Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মধু-মালতী || Sharadindu Bandyopadhyay

মধু-মালতী || Sharadindu Bandyopadhyay

যাঁহারা মহারাষ্ট্র দেশে বাস করিয়াছেন তাঁহারা জানেন, মারাঠীরা গান ভালবাসে, ফুল ভালবাসে এবং বাইসাইকেল চড়িতে ভালবাসে। পুণার অলিতে-গলিতে ফুলের দোকান, গান বাজনার আখড়া, সাইকেলের আড়ৎ। আড়তে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়; এক আনা ভাড়া দিয়া এক ঘণ্টা সাইকেল চড়িয়া বেড়াও। মেয়ে-মদ্দ সবাই সাইকেল চড়ে, বিশেষত কলেজের ছেলেমেয়েরা।

এদেশে মেয়েদের আলাদা কলেজ নাই, সকলে একসঙ্গে পড়ে। কলেজের ছুটি হইলে দেখা যায়, রাস্তা দিয়া সাইকেলের নব-যৌবন জলতরঙ্গ বহিয়া চলিয়াছে।

আমি প্রথম যেবার পুণায় আসি, সেবার শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি হোটেলে মাসখানেক ছিলাম। রাস্তার নাম টিলক রোড, অদূরে এস্ পি কলেজ; আরও একটু দূরে টিলার মাথায় পার্বতী মন্দিরের চূড়া দেখা যায়।

দক্ষিণ দিক ফাঁকা, দিগন্তে পাহাড়ের চক্ররেখা। এই চক্ররেখা চক্ষু দ্বারা অনুসরণ করিলে সিংহগড় দুর্গ চোখে পড়ে। শিবাজী মহারাজের সিংহগড়, যে সিংহগড় জয় করিবার মুহূর্তে তানাজি মালেশ্বর প্রাণ দিয়াছিলেন। সিংহগড়ের সিংহ গিয়াছে পড়ে আছে শুধু গড়—

শীতের শেষ। রাস্তার ধারে আমগাছে বোল ধরিয়াছে, মিষ্ট-কষায় গন্ধে চারিদিক, আমোদিত। আমি ডাক্তারের আদেশে পুণায় আসিয়াছি, সকাল-বিকাল পদব্রজে ঘুরিয়া বেড়াই। হোটেলে আমার দ্বিতলের ঘরের সম্মুখে ছোট্ট একটি ব্যাকনি আছে, সেখানে দাঁড়াইয়া রাস্তার লোক চলাচল দেখি। বোম্বাইয়ে থাকাকালে যে-পেট জবাব দিয়াছিল, তাহা এখন নানাবিধ স্থানীয় খাদ্য অম্লানবদনে হজম করিতেছে। দহি বড়া, ইলি-সম্বর, দোসা—কিছুই বাদ পড়ে না। দশদিন যাইতে না যাইতে প্রাচীন পুণ্যা নগরীকে ভালবাসিয়া ফেলিলাম।

কিন্তু আমি বিভূতি বাঁড়ুয্যে নই, পায়ে হাঁটিয়া বেড়াইয়া তিলমাত্র আনন্দ পাই না। অথচ ডাক্তারের হুকুম।

একদিন ব্যালকনিতে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া একটি বুদ্ধি মাথায় খেলিয়া গেল। সামনেই রাস্তার। ওপারে প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড বামনরাও সাইকেল মার্ট। সাইকেলের দোকান। কত লোক আসিতেছে, সাইকেল ভাড়া লইয়া চলিয়া যাইতেছে। আমিও সাইকেল চড়িয়া বেড়াই না কেন? অবশ্য অনেক দিন চড়ি নাই, কিন্তু সাঁতার কাটা এবং সাইকেল চড়া মানুষ ভোলে না। সুতরাং সাইকেল চড়িয়া ডাক্তারের আজ্ঞা পালন করিব। যস্মিন্ দেশে যদাচারঃ।

বিকেলবেলা সাইকেলের দোকানে গেলাম। দোকানদার বামনরাও খাতায় আমার নাম-ধাম লিখিয়া লইয়া সাইকেল দিল। বামনরাওয়ের চেহারা বেঁটে, মজবুত, বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ। দোকানের পেছনের একটি ঘরে সস্ত্রীক বাস করে।

অতঃপর রোজ দুবেলা সাইকেল চড়িয়া বেড়াই। শহর বাজার এড়াইয়া পুণার কিনারে কিনারে ঘুরি। কখনও যাই গণেশখিণ্ডের দিকে, কখনও খড়গবৎসলার হ্রদের পানে? আনন্দে আছি; বামনরাওয়ের সঙ্গে প্রণয় জন্মিয়াছে। সে অল্পস্বল্প হিন্দী বলিতে পারে; নির্বান্ধব পুরীতে সেই আমার প্রথম বন্ধু।

প্রস্তাবনা শেষ করিয়া এবার আসল কথায় আসা যাক।

সে রাত্রে যথাসময় আহারাদি করিয়া শয়ন করিয়াছিলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসিল না। বোধ হয় দিবানিদ্রা কিছু বেশী হইয়া গিয়াছিল। শুইয়া শুইয়া বই পড়িবার চেষ্টা করিলাম; তাহাতে ঘুম আসে বটে, কিন্তু বই বন্ধ করিলেই তন্দ্রা ছুটিয়া যায়।

রাত্রি প্রায় একটা পর্যন্ত ঝুলোঝুলি করিয়া উঠিয়া পড়িলাম। গায়ে বালাপোশ জড়াইয়া ব্যাল্কনিতে গিয়া দাঁড়াইলাম।

বাহিরে কনকনে ঠাণ্ডা। এক আকাশ নক্ষত্র যেন শীতের বাতাস লাগিয়া কাঁপিতেছে। রাস্তায় লোক নাই, আবছায়া পথের দুই ধারে দীপস্তম্ভগুলি সারি দিয়া এই নিশীথ নিস্তব্ধতাকে পাহারা। দিতেছে।

পাঁচ মিনিট দাঁড়াইয়া আছি, উত্তপ্ত মুখে বাতাসের শীতল করস্পর্শে মন্দ লাগিতেছে না। হঠাৎ রাস্তার এক দিক হইতে কিড়িং কিড়িং শব্দ কানে আসিল। সাইকেল আসিতেছে। একটু বিস্মিত হইয়া সেই দিকে তাকাইলাম। সাইকেল দেখা গেল না, এখনও দূরে আছে। কিন্তু রাস্তা নির্জন, সাইকেল চালক কাহাকে দেখিয়া ঘন্টি বাজাইল?

তাকাইয়া রহিলাম।

অস্পষ্টভাবে দেখা গেল, এক জোড়া সাইকেল পাশাপাশি আসিতেছে, তাদের ল্যাম্প নাই। সহসা মধুর হাসির শব্দ কানে আসিল। দুইজন একসঙ্গে হাসিতেছে, একজন পুরুষ একজন স্ত্রীলোক। কিন্তু দুজনের হাসি এক সুরে বাঁধা। একজন উদারা, একজন মুদারা।

সাইকেল দুটা ক্রমশ কাছে আসিতেছে, এবার তাহাদের স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি। হঠাৎ ঘাড়ের রোঁয়া শক্ত হইয়া খাড়া হইয়া উঠিল। সাইকেল দুটা আসিতেছে বটে, কিন্তু তাহাদের আরোহী নাই। আরোহীর আসন শূন্য, কেবল দুটা জড় সাইকেল পরস্পর সমান্তরালে চলিয়া আসিতেছে!

বুকের রক্ত হিম হইয়া গিয়াছে, তবু বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া আছি। সাইকেল দুটা স্বচ্ছন্দ গতিতে আসিতেছে, কোনও ত্বরা মাই। ঠিক আমার সামনে দিয়া যাইতে যাইতে থামিয়া গেল; মনে হইল অদৃশ্য আরোহীরা সাইকেল হইতে নামিল। নিথর বাতাসে যেন ফিসফিস কথা বলার আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। তারপর সাইকেল দুটি বামনরাওয়ের দোকানের দিকে গেল। দরজা বন্ধ, সাইকেল দুটি দরজার গায়ে হেলিয়া দাঁড়াইল। কিড়িং করিয়া একবার ঘন্টি বাজিল।

তারপর আর কোনও সাড়া-শব্দ নাই।

ব্যালকনি হইতে আমি ঘরে আসিয়া বসিলাম। এ কি চোখের ভুল? কিন্তু না, শুধু চোখের ভুল হইতে পারে না; হাসি শুনিয়াছি, ঘণ্টির আওয়াজ শুনিয়াছি! তবে কি অনিদ্রাবশতঃ আমার মস্তিষ্ক এতই উত্তপ্ত হইয়াছে যে জাগিয়া দুঃস্বপ্ন দেখিতেছি? কিংবা

হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়াতে আমি আবার তাড়াতাড়ি ব্যালকনিতে ফিরিয়া গেলাম।

বামনরাওয়ের দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনি বন্ধ আছে, কিন্তু সাইকেল দুটা অদৃশ্য হইয়াছে।

.

শেষরাত্রির দিকে ঘুমাইয়া পড়িলাম; যখন ঘুম ভাঙিল তখন নটা বাজিয়া গিয়াছে। প্রাতভ্রমণের আর সময় নাই; কারণ পুণায় শীতকালেও রৌদ্র বেশ কড়া। প্রাতঃকৃত্য সারিয়া ব্যাকনিতে গিয়া দাঁড়াইলাম।

বামনরাওয়ের দোকান খোলা রহিয়াছে, রাস্তায় কর্মদিবসের ব্যস্ত তৎপরতা; মোটর টাঙা অটো-রিক্সা ও সাইকেলের ছুটাছুটি। কাল রাত্রি একটার সময় এই পথের ছায়াচ্ছন্ন নির্জনতায় দুটি স্বয়ংচল সাইকেল আমার সম্মুখ দিয়া চলিয়া গিয়াছিল বিশ্বাস করা কঠিন।

দুপুরবেলা বামনরাও সাইকেল মার্টে গেলাম।

সাইকেল-ভাড়াটে খদ্দেরের ভিড় কমিয়া গিয়াছে, বামনরাও মোটা একটা খাতায় হিসাব লিখিতেছে। বলিল, কাকা, আজ তুমি বেড়াতে গেলে না?

মারাঠীরা যাহাকে খাতির করে তাহাকে কাকা বলিয়া ডাকে, কিন্তু সকলকেই তুমি বলে।

আমি একটি লোহার চেয়ারে বসিয়া বলিলাম, না, ওবেলা যাব। বামনরাও, কাল রাত্রি একটার সময় তোমার কোনও খদ্দের সাইকেল ফেরত দিতে এসেছিল?

বামনরাও চকিতে আমার পানে চাহিল, তারপর যেন চিন্তা করিতেছে এমনি ভাবে ঘাড় উঁচু করিয়া গাল চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল, কই না তো! এ কথা কেন জিজ্ঞাসা করছ কাকা?

বলিলাম, কাল রাত্রে আমার ঘুম হচ্ছিল না, ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হল কারা দুটো সাইকেল রেখে চলে গেল।

সাইকেলে যে আরোহী ছিল না সে কথা বলিলাম না।

বামনরাও খাতার ওপর চোখ রাখিয়া ধীরে ধীরে বলিল, তুমি ভুল দেখেছ কাকা। অত রাত্রে কে সাইকেল ফেরত দিতে আসবে! মারাঠীরা রাত্রি দশটার মধ্যে সব ঘুমিয়ে পড়ে। তোমারও বেশী রাত জাগা ভাল নয়; কাহিল শরীর, আবার অসুখে পড়ে যাবে।

দেখিলাম বামনরাও সত্য গোপন করিতেছে, নিশ্চয়ই ভিতরে কিছু আছে। তাহাকে আর প্রশ্ন করিলাম না, চলিয়া আসিলাম। মনে মনে স্থির করিলাম, আজ রাত্রেও পাহারা দিব।

মধ্যাহ্নে বেশ খানিকটা ঘুমাইয়া লইয়া বৈকালে বামনরাওয়ের সাইকেল লইয়া বেড়াইতে বাহির হইলাম। বামনরাও আমার পানে বক্র কটাক্ষপাত করিল। তাহার ভাব-গতিক দেখিয়া সন্দেহ আরও দৃঢ় হইল। যদি কিছুই নয়, তবে লোকটা এমন ঘটি-চোরের মতো তাকাইতেছে কেন?

.

রাত্রি সাড়ে নটার পর আহার সম্পন্ন করিয়া ঘরের আলো নিভাইলাম, ব্যাল্কনিতে চেয়ার লইয়া বসিলাম। এমনভাবে বসিলাম যাহাতে আমাকে বাহির হইতে দেখা না যায়, অথচ আমি সাইকেলের দোকান দেখিতে পাই। বসিয়া বসিয়া দেখিতে লাগিলাম নগর ধীরে ধীরে ঘুমাইয়া পড়িতেছে। দোকানগুলি একে একে বন্ধ হইয়া গেল। রাস্তায় যানবাহনের চলাচল বিরল হইয়া থামিয়া গেল।

বামনরাও প্রায় সাড়ে দশটার সময় দোকান বন্ধ করিল, দুটি সাইকেল বাহিরে পড়িয়া রহিল। দরজা লাগাইবার সময় সে উৎকণ্ঠিত চক্ষে আমার ব্যাকনির দিকে তাকাইল।

আমি ঘাপটি মারিয়া রহিলাম।

নগর-গুঞ্জন ক্ষান্ত; রাত্রির গাঢ়তা ঘনীভূত হইতে লাগিল। পথের দীপস্তম্ভমালা নিষ্পলক চাহিয়া আছে। আকাশে লুব্ধক নক্ষত্র মৃগশিরাকে ধরিবার জন্য ছুটিয়াছে কিন্তু ধরিতে পারিতেছে না।

ঘড়িতে সাড়ে এগারটা। গায়ে বালাপোশ সত্ত্বেও বেশ কাঁপুনি ধরিয়াছে। আমি সঙ্গে একটি মঙ্কি ক্যাপ আনিয়াছি। সেটি মাথায় পরিলে কান দিয়া ঠাণ্ডা ঢুকিতে পারিবে না। বামনরাওয়ের দোকানের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম বন্ধ দরজার সামনে সাইকেল দুটি পরস্পর ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

চট করিয়া ঘরে গিয়া মঙ্কি ক্যাপ পরিয়া ফিরিয়া আসিলাম। বোধ হয় আধ মিনিটও সময় লাগে নাই। কিন্তু এ কি! ইহারই মধ্যে সাইকেল দুটি অদৃশ্য হইয়াছে।

বোকার মতো চাহিয়া রহিলাম।

দূরে টিং টিং করিয়া সাইকেলের ঘণ্টি বাজিল, একটু মিষ্ট হাসির আওয়াজ ভাসিয়া আসিল। উহারা কি ওত পাতিয়া ছিল? আমি যে পাহারা দিতেছি তাহা জানিতে পারিয়াছে? আমার ঘাড়ের রোঁয়া আবার কাঁটা দিয়া উঠিল।

কিন্তু ছাড়িব না। একবার বোকা বনিয়াছি, দ্বিতীয়বার বোকা বনিব না। যখন সাইকেল লইয়া গিয়াছে তখন নিশ্চয় ফিরাইয়া দিতে আসিবে।

বামনরাওয়ের দরজার ওপর চোখ রাখিয়া বসিয়া রহিলাম। একটা বাজিল। একটু সজাগ হইয়া বসিলাম। দুটা বাজিল। এখনও সাইকেলের দেখা নাই। মাঝে মাঝে মনটা খালি হইয়া যাইতেছে, চোখ দুটা জুড়িয়া আসিতেছে—

চোখে কিছু দেখিলাম না, কানেও কিছু শুনিলাম না, হঠাৎ পঞ্চইন্দ্রিয় সতর্কভাবে সজাগ হইয়া উঠিল।

সাইকেল দুটা চুপিচুপি বামনরাওয়ের দ্বারের দিকে যাইতেছে। নিঃশব্দে তাহারা পরস্পরের গায়ে হেলান দিয়া দাঁড়াইল; টুং করিয়া একবার ঘণ্টির মৃদু শব্দ হইল। তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ নাই। যাহারা সাইকেল চড়িয়া আসিয়াছিল তাহারা চলিয়া গিয়াছে।

পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট কাটিয়া গেল।

তন্দ্রাবেশ ছুটিয়া গিয়াছে, নিষ্পলক চক্ষে সাইকেল মার্টের পানে চাহিয়া আছি…খুট করিয়া শব্দ হইল। দরজা একটু খুলিয়া বামনরাও গলা বাড়াইয়া এদিক ওদিক দেখিল, তারপর একে একে সাইকেল দুটি তুলিয়া ভিতরে লইয়া গেল।

দরজা আবার বন্ধ হইল।

.

পরদিন দ্বিপ্রহরে সাইকেল মার্টে গেলাম। বামনরাও একলা ছিল। তাহাকে বলিলাম, বামনরাও, কাল রাত্রে আমি সব দেখেছি।

বামনরাওয়ের মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল, কী! কি দেখেছ কাকা?

বলিলাম, যতটুকু চোখে দেখা যায় দেখেছি। অশরীরী ওরা কারা? আমি জানতে চাই।

বামনরাও ভীত স্বরে বলিল, কাকা, একথা কাউকে বোলো না। জানাজানি হলে ওরা আর আসবে না। ওরা ভারি পয়মন্ত, ওরা যদি না আসে, আমার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

বেশ, কাউকে বলব না। কিন্তু ব্যাপার আমাকে বলতে হবে।

বামনরাও কিছুক্ষণ ঘাড় নিচু করিয়া ভাবিল। শেষে অনিচ্ছাভরে বলিল, আজ রাত্রে দোকান বন্ধ করবার পর তুমি এসো। তখন বলব।

সে-রাত্রে বন্ধ দোকানঘরে বসিয়া বামনরাওয়ের কাহিনী শুনিলাম। কাহিনীতে চমকপ্রদ নূতনত্ব কিছু নাই, কালে কালে দেশে দেশে এরূপ ঘটনা বহুবার ঘটিয়াছে; যৌবনের কাছে মানুষের সংঘবদ্ধ বিষয়বুদ্ধি পরাভূত হইয়াছে। আমরা যখন মানুষের দুঃখদুর্দশা দীনতার কথা চিন্তা করি তখন ভুলিয়া যাই, মানুষ কোনও দিন জীবনের কাছে মাথা হেঁট করে নাই, সে চিরদিন অপরাজিত।

বামনরাও বলিল, বছর তিনেক আগেকার কথা। আমি তখন এখানে নতুন দোকান খুলেছি। সাইকেলের দোকানের পক্ষে জায়গাটা ভাল। কাছেই এস্ পি কলেজ, অনেক ছেলেমেয়ে সেখানে পড়ে। বেশীর ভাগ তারাই সাইকেল ভাড়া নিয়ে আমার দোকান চালু রেখেছে—

এই পর্যন্ত বলিয়া বামনরাও থামিল, উৎকর্ণ হইয়া যেন কি শুনিল। তারপর বলিল, একটু বসো, আমি আসছি—

সে দরজা খুলিয়া দুইটি সাইকেল বাহিরে রাখিয়া আসিল; একটি মেয়েদের সাইকেল, একটি পুরুষদের।

বাহিরে তখন নিশুতি হইয়া গিয়াছে।

বামনরাও ফিরিয়া আসিয়া বসিল।

তাহার স্ত্রী দুই বাটি গরম চা রাখিয়া গেল। একটি বাটি আমার দিকে ঠেলিয়া দিয়া এবং অন্যটি নিজের কোলের কাছে টানিয়া লইয়া বামনরাও আবার বলিতে শুরু করিল—

এস্ পি কলেজে একটি ছেলে পড়ত, তার নাম মধুকর। বোধ হয় উচু কেলাসে পড়ত, আমি যখন তাকে দেখি তখন তার বয়স একুশ-বাইশ। চমৎকার চেহারা, টক্টকে রঙ, লম্বা ছিপছিপে গড়ন। মারাঠীদের মধ্যে এমন দেখা যায় না, যেন ময়ূরবাহন কার্তিক। খুব ভাল ক্রিকেট খেলতে পারত।

আমি দোকান খোলবার পর মধুকর প্রায়ই আসত। তার নিজের সাইকেল ছিল না, হেঁটে কলেজে আসত। কোথাও বেড়াতে যাবার ইচ্ছে হলে আমার কাছ থেকে সাইকেল ভাড়া নিয়ে যেত। কত ছেলেই তো আসে, কিন্তু মধুকরের চেহারায় এমন একটি মিষ্টতা ছিল, ব্যবহারে এমন শান্ত ছেলেমানুষী ছিল যা সচরাচর চোখে পড়ে না। বড় বংশের ছেলে, চিৎপাবন ব্রাহ্মণ, কিন্তু শরীরে এতটুকু অহঙ্কার ছিল না।

একদিন মধুকরের সঙ্গে একটি মেয়ে এল। সম্প্রতি স্কুল থেকে পাস করে কলেজে ঢুকেছে। ছোটখাটো মেয়েটি, বয়স বড়জোর সতের; মধুকরের মতো সুন্দর নয়, কিন্তু ভারি মিষ্টি নরম চেহারা। নাম মালতী।

মধু আর মালতী দুটি সাইকেল নিয়ে চলে গেল। এদেশে মেয়েদের পর্দা নেই, কোনও দিন ছিল না; উত্তর ভারতের ওই ম্লেচ্ছ বর্বরতা মারাঠাদেশ কখনো স্বীকার করে নেয়নি। আমাদের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়ে, একসঙ্গে খেলাধুলো করে। এখানে ছেলেমেয়েরা চোখাচোখি হলেই প্রেমে পড়ে না; কিন্তু যখন সত্যিই প্রেমে পড়ে তখন মা বাপকে গিয়ে বলে, মা বাপ বিয়ে দেন। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলে কেউ কিছু মনে করে না, টিপ্পনীও কাটে না।

যাহোক, মধু আর মালতী মাঝে মাঝে আসে, সাইকেল নিয়ে বেড়াতে বেরোয়, আবার সন্ধ্যার পরেই সাইকেল ফেরত দিয়ে যায়। অন্য ছেলেমেয়েরাও আসে। কাছে পিঠে অনেক ভোলা জায়গা। আছে; যেখানে একটু সবুজ ঘাসের টুকরো পায় সেখানে বসে দুদণ্ড গল্প-সল্প করে, তারপর যে-যার ঘরে ফিরে যায়।

বামনরাও চুপ করিল, উৎকর্ণ হইয়া শুনিল, তারপর নিম্নস্বরে বলিল, ওরা সাইকেল নিয়ে গেল—

আমার কৌতূহল হইল; দ্বার খুলিয়া উঁকি মারিলাম। সাইকেল দুটা সত্যই অদৃশ্য হইয়াছে।

ফিরিয়া আসিয়া বসিলে বামনরাও বলিল, যাহোক, তারপর শোন একদিন অন্য দুটি কলেজের ছেলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে শুনতে পেলাম। মালতীও খুব বনেদী ঘরের মেয়ে, কিন্তু দুই বংশে ভীষণ শত্রুতা। আজকের শত্রুতা নয়, সেই পেশোয়াদের আমল থেকে চলে আসছে। সেকালে দুই পক্ষের রাস্তা-ঘাটে দেখা হলে ছোরাছুরি চলত, এখন দুপক্ষ মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। তার যদি জানতে পারে মধু আর মালতী একসঙ্গে সাইকেল চড়ে বেড়াতে যায়, কুরুক্ষেত্র কাণ্ড হবে।

কিছু দিন পরে দেখলাম মধু আর মালতী সাবধান হয়েছে। একসঙ্গে দোকানে আসে না; সন্ধ্যের পর মধু দুখানে সাইকেল নিয়ে যায়, মালতী বোধ হয় আড়ালে কোথাও লুকিয়ে থাকে। তারপর সকলের চোখ এড়িয়ে দুজনে বেরোয়। ওদের বাড়ির লোকেরা বোধ হয় কিছু সন্দেহ করেছিল।

একদিন রাত্রি সাড়ে আটটার সময় তারা সাইকেল ফেরত দিতে এসেছে। দুজনের মুখ তৃপ্তিতে ভরা। মালতী একবার মধুকরের মুখের পানে তাকাল। সেই চাউনি দেখে বুঝতে পারলাম, এ শুধু যুবক-যুবতীর মধ্যে সহজ বন্ধুত্ব নয়, মালতীর বুক মধুতে ভরে উঠেছে।

-কাকা, আমার বয়স হয়েছে, ভালবাসাবাসির ব্যাপার অনেক দেখেছি। দুটি ছেলে-মেয়ের মধ্যে ভালবাসা হল, তারপর যখন তারা দেখল বিয়ে হবার নয়, তখন দুচার দিন কান্নাকাটি করল, মন খারাপ করে রইল। ক্রমে আবার সব ঠিক হয়ে গেল। এ কিন্তু সে জিনিস নয়। এ একেবারে জীবন-মরণের ব্যাপার। মধু আর মালতী প্রাণ দেবে তবু পরস্পরকে ছাড়বে না।

হঠাৎ একদিন ওদের যাওয়া-আসা বন্ধ হয়ে গেল। দশ দিন আর মধুর দেখা নেই। তারপর একদিন দুপুরবেলা মধু এল, বলল, একটা সাইকেল দাও একটু ঘুরে আসি।

দেখলাম, তার মুখ-চোখ শুকনো, চুল রুক্ষ, যেন কতদিন স্নান করেনি, খায়নি।

আমি বললাম, একটা সাইকেল?

সে বলল, হ্যাঁ, মালতীকে ওরা কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে, ঘরে বন্ধ করে রেখেছে।

মধু দুই হাত মুঠি করে কিছুক্ষণ ঘোলাটে চোখে চেয়ে রইল, তারপর সাইকেল না নিয়েই চলে গেল।

তিন-চারদিন পরে বর্ষার বৃষ্টি নেমেছে। পুণায় বৃষ্টি মুষলধারে বড় হয় না। রিম ঝিম্‌, রিম ঝিম; চারিদিক ঠাণ্ডা। আমার দোকানে রাত্রি নটার মধ্যেই খদ্দের আসা বন্ধ হয়ে গেছে। আন্দাজ সাড়ে নটার সময় আমি দোকান বন্ধ করে শুতে যাচ্ছি, দরজায় ঠক্ ঠক্ টোকা পড়ল। দোর খুলে দেখি— মধু আর মালতী।

দুজনের জামা কাপড় ভিজে, চোখে মুখে বাঁধন-ছেঁড়া উল্লাস। মধু বলে উঠল, বামনরাও মালতীকে দোতলার ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল। ও ব্যালকনি থেকে বিছানার চাদর ঝুলিয়ে নেমে এসেছে।

কী ডাকাত মেয়ে! মালতীর দিকে চেয়ে দেখলাম, তার মাথার চুল ভিজে, মুখে বিন্দু বিন্দু জলের ছিটে লেগেছে, কাপড়-কাপড় একটু এলোমেলো। সে মুখ টিপে হাসছে।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, পালিয়ে এসেছে! তারপর?

মধু বলল, তারপর আর কী? একটু বেড়িয়ে-টেড়িয়ে আবার নিজের ঘরে উঠে শুনে থাকবে, কেউ জানতে পারবে না। মধু জোরে হেসে উঠল— দাও, দাও, শিগগির সাইকেল দাও।

অ্যাাঁ! এই বর্ষার রাতে বেড়াতে বেরুবে!

বর্ষা কই? এর নাম কী বর্ষা! দাও সাইকেল।

দুজনে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হল আমিও ওদের প্রেমের ষড়যন্ত্রে শরিক হয়ে পড়েছি।

তারপর বার তিনেক ওরা সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল। আমি দোকান বন্ধ করবার পর এসে দোরে টোকা দিত, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেত; ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এসে সাইকেল রেখে বাড়ি ফিরে যেত।

আমি ওদের দেখতাম আর ভাবতামকী দুঃসাহসী ওরা! একবার যদি ধরা পড়ে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। এ রকম ব্যাপারে মেয়ে-পক্ষেরই অপমান বেশী, ওরা যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে মধুকে প্রাণে বাঁচতে হবে না।

হলও তাই। এ ব্যাপার বেশীদিন চলল না। একদিন রাত্রি এগারোটার সময় আমার দোরে ধাক্কা পড়ল। দোর খুলে দেখি মধু আর মালতী— দুজনেরই দিশাহারা অবস্থা।

মধু বলল, বামনরাও, শিগগির সাইকেল দাও, ওরা জানতে পেরেছে।

বললাম, সে কি! এত রাত্রে তোমরা কোথায় যাবে?

তা জানি না

এই সময় দূরে মোটর বাইকের ফট ফট শব্দ শোনা গেল। মালতী চমকে উঠে বলল, ওই দাদা আসছে!

ওরা আর দাঁড়াল না, দুটো সাইকেল নিয়ে বিদ্যুতের মতো বেরিয়ে গেল।

আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই মোটরবাইক এসে দোকানের সামনে থামল। আরোহী চড়া গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করল–একটা মেয়ে আর একটা ছেলে এখান থেকে সাইকেল নিয়ে গেছে?

আমি ঢোক গিলে বললাম, হ্যাঁ।

সে প্রশ্ন করল, কোন্ দিকে গেছে?

বললাম, তা দেখিনি।

লোকটা লাফিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।

তার কোমরে একটা খাপসুদ্ধ ছোরা গোঁজা রয়েছে। ভারি জোয়ান চেহারা কিন্তু মুখের আদল থেকে চেনা যায়, মালতীর দাদা। সে আমাকে ধমক দিয়ে বলল–তুই নিশ্চয় জানিস। বল্ তারা কোথায় গেছে।

কাকা, আমি মারাঠী, মিষ্টি কথার গোলাম; কিন্তু চোখ রাঙিয়ে আমাকে কেউ ভয় দেখাতে পারে। আমি একটা স্প্যানার তুলে নিয়ে বললাম, যাও আমার দোকান থেকে, নইলে মাথা ফাটিয়ে দেব।

এই সময় আর একটা মোটরবাইক এসে দাঁড়াল। তার আরোহী ডেকে বলল, জয়ন্ত! খবর পেয়েছি, ওরা সিংহগড়ের দিকে গেছে।

মালতীর ভাই একলাফে গিয়ে নিজের মোটরবাইকে বসল।

দুটো মোটর বাইক গর্জন করে ছুটে বেরিয়ে গেল।

সে রাত্রে আমি আর কিছু দেখিনি।

পরে জানতে পেরেছিলাম, মধু আর মালতী সিংহগড় পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। তারা যখন খড়গবৎসলার হ্রদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, সেই সময় পিছনে মোটর বাইকের গর্জন শুনতে পায়, তারা সাইকেলসুদ্ধ হ্রদে লাফিয়ে পড়েছিল।

বামনরাও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল।

.আমিও ভাবিতে লাগিলাম, এ ছাড়া এ গল্পের অন্য পরিণতি কি ছিল না? যাহারা পরস্পরকে একান্তভাবে চায় তাহারা ব্যর্থ হইয়া আত্মহত্যা করে কেন? প্রেম কি তবে একটা সাময়িক উন্মাদনা? কিংবা সংসার এত প্রেম পছন্দ করে না তাই তাহার এই পরিণাম?

কিন্তু গল্প এখনও শেষ হয় নাই। বলিলাম, তারপর?

বামনরাও একটা নিশ্বাস ফেলিয়া চোখ তুলিল।

তারপর দিন দশেক কেটে গেল। ওদের মৃত্যু নিয়ে শহরে বেশ হৈচৈ হয়েছিল, তাও ক্রমে নিভে এল। দুটি অপরিণত বুদ্ধি ছেলেমেয়ের হঠকারিতার কথা কে বেশীদিন মনে করে রাখে! দৈনিক কাগজে খানিক লেখালেখি হল, সাপ্তাহিক পত্রিকায় কবিতা বেরুল, তারপর সব চুপচাপ।

একদিন বেশ বর্ষা নেমেছে, আমি দশটার মধ্যেই দোকানপাট বন্ধ করে শুয়ে পড়েছি। তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় দোরে খুট খুট শব্দ হল। তন্দ্রা ছুটে গেল, আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। ঠিক মধু যেভাবে টোকা দিত সেই টোকা। কিছুক্ষণ চুপ করে বিছানায় বসে রইলাম। আবার টোকা পড়ল। তখন উঠে দরজা খুললাম।

বাইরে কেউ নেই। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে, জনমানুষ নেই। দরজা বন্ধ করে যেই পিছু ফিরেছি। অমনি আবার টোকা পড়ল। আবার দরজা খুললাম…কেউ নেই। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

এইরকম বার পাঁচেক হবার পর বুঝতে পারলাম। ওরা এসেছে, সাইকেল চায়। দুটো সাইকেল বাইরে রেখে দোর বন্ধ করে দিলাম। আর টোকা পড়ল না। দশ মিনিট পরে দরজা খুলে সন্তর্পণে গলা বাড়ালাম, সাইকেল অদৃশ্য হয়েছে। ঘণ্টাখানেক বাদে বাইরে কিড়িং শব্দ হল।

দোর খুললাম। সাইকেল ফিরে এসেছে।

সেই থেকে প্রায় রোজ এই ব্যাপার চলছে। তুমি নিজের চোখে দেখে ফেলেছ, তোমার কাছে লুকোবার চেষ্টা বৃথা। আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানে না। ওরা ভারি পয়মন্ত, দুদিন

এলে আমার খদ্দের কমে যায়। কাকা, তুমি কাউকে বলো না।

বলব না, বলিয়া আমি উঠিলাম।

এই সময় বাহিরে সাইকেলের মৃদু ঘন্টি বাজিল— কিড়িং।

আমি বামনরাওয়ের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। সে গিয়া দ্বার খুলিল। দেখিলাম, সাইকেল দুটি পরস্পরের গায়ে হেলান দিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *