Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দুবার ঘনাদার মুখে আট কোটি কিলোমিটার শোনবার পর আর কিছু বলতে হয়। তক্তপোশের এধার-ওধারে যে যেখানে পারি তখন চেপে বসে গেছি! ব্লাডপ্রেশার সোম, কার্ডিয়োগ্রাম সান্যাল আর ব্লাভটেস্ট গুপ্তও বাদ যায়নি।

আমাদের সকলেরই একরকম জায়গা হয়েছে, কিন্তু ঘনাদা? ঘনাদা বসবেন কোথায়? তাঁর কথা কি কেউ ভাবেনি?

যে ভাবার সে ঠিকই ভেবেছে। আট কোটি কিলোমিটার শোনবার পরই গৌরকে আর যে দেখতে পাওয়া যায়নি সে খেয়াল আমাদের বিশেষ ছিল না।

এইবার সগর্বে তাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখা গেছে। সঙ্গে তার বনোয়ারি, আর দুজনের সযত্নে ধরে বয়ে আনা দোতলার আড্ডাঘরের সেই মাকামারা আরামকেদারা, ঘনাদার যা মৌরসি।

এটা আবার বয়ে আনতে গেলে কেন? কেদারাটা গৌর বেশ জুত করে পাতবার সময় ঘনাদা মদু একটু আপত্তি জানিয়েছেন, কিন্তু বসতে ত্রুটি করেননি।

শিশির অবশ্য তার আগে থাকতেই এক পায়ে খাড়া। ঘনাদা আরামকেদারায় কাত হতে না-হতে হাতের টিনটা বাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর দিকে আর সিগারেটটা তিনি মুখে তোলার আগেই লাইটার জ্বেলে ধরতে এক সেকেন্ড দেরি করেনি।

পুজোর ব্যবস্থাটা যোড়শোপচারেই তৈরি। দোতলা থেকে শুধু আরামকেদারাই আসেনি, নীচে রামভুজের কাছে হুকুম চলে গেছে। বনোয়ারি ওপর থেকে চেয়ার রেখে নামবা মাত্রই যেন ফুটন্ত কড়ায় মাংসের শিঙাড়া ছাড়তে শুরু করে। ভাজা শিঙাড়ায় যতক্ষণ প্লেট বোঝাই হবে ততক্ষণে বনোয়ারি দুপুর থেকে এনে রাখা তোতাপুলিগুলো ছোট ডিশে সাজিয়ে ফেলবে।

ওসব নৈবিদ্যি বাদে ধুপধুনো হিসেবে শিশিরের সিগারেট জ্বালানো তো আগে থেকেই শুরু হয়েছে।

এখন দেবতা শুধু প্রসন্ন হলেই হয়।

লক্ষণগুলো এখন শুভই মনে হচ্ছে।

ঘনাদা সিগারেটে খুদে খুদে টান থেকে একেবারে রামটানে পৌঁছে প্রায় মানোয়ারি জাহাজের মতো ধোঁয়া ছাড়লেন।

আমরা কিন্তু তখন নিশ্বাসটা ছাড়তেও একটু দ্বিধা করছি, ঘনাদার আট কোটি কিলোমিটারের পাড়িটা পাছে ভেস্তে না যায়।

আট কোটি কিলোমিটারের আশা দিয়ে ঘনাদা আজকের সন্ধ্যাটাও কি আমাদের পার করে দেবেন না?

এখন দরকার শুধু একটু লাগসই উসকানির।

কেমন করে সেটা দেওয়া যাবে?

আমরা যখন ভেবে সারা তখন ঘনাদাই তার মৌ-কা করে দেন।

প্রেশার কার্ডিয়োগ্রাম আর ব্লাডটেস্টের সম্বন্ধে হঠাৎ যেন ভাবিত হয়ে উঠে বলেন, এঁদের সব ডেকে এনে মিছিমিছি কষ্ট দিলে। ডাকবার আগে একবার যদি আমায় জানাতে।

এমনই একটা সুযোগর জন্যই ওত পেতে ছিলাম। পাওয়া মাত্র একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরে বলি, আজ্ঞে আপনাকে জানাব কী! আমাদের কি তখন মাথার ঠিক আছে! এক হপ্তা আপনি দোতলায় নামেননি?

তারপর রামভুজের মুখে শুনলাম, বুকের কী হয়েছে বলে এক বেলা মুরগির আর একবেলা নালির সুরুয়া খাচ্ছেন আর সব কিছুর সঙ্গে।

তাই ভয়ে দিশেহারা হয়ে যেখানে যাকে পেয়েছি সবরকম পরীক্ষার জন্য ডাকিয়ে এনেছি। তখন কি জানি যে আপনার নিজের কাছেই কাঠপোড়া ছাইয়ের ধন্বন্তরী আছে অমন!

আচ্ছা, ওই কাঠপোড়া ছাই, রিলে রেসের মতো আমি, শিবু ও শিশির পর পর কথার খেই টেনে নিয়ে যাবার পর গৌর শেষ চালটা দেয়, ওটা আপনার সেই আট কোটি কিলোমিটারেই কাজে লেগেছিল বুঝি?

তাইতেই বাজিমাত। আর ঠেলাঠেলির দরকার হয় না। চাকা আপনা থেকেই গড়িয়ে চলে।

না। ঘনাদাকে যেন একটু ভেবে নিয়ে বলতে হয়, তখনও পুরো আট কোটি হয়নি। হঠাৎ পাথর। পাথর! একটা পাহাড়ের চাঁই। বলে চিৎকার শুনে চমকে উঠলাম! সেই সঙ্গে টের পেলাম বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়ফড় করছে।

উত্তেজনা হওয়া তো আশ্চর্য কিছু নয়।

আটলান্টিকের মাত্র ছ-হাজার কিলোমিটারের অজানায় পাড়ি দেবার পর সান সালভাডোর-এর প্রথম ডাঙা দেখে কলম্বাস আর তাঁর নাবিকেরা যদি ধেই ধেই নৃত্য করে থাকেন, তা হলে আট কোটি কিলোমিটার মহাশূন্যে ছুটে এসে প্রথম ধরা-ছোঁয়ার মতো কঠিন কিছু একটার খবর শুনে উত্তেজনা কি তার চেয়ে কম হবে?

কিন্তু বুকের কষ্টটা যে শুধু উত্তেজনায় নয় তা বুঝতে দেরি হল না।

কোনও রকমে টলতে টলতে জানলাটায় গিয়ে তখন দাঁড়িয়েছি।

সুরঞ্জন তখনও পাগলের মতো হাত নেড়ে চিৎকার করছে, দেখেছেন? ওই দেখুন কী প্রকাণ্ড একটা পাথরের চাংড়া! পেয়েছেন দেখতে?

দেখতে খুবই পেয়েছি।

হ্যাঁ, পাথরের চাংড়া হিসেবে প্রকাণ্ড বটে, কিন্তু তা ছাড়া আর কিছু তো নয়। মাপ যা মনে হল তাতে লম্বায় চওড়ায় বড় জোর পঁচিশ আর কুড়ি কিলোমিটার।

আমাদের যা বিপদ আর সমস্যা তা তো ওতে মিটবে না।

এইটুকুমাত্র আশা করা যায় যে অকূল সমুদ্রের জলে ফল-ভরা একটা গাছের ডাল ভাসতে দেখে কলম্বাস যেমন কাছাকাছি ডাঙার আশ্বাস পেয়েছিলেন, এই পাথরের চাংড়ায় তেমনই শূন্যমার্গের কোনও আশ্রয়ের ইঙ্গিত থাকতে পারে।

কিন্তু কোথায় সে আশ্রয়?

মহাশূন্যে প্রায় আট কোটি কিলোমিটার পার হয়ে কোথায় যে এসেছি কিছুই জানি না।

যার জানবার কথা সেই উন্মাদ লুটভিক এর হাত থেকে বাঁচবার জন্যই তো তাকে বাইরে রেখে এ কামরার দরজা এঁটে নিজেদের স্বেচ্ছাবন্দি হতে হয়েছে। সঙ্গীর মধ্যে আছে ওই সুরঞ্জন আর নেহাত গোবেচারি বটুকেশ্বর।

মহাশূন্যের এই অজানা বিস্তারে আশ্রয় নেবার মতো জায়গা কি সত্যিই মেলা সম্ভব? আর মিললেও তাতে যে নামতে পারব, তার আশা কোথায়?

মোটা সাতপুরু কাঁচের জানলা দিয়ে পাথরের চাংড়াটা দেখতে দেখতে এসব ভাবনা ছাপিয়ে বুকের কষ্টটা ক্রমশ তখনও বাড়ছে।

একটু জল আনবার জন্য সুরঞ্জনকে বলতে গিয়ে দেখি বুকের ওপর হাত চেপে সে মেঝের ওপর বসে পড়েছে। কী হল কী? বলে কোনওরকমে হাঁক দিলাম, বটুক! বটুক!

কিন্তু সাড়া পেলাম না কারও।

নিজেরই তখন মেঝেতে একটু নেমে বসলে আরাম হবে মনে হচ্ছে।

কিন্তু তার আগেই জ্ঞানটা লোপ পাবে নাকি! সেইরকম যেন লক্ষণ।

চমৎকার একটা সমাপ্তি! বসতে গিয়ে তখন ভাবছি, মহাশূন্যে পৃথিবী থেকে আট কোটি মাইল দূরে চারটি মানুষ। এমন করে বেঘোরে নিয়তি যাদের হিসেব চুকিয়ে দিতে যাচ্ছে, একজন তার মধ্যে লুটভিক-এর মতো উন্মাদ বৈজ্ঞানিক, একজন সুরঞ্জনের মতো গানের জগতের ভাবী দিকপাল, বটুকেশ্বরের মতো একজন মুখসুখ গোবেচারা অনুচর, আর আমার মতো একজন অকর্মণ্য অপদার্থ সর্বঘটের কাঁটালিকলা।

ঘনাদার মুখে এমন আত্মনিন্দা!

সকলে মিলে সরবে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার তখন সময় নেই।

প্রতিবাদ তাঁর কানেও যেত কি না সন্দেহ।

তিনি তখন চোখ-কান সব সামনের ছাদের সিঁড়ির দিকে খাড়া করে বসে আছেন।

সেখানে হাতে প্রকাণ্ড ট্রে সমেত বনোয়ারিকে দেখা গেছে। তার পেছনে আর-একটা ছোট ট্রে নিয়ে রামভুজ।

ঘরে এসে নামাবার পর জোড়া ট্রের রহস্য বোঝা গেল। একটিতে মাংসের শিঙাড়া, অন্যটিতে তোতাপুলি।

এসব আবার কেন হে? ঘনাদা একটু যেন বৈরাগ্যের ভাব দেখালেন।

এমন একটা সুযোগ দিলে আর ছাড়া যায়।

আমি তাই বারণ করেছিলাম ওদের! শিশির যেন আমাদের সকলের ওপর খাপ্পা হয়ে শোনাল, বলেছিলাম ঘনাদার হার্টের অসুখ। ওপর থেকে নীচে নামেন না, দুবেলা তাঁকে চাঙ্গা হতে সুরুয়া খেতে হচ্ছে, আর তাঁর জন্য এইসব বিষের ব্যবস্থা করছিস! তাঁকে কি ওই মাংসের শিঙাড়া আর তোতাপুলি দিয়ে লোভ দেখাতে চাস? তিনি কি টলবার মানুষ?

যা, নিয়ে যা সব ছাই পাঁশ! শেষ হুকুমটা বনোয়ারিকে, আমাদের গুলো রেখে ওঁর জন্য শুধু দুটো চিড়ে ভিজিয়ে নিয়ে আয়, আর তার যদি জোগাড় না থাকে তো দুটি থিন অ্যারারুট বিস্কুট।

ঘনাদার মুখের দিকে চাইতেও তখন আর ভরসা হচ্ছে না।

তাঁর নিজের ফাঁদেই তাঁকে ফেলা হয়েছে, শুধু খেয়াল রাখতে হবে মাত্রাটা যেন না ছাড়ায়।

তাই ছাড়াবার উপক্রমই হল আমাদের ভাড়াটে সাজা-ডাক্তারদের আহম্মুকিতে।

কার্ডিয়োগ্ৰাম সান্যাল দুচোখ একেবারে কপালে তুললেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ দেখিয়ে।

বলিহারি আপনাদের আক্কেল! হার্টের রুগি, আর তার সামনে ওই বিষগুলি শিঙাড়ার নাম করে ধরে দিয়েছেন?

সরিয়ে নিয়ে যান ওসব ওঁর সামনে থেকে! ওই অন্যায় লোভ আর দেখাবেন না ওঁকে। প্রেশার সোম হুকুম করলেন সরোষে।

ঘনাদার হাতটা তখন প্লেটের কাছে নামতে গিয়ে থমকে আছে।

চোখে যেন দুর্যোগের লক্ষণ।

মাত্রা কি ছাড়িয়েই গেল নাকি?

তা যাক না। আমাদের মতো কৌঁসুলি তা হলে আছে কী করতে! ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে, আবার টেনে তুলে, আবার ছাড়িয়ে আনাই তো আমাদের বাহাদুরি।

সেই বাহাদুরিই দেখাল শিবু।

হাত গুটিয়ে আছেন কেন, ঘনাদা? খান আপনি। শিবুর উদার উসকানি।

ঘনাদাকে আর দুবার বলতে হয়। প্লেট থেকে একটা গোটা শিঙাড়া এর মধ্যেই তিনি যথাস্থানে প্রেরণ করেছেন। সত্যি বলতে গেলে স্টপওয়াচ না থাকলে শিবুর মুখ থেকে প্ররোচনা খসা আর তাঁর নিজের মুখে শিঙাড়া প্রেরণ—কোনটা আগে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। আমাদের স্কুল চাক্ষুষ বিচারে প্ররোচনাটা প্রেরণের কাছে এক চুলের জন্য মার খেয়েছে বলেই যেন লাগল।

ওদিকে সাজা-ডাক্তাররা তখন একেবারে খাপ্পা।

আপনারা জেনে শুনে মানুষকে খুন করছেন!

আপনাদের ক্রিমিন্যালি প্রসিকিউট করা উচিত।

ওঁকে ওই শিঙাড়া খাওয়ানোর মানে কী তা জানেন?

জানি। গুরুগম্ভীর জবাবটা এবার শিবুর। জানেন!

ব্লাডটেস্ট গুপ্তর তিক্ত বিদ্রুপ, কী জানেন?

জানি যে খাওয়া মানে হজম! শিবু যেন গুরুমশাই।

হজম তো পেটে! কার্ডিয়োগ্রাম সান্যাল যুক্তির সাঁড়াশি চালালেন, কিন্তু বুকে, মানে ওঁর হার্টে কী হতে পারে তা ভেবেছেন?

ভেবেছি। শিবুর মুরুব্বি চালে মোক্ষম জবাব—হার্টের কিচ্ছু হবে না। ওই কাঠপোড়া ছাই আছে কী করতে! ইচ্ছে করলে উনি একটা কেন, পাঁচটা প্লেট সাবাড় করতে পারেন।

ঘনাদা শিবুর পরামর্শ আর কী করে ঠেলেন?

যথার্থই গুণে গুণে পাঁচটি প্লেট সাবাড় করবার পর যেন কর্তব্যবোধে তোতাপুলির দিকে হাত বাড়ালেন।

তাঁর চোখে তখন যে ভাব দেখলাম তা কৃতজ্ঞতা যদি না হয় তা হলে তারই মাসতুতো-পিসতুতো কিছু। আমাদের আসর যে এর পর মালাই কুলপির মতো জমবে এ বিষয়ে অন্তত আর কোনও সন্দেহ রইল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *