Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভেতরে ঢোকার পর || Humayun Azad

ভেতরে ঢোকার পর || Humayun Azad

এক সময় বাইরে ছিলাম;–যা কিছুর অভ্যন্তর,
দরোজাজানালা আছে, যথা–অট্টালিকা, নারী, সংঘ,
পরিষদ, সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র, সভ্যতা প্রভৃতি
প্রবেশাধিকার ছিলো না সে-সবে। দাঁড়িয়ে থেকেছি
বাইরে–শিলাবৃষ্টিতে, ঘূর্ণিঝড়ে, বোশেখি আঁধিতে,
আভালাঁসে, দাবানলের চেয়েও ক্রুদ্ধ হিংস্র রৌদ্রে,
ক্ষুধার্ত রাস্তায়। আমার বর্বর গোড়ালি-ঘর্ষণে
পিচে জ্বলতো কর্কশ আগুন; ট্রাউজার ছিঁড়ে ফেড়ে
দিগ্বিদিক বেরিয়ে পড়তো বিভিন্ন অশ্লীল অঙ্গ
অশীল, উদ্ধত, রাগী, বেয়াদব। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড
নৌকোর পালের মতো ছেঁড়া শার্ট তোলপাড় করে
দেখা দিতে অসভ্য পাঁজর। যতোবার আমি গেছি
অভ্যন্তরসম্পন্ন সামগ্রীর কাছে–দূর থেকে
উন্মুক্ত দরোজা দেখে, খোলা দেখে জানালাকপাট
ততোবার সেই সব স্বয়ংক্রিয় দরোজাজানালা
ধাতব ক্রেংকার তুলে মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেছে।
নারী–সুপরিকল্পিত অট্টালিকা, স্ফটিকে গঠিত,
চতুষ্কোণ, দুর্গম, কারুকার্যমণ্ডিত। চারদিক
সাজানোগোছানো, সামনে বাগান, গম্বুজ-সূড়ঙ্গ
ঘেরা; ঝাড়লণ্ঠনসজ্জিত বৈঠকখানায় তীব্র
উৎসব; কক্ষে কক্ষে দ্বৈতশয্যা;–আমাকে দেখলেই
নিভতো সমস্ত বাতি, বন্ধ হতো আলোঝলকিত
ওই রঙিন ক্যাসল। সমাজ–নোংরা ডাস্টবিন;
প্রকট দুর্গন্ধে বোঝা যায় ওই আবর্জনাস্তূপে
জমে আছে উন্মাদের পাতলা মল, মরা ব্যাঙ, বমি,
গর্ভস্রাব, প্লেগের ইঁদুর, হিসি, অশনাক্ত লাশ;
তবু ওই আবর্জনা বেড়া দিয়ে বসে আছে ঝানু
মলের সম্রাট। পরিষদ–অভিজাত গোরস্তান;
দেয়ালে গিলাফে সুরক্ষিত কতিপয় মাননীয়
মৃতদেহ মেপে যায় অমরতা; জীবনে জীবিত .
ছিলো না বলেই ঠিকঠাক করে তারা কবরস্থ
হওয়ার পরে গর্তে চিরকাল বাঁচার কৌশল।
পরস্পরের দিকে উদ্যত ছুরিকা নিয়ে শক্ত
দেয়ালের অভ্যন্তরে ঘাতকেরা গড়ে যা, তাইতো
সংঘ;–ফিনকি-দেয়া রঙিন রক্তের চেয়ে মনোরম
দৃশ্য নেই, সংঘবদ্ধ ঘাতকেরা দরোজাজানালা
সেঁটে মনপ্রাণভরে রক্তের দৃশ্য দেখে যায়।
রাষ্ট্র–দেয়াল, প্রহরী, গুপ্তচর, ভয়াল পরিখা,
রক্ষী, সুড়ঙ্গ ও ঘনঘন ষড়যন্ত্র; মধ্যরাতে
বুটের অদ্ভুত শব্দ, পিস্তলের জঘন্য উল্লাস।
সভ্যতা–সম্ভ্রান্ত পতিতাপল্লী, যাতে আশ্লেষের
অধিকার পায় তারা যারা কোনো দিন দুঃস্বপ্নেও
দ্যাখেনি বর্বর রৌদ্র, গোখরোর দুর্দান্ত মস্তক।

আমি, প্রবেশাধিকারহীন ওই দরোজাজানালা
অভ্যন্তরমণ্ডিত সামগ্রীতে, বাইরে থেকেছি
যুগযুগ। যা কিছুর অভ্যন্তর, দরোজাজানালা
নেই, যা কিছু আপাদমস্তক বাইর, বহির্দেশ
আমি সে-সবে থেকেছি। এক পা রেখেছি টলোমলো
শিশিরবিন্দুর শিরে, অন্য পা রাখার স্থানাভাবে
প্রসারিত করে তাকে পাঠিয়েছি অনন্তের দিকে।
ক্ষুধা ছিলো আমার খাদ্য ও পানীয়; দিনরাত
একশো ইন্দ্রিয় দিয়ে খেয়েছি ক্ষুধার মতো অসম্ভব সুধা।
ক্ষুধা–সুধা–ক্ষুধা–সুধা; সারা রাত্রি জেগে থেকে
সর্বস্বে ঢেলেছি বীর্য–ওই মেঘ, তন্বী চাঁদ, পাখি,
শস্যকণা, পলিমাটি, উপত্যকা, মগ্ন মহাদেশ,
নগ্ন নদী, টাওয়ার, নর্তকী ঝরনা, কাছে-দূরে
স্বপ্নে দ্যাখা কিশোরী যুবতী, সবাই আমার বীর্যে
কমবেশি গর্ভবতী। প্রাগৈতিহাসিক নদী ছিলো
আমার শিরায়; বন্য মোষের মতো সারাক্ষণ
গোঁ-গোঁ করতো আমার প্রচণ্ড রক্ত আমার জীবন।
এক দিন সব কিছু খুলেছে দরোজা বন্ধ নারী,
অট্টালিকা, সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র, সংঘ, পরিষদ,
সভ্যতা–যা কিছু দরোজাসম্পন্ন, অভ্যন্তরমণ্ডিত।
আমি আরো অভ্যন্তরে যাবো বলে পা বাড়াই, দেখি
আর অভ্যন্তর নেই, আছে শুধু গাঢ় অন্ধকার।

আমার চারদিকে আজ ভারি পর্দা দোলে, ভারি পর্দা
দোলে, ভারি পর্দা দোলে; জীবনের দারুণ গর্জন
শোনা যায় পর্দার ওপারে। আমি অন্ধকার ঘরে
বসে আছি–ক্ষুধা নেই, রক্ত নেই; বহু দিন ঝড়,
নৌকোর উদ্দাম নাচ, যুবতীর উত্তেজিত স্তন,
শস্য, বর্ষণ দেখি নি। একদা আমার ক্ষিপ্ত বীর্য
বন্ধ্যা পাথরকেও করেছে পুষ্পবতী; সেই আমি,
এখন সংরার্গহীন, নপুংসক, নিরুত্তাপ, জীর্ণ,
প্রতিভাবঞ্চিত, ম্লান; না, আমি বেরিয়ে পড়বো;
এই পর্দা, দেয়াল, সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা লণ্ডভণ্ড করে
আবার বর্বর ঝড় রৌদ্র ক্ষুধাভরা বাইরে বেরোবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *