Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin » Page 8

ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin

বাড়িতে আমার এক মামাতো ভাই বেড়াতে আসে। রতন। আমার সমবয়সী। বন্ধুর মত।

–কীরে খুব সংসার করছিস! তুই সেদিনের মেয়ে, এত সংসারি হলি কি করে? ঘরবাড়ি ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতে রতন বলে।

–মেয়েরা সংসারি না হলে আর হবে কী! আমার বিষণ্ণ উত্তর। রতনের সঙ্গে ছোটবেলার গল্প করি। একবার পেয়ারা গাছে আমার জন্য পেয়ারা পাড়তে উঠেছিল। পড়ে পা ভেঙে গিয়েছিল ওর।–আহা তোর জন্য সে কী কেঁদেছিলাম আমি। আচ্ছা, তোর মনে আছে টুটুলের কথা? কী ধরাটা খেয়েছিল! মামা কী এখনও রাতে রাতে ভূত দেখে চমকে ওঠে? আমার চোখের তারায় থিরথির করে নষ্টালজিয়া কাঁপে।

রতন চটপটে ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। দুটো তিনটে মেয়ের সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় হয়েছে, ওদের কী করে প্রেমে পড়ানো যায়, সেই ফন্দি করে। এ নিয়ে আমরা তুমুল হাসি। রতন ঠোঁট উল্টে বলে–আসলে জানিস হীরা, একটু খরচ করতে পারলে মেয়েদের পটানো যায়।

–কী রকম খরচ?

–ধর, কেন্টিনে চা সিঙারা খাওয়ালাম। চায়নিজে নিয়ে গেলাম। কিছু গিফট করলাম।

–আরে না, মেয়েরা এইসব পেলে খুশি হবে কেন? ওরা এত লোভী নাকি!

–তুই মেয়েদের চিনিসই না, ওরা খুব পাজি হয়।

–পাজিই যদি হয়, তবে আর প্রেম করতে চাও কেন?

–চাই। প্রেম তো করতেই হবে।

–পাজিদের সঙ্গে প্রেম করতে হবে?

–এছাড়া উপায় কী!

–ওদের ছাড়া তাহলে তোমার উপায়ও নেই।

রতন চলে যেতে চায়। আমি আটকে রাখি, বলি–খেয়ে যাও।

দুপুরে এক সঙ্গে খাই। রতন বলে–তুই খুব সুখে আছিস।

–সুখ করে নাম? বাড়ি গাড়ি, ভাল খাওয়া দাওয়া, টেলিভিশন, ভি. সি. আর, ডিশ এন্টেনা……এসবেই বুঝি খুব সুখ থাকে?

–তা তো থাকেই, যা চাচ্ছিস, পাচ্ছিস।

–অনেক জিনিসপত্র এ বাড়িতে হয়ত আছে। কিন্তু যা চাচ্ছি তা পাচ্ছি, এটা ঠিক নয়।

–বলে না সুখে থাকলে ভূতে কিলায়, তার হয়েছে সেই রোগ। রতন রাগ করে বলে। সে চায় তার বোনটি সুখে আছে, সুখে থাক। এই সুখের মধ্যে কখনও কোনও অসুখ যেন বাসা না বাঁধে। রতন দুপুরের খাবার খেয়ে চা টা খায়। বলে–দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বিকেলে জরুরি একটা কাজ আছে রে। চলে যেতে হবে। তুই দুলাভাইকে নিয়ে বেড়াতে আসিস। বাড়িতে তোদের কথা খুব হয়, তোদের মানিয়েছে খুব এই সব। সময় নিয়ে যাস, কেমন? আলতাফ ঘরে ফিরলে রতনের কথা বলি। ও এসেছিল, দুপুরে খেয়ে গেছে এইসব। আলতাফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে–কোন রতন?

–ওই যে এনায়েত মামার ছেলে। চেনো না? তোমাকে না সেদিন শার্ট প্রেজেন্ট করল।

–ও। ও কী বলল?

–গল্প টপ করল।

–কী গল্প করলে?

–এই ছোটবেলার কথা টথা। তারপর ওর ইউনিভার্সিটির গল্প।

–আর?

–আর কী এইসবই।

–বাড়ি বয়ে ছোটবেলার গল্প করতে এসেছে?

–মামাতো ভাইএর সঙ্গে ছোটবেলার গল্পই তো হবে। এক সঙ্গেই যখন বড় হয়েছি। আমি তো দশ বছর অব্দি নানাবাড়িতেই ছিলাম।

–বড়বেলার কোনও গল্প করনি?

–বড়বেলার মানে?

–এই ধর তোমার স্বামীটি কেমন, তাকে তোমার ভাল লাগে কি না। সহ্য হয় কি না। তাকে ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে কি না।

–তোমাকে নিয়ে কোনও কথাই হয়নি।

–ও, তাহলে নিজেদের নিয়েই মত্ত ছিলে! আমাকে ভুলেই ছিলে!

–তোমাকে ভুলব কেন!

–আমি কী করে বিশ্বাস করি?

–এসব বলে আমার লাভ কী বল?

–লাভ নিশ্চয়ই আছে। লাভ না থাকলে আর বলছি কেন?

–তুমি যে কী সব বলছ, বুঝতে পারছি না।

–বুঝতে পারবে কেন। তোমার তো মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে।

মাথা সত্যিই ঝিমঝিম করে ওঠে আমার। আলতাফ খেতে বসে বারবারই বলে–মামাতো ভাইটাই এর দৃষ্টি সুবিধের হয় না। ও কি আবার আসবে নাকি? জরুরি না হলে…..কী দরকার আসার?

সারারাত আমার ঘুম আসে না। কেমন দম বন্ধ লাগে। অল্প অল্প করে কোথায় ঠেলে দিচ্ছে সে আমাকে। রতন আর না আসুক, আলতাফ চায়। আমার এ কথা মানতে হবেই। কারণ এই বাড়িটি আলতাফের। যতই আমি বলি এটি আমার সংসার, আমার বাড়ি, আসলে যে এটি আলতাফের বাড়ি, তা সে সময় মত বুঝিয়ে দেয়। আমার একজন আত্মীয়কেও যে ইচ্ছে করলে আমি বাড়িতে ডাকতে পারি না, তাও কায়দা করে বোঝায়। আমার কিছুতে অধিকার নেই। না সম্পদে, না স্বাধীনতায়। মামাতো ভাইদের দৃষ্টি ভাল হয় না বলবার কারণ কী, রতন কি আমার দিকে খারাপ চোখে তাকায়। আলতাফের অযথা সন্দেহ হয়, স্পষ্ট বুঝি। এই অমূলক সন্দেহের কারণ কী তবে এই যে সে ভাবছে আমি কারও প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি? রতনের প্রতি? এক রাতে আলতাফের তিন বন্ধু আসে বাড়িতে। এদের সবার সঙ্গে আমার আলাপ আছে। আলতাফ এদের বাড়ি আমাকে নিয়েও গেছে। ড্রইংরুমে বসে তারা যখন ধুম আড্ডা দিচ্ছে, আমি ভাবছি ও ঘরে গিয়ে বসব, চা টা খাব এক সঙ্গে। এলো চুলগুলো আঁচড়ে নিয়ে যেই যাব, আলতাফ আচমকা ঘরে ঢুকে বলে।

–আমি বলেছি তুমি অসুস্থ। শুয়ে আছ।

–আমি তো অসুস্থ নই! বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করি।

–ওদের বলেছি তুমি অসুস্থ। তোমার ওঘরে যাবার দরকার নেই। ওরা লোক তেমন ভাল নয়।

–তুমি না নিজেই বলেছ মনজুর, হায়দার, লতিফ এরা খুব ভাল বন্ধু তোমার!

–দূর, যতসব বাজে। আলতাফ কপাল কুঁচকে বলে।

–কেন কী করেছে ওরা?

–এরা হেন খারাপ কাজ নেই যে না করে।

–আমার সঙ্গে তো করেনি।

–তার মানে আমার কথা তুমি শুনবে না? তুমি ওখানে শরীর দেখাতে যাবে!

–শরীর দেখাতে যাব, তোমারই তাই মনে হয়?

–হ্যাঁ, তাই।

–তুমি এত মিন। ছি ছি।

–যত ছিছি কর ঘরে বসে কর। ওঘরে যেতে হবে না।

ওঘর থেকে হাসির শব্দ শোনা যায়। ওরা মদ খাচ্ছে। প্রায় রাতেই স্কচ হুইস্কির • বোতল খুলে ওরা বসে। আমি শুয়ে থাকি একা ঘরে। নিজেকে বড় একা মনে হয়। জগৎ সংসারে কেউ নেই যেন আমার। আলতাফকে আপন ভাবতে শিখিয়েছিল আমাকে সবাই, পরিবারের লোকেরা, পাড়া পড়শি, চেনা অচেনা সবাই। আপন তাকে তো ভেবেছিলাম, কিন্তু এ আবার কেমন আপন লোক, সে একা ফুর্তি করে, আমাকে ছাড়া! আমাকে একা ঘরে ফেলে! হঠাৎ লক্ষ্য করি আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে জলে। রোধ করতে পারি না। বালিশ ভিজে যায়।

রাতে বন্ধুবান্ধব বিদেয় করে শুতে আসে আলতাফ। মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোয়। আমার নাক জ্বলে যায়। কথা জড়িয়ে আসে আলতাফের। বলে–লেট মি লাভ। লেট মি লাভ হীরা।

আমি সরিয়ে নিই শরীর। আলতাফ শক্ত হাতে টানে আমাকে। হাত ধরে রাখে শক্ত মুঠোয়, ছাড়াতে চাই, শক্তিতে পারি না। মুচড়ে দেয় হাত। ককিয়ে উঠি কষ্টে, বলি-খবরদার আমাকে ছোঁবে না।

হঠাৎ আমার গালে কষে চড় দেয় আলতাফ। চমকে উঠি। আলতাফ, আমার স্বামী, সে আমাকে মারছে। বিশ্বাস করতে পারি না। কথা কাটাকাটি হয়, সেটা মানা যায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত গায়েও হাত তুলল। আমাকে আবারও চমকে দিয়ে পর পর আরও চড় কষাতে থাকে দুই গালে। আমি আমার শরীরের সবটুকু শক্তি খরচ করেও নিজেকে ছাড়াতে পারি না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *