জমির দলিলটা
জমির দলিলটা বের করবেন বলে দুপুরবেলা মন্টুরামবাবু তাঁর দোতলার শোয়ার ঘরের মস্ত কাঠের আলমারিটা খুলতেই ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে একটা লোক বেরিয়ে এল। মন্টুরামবাবু তো হাঁ। এই পুরনো আর পেল্লায় আলমারিটা তাঁর ঠাকুরদার আমলের জিনিস। এর আগে কখনও তিনি আলমারি থেকে মানুষ বেরোতে দেখেননি। বছর খানেক আগে একবার একটা ইঁদুর বেরিয়েছিল বটে! আর এক-আধবার আরশোলা। কিন্তু মানুষ কখনও বেরোয়নি। তাই তিনি ভারী তাজ্জব হয়ে লোকটাকে দেখছিলেন।
লোকটা ভারী বেঁটেখাটো। সাড়ে চার ফুটের এদিক-ওদিক হবে, রোগাভোগা চেহারা। পরনে আঁট করে মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, গায়ে একটা কালচে রঙের পিরান আর গলায় মাফলারের মতো জড়ানো একটা লাল গামছা। বেরিয়েই লোকটা হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “আর একটু হলেই তো খুনের মামলায় পড়ে যেতেন মশাই!”।
মন্টুরাম এখনও ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা সামলে উঠতে পারেননি। কথাটা শুনে ভড়কে গিয়ে বললেন, “খুনের মামলা! বলো কী হে? হঠাৎ খুনের মামলায় পড়তে যাব কেন?”
“এই যে বারো ঘণ্টার উপর আমাকে আলমারির মধ্যে আটকে রাখলেন, তাতে তো এতক্ষণে আমার মরে কাঠ হয়ে যাওয়ার কথা। প্রাণায়াম-টানায়াম করা ছিল বলে প্রাণটা এখনও দেহ ছেড়ে বেরোয়নি। কিন্তু খিদে-তেষ্টা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি! আগে একটু ঠান্ডা জল আর গরম দুধের ব্যবস্থা করুন দিকি। তারপর যা হোক চাট্টি মাছের ঝোল-ভাত হলেই চলবে। গায়ে মোটে জোরই পাচ্ছি না মশাই।”
মন্টুরামবাবুর মাথাটা এখনও পরিষ্কার হয়নি। তিনি বললেন, “রোসো বাপু, আমার মাথার ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা এখনও যায়নি। ব্যাপারটা আমাকে ধীরেসুস্থে বুঝতে দাও।”
লোকটা উবু হয়ে বসে ধুতির খুঁটে মুখ মুছে বলল, “তবে তো মুশকিলেই ফেললেন মশাই৷ খুনের মামলা থেকে বেঁচে গিয়ে কি শেষে ব্রহ্মহত্যার পাপে পড়বেন? খিদে-তেষ্টায় যে আমার প্রাণ যায়!”
“ব্রহ্মহত্যা! তুমি কি ব্রাহ্মণ নাকি?”
“তা ধরুন একরকম তাই। ব্রহ্ম কার ভিতরে নেই বলুন। ঝালে, ঝোলে, অম্বলে সর্বত্র রয়েছেন।”
“দাঁড়াও বাপু, আমার মাথাটা আরও গুলিয়ে দিয়ো না। আগে ব্যাপারটা বুঝতে দাও। আলমারি থেকে আস্ত একটা জ্যান্ত মানুষ বেরিয়ে এলে কার মাথার ঠিক থাকে বলো তো?”
লোকটা জুলজুলে চোখে মন্টুরামবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “আজ্ঞে, সেই কথাটাই তো বলতে চাইছি। আলমারি থেকে জ্যান্ত বেরোলুম বলেই তো জোর বেঁচে গেলেন মশাই। ধরুন, যদি আমার বদলে আমার লাশ বেরোত, তা হলে যাবজ্জীবন না হয় তো ফাঁসি যে বাঁধা ছিল আপনার।”
মন্টুরামবাবু মিটমিট করে লোকটার আগাপাশতলা দেখে নিয়ে বললেন, “তুমি বেশ ঘোড়েল লোক দেখছি। আমার ঘরে ঢুকে আমারই আলমারির মধ্যে সেঁধিয়ে বসে রইলে, ফের আমাকেই ফাঁসির ভয় দেখাচ্ছ! তা বাপু, অত কথায় কাজ নেই। কানাই দারোগাকে খবর পাঠাচ্ছি, সে-ই এসে বুঝুক কার যাবজ্জীবন আর কার ফাঁসি হওয়া উচিত।”
এ কথায় লোকটা ভারী ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠল, “আজ্ঞে, দু’জন ভদ্রলোকের মধ্যে ভাল-মন্দ দুটো কথা হচ্ছে, তার মধ্যে দারোগা-পুলিশ এনে ফেলা কি ঠিক হবে বাবু?”
মন্টুরামবাবু একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, “ওহে বাপু, দারোগা-পুলিশ তো পরের কথা, তার আগে এ বাড়ির লোকেরাই কি ছেড়ে কথা কইবে বলে ভেবেছ? আমার তিন ভাই, সাত ভাইপো আর দুই ভাগনে রয়েছে যে, তারা সবাই বেজায় চড়া মেজাজের লোক। তাদের হাতে উত্তমমধ্যম খেয়ে যদি বা বেঁচে যাও, তারপরে আছে গাঁয়ের লোকের হাটুরে কিল। তারপরও কানাই দারোগার জন্য যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবে না?”
লোকটা দেওয়ালঘড়ির দিকে চেয়ে হঠাৎ শশব্যস্তে বলে উঠল, “ইস, বেলা বারোটা বাজে! কথায় কথায় বড্ড দেরি হয়ে গেল কর্তা। বাড়ির সবাই ভাবছে। তা হলে…।”
“আহা, ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? আলাপ-পরিচয় হল না, দুটো ভালমন্দ কথা হল না, হুট করে চলে গেলেই কি হয়? বলি, নাম কী তোমার?”
লোকটা হাল ছেড়ে দিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আজ্ঞে, সুধীর গায়েন নামটা কি চলবে?”
মন্টুরামবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “খুব চলবে। না চলার কী আছে? আমার মন্টুরাম নাম যদি চলে গিয়ে থাকে, তা হলে তো সেই তুলনায় সুধীর দিব্যি নাম।”
“যে আজ্ঞে, সবাই তাই বলে বটে, সুধীর নামটা নাকি বড্ডই ভাল। বেশ ঠান্ডা, সুস্থির নাম। এখন আপনার পছন্দ হলেই হল।”
“না না, নাম আমার পছন্দই হয়েছে হে। তবে কিনা কানাই দারোগার পছন্দ হলেই হয়।”
সুধীর একগাল হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তা হলে কথাবার্তা
তো সব হয়েই গেল, এবার বরং রওনা হয়ে পড়ি! রোদটা এর পর বড় চড়ে যাবে, পথও তো কম নয়!”
“বাপু সুধীর, এ বাড়িতে ঢোকা যত সহজ, বেরোনো তত সোজা নয়।”
সুধীর আঁশটে মুখে বলে, “ঢোকাটাও যে খুব সহজে হয়েছে, তা মোটেই নয়। প্রথমে দু-দুটো সড়ালে কুকুর!”
“হ্যাঁ-হ্যাঁ, বাঘা আর হালুম।”
“তারপর একটা রাক্ষসের মতো চেহারার পাহারাদার।”
“ওই হল রঘু পালোয়ান।”
“তারপর ডাইনির মতো চেহারার তিনটে ঝগড়ুটে বুড়ি।”
“হেঃ হেঃ, তেনারা আমার তিন পিসি, সর্বদা চতুর্দিকে নজর রাখেন।”
“একজন বিচ্ছিরি রাগী চেহারার সিঁড়িঙ্গে বুড়ো।”
“ঠিক চিনেছ, উনি হলেন আমার শ্রদ্ধেয় খুড়োমশাই। তা বাপু, তোমার বেশ এলেম আছে দেখছি। এত লোককে ফাঁকি দিয়ে এ বাড়িতে ঢোকা তো সোজা কথা নয়।”
“আজ্ঞে, ঢুকতে আমার কালঘাম বেরিয়ে গিয়েছে। তবে কিনা বাঁকাবাবার কাছে গা-ঢাকা দেওয়ার বিদ্যেটা শেখা ছিল বলে রক্ষে। তবে শেষরক্ষে বলেও একটা কথা আছে। সেইটেই যা হল না। আপনার মতো আনাড়ির কাছে ধরা পড়ে যেতে হল।”
“তবেই বোঝো, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কি না।”
সুধীর ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলে, “খুব নড়ে কর্তা, খুব নড়ে। আর ওই ধর্মের কলে বাতাস দেওয়ার জন্যই তো আমার আসা কিনা।”
মন্টুরাম একটু থতমত খেয়ে বলেন, “তার মানে? তুমি আবার কোন ধর্মের কলে নাড়া দিতে এলে হে? চোর-ডাকাতদেরও আজকাল ধর্মের নাড়ি টনটনে হয়ে উঠেছে নাকি?”
“তা উঠবে না? চোর-ডাকাতেরও ধর্ম আছে কর্তা। এ লাইনে কি বিপদআপদ কম নাকি? ধর্ম না মানলে চলে?”
“তা বটে। কথাটা ভেবে দেখার মতো। তা বাপু সুধীর, কোন ধর্ম কর্ম করতে এ বাড়িতে ঢুকেছিলে, বলো তো?”
“আজ্ঞে, খিদে পেলে খাওয়াটাও তো ধর্ম, নাকি কর্তা?”
“তা তো বটেই।”
“আমিও ওই পেটের ধর্ম পালন করতেই বিপদ ঘাড়ে করে এই বাড়িতে ঢুকেছিলুম মদন তপাদারের হারানো বাক্সটার খোঁজে। কড়ার ছিল, বাক্সটা উদ্ধার করতে পারলে হাজার পাঁচেক টাকা পাওয়া যাবে।”
মন্টুরাম কিছুক্ষণ হাঁ করে সুধীরের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “কে মদন তপাদার? আর কীসেরই বা বাক্স, এসব আবোল তাবোল হেঁয়ালি বলে পার পাবে ভেবেছ?”
সুধীর হাতজোড় করে বলে, “আজ্ঞে, অপরাধ নেবেন না। এসব আমার কথা নয়। আমাকে যেমন বলা হয়েছিল, তেমনই বলছি।”
“হেঁয়ালি ছেড়ে ঝেড়ে কাশো তো বাপু।”
“কাশছি, কাশছি। শুনেছিলুম যেন, বছর দশেক আগে জাদুকর মদন তপাদার এক সন্ধেবেলায় আপনার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিলেন।”
“বলি, মদন তপাদারটা কে বটে হে? নামটা জীবনে শুনেছি বলেই তো মনে হচ্ছে না।”
“আজ্ঞে, তিনি ধনপতি বা হুডিনি নন, নিতান্তই গেঁয়ো আর গরিব এক জাদুকর। গাঁয়েগঞ্জে, হাটে-বাজারে ঘুরে-ঘুরে ম্যাজিক দেখাতেন। পসার টসার তেমন ছিল না। হতদরিদ্র অবস্থা। ছেঁড়া পাতলুন, তালি দেওয়া জামা, তাপ্পি মারা জুতো, এই ছিল তাঁর পোশাক। তবে একটা টুপি পরতেন। তার ধারণা ছিল, টুপি পরলে বোধহয় কেষ্টবিষ্ট্রর মতো দেখায়। রোগা, সিঁড়িঙ্গে চেহারার মানুষ, মনে পড়ছে কি কর্তা?”
“না হে বাপু, মনে পড়ছে না। মনে পড়ার কথাও নয়। ওরকম বিটকেল চেহারার কোনও লোককে জীবনে দেখিনি।”
সুধীর উদাস গলায় বলে, “আপনি যদি বলেন তো তাই। তবে কিনা কালোবাবু অন্য কথা বলেন।”
“কালোবাবুটা আবার কে?”
“তা কে জানে কর্তা। চাঁদর মুড়ি দিয়ে ঘোরেন, হাটে-বাজারে দেখা হয়, দাড়ি-গোঁফ আছে, ব্যস, এইটুকু জানি।”
“তা তিনি কী বলেন শুনি!”
“তা তিনি বলেন যে, সেই রাতে আপনি তাকে দাওয়ায় শুতে দেন। তবে তিনি নাকি বাক্সটা আপনাকে দিয়ে বলেছিলেন, “মশাই, এই বাক্সখানায় আমার যথাসর্বস্ব আছে, চুরি হয়ে গেলে পথে বসব। রাতের মতো বাক্সটা আপনার হেফাজতে থাক। মনে পড়ছে কি কর্তা?”
“না হে বাপু, লোকটাকেই মনে পড়ছে না তো বাক্স। তা সেই বাক্সে ছিলটা কী?”
“আজ্ঞে, সে কথা কালোবাবু বলেননি। তিনি শুধু বলেছেন যে, ওই বাক্সটা তাঁর চাই-ই চাই।”
মন্টুবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “এঃ, মামার বাড়ির আবদার আর কী! মদন তপাদারের বাক্স কি ছেলের হাতের মোয়া যে, চাইলেই পাওয়া যাবে!”
“আজ্ঞে, আমিও তো কালোবাবুকে সেই কথাই বলেছি।”
“কী বলেছ?”
“বলেছি, মন্টুরামবাবু বড় হুঁশিয়ার লোক। বাক্সখানা তাঁর হেফাজত থেকে বের করে আনা ভারী শক্ত কাজ হবে।”
মন্টুরামবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “অ্যাঁ! আমার কাছে বাক্স! ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাওনি? বাক্স-ফাক্স আমার কাছে নেই। মদন তপাদার নামে কাউকে আমি কস্মিনকালেও চিনি না।”
ঘাড় কাত করে সুধীর ভালমানুষের মতো বলে, “তাই বলে দেবখন।”
“হ্যাঁ, বোলো। আর এ কথাটাও বলে দিয়ো যে, ফের কোনও বেয়াদপি দেখলে তাকে পুলিশে দেব।”
“যে আজ্ঞে। তবে থানা-পুলিশ তো কালোবাবুর জলভাত কিনা। তাঁর নামে সাতটা খুনের মামলা ঝুলছে!”
চোখ বড় বড় করে মন্টুবাবু বলেন, “সাতটা খুনের মামলা! সে তো ডেঞ্জারাস লোক হে!”
“খুব খুব! ডেঞ্জার বলে ডেঞ্জার, তার অ্যাঙ্গারও সাংঘাতিক। অ্যাঙ্গারের উপর অ্যাঙ্গার, কাঁধে বন্দুক, পকেটে পিস্তল, কোমরে ছোরা। খেপে গেলেই রক্তারক্তি। এমন ডেঞ্জার আর অ্যাঙ্গার লোক দুটো দেখিনি মশাই। মদন তপাদারের বাক্স না পেলে আমার গর্দান কি আস্ত থাকবে?”
গলাটা একটু নামিয়ে মন্টুরামবাবু বললেন, “কেন হে বাপু, সেই বাক্সে আছেটা কী? সোনাদানা, হিরে-জহরত তো আর নেই, তিন প্যাকেট তাস, গোটা কয়েক লোহার বল, কয়েকটা চোঙা, একটা খেলনা পিস্তল আর বিটকেল সব হাবিজাবি জিনিস। একজন হাটুরে জাদুকর তো আর বাক্সভরতি মোহর নিয়ে ঘুরে বেড়াত না রে বাপু!”
ঘাড়টা নেড়ে কথাটায় সায় দিয়ে সুধীর বলল, “যে আজ্ঞে, তা হলে কালোবাবুকে গিয়ে তাই বলব যে, আপনি বাক্সখানা ভাল করে নেড়ে-ঘেঁটে দেখেছেন। তাতে তিন প্যাকেট তাস, খেলনা পিস্তল, লোহার বল, চোঙা আর বিটকেল কিছু জিনিস ছাড়া আর কিছু নেই। এই তো! তা বাবু, বাক্সখানা সাবধানে রাখবেন কিন্তু।”
মন্টুরামবাবু হঠাৎ হুংকার দিয়ে উঠলেন, “বাক্স! কীসের বাক্স? কোথায় বাক্স? কার বাক্স? কবেকার বাক্স? বাক্স বললেই হল? বাক্স কি গাছে ফলে? কোথাকার কোন মদন তপাদার, তার কীসের না কীসের বাক্স, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা কীসের হা? বাক্সে কী আছে তা কি আমার জানার কথা? সেই বাক্স চোখেই দেখলুম না।” সুধীর সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বলে, “আজ্ঞে, সে তো ঠিক কথাই। মদন তপাদারের বাক্স নিয়ে আমাদের মতো মনিষ্যির মাথাব্যথা কীসের? তবে কিনা কালোবাবু, ল্যাংড়া গেনু, ফুটু সর্দাররা ওই বাক্সটার জন্য বড়ই হন্যে হয়ে পড়েছে।”
মন্টুবাবু হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “ল্যাংড়া গেনু আর ফুটু সর্দার আবার কোথা থেকে উদয় হল?”
“আজ্ঞে, তাঁরা উদয় হয়েই আছেন। শ্রদ্ধাস্পদ কানাই দারোগামশাই এই দু’জনের যাতে সন্ন্যাস রোগ বা সর্পাঘাতে মৃত্যু হয়, তার জন্য হটুগঞ্জের জাগ্রত কালীবাড়িতে দু’জোড়া পাঁঠা মানত করে রেখেছেন। এই আক্রার বাজারে দু’ জোড়া পাঁঠার দামটাও একটু ভেবে দেখুন। তা হলেই বুঝতে পারবেন এ দু’জনের এলেম কত।”
“তুমি কি বলতে চাইছ, এই দু’জনেও মদন তপাদারের বাক্সের খদ্দের?”
“পরিপাটি বুঝতে পেরেছেন মশাই। বাক্সের তল্লাশে তিন পক্ষই আসরে নেমেছেন। তিনজনের যে-কোনও সময়ে খুনোখুনি হয়ে যেতে পারে। তা হলেই ভেবে দেখুন, মদন তপাদারের বাক্সখানা কী সাংঘাতিক জিনিস!”
মন্টুরামবাবু ভারী বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভাব করে বললেন, “দুর, দূর! আহাম্মক আর কাকে বলে। বাক্স বলতে তো একটা পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া চামড়ার সুটকেস! তার মধ্যে বোকা লোকদের বুরবক বানানোর সব এলেবেলে সস্তা জিনিস! ওর জন্য কেউ হেঁদিয়ে মরে নাকি? ছ্যা ছ্যা! তুমি বরং গিয়ে ওদের বেশ ভাল করে বুঝিয়ে বোলো যে, ও বাক্সে তেমন কিছু নেই। ওদের কেউ ভুল খবর দিয়েছে।”
“সে বলবখন। ছেঁড়াখোঁড়া চামড়ার পুরনো একটা সুটকেস তো? তা বাক্সটা কতটা বড় হবে বলুন তো কর্তা!”
মন্টুরামবাবু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “তার আমি কী জানি! সুটকেস কি আমি দেখেছি নাকি? চামড়ার বাক্স না টিনের বাক্স, তা কি আমার জানার কথা? আবোল তাবোল বকে আমার মাথাটা আর গুলিয়ে দিয়ো না তো বাপু। কোথাকার কোন মদন তপাদার আর তার কোন না-কোন সুটকেস? ভাল জ্বালা হল দেখছি।”
ঠিক এই সময়ে মন্টুরামবাবুর গিন্নি হরিমতী ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠে বললেন, “ওমা! এটা আবার কে গো?”
মন্টুরামবাবু ভারী তেতো গলায় বললেন, “আর বোলো না, এটা একটা চোর।”
হরিমতী ড্যাবড্যাব করে খানিকক্ষণ সুধীর গায়েনের দিকে চেয়ে দেখে হঠাৎ ভারী আহ্লাদের গলায় বললেন, “ওমা! কী সুন্দর ছোট্টখাট্টো পুতুল-পুতুল চোর গো! কেমন গোপাল গোপাল চেহারা। ইচ্ছে করছে, আমার পুতুলের আলমারিতে সাজিয়ে রাখি!”
একথা শুনে সুধীর কঁকিয়ে উঠে হাতজোড় করে বলে, “না মাঠান, আলমারিতে আর না, আলমারি বড় ভয়ংকর জিনিস।”
মন্টুরামবাবু গম্ভীর গলায় হরিমতী দেবীকে বললেন, “আর আশকারা দিয়ো না তো। একে পুলিশে দেব।”
হরিমতী মন্টুরামের দিকে তাকিয়ে ঝংকার দিয়ে বললেন, “পুলিশে দিলেই হল! তুমি পাষণ্ড আছ বাপু। এই একরত্তি একটা চোরকে কেউ পুলিশে দেয়?”
“চোরের আবার ছোট-বড় কী? সাইজ যাই হোক, চোর তো!”
“মোটেই না! এইটুকু একরত্তি চোরটা পুলিশের হাতে মার খেলে বাঁচবে নাকি? পুলিশগুলোর যা গোদা গোদা চেহারা! না বাপু, তোমার মায়া-দয়া না থাক, আমার আছে।”
মন্টুরামবাবু ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী মুশকিল। চোর ছ্যাচড়কে প্রশ্রয় দিলে যে দেশটা অরাজকতায় ভরে যাবে! একরত্তি দেখতে বটে, কিন্তু সাংঘাতিক লোক, সারা রাত আলমারির মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল।”
হরিমতীর চোখ ছলছল করে উঠল, “আহা রে, তবে তো বাছার খুবই কষ্ট গিয়েছে। খিদে-তেষ্টায় মুখ শুকিয়ে একেবারে হস্তুকি। এসো তো বাছা, পেট ভরে ভাত খেয়ে যাও। চোর বলে কি আর মানুষ নয়।”
এই বলে হরিমতী সুধীরের নড়া ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন।
মন্টুরামবাবু অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলেন, “কী মুশকিল! কী মুশকিল! এরকম চলতে থাকলে চোর-ডাকাতরা কি আর বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইবে? এ বাড়িতেই থাবা গেড়ে বসে থাকবে যে!”
ঘরের মধ্যে নীরবেই দ্রুত পায়চারি করছিলেন মন্টুরাম। খুব চিন্তিত, কপালে ভাঁজ।
ঠিক এই সময় শুনতে পেলেন, কে যেন বলে উঠল, “মন্টুরাম!”
মন্টুরাম চমকালেন না, কারণ গলাটা তিনি বিলক্ষণ চেনেন। এ
হল দু’নম্বর মন্টুরামের গলা। দু’নম্বর মন্টুরামের সবচেয়ে বড় দোষ হল, সে প্রায়ই মন্টুরামকে উপদেশ দেওয়ার জন্য হাজির হয়।
মন্টুরাম অত্যন্ত তিক্ত গলায় খ্যাক করে উঠলেন, “কী চাই?”
“কাজটা তুমি ঠিক করোনি মন্টুরাম।”
“কোন কাজটা?”
“মদন তপাদারের বাক্সটা হাতিয়ে নেওয়াটা তোমার ঠিক হয়নি।”
“ঠিক হয়নি মানে? মদন তপাদার যে আমার নতুন সাইকেল, পিতলের ঘড়া, দেওয়ালঘড়ি আর এক পাঁজা বাসন চুরি করেছিল!”
“মন্টুরাম, তুমি ভালই জানো, ওসব মোটেই মদন তপাদার চুরি করেনি।”
“তবে কে করেছিল?”
“তা কে জানে! যে-ই করুক, মদন তপাদার নয়।”
“তাকেই সবাই সন্দেহ করেছিল। তার ভাগ্য ভাল যে, আমরা তাকে পুলিশে দিইনি।”
“কিন্তু ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। আর বাক্সটাও তাকে ফেরত দাওনি।”
“আহা, বাক্সের যা ছিরি, ওটা বিক্রি করলেও আমার চুরির জিনিসের দাম উঠত না।”
“কিন্তু বাক্সখানার কদর যে বেড়েছে মন্টুরাম। ও বাক্সে যা আছে, তার যে অনেক দাম!”
“দূর দূর! ও ছাইভস্মের আবার দাম কী?”
“আছে হে মন্টুরাম, আছে। তোমার মতো পাপী-তাপীরা ওর মর্ম বুঝবে না হে।”