ভয়
পুকুরটা বেশ বড়ো আর গভীর। মাঠের শেষ প্রান্তে। মাঝে কবরস্থান। চারিদিকে খাঁখাঁ জনশূন্য। সূর্যের আলোয় পাড়ের বালি করে চিকচিক, আর জলের উপর পানা ভর্তি থাকায় গাঁয়ের সকলেই যেত সেই ঠান্ডা জলে স্নান করতে।
ঝুমা প্রথম যেদিন তার ঠাকুমার সাথে গেছিল, নূপুর পড়া পায়ে বালির উপর নাম লিখেছিল নিজের। পুকুরের একদম মাঝখানে একটা শান বাঁধানো জায়গা দেখে খুব আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করেছিল তার ঠাকুমাকে – যে ওখানে কি কেউ বসে? ঠাকুমা গাঁয়ে যা প্রচলিত ছিল সেটাই আদরের নাতনিকে বলেছিল – “কি জানি কোন দেবতা না অপদেবতা এসে বসে ওখানে। ছোটো বাচ্চাদের একা দেখলে তাকে নাকি ধরে নিয়ে যায়। দিদিভাই একা কক্ষনো এখানে আসিস না।” কবরস্থানের উপরে গাঁয়ের লোকেদের যাতায়াতে তাদের পায়ের ছাপে একটা অস্পষ্ট রাস্তা হয়ে গেছিল । কিছু কবরের উপর ছিল গর্ত আর কিছু কবরের উপর ফুটে থাকত নানা রঙের ফুল।
একবার চৈত্রের টানা দিনে ঠাকুমা পড়ল জ্বরে। মাও কাজে নাজেহাল। এদিকে দিনটা রবিবার। পুকুরে যাওয়ার কথা বললে কেউ রাজি হবে না, তাই ঝন্টুর হাত ধরে মাকে বলল আমরা একটু পাড়া থেকে ঘুরে আসি। বাইরে বেরিয়ে ঝনটুকে বলল খুব মজার একটা জায়গায় নিয়ে যাবো দেখিস কত সুন্দর, কিন্তু মাকে বলবি না খবরদার। দুপুররোদে ফাঁকা রাস্তা পেরিয়ে যখন তারা কবরস্থানে ঢুকল ঝন্টু দিদির গা ঘেসে বলল – দিদি কবর থেকে কেউ উঠে আসবে না তো? ওই যে ওই কবরের উপরের মাটিগুলো অমন ফাঁকা কেনো? ঝুমা ভাইকে সাহস দিতে বলল – ও কিছু না। কুকুরে খুবলে গর্ত করেছে। এদিকে এতটা দূরে এসে ঝুমার মনে হচ্ছে, না এলেই ভালো হতো। মনের মধ্যে দোলাচল তাও ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে ঝুমা এগিয়ে চলল।
পুকুরে পৌঁছিয়ে দুজন খুব সাবধানে পাতা ভেজা জলে গিয়ে দাঁড়াতেই পেরিয়ে আসা পথের চিন্তা আর ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো নিমেষেই। ঝন্টু তাকিয়ে দেখল এমন নির্জন সুন্দর জায়গা সে আগে দেখেনি । ভাবলো দিদি মিথ্যে বলে নি। শান বাঁধানো উঁচু জায়গাটায় দেখে জিজ্ঞাস্য চোখে দিদির দিকে তাকাতেই ঝুমা ঠাকুমার থেকে যা শুনেছিল ভাইকে বলল। শুধু ছোটো ছেলে মেয়েদের একা আসতে বারণ এটা বাদ দিয়ে।
কিছুক্ষণ ভাইবোন জলের মধ্যে খেলা করার সময় লক্ষ্য করল যেন দূর থেকে কি ধেয়ে আসছে, হাওয়ার মত ঘুরপাক খেতে খেতে। ঝুমা বুঝল ঝড় উঠেছে আর ধুলোবালি নিয়ে সেই ঝড় তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে সেই গরম ঝড় এসে আছড়ে পড়ল পুকুরে , চারিদিকে ধুলো বালি ভর্তি । সেই ঝড়ের মধ্যে ঝন্টু তাকিয়ে দেখল শান বাঁধানো জায়গাটায় কে যেন একটা বসে আছে। চিৎকার করে দিদিকে বলতেই ঝুমা ভাইয়ের হাত ধরে প্রাণপ্রনে ছুটতে লাগল। তারা কবরস্থানে পৌঁছিয়ে গেল, কিন্তু ঝড় যেন তাদের পিছু ছাড়ছে না। এমনসময় একটা কবরের গর্তের মধ্যে ঝন্টুর পা গেল আটকে। ঝন্টু ভয়ে উঠল কেঁদে। ঝুমা দেখল ভয়ানক কিছুর ভয়ে তারা রাস্তা ছেড়ে কবরের মধ্যে দিয়ে দৌড়াচ্ছিল। ভাইকে ধরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে টানতে লাগল তবুও ঝন্টুর পা বার করা গেল না। বাইরে কোনো জনপ্রাণী নেই যে এই আতঙ্কিত, ভীত ভাইবোনকে সাহায্য করবে। ঝুমা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল – “আর আসবো না কোনোদিন, এবারের মত ক্ষমা করে দাও ।” প্রচুর টানাটানি আর কান্নাকাটির পর ঝন্টুর পা বেড়িয়ে এলো। কোনরকমে ভাইকে তুলে বুকের মধ্যে ধরে কবরস্থান পেরোতেই দেখে বাড়ি থেকে মা বাবা দাদু ছুটে আসছে সেদিকে। দুজন গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল – আর কক্ষণো আসবো না মা। তাদের আঁচলে জড়িয়ে মা বাড়ি নিয়ে গেল। তারপর থেকে ভয়ে তারা আর ওদিকটা মারায় না।