ভ্রমর কইও গিয়া : 02
আলতাফ মদ খায় না। মেয়েমানুষ দেখলে ছোঁক ছোঁক করে না। সবই আমি স্বীকার করি। সে কি আমাকে গালমন্দ করে? না তাও করে না। বরং বুকের মধ্যে জড়িয়ে। বলে ‘ও আমার হীরে। ও আমার সোনা বউ।‘ অফিস থেকে ফিরেই ‘হীরা হীরা হীরা। হীরা কাছে বস। হীরা হাসো। হীরা মুখ তোল। হীরা কী আর মুখ তোলে! হীরার তো মুখ তুলতে ইচ্ছে করে না। হীরা তুমি কি খেতে ভালবাস? চল আজ সোনার গায়ে খাই। চল লং ড্রাইভে কোথাও যাই। হীরার কি আর যেতে ইচ্ছে করে। ভাল না লাগায় পেয়েছে তাকে। সে কেন যাবে?
মা আসেন। আশংকা তিরতির করে কাঁপে তাঁর চোখের তারায়। আমাকে আড়ালে ডেকে মা জিজ্ঞেস করেন–আলতাফ কি তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে? আমি জানালায় উদাস তাকিয়ে উত্তর দিই–না।
–তোর শ্বশুর শাশুড়ি, ওঁরা কী তোকে ভালবাসেন না? মা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন।
–বাসেন। আমি দু’আঙুলে জানালার শাদা গ্রিলগুলোর ময়লা তুলতে তুলতে বলি।
–আর আলতাফ?
–আলতাফও। আমার স্বরে যথেষ্ট সংযম।
–সময় মত ফেরে অফিস থেকে?
–ফেরে।
–তোকে কি রান্নাবান্ন করতে বলে?
–না। ও তো কাজের লোকেহ করে।
— বেড়াতে টেড়াতে নয়?
–হ্যাঁ নেয়। সেদিন চিটাগাং গেলাম।
–তবে? তুই থাকতে চাস না কেন? হয়েছে কী তোর?
এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। আমি বোঝাতে পারি না কেন আমার ভাল লাগে না। কেন আলতাফের মত চমৎকার এক যুবককে আমি ভালবাসতে পারছি না। কেন এক হৃদয়বান চরিত্রবান স্বামীর ঘর ছেড়ে আমি বারবারই চলে যেতে চাই। বাবাও একদিন গুলশানে আমার স্বামীর বাড়ি এলেন। থমথমে মুখ। তাঁকে বললাম–বস চা টা দিই। না তিনি বসবেন না। আমার সঙ্গে জরুরি কথা বলবেন।
–কী কথা?
–তোর প্রব্লেম কী বল?
–প্রব্লেম মানে?-
-তুই বাড়ি যাবার জন্য কান্নকাটি করছিস?
–হ্যাঁ করছি।
–কেন? তোর কি খাওয়া পরার অভাব?
–না।
–যা দরকার আলতাফ কি সব দেয় না?
–মানে?
–মানে এই কসমেটিকস্, শাড়ি কাপড়, যখন যা লাগে টাকা পয়সা?
–হ্যাঁ দেয়।
–তবে?
এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। বাবা আমাকে যাবার সময় বলেন ‘আসলে প্রব্লেম তুই নিজেই। এত ভাল একটা ছেলে পেয়েছিস, মনে ধরছে না। আলতাফ হীরের টুকরো ছেলে, ওকে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ঢাকা শহর খুঁজে বার কর তো এরকম দ্বিতীয় একটি ছেলে! তোর এত অহংকার কিসের? বেশি সুখে আছিস তো, টের পাচ্ছিস না। এখনও সময় আছে নিজেকে সংশোধন কর।‘
নিজেকে সংশোধনের কিছু খুঁজে পাই না আমি। আমার কোনও কিছু নিয়ে আলতাফ এখন পর্যন্ত আপত্তি করেনি। আমি যে বিয়ের একমাসের মাথায় বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম এ নিয়েও আলতাফ কিছু বলেনি, একবারও জিজ্ঞেস করেনি কেন গিয়েছিলে, বরং চলে যে এলাম তাতেই বোধহয় ও একটু অবাক হয়েছে। অবাক হবার তো কথাই। আসলে যত আপত্তি আমার বাবা মায়ের, শ্বশুর শাশুড়ির। আমি নাকি মনমরা বসে থাকি সারাদিন, খেতে চাই না, কথা টথা বলি না বেশি, সাজি না, ভাল একটা শাড়ি পরি না, বিয়ের পর বউরা একটু সেজেগুঁজে না থাকলে চলে! শাশুড়ি প্রায়ই আলতাফকে বলেন-’কীরে তোর বউএর হয়েছে কী বল তো। শরীর খারাপ?’
আলতাফ বলে–না। না। শরীর খারাপ হবে কেন?
–সারাদিন একা ঘরে শুয়ে থাকে। বলি ভিসিআর দেখ। গান টান ভাল লাগলে শোন। কিছুই করে না।
-–ও কিছু না। বাড়ির কথা মনে পড়ে তো, তাই।
–তাই বা হবে কেন? ইস্কাটন গিয়েও নাকি ওই অবস্থা করে।
–ঠিক হয়ে যাবে। এত ভেব না তো এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে।
শাশুড়ির বয়স হয়েছে। সারাদিন ঘরে বসে তাসকেরাতুল আউলিয়া, বেহেসতি জেওর আর মোকসেদুল মোমেনিন পড়েন। পঁচবেলা নামাজ পড়েন আর আখেরাতের জন্য জীবন গুছিয়ে রাখেন। অবশ্য জগৎ সংসারের দিকে তার যে মনোযোগ একেবারেই নেই তা ঠিক নয়। তিনি প্রায়ই আমেরিকা যান। বড় ছেলের কাছে মাস ছয় থেকে আবার ফেরত আসেন। এখনও শক্ত সমর্থ বেশ। সকালে পার্কে হাঁটেন। বিকেলে নিয়ম করে ফলের রস খান। স্বাস্থ্য ভাল, চোখেও ভাল দেখেন। হাতে তসবিহ নিয়ে হাঁটেন আর বিড়বিড় করেন–’ঠিকের তো কিছু দেখছি না। পাশের বাড়ির মেয়েরা এসেছিল সেদিন। ভাবী ভাবী বলে কত ডাকল। বউ তো কোনও বা শব্দ করল না। ঘরের দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি ওদের বললাম বউমার শরীর খারাপ, আরেকদিন এস।’
আলতাফ শোনে, কিছু বলে না। আমি বুঝতে পারি না আমার কী করা উচিত। আমি কি এখন আগের মত হাসব? আগের মত, বিয়ের আগে যেমন রিনিঝিনি হাসতাম, কথা বলতাম! কিন্তু জোর করে কি হয় এসব! আলতাফ আমার মন ভাল রাখবার জন্য তার বন্ধু বান্ধবের বাড়ি নিয়ে যায়। সোহেল, রকিব, লতিফ, মনজুরের বাড়ি। সবার এক কথা–’ভাবী আমাদের সঙ্গে এত কম কথা বললে চলবে না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে আপনার। কী, আলতাফ বুঝি ঘুমোতে দেয় না আপনাকে? হা হা হা।‘ ওরা হাসে সবাই, আমার দিকে চোখ ছোট করে তাকায়।
মনে মনে বলি ও কেন ঘুমোতে দেবে না! ও তো আমাকে ঘুমোতেই দেয়, আমারই ঘুম আসে না। আলতাফ বন্ধুদের সঙ্গে রহস্যের হাসি হাসে। যেন ও সত্যিই আমাকে ঘুমোতে দেয় না। ও আমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখে। সারারাত আমাকে আদর করে ও যেন ওর আদর পেয়ে আমি ভরে আছি শরীরে, মনে। আমি যেন তৃপ্ত, তুষ্ট এক নারী। আমার কোনও কষ্ট নেই। কোনও অভিযোগ নেই কারও প্রতি।
আলতাফের বন্ধুরা, বন্ধুর স্ত্রীরা আমাকে নিয়ে পড়ে; নতুন বিয়ে হয়েছে বলেই বোধ হয় অথবা আলতাফকে তাদের বিশেষ পছন্দ আর আমার চেহারাছবিও তাদের মনপুত হয়েছে। আমি কী খেতে পছন্দ করি, কী গান ভাল লাগে আমার, কী পোশাক পরতে ভাল লাগে সব তাদের জানা চাই। আমার চোখের নিচের কালির অন্য অর্থ হয়। আমি বা আলতাফ কেউ সংশোধন করে দিই না যে সারারাত আদরে মেতে উঠবার জন্য নয় চোখের নিচে আমার জেগে থাকবার দাগ। এ অন্য দাগ। এ আমার কষ্ট পোহানো দাগ। এ আমার দুঃখ রাতের গান। সারারাত আমি আলতাফের ঘুমন্ত, তৃপ্ত শরীরটিকে ছুঁয়ে নিঘুম রাত পার করি। আমি তাকে আমার আরও গভীর গহনে চাই। কেবল চাই ই। পেতে পারি না। কত কত রাত আলতাফকে ডেকে তুলে বলেছি–তুমি একা একা কী করে ঘুমোও! আমার যে ঘুম হচ্ছে না!
আলতাফ বলেছে–’আমি কী করতে পারি বল। তুমি ঘুমোবার চেষ্টা কর। ঘুম এসে যাবে। আমার তো সকালে অফিস যেতে হবে। তোমার মত না ঘুমোলে তো আমার চলবে না।‘
আলতাফ ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ঘুমোবার কোনও আয়োজন না করেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার বলতে লজ্জা হয় কেন আমার ঘুম আসে না। আলতাফ নিশ্চয়ই বুঝতে পারে কিন্তু সে এমন ভান করে সে কিছুই বোঝে না আমার ইনসোমনিয়ার ব্যাপারটি। সে কিছুই বোঝে না এ আমার বিশ্বাস হয় না–সবই বোঝে সে। সবই বোঝে উত্থানরহিত সুদর্শন পুরুষটি। আমার সামনে তার যত অবুঝ অবোধ ভঙ্গি।
আলতাফ তার বন্ধুদের কাছ থেকেও ক্রেডিট নেয়। সে খুব ভাল প্লেয়ার এই জাতীয় ক্রেডিট। আমি ম্লান হাসি। ফাঁস করি না কিছু। স্বামীর দুর্বলতা ফঁস করব এমন অকৃতজ্ঞ স্ত্রী নই আমি। সতীসাধ্বী স্ত্রীলোককে মানায় না এব। পতিব্রতা হলে সমাজে মান থাকে। আলতাফ এবং তার বন্ধুরাও ভাল বলে। আমি যদি চিরকাল এমন মুখ বুজে পড়ে থাকি, লোকে বলবে এমন ভাল মেয়েই হয় না। এমন লক্ষ্মী বউ খুব কমই দেখেছি। এসব কথার দাম আছে মেয়েদের জীবনে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি মেয়েদের কী আছে! মা প্রায়ই বলেন—’এই ফ্যামিলিতে মেয়ে নিয়ে কোনও স্ক্যাণ্ডাল হয়নি। দেখিস স্বামীর সঙ্গে কখনও যেন কোনও গণ্ডগোল না হয়।‘ মাও বোঝাতে চান, স্বামীর সঙ্গে কিছু হলে স্ক্যাণ্ডাল আমার হবে, স্বামীর নয়।