Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin » Page 15

ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin

ছেলেটির সঙ্গে আগে আমার পরিচয় ছিল। মিতুল নামে আমার এক বন্ধুর চাচাতো ভাই টাই হবে। তাকে হঠাৎই একদিন দেখি হোস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। আমি প্রথম নাম মনে করতে পারিনি তার। দেখেই জিজ্ঞেস করলাম–কী ব্যাপার আপনি এখানে?

–হ্যাঁ। তুমি এখানে কেন? বলল ছেলেটি।

–আমি থাকি এখানে।

–ও তাই বল। মিতুলকে সেদিনও জিজ্ঞেস করেছি হীরা এখন থাকে কোথায়। বলল জানে না। আর আমিও অনেকদিন ভেবেছি তোমার কথা।

কথা বলতে বলতে নাম মনে হল। কায়সার। সাদামাটা চেহারা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কিন্তু চোখদুটো তাকিয়ে থাকবার মত সুন্দর। সেই চোখ থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারি না। কায়সারের সঙ্গে মিতুলের বাড়িতে দেখা হত। দুএকবার কথা হয়েছে। মনে রাখবার মত এমন কিছু নয়।

–আপনি এখানে কেন? জিজ্ঞেস করি।

–আমার বোন থাকে এই হোস্টেলে।

–আপনি কি মহসিন হলেই আছেন?

বাহ মনে রেখেছ কোন হলে থাকি? মনে মনে বলি মনে আর রেখেছিল। সবই তো ভুলে বসে আছি। নামটাও মনে পড়েনি। অল্প চেনা ছেলেকেই বড় আপন মনে হয় আমার। ছেলেটি আমাকে যে পছন্দ করত তা মিতুলও কথায় কথায় আমাকে বলেছিল। আমার সঙ্গে পরিচিত হবার আশায় সে মিতুলের জন্মদিনে গিয়েছিল। কায়সার পলটিক্যাল সায়েন্সে ফাঁইনাল ইয়ারে পড়ে। আমি গেটে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, বলল–চল হেঁটে হেঁটে কথা বলি।

কী আর কথা। মিতুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেদিনের কথা মনে পড়ে মিতুলের বাড়িতে যেদিন লজ্জায় কথাই বলিনি তার সঙ্গে, তার বড় বোন ব্যাংকে চাকরি করে এইসব। আমি ছোট চাকরি করি বলাতে কায়সার অবাক হয়ে বলে–এই বয়সে চাকরি করছ? পারো চাকরি করতে? তুমি তো সেদিনের বাচ্চা মেয়ে। কায়সার হেসে ওঠে।

আমিও হেসে উঠি-আমি বোকা মেয়ে?

কায়সারের বোন গেটে এসে দাঁড়ায়। আমরা আবার দেখা হবে জাতীয় কিছু বলবার : আগেই বিচ্ছিন্ন হই। কায়সারকে এরপর প্রায়ই দেখি গেটে দাঁড়ানো। একদিন বলল–আজ তোমার জন্য এলাম।

–আমার জন্য? আমি বিস্মিত হই।

–তোমার জন্য বুঝি আসতে নেই? তোমার সঙ্গে কথা আছে। কথাটি হচ্ছে–তোমার চাকরি করা এখন উচিত নয়। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির দরখাস্ত চাওয়া হয়েছে। এপ্লাই কর।

–আমার চাকরি না করলে চলবে কেন?

–টিউশনি কর। তবু ভর্তি হও।

–আপনি এত করছেন কেন আমার জন্য? আমি তো বলিনি।

কায়সার চুপ হয়ে যায়। বলে–সরি।

সেদিন আর কথা হয় না। রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকি। সেই কবে বাড়ি থেকে মাকে ডিঙিয়ে বেরিয়ে এসেছি। জীবনে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। ওঁরা খবরও রাখেন না। নাকি আলতাফ গভীর কোনও ষড়যন্ত্র করছে। হঠাৎ একদিন তুলে নিয়ে যাবে? ভয় লাগে। একা ঘরে শিউরে উঠি আমি। মনজু কাকা বলেছেন কাজ ভাল হলে দুমাস পর বেতন বাড়াবে। মন্দ নয় চাকরিটা। আবার হলে থেকে ভার্সিটিতে পড়াশুনাও হবে-কায়সারের এই প্রস্তাবটিও মন্দ নয়।

ক্লান্ত এক বিকেলে কায়সার ডেকে পাঠায় হোস্টলের গেটে। আমার জন্য কোনও ভিজিটর অপেক্ষা করছে নিচে, ভাবতে ভাল লাগে। কায়সার ভর্তি ফরম নিয়ে এসেছে। চোখে চোখ পড়তেই হেসে বলে–তিনটে টিউশনি কর, হয়ে যাবে।

–চাকরি ছেড়ে দেব?

–চাকরি কি আর পাবে না পরে? চাকরি করলে তুমি তো ক্লাস করার সময় পাচ্ছো না।

কায়সারের কণ্ঠে ভালবাসা টের পাই। আমি ভর্তি হই না হই তার কী, অথচ যেন তার বড় একটি কর্তব্য এই ব্যাপারে আমাকে বোঝানো। কায়সার হাঁটতে হাঁটতে বলে–পল সায়েন্সে ভর্তি হলে তোমার কোনও অসুবিধে নেই। আমি তো আছিই। কায়সারের ‘আমি তো আছিই বাক্যটি আমাকে কেমন কাঁপায় ভেতরে ভেতরে। আমি হাঁটতে হাঁটতে বলি-ভালই একটি নিয়ম হয়েছে, আপনার সঙ্গে বিকেলে হেঁটে বেড়ানো।

–তোমার ভাল লাগে বেড়াতে?

বলি–খুব।

কায়সারের মুখ হাসিতে ঝলমল করে ওঠে, বলে–চল যাই, একদিন চল রিক্সা করে ঘুরে বেড়াই, ভাল লাগবে হাওয়া খেতে।

আমি মাথা নাড়ি। আমার যদি ভাল লাগে, যাব না কেন? যাব। কায়সারের ঢিলে সার্ট, না আঁচড়ানো চুল, গভীর চোখ, উদাস হাঁটাচলা সব আমার ভাল লাগে। মনে হয় বিকেলটা যদি কায়সারের সঙ্গে এমন গল্প করে কাটে, তবে মন্দ কী। আমাদের মুখে বলা হয় না, তবু বোঝা হয়ে যায়, কায়সার বিকেল হলেই আসবে, আমি তার সঙ্গে গল্প করতে রাস্তায় বেরোব। কখনও ক্রিসেন্ট লেকে গিয়ে বসব, কখনও কোনও রেস্তোরাঁয়, একদিন হাঁটতে হাঁটতে আমরা শাহবাগের একটি রেস্তোরাঁয় বসি। চা সিঙারা খাই। বিল দেয় কায়সার। আমি বলি–একদিন আমি খাওয়াব আপনাকে। আমার নিজের পয়সা, বাধা দেবার কে আছে। পরদিন বিকেলে শাহবাগ ছাড়িয়ে চলে যাই মতিঝিলের কাফে ঝিলে। পরাটা আর ঝাল ফ্রাই খাই দু’জন। আমি বিল মেটাবার পর কায়সার বলে–নেক্সট আমি খাওয়াব। কী বল?

রিক্সায় বসে কায়সার হাত রাখে আমার পিঠের পেছনে। কী রকম যেন লাগে। কী রকম এক আনন্দ। কায়সারের চোখের দিকে তাকালে কী রকম টুকরো টুকরো ভেঙে যাই ভেতরে। আমার ভেতর হঠাৎ এই ব্যাপারটি ঘটেনি। আমি অল্প অল্প করে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি আমি কী চাই, কায়সার ডাকলেই যে চলে আসি, সে কেন ডাকে, আর আমিই বা আসি কেন–এ কী দুদিনের মোহ, একসময় কেটে যাবে? উত্তর জোটে, কায়সার প্রতারণা না করলে মোহ কাটবে কেন? সে যদি সুস্থ সমর্থ পুরুষ হয়, ভালবাসা ম্লান হবে কেন? কায়সার এক বিকেলে টি এস সির মাঠে দাঁড়িয়ে বলে মনে হয় তোমাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি।

–অনেকদিন মানে কতদিন?

–জন্ম থেকে।

আমি আবার কেঁপে উঠি। টিএসসির ব্যস্ত মাঠ ছেড়ে ইচ্ছে করে দূরে কোথাও চলে যাই, সামনে কোনও নদী রেখে চুপচাপ বসে থাকি। নক্ষত্র ভরা আকাশ দেখব আর : গান গাইব—’পিপাসা হায় নাহি মিটিল।’

পিপাসা আমার তো মেটেইনি। আমার শরীর ভরে, হৃদয় ভরে প্রবল পিপাসা। কায়সার কি আমার পিপাসা মেটাতে পারবে, যদি না মেটাতে পারে, যদি সে আলতাফের মত ওরকম ছিঁড়ে খাওয়া লোক হয়! কেবল কষ্ট দেবে, সুখ দেবে না! কী করে বুঝি, পরখ করবার উপায় কী। পরখ করে দেখতে ইচ্ছে করে। কায়সারের জন্য কী রকম যেন লাগে আমার। ওকে বড় ছুঁতে ইচ্ছে করে। কতদিন কাউকে ছুঁই না। আমার আঙুলগুলো তৃজ্ঞার্ত হয়ে থাকে। কতদিন জল পায় না, কতদিন কারও পৌরুষ ছোঁয়া হয় না আমার। কতদিন কেন, আমি কবেই বা ছুঁয়েছিলাম কাকে?

আলতাফকে ছুঁতে আমার ভাল লাগত, কিন্তু ওর প্রবলেম যখন একটু একটু করে প্রকাশিত হল তখন আর ছুঁয়ে ভাল লাগেনি ওকে। মনে হত কোনও জড় কিছুকে পর্শ করছি। টেবিল চেয়ার জাতীয় কিছু। আলতাফের জন্য মাঝে মাঝে আমার মায়াই হয়। বেচারা। আবার এও ভেবে রাগ হয় ও বিয়েই বা করতে গেল. কেন, ও তো জানতোই শরীর ওর সাড়া দেয় না, ও কেন কষ্ট দেবার জন্য আমাকে এমন লোক জানিয়ে ঢোল বাজিয়ে বিয়ে করল? আমি আলতাফকে ক্ষমা করতে পারি না। সেইসব দিনের কথা ভাবলে আমার শরীর থেকে আগুন ছিটকে বেরোয়। আমি ওই নিষ্ঠুর স্বার্থপর মানুষটিকে ক্ষমা করতে পারি না।

রাতে শুয়ে থাকি একা বিছানায়। কায়সার কী আমাকে ভালবাসে? বাসেই তো মনে হয়। ও ডাকলেই আমি ছুটে যাই, আমার ভেতরেও যে ওর জন্য কিছু একটা কাজ। করে, কিছু একটা তীব্রতা তা নিশ্চয় বোঝে কায়সার। আমি কেন সামলে চলব, আমি কি কারও কাছে জীবন বন্ধক দিয়েছি যে নিজেকে সংযত করব, নিজেকে আটকে রাখব একটি অদৃশ্য খাঁচায়! কে আছে আমার যে আমি তার জন্য ভাবব, আমার মনে হবে আমি অন্যায় করছি! বরং মনে হয় আরও আগে আলতাফের ঘর আমার বেরিয়ে আসা উচিত ছিল, আরও আগেই প্রতারকটির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে আসতে পারলে অনেকটা সময় আমি নিজের জন্য পেতাম।

কায়সার যে আমাকে ভালবাসে তা আর গোপন করতে পারেনি। ও জানে আমি বিবাহিতা এক মেয়ে, এখনও সম্পর্কটি টিকে আছে আলতাফের সঙ্গে, তারপরও কায়সার কাছে আসে, তার প্রাপ্তি কতটুকু না জেনেই আসে। এই ভালবাসা শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানি না। মাঝে মধ্যে মনে হয় ওকে ফিরিয়ে দিই। কিন্তু ফিরিয়েই বা দেব কেন। আমি কি আলতাফের কাছে কখনও ফিরে যাব যে কায়সারকে প্রত্যাখান করতে হবে আমার! সে আসুক, ভালবাসুক, আমি তার ভালবসায় গা ভিজিয়ে স্নান করব! আমাকে কে বাধা দেবে, আলতাফের কী ক্ষমতা আছে আমাকে বাধা দেবার! সে বড়জোর আইন দেখাবে। তালাকনামা পাঠিয়ে দিলে কোথায় যাবে আইন! এসব ঠুনকো কাগুঁজে সম্পর্কের কোনও জোর আছে বলে আমার মনে হয় না। কাগজ দিয়ে মানুষকে আটকে রাখা যায়, যদি মন না চায়! আমি হঠাৎ হঠাৎ ভুলেই যাই আলতাফ নামের এক লোকের স্ত্রী আমি। আমি তার ঘরে দীর্ঘদিন থেকেছি। ভাবলে আমি অবাক হই একটি লোক নানারকম দোষের তলে আমাকে ফেলেছে। আর আমিও নির্বিচারে মেনে নিয়েছি তার সব মিথ্যাচার। যেটুকু প্রতিবাদ করেছি তা করা না করা সমানই ছিল। কষে যেখানে দু ঘা লাগানো দরকার সেখানে গাল ফুলিয়ে রাখলে চলে! আমি অপোস করেছিলাম বলেই আমার এই দুরবস্থা। সবাই ভেবে নিয়েছে একে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করানো যায়। এ তো মেনে নেবেই সব নির্যাতন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *