Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভয়ংকর সুন্দর || Sunil Gangopadhyay » Page 7

ভয়ংকর সুন্দর || Sunil Gangopadhyay

গ্রামে ফিরে গিয়েই আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রওনা হলাম সোনমার্গের দিকে। কাকাবাবু আর এক মুহুৰ্তও সময় নষ্ট করতে রাজি নন। খাবারদাবার তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো আমরা সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। কাকাবাবু বললেন, যে, পথে কোনও নদীর ধারে বসে খেয়ে নিলেই হবে।

গ্রামের বেশ কয়েকজন লোক আমাদের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দূর পর্যন্ত এল। আমরা এ রকম হঠাৎ চলে যাব শুনে তারা তো অবাক! কেনই বা ওদের গ্রামে থাকতে এসেছিলাম, কেনই বা চলে যাচ্ছি। এত তাড়াতাড়ি, তা ওরা কিছুই বুঝল না। ওরা আমাদের সম্পর্কে কী ধারণা করছে কে জানে! ওরা কেউ বাংলা দেশের নাম শোনেনি, কলকাতা শহরের নাম শুনেছে মাত্র দুজন। ঐসব লোকেরা ইতিমধ্যে ভালবেসে ফেলেছিল আমাদের। একজন মুসলমান বৃদ্ধ আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীবাদ করতে কেঁদেই ফেললেন। আবু তালেব আর হুদা তো এলই সোনমাৰ্গ পর্যন্ত।

সোনমার্গে এসে আমরা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। বাসের আর পাত্তা নেই। বিকেল হয়ে এসেছে। এর পর আর বেশিক্ষণ বাস বা গাড়ি চলবেও না। এ পথে। কাকাবাবু চেষ্টা করলেন কোনও জিপ ভাড়া করার জন্য। তাও পাওয়া গেল না। একটু বাদে একটা স্টেশন ওয়াগন হুস করে থামাল আমাদের সামনে। সামনের সীট থেকে দাড়িওয়ালা একটা মুখ বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী প্রোফেসারসাব, পহলগ্ৰাম ফিরবেন নাকি?

সূচা সিং। আশ্চর্যের ব্যাপার আমরা যখনই কোনও জায়গায় যাবার চেষ্টা করি, ঠিক সূচা সিং-এর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ওঁকে দেখে কাকাবাবু এই প্রথম একটু খুশি হলেন। নিজেই অনুরোধ করে বললেন, কী সিংজী, আমাদের একটু পহলগ্ৰাম পৌঁছে দেবে নাকি? আমরা গাড়ি পাচ্ছি না।

সূচা সিং গাড়ি থেকে নেমে এসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! আপনি আমার গাড়িতে চড়বেন এ তো আমার ভাগ্য! আসুন, আসুন! কী খােকাবাবু, গাল দুটো খুব লাল হয়েছে দেখছি। খুব আপেল খেয়েছ বুঝি?

কাকাবাবু বললেন, সিংজী, তোমার গাড়ির যা ভাড়া হয় তা আমি দেব। তোমার ব্যবসা, আমরা এমনি-এমনি চড়তে চাই না।

সূচা সিং একগাল হেসে বললেন, আপনার সঙ্গেও ব্যবসার সম্পর্ক? আপনি একটা মানী গুণী লোক। তাছাড়া, আজ আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছি, আজ তো আমি ব্যবসা করতে আসিনি। আপনাকে বলেছিলাম না, আমি কাশ্মীরি মেয়ে বিয়ে করেছি? এইদিকেই বাড়ি

গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ির পেছনে নানান রকমের ফলের ঝুড়িতে ভর্তি। সূচা সিং বোধহয় ওসব উপহার পেয়েছেন শ্বশুরবাড়ি থেকে। আমরা আমাদের জিনিসপত্র পেছনেই রাখলাম, কিন্তু সেই তামার বাক্সটা কাকাবাবু একটা কাঠের বাক্সে ভরে নিয়েছিলেন, সেটা কাকাবাবু খুব সাবধানে নিজের কাছে রাখলেন।

গাড়ি ছাড়ার পর সূচা সিং বললেন, প্রোফেসারসাব, আপনার এদিককার কাজ কর্ম হয়ে গেল? কিছু পেলেন?

কাকাবাবু উদাসীনভাবে উত্তর দিলেন, না, কিছু পাইনি। আমি এবার ফিরে যাব।

ফিরে যাবেন? এর মধ্যেই ফিরে যাবেন? আর কিছু দিন দেখুন!

নাঃ, আমার দ্বারা এসব কাজ হবে না বুঝতে পারছি। তাছাড়া গন্ধকের খনি এখানে বোধহয় পাবার সম্ভাবনা নেই।

ওসব গন্ধক-টন্ধক ছাড়ুন! আপনাকে আমি বলে দিচ্ছি, এখানকার মাটির নীচে সোনা আছে। মাটন-এর দিকে যদি খোঁজ করতে চান, বলুন, আমি আপনাকে সব রকম সাহায্য করব।

তুমি অন্য লোককে দিয়ে চেষ্টা করো সিংজী, আমাকে দিয়ে হবে না।

কোন প্রোফেয়ারসাব, আপনি এত নিরাশ হচ্ছেন কেন? আপনাকে আমি লোকজন, গাড়ি-টাড়ি সব দেব-আপনি শুধু বাৎলাবেন!

আমি বুড়ো হয়ে গেছি। পায়েও জোর নেই। আমি একটু খাটাখাটি করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি, আমার দ্বারা কি ওসব হয়?

আপনার ঐ বাক্সটার মধ্যে কী আছে?

কাকাবাবু তাড়াতাড়ি বাক্সটার গায়ে ভাল করে হাত চাপা দিয়ে বললেন, ও, কিছু না, দু একটা টুকিটাকি জিনিসপত্তর।

কী আছে, বলুন না! আমি কি নিয়ে নিচ্ছি নাকি? হাঃ হাঃ—

আমি সূচা সিংকে নিরস্ত করবার জন্য বলে ফেললাম, ওর মধ্যে একটা পাথর আছে। আর কিছু নেই!

বলেই বুঝলাম ভুল করেছি। কাকাবাবু আমার দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকালেন। সূচা সিং ভুরু কুঁচকে বললেন, পাথর? একটা পাথর অত যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছেন? সোনাটোনার স্যাম্পেল নাকি? সোনা তো পাথরের সঙ্গেই মিশে থাকে!

কাকাবাবু কথাটা হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বললেন, আরে ধ্যাৎ, সেসব কিছু না। তুমি খালি সোনার স্বপ্ন দেখছি। এটা একটা কালো রঙের পাথর, দেখে ভাল লাগল, তাই নিয়ে যাচ্ছি।

আলাদা বাক্সে কালো পাথর? এদিকে কালো পাথর পাওয়া যায় বলে তো কখনও শুনিনি। প্রোফেসার, আমাকে একটু দেখাবেন?

পরে দেখবে। এখন এটা খোলা যাবে না।

কেন, খোলা যাবে না কেন? সামান্য একটা বাক্স খোলা যাবে না? দিন, আমি খুলে দিচ্ছি?

এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে সূচা সিং একটা হাত বাড়ালেন বাক্সটা নেবার জন্য।

কাকাবাবু বাক্সটা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বললেন, না এখন না। বলছি তো, এখন খোলা যাবে না!

সূচা সিং তবু হাত বাড়িয়ে হাসতে হাসতে বললেন, দিন না, একটু দেখি!

পাথর নিয়ে যাচ্ছেন, না লুকিয়ে লুকিয়ে সোনার স্যাম্পেল নিয়ে যাচ্ছেন, সেটা একটু দেখব, না! ভয় নেই, ভাগ বসাব না। শুধু দেখে একটু চক্ষু সার্থক করব!

কাকাবাবু হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, না, এ বাক্সে হাত দেবে না। বারণ করছি, শুনছ না কেন?

সূচা সিং কঠিন চোখে তাকালেন কাকাবাবুর দিকে। স্থির ভাবে। তাকিয়েই রইলেন দু এক মিনিট। আমি বুঝতে পারলাম, ওঁর মনে আঘাত লেগেছে। কাকাবাবুর দিকে থেকে মুখ ফেরালেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, প্রোফেসারসাব, আমার নাম সূচা সিং। আমাকে এ তল্লাটের অনেকে চেনে। আমাকে কেউ ধমক দিয়ে কথা বলে না।

কাকাবাবু তখনও রাগের সঙ্গে বললেন, আমি বারণ করলেও কেউ আমার জিনিসে হাত দেবে, সেটাও আমি পছন্দ করি না। তুমি আমার সঙ্গে চোখ রাঙিয়ে কথা বলে না!

সূচা সিং বাক্সটার দিকে একবার, কাকাবাবুর মুখের দিকে একবার তাকালেন। আমার ভয় হল, সূচা সিং যে-রকম রেগে গেছেন, যদি এখানেই গাড়ি থেকে নেমে যেতে বলেন! এখনও যে অনেকটা রাস্তা বাকি!

সূচা সিং কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, প্রোফেসারসাব, আপনি হঠাৎ এত রেগে গেলেন কেন? একটা সামান্য পাথরও আপনি আমায় দেখাতে চান না! ঠিক আছে, দেখাবেন না। আমি কি আর জোর করে দেখব? আমি আপনাকে কত ভক্তি শ্রদ্ধা করি। আপনার মতন মানী গুণী লোক তো বেশি দেখি না। সারাদিন ব্যবসার ধান্দায় থাকি, তবু আপনাদের মতন লোকের সঙ্গে দুটো কথা বললে ভাল লাগে। আপনি আমার ওপর রাগ করছেন?

কাকাবাবু তখনও রেগে আছেন, স্পষ্ট বোঝা যায়। তবু একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললেন, কেউ কোনও কিছু একবার না বললে, তারপর আর সে নিয়ে জোর করতে নেই। তাহলেই রাগের কোনও কারণ ঘটে না।

ঠিক আছে, আমার গোস্তাকি হয়েছে। আমাকে মাপ করে দিন। তা প্রোফেসারসাব, সোনমাৰ্গ ছেড়ে দিলেন, এবার কি অন্য কোনও দিকে কাজ শুরু করবেন?

না, আর কাজ-টাজ করার মন নেই। এবার কলকাতায় ফিরব!

সে কী, এত খাটাখাটি করে শেষ পর্যন্ত একটা পাথরের টুকরো নিয়ে ঘর যাবেন?

ওটা একটা স্মৃতিচিহ্ন!

এরপর কিছুক্ষণ কেউ আর কোনও কথা বলল না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, কাকাবাবুর রাগ এখনও কমেনি, কাকাবাবু এমনিতে শান্ত ধরনের মানুষ, কিন্তু একবার রেগে গেলে সহজে রাগ কমে না। ঐ বাক্সটা তিনি আর কারুকে ছুতে দিতেও চান না।

একটু বাদে সূচা সিং আবার বললেন, প্রোফেসারসাব, আপনার কোটের পকেট থেকে একটা রিভলভার উঁকি মারছে দেখলাম। সব সময় অস্ত্ৰ নিয়ে ঘোরেন নাকি?

কাকাবাবু গভীরভাবে বললেন, জন্তু-জানোয়ার কিংবা দুষ্ট লোকের তো অভাব নেই। তাই সাবধানে থাকতে হয়।

সূচা সিং হেসে হেসে বললেন, সে কথা ঠিক, সে কথা ঠিক!

পহলগ্রামে এসে পৌঁছুলাম সন্ধের পর। নটা বেজে গেছে। গাড়ি থেকে নামবার পর সূচা সিং কাকাবাবুর দেওয়া টাকা কিছুতেই নিলেন না। বরং কাকাবাবুর করমর্দন করে বললেন, প্রোফেসারসাব, আমি আপনার দোস্ত। গোসা করবেন না। যাবার আগে দেখা করে যাবেন! খোকাবাবু, আবার দেখা হবে, কী বলে?

আমার মনে হল, সূচা সিং মানুষটা তেমন খারাপ নয়। কাকাবাবু ওর ওপর আমন রাগ না করলেই পারতেন।

পহলগ্ৰামে লীদার নদীর ওপারে আমাদের তাঁবুটা রাখাই ছিল। যে রকম রেখে গিয়েছিলাম, জিনিসপত্তর ঠিক সেই রকমই আছে। সেখানে পৌঁছবার পর কাকাবাবু কাঠের বাক্সটা খুব সাবধানে তাঁর ট্রাঙ্কে ভরে রাখলেন। তারপর বললেন, সন্তু, তোমাকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, এটার কথা কারুকে বলবে না। আর এটাকে কিছুতেই চোখের আড়াল করবে না। আমি যখন তাঁবুতে থাকব না, তুমি তখন সব সময় এটার সামনে বসে থাকবে। আর তুমি না থাকলে আমি পাহারা দেব। বুঝলে?

আমি বললাম, কাকাবাবু, মুণ্ডুটা আমি তখন ভাল করে দেখিনি, আর একবার দেখব এখন?

কাকাবাবু উঠে গিয়ে আগে তাঁবুর সব পদটিদা ফেলে দিলেন। অন্য সব আলো নিভিয়ে শুধু একটা আলো জ্বেলে রেখে তারপর ট্রাঙ্ক থেকে বার করলেন কাঠের বাক্সটা। কাঠের বাক্সটার মধ্যে সেই পুরনো তামার বাক্স, সেটার গায়েও এক সময় কী যেন লেখা ছিল–এখন আর পড়া যায় না।

পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে কাকাবাবু কণিষ্কর মুখ মুছতে লাগলেন। এখন তার কপাল, চোখ, ঠোঁটের রেখা অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠল। ভাঙা নাক ও কান দুটো জোড়া দিলে সম্পূর্ণ মুখের আদল ফুটে উঠবে। কাকাবাবুকী স্নেহের সঙ্গে হাত বুলোচ্ছেন সেই পাথরের মূর্তিতে। আমার দিকে ফিরে আস্তে আস্তে বললেন, সন্তু, এটার আবিষ্কারক হিসেবে তোর নামও ইতিহাসে লেখা থাকবে?

রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া করে আমরা খুব সকাল-সকাল শুয়ে পড়লাম। আজ রাত্তিরে আর কাকাবাবু ঘুমের ঘোরে কথা বলেননি একবারও। আজ তিনি সত্যিকারের শাস্তিতে ঘুমিয়েছেন।

ভোরবেলা কাকাবাবুই আমাকে ডেকে তুললেন। এর মধ্যেই ওঁর দাড়ি কামানো হয়ে গেছে। কাকাবাবু বললেন, লীদার নদীর জলে রোদ্দুর পড়ে কী সুন্দর দেখাচ্ছে, দ্যাখো! কাশ্মীর ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে তোমার মন কেমন করছে, না?

কাকাবাবু, আমরা কি আজই ফিরে যাব?

প্লেনে কবে জায়গা পাই সেটা দেখতে হবে। আজ জায়গা পেলে আজই যেতে রাজি। তুমি সব জিনিসপত্তর বাঁধাছাদা করে ঠিক করে রাখো।

বেলা বাড়ার পর কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুমি তাঁবুতে থাকো, আমি সব খোঁজখবর নিয়ে আসি। ব্যাসাম সাহেব আর ব্ৰতীন মুখার্জিকে দুটো টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে—ওঁরা কণিষ্ক সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। আমি না। আসা পর্যন্ত তুমি কিন্তু কোথাও যাবে না।

কাকাবাবু চলে গেলেন। আমি খাটে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে লাগলাম। একটা অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। পড়তে পড়তে মনে হল, আমরা নিজেরাও কম অ্যাডভেঞ্চার করিনি। গুহার মধ্যে হঠাৎ পড়ে যাওয়া, পাইথন সাপ—কলকাতায় আমার স্কুলের বন্ধুরা শুনলে বিশ্বাসই করতে চাইবে না। কিন্তু এত বড় একটা আবিষ্কারের কথা কাগজে নিশ্চয়ই বেরুবে। তখন তো সবাইকে বিশ্বাস করতেই হবে।

কাকাবাবুজিগ্যেস করছিলেন, কাশ্মীর ছেড়ে যেতে আমার মন কেমন করবে: কি না! সত্যি কথা বলতে কী, আমার আর একটুও ভাল লাগছিল না থাকতে। যদিও শ্ৰীনগর দেখা হল না, তাহলেও-। পৃথিবীর লোক কখন আমাদের আবিষ্কারের কথা জানবে, সেই উত্তেজনায় আমি ছটফট করছিলাম।

কতক্ষণ বই পড়েছিলাম জানি না। হোটেলের বেয়ারা যখন খাবার নিয়ে এলো তখন খেয়াল হল। ওপারের হোটেল থেকে আমাদের তাঁবুতে খাবার নিয়ে আসে। কিন্তু কাকাবাবু তো এখনও এলেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম কাকাবাবুর জন্য। তারপর খিদেয় যখন পৌঁট চুই চুই করতে লাগল, তখন খেয়ে নিলাম নিজের খাবারটা। কাকাবাবুর খাবারটা ঢাকা দিয়ে রাখলাম।

বিকেল গড়িয়ে গেল তখনও কাকাবাবু এলেন না। দুশ্চিন্তা হতে লাগল খুব। কাশ্মীরে এসে কাকাবাবু কক্ষনো একলা বেরোননি। সব সময় আমি সঙ্গে থেকেছি। কিন্তু এখন যে একজনকে তাঁবুতে পাহারা দিতে হবে! এত দেরি করার তো কোনও মানে হয় না। ছোট জায়গা, পোস্ট আফিসে লাইন দিতেও হয় না। কলকাতার মতন। কাকাবাবুর কোনও অ্যাকসিডেনট হয়নি। তো? হঠাৎ জরুরী কাজে কারুর সঙ্গে দেখা করার জন্য কোথাও চলে যেতে হয়েছে? কিন্তু তাহলে কি আমায় খবর দিয়ে যেতেন না? কাকাবাবু তাঁবু থেকে বেরুতে বারণ করেছেন, আমি খোঁজ নিতে যেতেও পারছি না।

বিকেল থেকে সন্ধে, সন্ধে থেকে রাত নেমে এল। কাকাবাবুর দেখা নেই। এতক্ষণ এক-একা এই তাঁবুতে থেকে আমার কান্না পাচ্ছিল। কিছুই করার নেই, কারুর সঙ্গে কথা বলার নেই। কী যে খারাপ লাগে! আমার বয়সী কোনও ছেলে কি কখনও এতটা সময় একলা থাকে? সেই সকাল থেকে-এখন রাত সাড়ে নটা। মনে হচ্ছিল, তাঁবুর মধ্যে আমায় যেন কেউ বন্দী করে রেখেছে! কাকাবাবুর কাছে কথা দিয়েছি যে মুণ্ডুটাকে ফেলে রেখে আমি কোথাও যাব না-তাই বেরুনোর উপায় নেই। যদিও, আমাদের কাছে যে এই মহা মূল্যবান জিনিসটা আছে সে কথা কেউ জানে না।তবু কাকাবাবুর হুকম, সব সময় ওটা চোখে চোখে রাখা। এখন আমি কী করব কে আমায় বলে দেবে?

রাত নিঝুম হবার পর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। এর আগে কোনওদিন আমি একলা কোথাও ঘুমোইনি। আমার ভয় করে। কিছুতেই ঘুম আসে না। খালি মনে হয়, কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। কাদের যেন পায়ের দুপদীপ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলেই দেখলাম, আমার মাথার কাছে একটা বিরাট লম্বা লোক দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে মনে হল চোখের ভুল। একবার চোখ বন্ধ করে আর একবার তাকাতেই দেখলাম তখনও দাঁড়িয়ে আছে লোকটি। প্ৰথমে মনে হল, ইতিহাসের আমল থেকে বোধ হয় কোনও আত্মা এসেছে প্রতিশোধ নিতে। তারপরই বুঝলাম, তা নয়, আমি চিৎকার করে ওঠবার আগেই মস্ত বড় একটা হাত আমার মুখ চেপে ধরল। আমি সে হাতটা প্ৰাণপণ চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলাম না। তাকিয়ে দেখলাম, তাঁবুর মধ্যে আরও দুজন লোক আছে। তাদের একজন আমার মুখের মধ্যে খানিকটা কাপড় ভরে দিয়ে মুখটা বেঁধে দিল। হাত আর পা দুটোও বাঁধল। তারপর তারা তাঁবুর সব জিনিসপত্তর লণ্ডভণ্ড করতে লাগল। একটু বাদেই তারা দুদ্দাড় করে বেরিয়ে গেল তাঁবু থেকে।

ঘটনোটা ঘটতে দুতিন মিনিটের বেশি সময় লাগল না। আমার মুখ বন্ধ, হাত পা বাঁধা, কিন্তু দেখতে পেলাম। সবই। কারণ ওরা মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালছিল। তাঁবুর সব জিনিস ওরা ওলোট পালোট করে গেল, কিন্তু ওরা একটা জিনিসই খুঁজতে এসেছিল।

এতদিন আমাদের তাঁবুটা এমনি পড়েছিল, কেউ কোনও জিনিস নেয়নি। আজ ডাকাতি হয়ে গেল। তবে, ওদের মধ্যে একজনকে আমি চিনতে পেরেছি। অন্ধকারে মুখ দেখা না গেলেও যে-হাতটা আমার মুখ চেপে ধরেছিল, সেই হাতটার একটা আঙুল কাটা ছিল। সূচা সিং-এর একটা আঙুল নেই।

ওরা চলে যাবার পরও কিছুক্ষণ আমি চুপ করে শুয়ে রইলাম। যতক্ষণ ওরা তাঁবুতে ছিল, ততক্ষণ খালি মনে হচ্ছিল ওরা যাবার সময় আমাকে মেরে ফেলবে।

বেশ খানিকটা পর আমি আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। হাত বাঁধা, চ্যাঁচাবারও উপায় নেই। কিন্তু এই অবস্থায় তো সারারাত কাটানো যায় না।

আস্তে আস্তে নোমলাম খাট থেকে। জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোবার চেষ্টা করলাম। দুবার পড়ে গেলাম হুমড়ি খেয়ে, তবু এগুনো যায়। ইস্কুলের স্পোর্টসে স্যাক রেস-এ দৌড়েছিলাম আমি, অনেকটা সেই রকম, কিন্তু বুক এমন কাঁপছে যে ব্যালেন্স রাখতে পারছি না।

কোনও রকমে পৌছুলাম টেবিলের কাছে। ড্রয়ার খুলে বার করলাম ছুরিটা। কিন্তু ছুরিটা ঠিক মতন ধরা যাচ্ছে না কিছুতেই। অতি কষ্টে ছুরিটা বেঁকিয়ে ঘষতে লাগলাম হাতের দড়ির বাঁধনে। প্ৰথমে মনে হল, এটা একটা অসম্ভব কাজ। এ ভাবে সারা রাত ঘষেও দড়ি কাটা যাবে না-কারণ আঙুলে জোর পাচ্ছি না। শীতে আমি বাঁশ পাতার মতন কাঁপিছি। কিন্তু বিপদের সময় মানুষের এমন মনের জোর এসে যায় যে অসম্ভবও সম্ভব হয় অনেক সময়। একবার ছুরিটা পড়ে গেল মাটিতে। সেটা তুলতে গিয়ে আমি নিজেও পড়ে গেলাম—একটুর জন্য আমার গালটা কাটেনি। সেই অবস্থায়, মাটিতে শুয়ে শুয়েই আমার মনে হল, ঘাবড়ালে কোনও লাভ নেই, কান্নাকাটি করলেও কোনও ফল হবে না-আমাকে উঠে দাঁড়াতেই হবে, কাটতেই হবে হাতের বাঁধন। ছুরিটা নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। প্রায় আধা ঘণ্টা লাগল কাটতে, ততক্ষণে আমার হাত দুটো প্রায় অসাড় হয়ে এসেছে। মুখ ও পায়ের বাঁধন খুলে ফেললাম। এঃ, আমার মুখের মধ্যে এমন একটা ময়লা রুমাল ভরে দিয়েছিল যে দেখেই আমার বমি পেয়ে গেল, বমি করে ফেললাম মাটিতে।

এই সময় বমি করার কোনও মানে হয়? কিন্তু রুমালটায় এমন বিশ্ৰী গন্ধ যে কিছুতেই সামলানো গেল না। ফ্লাস্কের গরম জলে মুখ ধুয়ে ফেললাম। তাও, ঠিক ঠক করে কাঁপতে লাগিলাম শীতে।

তাঁবুর মধ্যে এক নজর তাকিয়েই বোঝা যায়, ওরা সেই কাঠের বাক্সটা নিয়ে গেছে। পাথরের মুণ্ডুটার কোনও মূল্যই ওদের কাছে নেই-তবু কেন নিয়ে গেল? হয়তো। ওরা নষ্ট করে ফেলবে। ওরা কি কাকাবাবুকে মেরে ফেলেছে! ওরা কি আমাকেও মারবে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress