Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin » Page 13

ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin

আমি একটি চাকরি খুঁজতে থাকি। চেনা পরিচিত ক’জনকে ফোনে বলি কোথাও কোনও কাজ টাজ পাওয়া যায় কি না দেখতে। সবাই অবাক হয়। বলে–তুমি চাকরি করবে কেন? তোমার না বিয়ে হয়েছে!

আমি বলি–বিয়ে হলে বুঝি চাকরি করতে নেই?

–স্বামী শুনেছি ইঞ্জিনিয়ার।

–স্বামী ইঞ্জিনিয়ার সে তো স্বামীর ব্যাপার। আমার নয়।

–তোমারও কিছু হতে হবে নাকি? তার টাকাই কি তোমার টাকা নয়?

–তার টাকা আমার টাকা হতে যাবে কেন? কোনও অর্থেই তার টাকা আমার টাকা নয়।

–কেন, সে কি টাকা পয়সা দেয় না? এটা ওটা কিনে দেয় না?

–তা দেবে না কেন? দেয়। কিন্তু সে তো তার দান হল। আমার নিজের তো কিছু হল না।

–নিজের আবার আলাদা করে লাগে না কি?

–নিশ্চয় লাগে। আমি যেহেতু একজন আলাদা মানুষ। কারও দ্বারা কোনও সাহায্য হয় না। বরং নানা রকম উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় আমাকে। আর আমিও আশ্চর্য হই আমার এই বোধ জন্মালো কী করে যে আমাকে একজন আলাদা মানুষ হতে হবে। আমার বাড়ির পরিবেশ আমাকে এই বোধ জন্মাতে দেবার কথা নয়। তবে কি এসব নিজের ভেতরেই জন্মেছে! আপনা আপনি! নাকি আলতাফের স্বামী আমাকে সচেতন করিয়েছে যে স্বামীত্বের আরেক নাম প্রভুত্ব। আর তার প্রভুত্ব মানবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না বলে আমার ভেতর অবচেতনেই জন্ম নিয়েছে একটি সত্ত্বা অর্জনের তাগিদ।

বাড়ি থেকে বেরোই। অনেকদিন এখানে গুমোট অন্ধকারে বসে ছিলাম। এখানেও কেমন দম বন্ধ লাগে। ধানমণ্ডিতে পাপড়ির বাড়ি, রিক্সা করে ও বাড়িতে যাই। বন্ধুদের মধ্যে ওকেই আমার সাহসী মনে হয় সবচেয়ে বেশি। এই বয়সে ইণ্ডিয়া ঘুরে এসেছে একা একা। ওর বাবা বলেন বাইরে একা ঘোরা অভ্যেস করা দরকার। মেয়েগুলো ঘরে বসে থাকতে থাকতে ইঁদুর হয়ে গেছে। জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানে না তারা।

আমার কী যে ভাল লাগে শুনে। পাপড়ির বাবার মত কেন আমার বাবা নন-মনে মনে এই নিয়ে আমার দুঃখও হয়েছে খুব।

আলতাফের কাছ থেকে চলে এসেছি শুনে পাপড়ি বলল–চেষ্টা করে দেখ থাকা যায় কি না।

আমি বললাম–না রে কোনও উপায় নেই। একজন ইমপোটেন্ট লোকের ঘরে বসবাস করার চেয়ে গরু ছাগলের সঙ্গে থাকা ভাল।

–বলিস কী! ইমপোটেন্ট লোককে বিয়ে করতে গেলি কেন?

–আমি কী জানতাম সে ইমপোটেন্ট?

–তাই তো কথা। তোর তো জানার কথা নয়। তোর বাবা মাকে বলেছিস?

–ওঁরা আগে থেকে এত উল্টো পাল্টা কথা বলছেন যে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। ওঁরা ধরেই নিয়েছেন যে আমি এক ছেলের প্রেমে পড়ে স্বামীর ঘর ছেড়েছি।

বাড়িতে আমাকে উদ্দেশ্য করে কী অশালীন এবং অসভ্য কথাবার্তা হয়, ভেবে, এই প্রথম, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাপড়ির বাড়ি এসে, আমি কেঁদে উঠি।

পাপড়ি আমাকে জড়িয়ে ধরে। বলে–ডোন্ট ওরি, বী হ্যাপি। তুই যদি চলেও আসতি কারও সঙ্গে কার কী বলার ছিল। চিয়ার আপ। ও আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে–জীবন তোর শুরু হল মাত্র, এখনই পেছনের ঝুটঝামেলা নিয়ে ভাবছিস কেন। আলতাফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবার পর কারও সামান্য স্নেহের স্পর্শ পাইনি। পাপড়ির এই ‘বী হ্যাপি উচ্চারণ আমাকে অনাবিল আনন্দ দেয়। অনেকদিন ভুলেই ছিলাম আনন্দ কি জিনিস।

পাপড়ি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইংরেজিতে অনার্স! জিজ্ঞেস করি–যদি আমিও পড়তে চাই।

–পড়তে চাইলে পড়বি।

–পড়াবে কে শুনি? বাবা তো পড়াতে চাইছেন না। বলছেন আবার ওই স্কাউড্রেলটার ঘরে যেতে।

পাপড়ি বলে–তুই টিউশনি করে পড়ার খরচ চালা। মালা কী করছে, দেখিস না? বাবা মারা গেছে। ভাই খরচপাতি দেয় না। সে দুটো টিউশনি করছে, পড়ছে।

পাপড়ির বাড়ির লনে বসে গল্প করি। খানিক পর পর চা আসে। আমি কে, কী নিয়ে কথা বলছি ইত্যাদি জানবার জন্য কেউ উঁকি ঝুঁকি দেয় না। সারাদিন কাটিয়ে সন্ধের আগে আগে ঘরে ফিরি। ফিরে দেখি বাবা মা পায়চারি করছেন। আমি কোথায় গেলাম, বাড়ি থেকে কারও হাত ধরে পালোম কি না ভাবছেন।

–কী কোথায় গিয়েছিলি? বাবার দাঁত খিচানো প্রশ্ন।

–পাপড়ির বাড়িতে।

–মিথ্যে কথা বলছিস কেন, তুই লতিফের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি।

–যদি তাই ভাবো তো, তাই। আমি খুব নির্বিকার উত্তর করি।

–এত সাহস তুই পেলি কোথায়?

–জানি না। আমার শান্ত কণ্ঠস্বর।

–জানি না বললে তো চলবে না। জানতে হবে। লতিফকে তুই বিয়ে করবি ঠিক করেছিস?

–তাও জানি না।

আমি কাপড় না পাল্টে শুয়ে পড়ি।

বাবা মা ধারণা করেন আমি প্রেমে অন্ধ হয়ে জগৎ সংসার ভুলে গেছি। আমার মাথার ঠিক নেই। তারা অনেক রাত অবধি জেগে থেকে আমার ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। আর আমি রাত জেগে কেবলই ভাবি কী করে পড়ালেখাটা করা যায়, কী করে টিউশনি যোগাড় করা যায়। কী করে মুক্ত হওয়া যায় নোংরা সংসারতন্ত্র থেকে। বুঝে পাই না। রোকেয়া হলে মালার সঙ্গে দেখা করলে সম্ভবত কিছু বুদ্ধি পাওয়া যাবে। এই ভেবে আপাতত নিশ্চিন্ত হই।

পরদিন সকালে যখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হই, মা চমকে ওঠেন আশংকায়, বুঝি মেয়ে তার এবার পালাচ্ছেই লতিফের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেন–কেথায় যাচ্ছিস?

–রোকেয়া হলে।

–কেন?

–কাজ আছে।

–কী কাজ?

–আছে।

–আছে বললেই তো হবে না। আমাদের বলতে হবে কী কাজের জন্য, বাইরে যাচ্ছিস তুই। যেতে হলে কাউকে নিয়ে যা। কেউ তোর সঙ্গে যাক।

–সঙ্গে যেতে হবে কেন? আমি কি পথ চিনি না?

–পথ চিনলেও তোকে একা যেতে দেওয়া হবে না।

–আমি যাবই, পারলে আটকাও তোমরা।

মাকে হতবাক করে আমি সোজা বেরিয়ে আসি বাড়ি থেকে। এ বাড়িটিও শ্বশুর বাড়ির আকার নিচ্ছে। নরক কে বলে পৃথিবীর বাইরে কোথাও থাকে? নিজের বাবা মাই আমাকে অপমান করছেন, এর চেয়ে মন্দ আর কী হতে পারে। চোখে জল জমে যায়। হাতের পিঠে মুছে নিয়ে হাঁটতে থাকি। রোকেয়া হলে মালাকে পাওয়া যায় না। ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খুঁজে বের করি। কোনও রাখ ঢাক না করে বলি–টিউশনি খুঁজে দাও। কলেজে ভর্তি হব। পড়ালেখাটা আমার করতেই হবে। ইন্টারমিডিয়েটে চাকরি জুটছে না। আর চাকরি কেন করব, স্বামী থাকতে এসব জিজ্ঞেস করবে তো! এসবের উত্তর হচ্ছে স্বামীটি দেখতে ভাল, কিন্তু ওর প্রবলেম আছে মানসিক শারীরিক দুই-ই।

সে কমপ্রোমাইজ চাচ্ছে আমি কোনও কমপ্রোমাইজে যেতে চাচ্ছি না।

মালা সেদিনই কিছু জানাতে পারল না। বলল–আর কদিন পরে এস, দেখি কিছু করতে পারি কি না। সময়ের অভাবে দুটো টিউশনি ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওখানে বলে দেখব তোমার কথা।

মনে মনে হুররে বলে উঠি। কখনও ভাবতে পারি নি নিজের জন্য নিজেই কিছু করা যায়। সচ্ছল বাবার সংসার থেকে সচ্ছল স্বামীর সংসারে বাকি জীবন কাটাতে গিয়েছিলাম। ওরা খেতে পরতে দেবে, বিনিময়ে যা নয় তা শুনতে হবে আমার, এক খাওয়া পরার জন্য নিজেকে অসম্মান করতে দেব কেন?

মালার সঙ্গে কথা বলতে বলতে লাইব্রেরী গেটের কাছে দাঁড়াই। কোন দিকে না। ভেবেই একটি রিক্সা নিই। রিক্সা দোয়েল চত্বরের দিকে যেতে থাকে। বাড়িতে যাব ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায়। অন্য কোথাও যদি যাওয়া যেত। দূরে কোথাও। এই চেনা শোনা পরিবেশ থেকে দূরের শহরে। রিক্সা যখন প্রেসক্লাব পার হয়ে যেতে থাকে, তখনও আমি জানি না মনজু কাকার অফিসে যাব। হঠাৎই মনে পড়ে মনজু কাকার কথা। আমার এক দূর সম্পর্কের কাকা, ইণ্ডাষ্ট্রি আছে মতিঝিলে। কাকা আমেরিকা ছিলেন, দেশে এসে ইণ্ডাষ্ট্রি দিয়ে বসেছেন। এখন দেশেই থাকবার চিন্তা ভাবনা করছেন। পাঁচ ছ বছর কোনও যোগাযোগ নেই। তাঁর কথা আমার মনে পড়বার কথা নয় বা তার কাছে আমার যাবার কথা নয়।

হঠাৎ মনে পড়ায় যাই সময় কাটাতে। বাড়ি ফিরলে আবার তো সেই হুল ফোঁটানো কথা। আমার ভাল লাগে না নিরন্তর সংসার সংসার স্বামী স্বামী বলে একটানা চিৎকার। চিৎকারই মনে হয় এসব। স্বামী দিয়ে যদি আমার সুখ না হয়, তবু স্বামীর কাছে পড়ে থাকতে হবে আমার, বাবা মার মুখ রক্ষা করতে। আমার জীবনের চেয়ে তাদের মুখের মূল্য যেন বেশি।

মতিঝিলে মনজু কাকাকে পেয়ে যাই। কাকা দেখে অবাক—তুমি এখানে?

–হ্যাঁ এলাম। করার কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না তো, তাই।

–বস বস। বাড়ির সবাই ভাল আছে? তোমার হাসবেন্ডের খবর কি। শুনলাম বিয়ে টিয়ে হয়েছে। আমরা তো দাওয়াত পেলাম না।

মনজু কাকার পঞ্চাশ হবে বয়স। এখনও তারুণ্যে ভরা হৃদয়। ছেলে মেয়ে সব বিদেশে। ওরা কোথায় কী পড়ছে বললেন। আমি পড়াশুনা কতদুর করেছি জিজ্ঞেস করলেন। লজ্জাই পেলাম বলতে যে মাত্র ইন্টারমিডিয়েট অবধি পড়েছি। বললাম-বিএ ভর্তি হব। সঙ্গে টিউশনি করব।

–কেন? টিউশনি করতে হবে কেন? এনি প্রবলেম?

মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ প্রবলেম। প্রবলেমই তো। বাবার বাড়ি থেকে কোনও সাহায্য করা হবে না যেহেতু আমি স্বামীর ঘর থেকে চলে এসেছি। তাই টিউশনি করতে হবে। তখন মনজু কাকা হেসে হেসেই বললেন টিউশনি করে আর কত পয়সা পাবে? আমার কোম্পানিতে চাকরি কর।

–আপনার এখানে চাকরি? কি বলছেন? আমি পারব নাকি?

–শিখিয়ে নেব। অসুবিধে কী?

অতল জলে ডুবে যাচ্ছে এমন মানুষের হাতের কাছে মাটির পাড় পেলে বোধ হয় এমন আনন্দই হয়। আমার এমনই আনন্দ হয় যে আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি।

কাকাকে বলি–আপনি কিন্তু বাড়িতে বলবেন না।

–কেন মতিন ভাই জানেন না তুমি চাকরি করবে?

–না। আমাকে ঘরে বন্দি করার প্ল্যান করছে। আপনি যদি চাকরি দেন আমি প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষাটা দিয়ে দেব। আমার বন্ধুরা আছে। নোট ফোট নিয়ে নেব। কোনও অসুবিধে হবে না।

–দেখ যা ভাল বোঝ।

আমার আনন্দিত চোখ দেখে মনজু কাকা সম্ভবত বুঝতে পারেন আমি একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে একটি চাকরি আমার খুবই প্রয়োজন। তার আরও একটি ব্যাপার আমার খুবই ভাল লাগে তা হল একবারও আমাকে তিনি বলেননি স্বামীর সংসারে ফিরে যাও, মানিয়ে নিতে চেষ্টা কর এই সব বোগাস কথা বার্তা অথবা তোমার বাবা না চাইলে কী করে চাকরি করবে এইসব।

মনজু কাকা ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাজে। আমি তার রুমের সোফায় বসে থাকি। তিনি ফাঁকে ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলেন–প্রথম অল্প বেতন পাবে। ধীরে ধীরে বাড়বে। আপত্তি নেই তো!

আমি হেসে বলি–কোনও আপত্তি নেই। এখানে যে এত বড় প্রাপ্তি যোগ তা কল্পনাই করিনি। আপনার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।

ঠিক হয় আগামি শনিবার থেকে আমি চাকরি করতে যাব। হঠাৎ করে হয়েও গেল সব। বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হয় এত শিগরি কারও কপাল কী খোলে! আমি তো কপাল পোড়া মেয়ে, আমার ভাগ্যে কি এত কম যোগ্যতায় আস্ত একটি চাকরি পাওয়া সম্ভব। আমার কেন যেন বিশ্বাস হয় না সত্যি সত্যি চাকরিটি আমি পেয়েছি। আমি কি করতে পারব কঠিন কঠিন সব কাজ। মনজু কাকা অবশ্য বলেছেন কাজ তেমন কঠিন নয়। চেষ্টা থাকলেই সব হয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress