Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দূরের ঢিবির আলোর রেখাটার দিকে চেয়ে তিনজনে তখনও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

পাকিস্তান বা ভারত যার সীমানার মধ্যেই পড়ুক, থর-এর মরুভূমির মাঝে মাথায় আলো জ্বলবার মতো ওরকম একটা টিবি কেমন করে থাকতে পারে।

আলোটা আবার সাধারণ টিম-টিম কেরাসিন কি তেলের আলো তো নয়। বালিঝড়ের ঘোলাটে অন্ধকারে একটু অস্পষ্ট দেখালেও আলোটা যে বিদ্যুৎ বাতির চেয়ে জোরালো কিছুর তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

ঢিবি আর আলোর রহস্য যাই হোক, আমাদের তখন আর অপেক্ষা করবার উপায় নেই।

মরুর ঝড়টা এতক্ষণ একটু থেমে ছিল, তা আবার তখন বাড়তে শুরু করেছে।

বালিগুলো ছুঁচের মতো গায়ে তো ফুটছেই, সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে সমস্ত শরীর।

ও ঢিবিটা যাই হোক, ওরকম জোরালো আলো মানেই সভ্যতা। ওখানে এখনকার মতো আশ্রয় তো পাওয়া যাবে।

সেই দিকেই তাই যতদূর তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ঢিবিটার তলায় গিয়ে পৌঁছে যেমন হতভম্ব তেমনই হতাশ হতে হল।

ঢিবিটা খুব ছোটখাটো নয়। নেহাত বালির না হলে মনে করা যেত যে লম্বা খাড়া একটা পাহাড়ের টুকরোই যেন সেখানে বসানো আছে। ওরকম জায়গায় একেবারে অসম্ভব, নইলে বালির ঢিবির মধ্যে লুকানো একটা কুতুবমিনার গোছের কিছুও ভাবা যেত।

কিন্তু এরকম একটা পাহাড়ের টুকরো কি বালিতে পোঁতা পুরনো মিনারের ধ্বংসাবশেষ হলে তার মাথায় অমন জোরালো আলো কোথা থেকে জ্বলতে পারে!

আর জোরালো আলো যার মাথায় জ্বলছে সে ঢিবির ভেতর ঢোকবার কোনও রাস্তা নেই কেন? চারদিকেই তো শুধু নিরেট বালির গা!

ব্যাপারটা কি ভুতুড়ে কিছু?

নাঃ, সারাদিনের ধকলে আর পিপাসায় আমাদের আর মাথার ঠিক নেই!

জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু জেগে জেগে স্বপ্ন দেখলে সবাই মিলে কি একই স্বপ্ন দেখে?

তা ছাড়া বালির ঝড় আবার শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটায় বালিগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে যে রকম ঠাণ্ডা ছুঁচের মতো গায়ের মধ্যে ফুটছে, যে-কোনও বেঘোর অবস্থা কাটিয়ে দেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট।

না, স্বপ্ন নয়, ভুতুড়ে কোনও ব্যাপার নয়, একেবারে বাস্তব সত্য। শুধু তার মানেটা একেবারে বোঝা যাচ্ছে না।

বালির ঝড় থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়ার জন্য ঢিবিটাকেই আড়াল করে তার যে দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সে দিকে থাকাও হঠাৎ বিপজ্জনক বলে মনে হল।

ঝড়ে নাড়া খেয়েই তার ওপর থেকে আগে থেকেই ঝুর ঝুর করে বালি ঝরে পড়ছিল। সেটা গ্রাহ্যের মধ্যে আনিনি।

তারপর হঠাৎ বেশ বড় একটা চাংড়া ওপর থেকে খসে গড়িয়ে পড়ায় সভয়ে লাফিয়ে পিছিয়ে যেতে হল।

বালির চাংড়াটা আর একটু হলে মাথার ওপরই পড়েছিল।

কিন্তু তারপর এটা কী আশ্চর্য ব্যাপার!

ঢিবিটার ভেতর থেকে যেন ক্ষীণ একটু আলো দেখা যাচ্ছে!

দেখতে দেখতে সে আলো একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঢিবির বালি এক জায়গায় খসে গিয়ে একটা যেন ছোট ফোকর দেখা যাচ্ছে। আলোটা আসছে সেই ফোকর থেকেই।

ফোকরের আলোটার দিকে চেয়ে আমরা যখন প্রায় সম্মোহিত হয়ে গিয়েছি তখন ঢিবিটার ওপর থেকে আরও কয়েকটা চাংড়া আর বেশ কিছু বালি খসে পড়ল! অবশ্য তখন নিজেরাই দূরে সরে আছি।

তারপরই অবাক হয়ে দেখলাম ছোট ফোকরটা বড় হতে হতে ক্রমশ যেন একটা বড় গহ্বর হয়ে উঠছে।

ফোকরের আলোটা আর কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। আলোটা না থাকার দরুন গহুরটা কেমন একটা অন্ধকার জন্তুর মুখের হাঁর মতো দেখাচ্ছে।

ব্যাপারটা তখন বোঝবার চেষ্টা করছি।

বালির ঢিবির এটা কি একটা স্বাভাবিক গহর? ঝড়ের ঘায়ে ওপরের বালির চাংড়া খসে পড়ায় আপনা থেকে কি এটার চেহারা বেরিয়ে পড়েছে?

আলোটা যা দেখেছি সেটা তা হলে কী? ঢিবির মাথায় যে অদ্ভুত আলো দেখে প্রথম আকৃষ্ট হয়েছি, ফোকরের আলোটার তা-ই যদি উৎস হয়, তা হলে ঢিবিটা আগাগোড়া সেই মাথা পর্যন্ত ফাঁপা।

এরকম কোনও বালির ঢিবি মরুভূমির মধ্যে থাকা কি সম্ভব?

সম্ভব অসম্ভব যাই হোক, তখন আর তা নিয়ে বেশি কিছু ভাববার সময় নয়।

বালির ঝড়টা আমাদের সামান্য একটু আড়ালের সুযোগ পেতে দেখে যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠল। যেমন তার প্রচণ্ড বেগ, তেমনই তার হাড় কাঁপানো শীত।

সাত-পাঁচ ভেবে সামনের ওই গহ্বরের আশ্রয়টুকু আর উপেক্ষা করা গেল না।

তিনজনে পর পর সেই গহ্বরের ভেতরে ঢুকলাম।

ভয়ে ভয়েই ঢুকেছিলাম, কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যেই ভয় ছাপিয়ে একটা সন্দিগ্ধ কৌতূহলই বড় হয়ে উঠল।

এ কী রকম গহুর?

বাইরে থেকে যা মনে হচ্ছিল ভেতরের জায়গাটা তার চেয়ে অনেক বড় মনে হল। একেবারে গাঢ় অন্ধকার হওয়ার দরুন মাথার ওপরটা কত উঁচু আর চারপাশে কতখানি ছড়ানো তা ঠিক বুঝতে না পারলেও একটা ছোটখাটো থিয়েটার হল-এর মতো জায়গায় যে ঢুকেছি সে বিষয়ে তখন আর সন্দেহ নেই।

অন্য কিছুর বদলে থিয়েটার হল-এর সঙ্গে মিলের কথাটা কেন যে মনে হয়েছিল কে জানে! নিজের অজান্তে মন কি ভবিষ্যতের কিছু আভাসই তখন পেয়েছিল?

কারণ এর পর থেকে যা শুরু হল, চমকদার যে কোনও আজগুবি নাটককে তা ছাপিয়ে যায়।

প্রথমেই নাটক করলে বটুক।

হঠাৎ মেঝেতে একটু পা ঘষে তার মার্কামারা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললে, খাঁচাটা কাঁপছে।

কী কাঁপছে? সুরঞ্জন যেমন উদ্বিগ্ন তেমনই একটু বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলে।

খাঁচা আবার কোথা থেকে এল? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

আমরা তো খাঁচার মধ্যেই আছি। বটুক যেন বিছানায় শুয়ে থাকার খবরের মতো জানিয়ে বললে, ঝাঁপটা তো বন্ধ হয়ে গেছে।

ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে!আমিই এবার সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, ঝাঁপ মানে যেখান দিয়ে এ গহ্বরে ঢুকেছি সেখানকার কোনও দরজার কথা বলছ?

হ্যাঁ, তবে দরজা নয়, ঝাঁপ! বটুক নিজের কথাটাই ধরে রইল, আমরা ঢোকবার পরই ওপর থেকে নেমে বন্ধ হয়ে গেছে, আর সমস্ত খাঁচাটা এখন কাঁপছে।

কম্পনটা তখন আমরাও টের পেয়েছি। কিন্তু বটুকের খাঁচা কথাটা ব্যবহারের কোনও মানে পাইনি। এ কাঁপা তুফানের দাপটের কি ভূমিকম্পের হতে পারে কি না বিচার করতে গিয়ে দ্বিতীয় নাটকীয় বিস্ময়।

হঠাৎ গহুরটা আলোয় আলো হয়ে গিয়েছে। আর তারই মধ্যে ওপর থেকে নেমে আসা একটা লোহার হেলানো সিঁড়িতে একটু অদ্ভুত মূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

মূর্তিটি যদি অদ্ভুত হয় তার প্রথম সম্ভাষণটা তার চেয়েও বেশি।

শীর্ণ হাড়-বেরুনো মুখে একটা শয়তানি হাসি নিয়ে সে বলছে, তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছি।

বলে কি মানুষটা! আমরা তো সবাই তাজ্জব!

সব কিছুই যে আজগুবি সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে।

ধু ধু মরুভূমির মাঝখানে একেশ্বর এক বিরাট বালির ঢিবি।

সে বালির ঢিবির মাথায় এমন আলো যে মরুর ঝড়ের ভেতরও দূরদূরান্ত থেকে দেখা যায়।

বালির ঢিবি আবার ফোঁপরা। তার ভেতর ঢোকবার পর তা যেন বিরাট অন্ধকার এক খাঁচা হয়ে ওঠে। যেখান দিয়ে তাতে ঢুকেছি সেখানে একটা ঝাঁপ পড়েই যেন বন্ধ হয়ে যায়, আর খাঁচার মতো গহ্বরটা হঠাৎ কাঁপতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আলোয় আলো হয়ে কোথা থেকে এক অদ্ভুত মূর্তি এসে দেখা দিয়ে বলে কিনা—তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি!

মানুষটা কি পাগল নাকি?

তা না হলে কী মানে ওই অদ্ভুত কথার?

যে বলেছে সে লোকটাই বা কে? আমাদের জন্যই বা অপেক্ষা করছে কেন?

এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্য শেষ পর্যন্ত মিলেছে, কিন্তু যখন তা পেলাম তখন এমন এক সৃষ্টিছাড়া ব্যাপারের নিরুপায় ভাগীদার হয়েছি যে নিয়তি বলে তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর করবার কিছু নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *