ইতিহাসপ্ৰসিদ্ধ রাস্তায়
সেদিন সন্ধেবেলা পহলগ্রামে আমাদের তাঁবুতে ফিরে এসে টের পেলাম, আমার বাঁ পায়ে বেশ ব্যথা হয়েছে। কখন একটু মচকে গেছে টের পাইনি। আয়োডেক্স মালিশ করলাম বেশ করে। কাকাবাবু যদিও বললেন, তাঁর কিছু হয়নি, তবুও আমি ওঁর দু পায়ে মলম মালিশ করে দিলাম।
বলতে ভুলে গেছি, এখানে সন্ধে হয় নটার সময়। সাড়ে আটটা পর্যন্ত বিকেলের আলো থাকে। প্রথম প্রথম ভারী অদ্ভুত লাগত। আমাদের রাত্তিরের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলেও বাইরে তখন বিকেল। সূর্য অস্ত যাবার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত দিনের আলো। আমাদের দেশেই কত জায়গায় কত যে আশ্চর্য সব ব্যাপার আছে। বই পড়ে এই পৃথিবীটাকে কিছুই চেনা যায় fr।
সিদ্ধাৰ্থদারা বলেছিলেন, ওঁরা আজকের রাতটা প্লাজা হোটেলে থাকবেন। ভেবেছিলাম ফিরে এসে ওঁদের সঙ্গে দেখা করে আসব। কিন্তু পায়ের ব্যথার জন্য যাওয়া হল না। হোটেলটা বেশ খানিকটা দূরে। বিছানায় শুয়ে লীদার নদীর শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা উঠে কাকাবাবুকে কিছু না বলেই আমি বেরিয়ে পড়লাম একলা-একলা। আজ কাকাবাবুর থেকেও আমি আগে উঠেছি। লীদার নদী পহলগ্ৰামে যেখানটায় ঢুকেছে, সেখানে একটা ছোট্ট কাঠের ব্রিজ। আমি ব্রিজটার ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। সিদ্ধাৰ্থদারা অমরনাথে যাবেন, এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে।
একটু পরেই দেখা গেল ওঁদের। সঙ্গে আরও কয়েকজন লোক আছেন, আর দুজন গাইড। সবাই ঘোড়ার পিঠে। স্নিগ্ধাদি আর রিণিকে তো চেনাই যায় না। ব্রীচেস, ওভারকোট, মাথায় টুপি, হাতে দস্তানা, চোখে কালো চশমা। সিদ্ধাৰ্থদাকেও বেশ মানিয়েছে, তবে সিদ্ধাৰ্থদার ঘোড়াটা ওঁর তুলনায় বেশ ছোট।
স্নিগ্ধাদি আমাকে দেখেই বললেন, ওমা, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? আমরা ভাবলুম বুঝি তোর সঙ্গে আর দেখাই হল না। কাল সারাদিন কোথায় ছিলি?
সোনমার্গে ছিলাম।
ওখানে কী করলি? ওখানে তো দেখার কিছু নেই।
আমি চট্ট করে একটু আকাশের দিকে তাকালাম। সত্যিই, আকাশটা রোজই নতুন হয়ে যায়।
সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, সন্তু, তুমিও আমাদের সঙ্গে গেলে পারতে!
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, আমাদের এখানে অনেক কাজ আছে।
সিদ্ধার্থদা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে এসে আবার কাজ কী? এখানেও স্কুলের হোম-টাস্ক করছ নাকি?
উত্তর দিলাম না। ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেলাম খানিকটা। রিণিকে বললাম, শোন, মুখে অনেকটা করে ক্রিম মেখে নে। না হলে কিন্তু ভীষণ চামড়া ফাটে!
রিনি খিলখিল করে হেসে বলল, দিদি, দেখছ, সন্তু কী রকম বড়দের মতন কথা বলতে শিখেছে?
আহা, আমি তোদের থেকে বেশিদিন আছি না! আমি তো এসব জানবই!
তুই সত্যি আমাদের সঙ্গে গেলে পারতিস। তুই বেশ গাইড হাতিস আমাদের! জানিস, আমি অনেকগুলো ছবি এঁকেছি। তোকে দেখানো হল না।
আমার তো ইচ্ছে হচ্ছিল তক্ষুনি ওদের সঙ্গে চলে যাই। যে-পোশাক পরে আছি, সেইভাবেই। কিন্তু তা হয় না। আমি একটু অবজ্ঞার সঙ্গে বললাম, অমরনাথে এমন কিছু দেখবার নেই। ওসব মন্দির-টন্দির দেখতে আমার ভাল লাগে না। তাছাড়া আমি তো চন্দনবাড়ি আর কোহলাই পর্যন্ত গিয়েছি একবার!
স্নিগ্ধাদি বললেন, হ্যাঁরে, আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত থাকিবি তো? আমাদের তো যাওয়া-আসা নিয়ে বড়জোর সাতদিন! কিংবা রাস্তা খারাপ থাকলে তার আগেও ফিরে আসতে পারি!
আমি জোর দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, থাকব। থাকব।
রিণি ঘোড়ার ওপর একটু ভীতু ভীতু ভাবে বসে ছিল। আমি ওকে বললাম, এই, ঠিক করে শক্ত হয়ে বোসী! প্রথম দিন একটু গায়ে ব্যথা হবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
রিণি বলল, যা, যা, তোকে আর শেখাতে হবে না! এলি না তো আমাদের সঙ্গে!
আমি বললাম, তোরা অমরনাথ থেকে ফিরে আয়-তখন অন্য কোথাও আমরা সবাই মিলে এক সঙ্গে বেড়াতে যাব।
তারপর ওরা এগিয়ে গেল, আমি দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দিকে হাত নাড়তে লাগলাম।
ক্যাম্পে ফিরেই আবার সব কিছু অন্যরকম হয়ে গেল। কাকাবাবু ততক্ষণে উঠে পড়েছেন। আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম বলে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। একমনে ম্যাপ দেখছিলেন। এক সময় মুখ তুলে বললেন, সন্তু, আমি ঠিক করলাম, পহেলগ্ৰামে আমাদের আর থাকা হবে না। এখান থেকে যাতায়াত করতে অনেক সময় যায়। সোনমার্গ থেকে কাল পাহাড়ের নীচে যে ছোট্ট গ্রামটা দেখলাম, ওখানে গিয়েই দিন দশেক থাকা যাক?
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। পহলগ্ৰাম থেকেও চলে যেতে হবে? সিদ্ধাৰ্থদা, রিণি, স্নিগ্ধাদিদের সঙ্গে আর দেখা হবে না?
আমি মুখ শুকনো করে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ গ্রামে থাকব? ওখানে থাকার জায়গা আছে?
কাকাবাবু আমার মুখের দিকে না তাকিয়েই বললেন, সে ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কালকে ঘোড়াওয়ালা ছেলে দুটোর সঙ্গে কথা বলেছি। ওরাও ঐ গ্রামে থাকে। এটাই বেশ ভাল হবে। চেন্নাশুনো। কারুর সঙ্গে দেখা হবে না-নিরিবিলিতে কাজ করা যাবে।
চেন্নাশুনা লোকের সঙ্গে দেখা হলে সবাই খুশি হয়। কাকাবাবুর সব কিছুই অন্যরকম। ঐ ছোট্ট গ্রামে থাকতে আমার একটুও ইচ্ছে করছে না। তবু পহেলগ্রামে কত লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়। এখন এ জায়গা ছেড়ে আবার কোন ধাদোড়া গোবিন্দপুরে যেতে হবে। কিন্তু কাকাবাবু একবার যখন ঠিক করেছেন, তখন যাবেনই!
কাকাবাবু বললেন, জিনিসপত্তর সব গুছিয়ে নাও। বেশি দেরি করে আর व्लाऊ र्दी?
বাস-স্টপের কাছে আজও সূচা সিং-এর সঙ্গে দেখা হল। বিশাল একখানা হাত আমার কাঁধের ওপর রেখে বললেন, কী খোকাবাবু, কাল সোনমার্গ কী রকম বেড়ানো হল?
তারপর হা-হা করে হেসে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী প্রোফেসারসাব, কাল যে বললেন সোনমাৰ্গ যাবেন না? আমি তো কাল দেখলাম, আপনারা সোনমাৰ্গ থেকে ফিরছেন বিকেলে!
কাকাবাবু নীরসভাবে বললেন, আমরা কবে কোথায় যাই কোনও ঠিক তো নেই।
তা এই গরিব মানুষের গাড়িতে যেতে আপনার এত আপত্তি কেন? আমি তো ঐদিকেই যাই!
তোমাকে শুধু শুধু কষ্ট দিতে চাই না।
এতে তকলিফ কী আছে? আপনি এত বড় পড়ালিখা জানা আদমি, আপনার যদি একটু সেবা করতে পারি-আপনি আজ কোনদিকে যাবেন?
আজও সোনমাৰ্গই যাব!
সূচা সিং একটু অবাক হয়ে গেলেন। ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আবার সোনমার্গ? ওখানে কিছু পেলেন? জায়গাটা তো একদম ন্যাড়া। কিছু নেই।
কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, সিংখ্রজী, তুমি মিথ্যেই ভাবনা করছিা! আমি সোনা খুঁজছি না। সে সাধ্যও আমার নেই।
সূচা সিং গলার আওয়াজ নিচু করে বললেন, আপনি মাটন-এর পুরনো মন্দিরে গেছেন? সবাই যে সূর্য দেবতার মন্দিরে যায় সেখানে নয়—পাহাড়ের ওপরে যে পুরনো মন্দির? লোকে বলে ঐ মন্দির ললিতাদিত্যের আমলের চেয়েও পুরনো। সিকান্দর বুত শিকন ঐ মন্দির ভেঙে দেয়। কেন অতি কষ্ট করে ঐ বিরাট মন্দির ভেঙে দিল জানেন? ঐ মন্দিরের কোনও জায়গায় মণি মণ সোনা পোঁতা আছে। সিকন্দর বুত শিকন তা খুঁজে পায়নি। সেই সোনা এখনও আছে।
কাকাবাবু বললেন, তাহলে সে কথা আমাকে বলে দিচ্ছ কেন? সোনার কথা কি সবাইকে বলতে আছে? নিজেই খুঁজে দেখো না।
সূচা সিং কাকাবাবুকে একটু তোষামোদ করার সুর করে বললেন, আপনারা পণ্ডিত লোক, আপনারা জানেন রাজারা কোথায় কোন জায়গায় গুপ্ত সম্পদ লুকিয়ে রাখতেন। সাধারণ লোকেরা কি ওসব জানতে পারে?
তাই যদি হত সিংজী, তাহলে পণ্ডিতরা এত গরিব হয় কেন? পণ্ডিতরা সোনার খবর কিছুই বোঝে না! আচ্ছা চলি?
সূচা সিং বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! কমসে কম এক পেয়ালা চা তো খান আমার সঙ্গে?
কাকাবাবু বললেন, আমি সকালে দুকাপের বেশি চা খাই না। সেই দু কোপ আজ খাওয়া হয়ে গেছে।
তা হলে খোকাবাবুকে কিছু খাইয়ে দিই! খোকাবাবু জিলাবি খেতে খুব ভালবাসে!
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমি কিছু খাব না। আমার পেট ভর্তি!
তবু সূচা সিং আজ আর কিছুতেই ছাড়লেন না। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে এড়ানো গেল না। আজ জোর করে আমাদের তুললেন নিজের গাড়িতে। একটা বেশ মজবুত জিপ গাড়ি, সূচা সিং সেই গাড়িতেই ওদিকেই কোথায় যেন যাচ্ছেন কোনও একজন সরকারী হোমরা-চোমরার সঙ্গে দেখা করতে।
যাওয়ার পথে সূচা সিং অনেক গল্প করতে লাগলেন। আমি অবশ্য সব বুঝতে পারলাম না। আমি তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে। কী সুন্দর ছবির মতন রাস্তা। পাহাড় চিরে এঁকেবেঁকে উঠেছে। দু পাশে পাইন আর পপলারের বন। মাঝে মাঝে চেনার গাছও দেখা যায়। চেনার গাছগুলো কী বড় বড় হয়, অনেকটা দেবদারু গাছের মতন-যদিও পাতাগুলো অন্যরকম। gঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে যায় আখরোট, খোবানি আর নাশপাতির গাছ। এগুলো অবশ্য আমার চোখে এখন নতুন লাগে না। আমি গাছ থেকে বুনো আপেল আর আঙুরও ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছি। কলকাতায় বসে এ কথা স্বপ্নেও ভাবা যায়? কত যে গোলাপফুল রাস্তাঘাটে ফুটে আছে!
কাকাবাবুজিজ্ঞেস করলেন, সিংজী, তুমি এই কাশ্মীরে কতদিন আছ?
সূচা সিং বললেন যে, কাশ্মীরে যখন যুদ্ধ হয় সাতচল্লিশ সালে, তখন তিনি এখানে এসেছিলেন লড়াই করতে। তখন সৈনিক ছিলেন। যুদ্ধে তাঁর একটা আঙুল কাটা যায়।
সূচা সিং তাঁর বাঁ হাতটা দেখালেন, সত্যিই তাঁর কড়ে আঙুলটা নেই।
সূচা সিংহাসতে হাসতে বললেন, আমি সবাইকে কী বলি জানেন? এই কড়ে আঙুলের ধাক্কা দিয়েই আমি হানাদারদের তাড়িয়ে দিয়েছি।
তারপর, তুমি এখানেই থেকে গেলে?
না। যুদ্ধ থামলে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাশ্মীর আমার এমন পসন্দ হয়ে গেল, সেনাবাহিনীর কাজ ছেড়ে দিয়ে আমি এখানেই চলে এলাম ব্যবসা করতে। এখন আমি এখানকারই লোক। কাশ্মীরি মেয়েকেই শাদী করেছি। দু। শো টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম এখন দেখুন না, আমার নয়খানা গাড়ি খাটছে! কাশ্মীরের মাটিতে সোনা আছে, বুঝলেন! নইলে ইতিহাসে দেখুন না, সবারই লোভ ছিল কাশ্মীরের দিকে!
কাকাবাবু তাঁকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, তুমি লেগে থাকে। তুমি হয়তো একদিন এই সোনার খোঁজ পেয়েও যেতে পারো সিংজী।
সোনমার্গ পৌঁছে সূচা সিং তাঁর চেনা একজন লোককে ডেকে বললেন, এই প্রোফেসার খুব বড়া আদমি। সব সময় এর দেখাশোনা করবে।
তারপর সূচা সিং চলে গেলেন। কাকাবাবু অবশ্য সূচা সিং-এর চেনা লোকটিকে পাত্তাই দিলেন না। তার হাত এড়িয়ে সোজা চলে এলেন। ঘোড়াওয়ালাদের জটলার দিকে। গত কালের সেই দুটো ছেলেকেই ঠিক করলেন আজ; কোনও রকম দরদরি না করেই ঘোড়ায় চড়ে বসে বললেন, চলো?
একটু দূরে গিয়েই কাকাবাবু থামলেন। ঘোড়াওয়ালা ছেলে দুটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এই তোমাদের নাম কী?
নাম জিজ্ঞেস করতেই ওদের কী লজ্জা। মেয়েদের মতন ওদের ফস গাল লাল হয়ে গেল। কিছুতেই বলতে চায় না। কেউ বুঝি কখনও ওদের নাম জিজ্ঞেস করেনি। একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসছে। তাই দেখে আমি আর কাকাবাবুও হাসতে লাগলাম। অনেক কষ্টে জানা গেল, একজনের নাম আবুতালেব। আর একজনের নাম তো বোঝাই যায় না। শুনে মনে হল, ওর নাম হুদা। কী? আর কিছু নেই? শুধু হুদা? তা সে জানে না। নামটা যেন খুবই একটা অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার।
কাকাবাবু আমার দিকে চেয়ে বললেন, এরা হচ্ছে খশ জাতি। এদিককার পাহাড়ে এদের দেখা যায়।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এখানে না এলে কি জানতে পারতাম, খশ জাতি নামেও একটা জাতি আছে আমাদের দেশে! যে-জাতের একটা ছেলে নিজের নামটাও ভাল করে জানে না। হুদার মতন একটা বিদঘুটে নাম কে ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, তাই নিয়েই ও খুব খুশি। অথচ কী সুন্দর দেখতে ছেলেটাকে। আর বেশ চটপটে, বুদ্ধিমান।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের গ্রামে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে? আমাদের থাকতে দেবে?
ছেলে দুটি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এ রকম প্রশ্ন ওরা কখনও শোনেনি। ওদের গ্রামে বোধহয় কোনও বাইরের লোক থাকেনি কখনও।
কাকাবাবু পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে বললেন, যদি থাকতে দাও। তাহলে রোজ দশ টাকা করে ভাড়া দেব। তাছাড়া খাবার খরচ আলাদা। যে-কোনও রকমের একটা ঘর হলেই আমাদের চলবে।
টাকাটা দেখেই ওদের মুখে হাসি ফুটল। পরস্পর কী যেন আলোচনা করে নিয়েই ওরা রাজি হয়ে গেল। তা বলে, ওদের কিন্তু লোভী মনে করা উচিত নয়। ওরা বড় গরিব তো, টাকার খুব দরকার ওদের।
গলাঙ্গীর নামে একটা জায়গা আছে, সেইদিকে ওদের গ্রাম। আমরা উঠতে লাগলাম পাহাড়ি পথে। পাশ দিয়ে রুপের পাতের মতন একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। কাকাবাবু বললেন, ওর নাম কঙ্গনা নদী। সন্তু ঐ যে রাস্তাটা দেখতে পােচ্ছ, ঐ রাস্তাটা চলে গেছে লন্দাকে। এমনিতে লোক যাকে বলে। লাদাক। এই রাস্তাটা খুব ভয়ংকর। এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে কত মানুষ যে প্ৰাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই!
আস্তে আস্তে ঘোড়া চলছে, আমি চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। কী সুন্দর জায়গাটা! এখানে এলে মরার কথা মনেই হয় না। পাহাড়ের পর পাহাড়ের সারি। দূরে একটা পাহাড়ের মাথা সব পাহাড়কে ছাড়িয়ে জেগে রয়েছে। সেটা দেখতে ঠিক মন্দিরের মতন।
কাকাবাবু, মন্দিরের মতন ঐ পাহাড়টার নাম কী?
ঠিকই বলেছিস, মন্দিরের মতন! সাহেবরাও ঐ পাহাড়ের নাম দিয়েছে। ক্যাথিড্রাল পীক। সব পাহাড় ছড়িয়ে উঠেছে। ওর মাথা। দেখলেই মনে হয় না, এক সময় দেবতারা থাকত। এখানে? ঐ যে রাস্তাটার কথা বললাম, ওটাকে ওয়াঙ্গাথ নালাও বলে। ঐ রাস্তা শুধু লন্দাকে নয়, ওটা দিয়ে সমরখন্দ, পামীর, বোখারা, তাসখন্দ যাওয়া যায়। হাজার হাজার বছর আগে থেকেও মানুষ ঐ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছে। ঐ রাস্তাটার জন্যই আমার এখানে আসা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাকাবাবু, এই রাস্তা দিয়েই কি আর্যরা ভারতে এসেছিল?
কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক বলা যায় না। আর্যদের বোধহয় রাস্তা কিছু কিছু বানিয়ে নিতে হয়েছিল। ইন্দ্ৰ কাশ্মীরে পাহাড় ফাটিয়ে বদ্ধ জলাশয়ের মুক্তি দিয়েছিলেন-এ রকম একটা কাহিনীও আছে।
যেতে যেতে একটা মিলিটারি ক্যাম্প পড়ল। বন্দুকধারী মিলিটারি এসে আমাদের আটকাল। কাকাবাবু ঘোড়া থেকে নেমে তার সঙ্গে কী যেন কথা বললেন। দেখালেন। কাগজপত্র। যে কোনও জায়গায় ঘোরাফেরা করার অনুমতিপত্ৰ কাকাবাবুর আছে। কাকাবাবুর কাছে একটা রিভলবার থাকে। সেটা আর তার লাইসেন্সও দেখালেন বার করে।
মিলিটারির লোকেরা আমাদের চা না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বে না। প্রায় জোর করে নিয়ে গেল ওদের তাঁবুতে। আমাদের দেখে ওরা হঠাৎ যেন খুব খুশি হয়ে উঠেছে। কাকাবাবু বললেন, ওরা তো কথা বলার লোক পায় না। মাসের পর মাস এখানে এমনি পড়ে আছে, আমাদের দেশকে পাহারা দিচ্ছে। তাই কথা বলার লোক পেলে ওদের ভাল লাগে।
সেখানে দুধে সেদ্ধ করা চা আর হালুয়া খেলাম। গল্প করলাম কিছুক্ষণ। আমাকে একজন মিলিটারি বলল, খোকাবাবু, হরিণের শিং নেবে? এই নাও!
বেশ একটা হরিণের শিং উপহার পেয়ে গেলাম। মিলিটারি দুজনেই পাঞ্জাবী শিখ। ভারী ভাল লোক। ঠিক আত্মীয়-স্বজনের মতন ব্যবহার করছিল। আমাদের সঙ্গে। আমরা একটা পাহাড়ি গ্রামে থাকব। শুনে ওরা তো অবাক। কত রকম অসুবিধের কথা বলল। কাকাবাবু সে সব হেসে উড়িয়ে দিলেন। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার উঠতে লাগলাম পাহাড়ি রাস্তায়। কাকাবাবু বললেন, আমরা সাড়ে সাত হাজার ফিটেরও বেশি উঁচুতে এসেছি।
আবু তালেব আর হুদীদের গ্রাম পাশাপাশি। কোন গ্রামে থাকব, তাই নিয়ে ওরা দুজনে আমাদের টানাটানি করতে আরম্ভ করল। কেউ ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত সব দেখেশুনে কাকাবাবু ঠিক করলেন, আবু তালেবদের গ্রামটাতেই থাকবেন। তবে, হুদা আমাদের জন্য রান্নাটান্নাও অন্যান্য ব্যাপার দেখাশুনোর কোজ নেবে-এ জন্য সে-ও রোজ দশ টাকা করে পাবে।
ওদের গ্রামে পৌঁছুনো-মাত্র গ্রামের সব লোক ভিড় করে এসে আমাদের ঘিরে ধরল। সবারই চোখে মুখে দারুণ কৌতূহল। ওদের গ্রামের বাচ্চারা কিংবা মেয়েরা আমাদের মতন জামাকাপড়-পরা মানুষই কখনও দেখেনি।
আবু তালেব নিজস্ব ভাষায় ওদের কী সব বোঝােল। ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করল খানিকক্ষণ। তারপর আমাদের একটা ঘরে নিয়ে গেল! একখানা ছোট কাঠের ঘর, বোধহয় অন্য কেউ থাকত, আমাদের জন্য এইমাত্র খালি করা হয়েছে। কাকাবাবু একবার দেখেই ঘরটা পছন্দ করে ফেলেছেন।
গ্রামখানা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। পাহাড়ের গায়ে বাড়িগুলো যেন সাজিয়ে সাজিয়ে বসানো হয়েছে। পাহাড়ের নীচের দিকে খুব ঘন জঙ্গল। শুনলাম, এই গ্রামে একটাই শুধু অসুবিধে, খুব জলের কষ্ট। পাহাড়ের একেবারে নিচু থেকে জল আনতে হয়। হোক, এই শীতে বেশি জল তো লাগবে না। আমাদের!
আমাদের ঘরখানার পেছনেই খানিকটা সমতল জায়গা। তার পর খাদ নেমে গেছে। খাদের ওপারে। আর একটা পাহাড়, সেই পাহাড়টা ভর্তি জঙ্গল। জানলা দিয়ে তাকালে মনে হয়, ঠিক যেন বিরাট একটা পাহাড়ের ছবি আকাশের গায়ে ঝোলানো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, ঘরটা ভাল করে গুছিয়ে ফ্যাল। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুই এখানে থাকতে পারবি তো?
আমি ঘাড় কাৎ করে বললাম, হ্যাঁ। কতদিন থাকব এখানে?
দিন দশ-বারো। এর মধ্যে যদি কিছু না হয়, তাহলে এবারকার মতন ফিরে যেতে হবে। তোরও তো ইস্কুলের ছুটি ফুরিয়ে আসবে।
আমার ইস্কুল খুলতে এখনও কুড়ি দিন বাকি।
ঠিক আছে। এবার ভাল করে কাজ শুরু করতে হবে।
আমার শুধু একবার মনে হল, সিদ্ধাৰ্থদা, স্নিগ্ধাদি, রিণিরা জানতেও পারবে না, আমরা কোথায় আছি। ওদের সঙ্গে আর দেখা হবে না।