল। ব্যাকনির নীচে দাঁড়াইয়া দিবাকর অবিচলিত মুখে সমস্ত শুনিয়াছিল; আর অধিক শুনিবার প্রয়োজন ছিল না।

.

রাত্রি সাড়ে আটটা। যদুনাথের হল-ঘরে কেহ নাই; কেবল নন্দা স্বপ্নাবিষ্টের মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।

টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। নন্দা কাছেই ছিল, সে ক্ষণেক শব্দায়মান যন্ত্রটার দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর ছুটিয়া গিয়া যন্ত্রটা তুলিয়া কানে ধরিল। যদি দিবাকর হয়।

হ্যালো

তারের অপরদিক হইতে কোনও শব্দ আসিল না।

হ্যালো হ্যালো

কোনও অনির্দিষ্ট স্থানে একটি টেবিলের সম্মুখে দিবাকর টেলিফোন কানে দিয়া বসিয়া আছে; তাহার মুখে স্নেহ-বিধুর হাসি। কিছুক্ষণ শুনিবার পর সে নরম সুরে বলিল—তুমি কথা বল, নন্দা, আমি শুনি।

ওদিকে নন্দার মুখ উজ্জ্বল হইয়া আবার পার হইয়া গেল।

তুমি—তুমি? কোথা থেকে কথা বলছ?

দিবাকর বলিল—তা জেনে কোনও লাভ নেই, নন্দা। তার চেয়ে তুমি কথা বল, তোমার গলার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করছে।

নন্দা ধরাধরা গলায় বলিল—শুধু গলার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করছে? আর—দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না?

দিবাকর প্রতিধ্বনি করিল—ইচ্ছে হচ্ছে না!

তবে ফিরে আসছ না কেন?

বলেছি তো, নন্দা, আসব। কিন্তু এখন নয়। একটা কথা শোনো।–আজ রাত্রে তুমি সজাগ থেকো, ঘুমিও না।

নন্দা সাগ্রহে বলিল——তুমি আসবে?

দিবাকর বলিল—তা ঠিক জানি না। কিন্তু তুমি জেগে থেকো।

আচ্ছা। —-ওঃ!

নন্দার দৃষ্টি পড়িল, যদুনাথ সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিতেছেন।

নন্দা নিম্নস্বরে বলিল—দাদু আসছেন। দাদু তোমাকে বাড়িময় খুঁজে বেড়াচ্ছেন—

নন্দা টেলিফোনের শ্রবণ-যন্ত্রটি টেবিলের উপর রাখিল, তারের সংযোগ কাটিয়া দিল না। তাহার ইচ্ছা যদুনাথ অন্যত্র চলিয়া গেলে আবার দিবাকরের সহিত কথা কহিবে। যদুনাথ কিন্তু চলিয়া গেলেন না, নন্দার সম্মুখে আসিয়া ক্ষুব্ধ মুখে বলিলেন—সে নিজের ঘরে নেই, চলে গেছে। আমাকে না বলে চলে গেছে। (লাঠি ঠুকিয়া) আমি জানতে চাই এর জন্যে দায়ী কে? নিশ্চয় কেউ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে, নইলে সে আমাকে না বলে চলে যাবে কেন?

টেলিফোনের অপর প্রান্তে দিবাকর যদুনাথের কথাগুলি শুনিতে পাইতেছে; তাহার চক্ষু বাষ্পোজ্জ্বল হইয়া উঠিল। ওদিকে যদুনাথ আরও উত্তপ্ত হইয়া বলিয়া চলিয়াছেন।

আমার কথার উত্তর কেউ দেবে? বাড়ির সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে। দিবাকর কোনও দিন আমাকে না জানিয়ে বাড়ির বাইরে যায় না, আজ কোথায় চলে গেল সে! কেন চলে গেল? নিশ্চয় কেউ তাকে চলে যেতে বলেছে তাই সে চলে গেছে। আমি তো কোনও দিন তাকে একটা কটু কথা বলিনি। নন্দা, তুই তাকে কটু কথা বলেছিস?

নন্দা নতমুখে উচ্চৈঃস্বরে বলিল-না দাদু।

যদুনাথ বলিলেন—তবে অমন ভাল ছেলেটা কেন চলে গেল। নন্দা, সত্যি বল, তুই তাকে তাড়িয়ে দিসনি?

নন্দা অধর দংশন করিয়া বলিলেন—না দাদু।

যদুনাথ বলিলেন—তবে আর কেউ দিয়েছে। সে তো অমনি অমনি চলে যাবার ছেলে নয়

এই সময় মন্মথ সদর দরজা দিয়া প্রবেশ করিল। তাহাকে দেখিয়া যদুনাথ বারুদের মতো জ্বলিয়া উঠিলেন—

এই মন্মথ! তুমি—তুমি দিবাকরকে তাড়িয়েছ! তুমি ছাড়া আর কেউ নয়।

মন্মথ বিস্ময়ে মুখব্যাদান করিল।

কি হয়েছে? আমি তো কিছুই জানি না।

যদুনাথ বলিলেন—এ বাড়ির কেউ কিছু জানে না, সবাই ন্যাকা। সব্বাইকে তাড়িয়ে দেব আমি, দূর করে দেব বাড়ি থেকে। যত সব চোর বাটপাড় গাঁটকাটার দল

যদুনাথ আফসাইতে লাগিলেন। মন্মথ চোরের মতো উপরে চলিয়া গেল। ইতিমধ্যে সেবক আসিয়া একপাশে দাঁড়াইয়াছিল, সে ভয়ে ভয়ে বলিল-বাবু

যদুনাথ সিংহ বিক্ৰমে তাহার দিকে ফিরিলেন।

তোমার আবার কী দরকার?

সেবক বলিল—খাবার দেওয়া হয়েছে।

যদুনাথ বলিলেন-খাবার! খাব না আমি খিদে নেই আমার

তিনি নিজের ঘরে প্রবেশ করিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন—ভাল চাও তো ফিরিয়ে নিয়ে এস তাকে, যেখান থেকে পারো ফিরিয়ে নিয়ে এস। নইলে

তিনি দড়াম করিয়া দ্বার বন্ধ করিলেন। সেবক ফ্যালফ্যাল করিয়া ইতি-উতি চাহিতে চাহিতে চলিয়া গেল। নন্দা আবার টেলিফোন তুলিয়া লইল। বলিল—শুনলে?

দিবাকর বলিল—শুনলাম।

তবু আসবে না?

আসব নন্দা। আমি শপথ করেছি আসব। কিন্তু তুমি তোমার শপথ ভুলে যাওনি তো?

না।

আজ রাত্রে সতর্ক থেকো, জেগে থেকো।

আচ্ছা। তোমার দেখা পাবার আশায় জেগে থাকব।

কিছুক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলিয়া সে টেলিফোন নামাইয়া রাখিল।

.

রাত্রি বারোটা। যদুনাথের দ্বিতলের বারান্দা।

মন্মথ নিজের ঘর হইতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া আসিল। তাহার গায়ে বিলাতী পোশাক, পায়ে রবারের জুতা। সে কান পাতিয়া শুনিল, কোথাও শব্দ নাই। তখন সে সন্তর্পণে নীচে নামিয়া গেল।

নন্দা নিজের ঘরে জাগিয়া ছিল। ক্ষীণ রাত্রি-দীপ জ্বালিয়া সে মুক্ত জানালার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ছিল; আশা করিতেছিল, দিবাকর আসিবে। মন্মথর বহির্গমন সে জানিতে পারিল না।

মন্মথ নীচে নামিয়া যদুনাথের শয়নঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়াছে। সে উৎকর্ণ হইয়া শুনিল, যদুনাথ নাসিকাধ্বনি করিয়া ঘুমাইতেছেন। মন্মথ তখন লঘু হস্তে দ্বার ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল।

যদুনাথের বালিশের পাশে চাবির গোছা রহিয়াছে, যদুনাথ বিপরীত দিকে ফিরিয়া ঘুমাইতেছেন। মন্মথ হাত বাড়াইয়া দৃঢ়মুষ্টিতে চাবির গোছা ধরিয়া ধীরে ধীরে তুলিয়া লইল। যদুনাথ জাগিলেন না।

বাহিরে আসিয়া মন্মথ চাবি দিয়া ঠাকুরঘরের দ্বার খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।

যদুনাথের ফটক হইতে কিছু দূরে রাস্তার পাশে একটি ট্যাক্সি দাঁড়াইয়া আছে; ট্যাক্সির চালক দাড়িওয়ালা শিখ গাড়ির বনেট খুলিয়া খুটখাট করিতেছে।

মন্মথকে দ্রুতপদে বাড়ির দিক হইতে আসিতে দেখা গেল। ট্যাক্সির পাশাপাশি আসিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল—ট্যাক্সি, যায়েগা?

চালক বনেট বন্ধ করিয়া ভাঙা গলায় বলিল—যায়েগা।

মন্মথ গাড়িতে উঠিয়া বসিল, শিখ চালক গাড়ি চালাইয়া দিল। শিখ চালক যে ছদ্মবেশী দিবাকর, দাড়িগোঁফের ভিতর হইতে মন্মথ তাহা চিনিতে পারিল না।

.

লিলির ড্রয়িংরুমে দাশু ও ফটিক পাশাপাশি সোফায় বসিয়া আছে। লিলি টেবিলের কাছে দাঁড়াইয়া একটি কাচের সোরাই হইতে গেলাসে বরফ-জল ঢালিতেছে। সকলের মুখের ভাব চিন্তাকুল। তাহারা মন্মথর প্রতীক্ষা করিতেছে।

দাশু হাতঘড়ি দেখিয়া বলিল—সাড়ে বারোটা।-লিলি, তোমার পাখি উড়েছে। সব পণ্ড হল।

লিলি বলিল—না, সে আসবে, নিশ্চয় আসবে—ঐ!

বাড়ির সদরে মোটর আসিয়া থামার শব্দ হইল। লিলি ছুটিয়া দ্বারের কাছে কান পাতিয়া শুনিল, তারপর হাত নাড়িয়া দাশু ও ফটিককে ইশারা করিল। তাহারা ত্বরিতে পাশের ঘরে লুকাইল।

ক্ষণেক পরে মন্মথ আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার চেহারা উষ্কখুষ্ক, হাত-পা কাঁপিতেছে, চোখে জ্বরগ্রস্তের তীব্র দৃষ্টি। লিলি উদ্ভাসিতমুখে তাহার হাত ধরিয়া ভিতরে টানিয়া আনিল এবং দরজা ভেজাইয়া দিল। মন্মথ সভয়ে চারিদিকে চাহিল—

এখানে আর কেউ নেই তো!

না না না, শুধু তুমি আর আমি। তোমার জন্য একলাটি জেগে বসে আছি। জানতাম তুমি আসবে।

মন্মথ সোফার উপর বসিয়া পড়িল। বলিল—

কি করে যে এসেছি। লিলি, চল, এখনি পালিয়ে যাই। আমি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

লিলি আগ্রহে বলিল—যাব যাব। কিন্তু কী এনেছ আগে দেখি।

মন্মথ পকেট হইতে সূর্যমণি লইয়া মুঠি খুলিয়া লিলির সম্মুখে ধরিল; ডিম্বাকৃতি সিন্দুরবর্ণ মণি তীব্র আলোক সম্পাতে ঝলমল করিয়া উঠিল। লিলি মণিটি মন্মথর হাত হইতে প্রায় কাড়িয়া লইয়া দুই চক্ষু দিয়া গিলিতে লাগিল।

সোফার পিছন দিকের দরজা দিয়া দাশু ও ফটিক নিঃশব্দে বাহির হইয়া আসিল। উভয়ের হাতে পুলিসের রুলের মতো একটি করিয়া খেঁটে।

মন্মথ বলিল—দেখলে তো? এবার চল—

এই সময় দাশুর ঘেঁটে তাহার মাথায় পড়িল। মন্মথ একটা অব্যক্ত চিৎকার করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেই ফটিক তাহার মাথায় আর এক ঘা দিল। মন্মথ অজ্ঞান হইয়া সোফার পায়ের কাছে পড়িয়া গেল।

দাশু বলিল—ব্যস, কাম ফতে!

ফটিক বলিল–চল এবার কেটে পড়া যাক।

লিলি বলিল—দ্যাখো দ্যাখো—কত বড় রুবি?

লিলি দুই আঙুলে সূর্যমণি তুলিয়া ধরিল; দাশু ও ফটিক সৃক্কণী লেহন করিয়া দেখিতে লাগিল।

ফটিক বলিল—আর আমাদের খেটে খেতে হবে না।

দ্বারের নিকট হইতে ব্যঙ্গ-পূর্ণ হাসির শব্দ আসিল। তিনজনে চমকিয়া দেখিল, এক দাড়িওয়ালা শিখ দাঁড়াইয়া আসিতেছে; তাহার হাতে পিস্তল।

দাশু চমকিয়া বলিল-কে তুমি? কোন হ্যায়?

দিবাকর বলিল—চেহারা দেখে চিনতে পারবে না। তবে নাম শুনেছ বোধ হয়—কানামাছি।

লিলি অব্যক্ত স্বরে বলিল—কানামাছি!!

তিনজনে বাক্যব্যয় না করিয়া মাথার উপর হাত তুলিল। দিবাকর লিলির হাত হইতে সূর্যমণি লইয়া পকেটে রাখিল।

দাশু ও ফটিককে বলিল—তোমরা দুজনে সোফায় বোসো। হাত নামিও না। চালাকি করতে গেলে বিপদে পড়বে।

দাশু ও ফটিক ঊর্ধ্ববাহু হইয়া সোফায় বসিল। মন্মথ অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেয় পড়িয়াছিল, দিবাকর তাহার প্রতি একবার দৃকপাত করিয়া লিলিকে বলিল—তুমি ওর মুখে জলের ছিটে দাও।

জলের গ্লাস দিবাকর লিলিকে দিল; লিলি যন্ত্রচালিতবৎ মন্মথর মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগিল। দিবাকর তখন তাহাদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া কোণাচে ভাবে টেলিফোনের দিকে চলিল। বলিল—

তোমাদের দিকে আমার নজর আছে। একটু বেচাল দেখলেই গুলি করব।

দিবাকর বাঁ হাতে টেলিফোন তুলিয়া একটা নম্বর দিল। তাহার চক্ষু কিন্তু তিনজনের উপর নিবদ্ধ।

যদুনাথের হল-ঘর। নন্দা সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিতেছে। দীর্ঘকাল নিজের ঘরে প্রতীক্ষা করিয়া আর মনের অস্থিরতা দমন করিতে না পারিয়া চুপি চুপি নীচে নামিয়া আসিতেছে।

টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। নন্দা ছুটিয়া আসিয়া টেলিফোন তুলিয়া লইল—হ্যালো—তুমি! কি! কী হয়েছে? দাদার বিপদ! প্রাণের আশঙ্কা!—কোথায়?

টেলিফোনের শব্দে যদুনাথের ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল; তিনি আলুথালু বেশে বাহির হইয়া আসিলেন।

নন্দা! তুই এত রাত্রে? কার ফোন?

নন্দা বলিল—দাদু, দাদা বিপদে পড়েছে প্রাণ-সংশয়। (টেলিফোনে) আঁ, কি ঠিকানা?…আচ্ছা, দাদু আর আমি এখনি যাচ্ছি

যদুনাথ বলিলেন-কে ফোন করেছে?

দিবাকরবাবু।

দিবাকর! চল চল, আর দেরি নয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress