Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভবিষ্য পুরাণ || Prithviraj Sen » Page 5

ভবিষ্য পুরাণ || Prithviraj Sen

শকদের অত্যাচারে ভারতবর্ষকে রক্ষা করার জন্য এক রাজার আবির্ভাব হল। তার নাম বিক্রমাদিত্য। তিনি শুধুমাত্র তেজস্বী রাজা নন, বুদ্ধিমান এবং সূক্ষ্ম বিচারে দক্ষ।

ইন্দ্রের আদেশে একজন অস্পরা বীরমণি নামে মানবীরূপে গন্ধর্বসেনকে বিয়ে করে মর্ত্যে ঘর সংসার করছে। সেই বীরমতির একটি পুত্রসন্তান জন্ম নিল। সেই সময় তার মাথায় স্বর্গ থেকে। পুষ্পবৃষ্টি হওয়ার ফলে তার নাম রাখা হল শিববৃষ্টি। বাল্যকালেই শিববৃষ্টি বনে গিয়ে শিবের তপস্যায় মগ্ন হল। ক্রমে ক্রমে মহাযোগী হয়ে সে নিজেই শিব হয়ে গেল।

পরজন্মে শিববৃষ্টি বিক্রমাদিত্য নামে জন্মগ্রহণ করলেন। তিনি পাঁচ বছর বয়সে বনে গেলেন তপস্যার জন্য। তিনি বারো বছর। কঠোর পরিশ্রম করলেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে বরদান করলেন। বিক্রমাদিত্য শিববরে বলীয়ান এবং মহাজ্ঞানী হলেন। এরপর রাজ্যে ফিরে রাজ্যভার গ্রহণ করলেন। শিব বত্রিশটি পুতুল দিয়ে তৈরী একটি অপূর্ব সিংহাসন তাকে দিলেন। সেই সিংহাসনে বসে তিনি রাজ্য পরিচালনা করতেন। পার্বতীর আদেশে বেতালরা সকলের অলক্ষ্যে তাঁকে ঘিরে থাকত, যাতে কেউ তাঁর কোন ক্ষতি করতে না পারে।

উমার সঙ্গে মহাকালেশ্বর শিবের পূজা করতে গিয়ে বিক্রমাদিত্য সেখানে একটি সুন্দর প্রাসাদ তৈরী করালেন। প্রচুর মণি-মাণিক্য খচিত সেই প্রাসাদ। শিবের প্রদত্ত সিংহাসন এনে তিনি সেই প্রাসাদে স্থাপন করলেন। সেই সিংহাসনে বসে তিনি ধর্মকথা আলোচনা করতেন। দেশের বিভিন্ন স্থানের পণ্ডিতরা সেই ধর্মসভায় আসতেন।

এই ধর্মসভা চালকালীন একদিন এক ব্রাহ্মণ সেখানে এলেন। ব্রাহ্মণকে খুব সমাদর করে রাজা সেখানে বসালেন।

আসলে এক বেতাল বিক্রমাদিত্যের ধর্মবুদ্ধির পরীক্ষা নেবার জন্যই এই ব্রাহ্মণের বেশ ধরে এসেছিলেন। রাজা কিন্তু তাঁকে ব্রাহ্মণ বলেই জানতেন।

ব্রাহ্মণরূপী বেতাল বলল–রাজমশাই, আমি আপনাকে একটি পুরানো ইতিহাস বলব, আপনি মন দিয়ে শুনুন।

শিবের মহাপবিত্রধান হল বারাণসী। বারাণসীর রাজার নাম ছিল প্রতাপমুকুট। রানি মহাদেবী। বজ্রমুকুট ছিল তাদের পুত্র। আর মন্ত্রীপুত্রের নাম বুদ্ধিদক্ষ। বজ্রমুকুট আর বুদ্ধিদক্ষের মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। একদিন বজ্রমুকুট বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চলে শিকারে চলল। শিকারের পর দুজনেই খুব ক্লান্ত, একটু বিশ্রাম দরকার। একটু খোঁজার পর তারা এক শিবালয় দেখতে পেল। তারা সেখানে গেল।

সেই শিবালয়ের পাশে এক সরোবর ছিল, তার ধারে বসল তারা। সেখানে তারা সুন্দরী সহচারী পরিবৃতা এক অপরূপা মেয়েকে দেখতে পেল। মেয়েটির রূপে বজ্রমুকুট মুগ্ধ হল।

সেই মেয়েটির মাথায় একটি পদ্মফুল ছিল। খোঁপা থেকে পদ্মফুলটিকে বের করে মেয়েটি কানে লাগাল, তারপর পায়ে ঠেকাল, দাঁত দিয়ে একটু কাটল। তারপর নিজের বুকের উপর ফুলটিকে চেপে ধরল। তারপর সেখান থেকে চলে গেল।

বজ্রমুকুট একদৃষ্টে মেয়েটিকে এইভাবে তাকিয়ে দেখল। তারপর বজ্রমুকুট রাজপ্রাসাদে চলে এল। মেয়েটিকে দেখার পর থেকে চঞ্চল হয়ে উঠেছে তার মন। তার মুখে হাসি নেই, বন্ধুদের সাথে খেলা নেই। আহার পর্যন্ত ত্যাগ করল। সকলেই চিন্তায় পড়লেন। শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিদক্ষ অনেক বুঝিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসল কারণটা জানতে পারল।

তারপর রাজপুত্রকে বুদ্ধিদক্ষ বলল–যাকে দেখে তোমার মন চঞ্চল হয়েছে, সেই মেয়েটি কর্ণাটকের রাজা দন্তবক্রের কন্যা। তার নাম পদ্মাবতী। তার সঙ্গে তোমার কিভাবে মিলন হরে তাই ভাবছি। খুব কষ্টকর হবে বলে মনে হয়।

তারপর রাজা প্রতাপমুকুটের কাছে গিয়ে বুদ্ধিদক্ষ আসল কথা গোপন করে বলল–একটা কঠিন অসুখ হয়েছে বজ্রমুকুটের তার আহার ত্যাগ করেছে। ওর এই অসুখ সারাতে হলে কর্ণাটকে চিকিৎসা করতে হবে। আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে কর্ণাটকে নিয়ে গিয়ে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো আমি।

রাজা প্রতাপমুকুট বুদ্ধিদক্ষের কথা শুনে তাকে বললেন–আরো লোকজন সঙ্গে নিতে। বুদ্ধিদক্ষ বলল–বেশি লোক গেলে অসুবিধা হবে। আমরা দুজনে দুটি ঘোড়ায় চড়ে সেখানে চলে যাব।

এইভাবে কৌশলে রাজার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারা কর্ণাটকের উদ্দেশে রওনা হল। সন্ধ্যার সময় তারা কর্ণাটকে উপস্থিত হল। এক বৃদ্ধের বাড়িতে তারা রাতে আশ্রয় নিল। সেই বৃদ্ধা ছিল রাজবাড়ীর দাসী। বৃদ্ধার মন জয় করার জন্য প্রচুর ধন দিয়ে তাকে খুশী করে, ‘মা’ সম্বোধন করে ডাকতে লাগল। রাত কেটে গেল।

পরের দিন সকালে যখন রাজবাড়ির উদ্দেশে রওনা হল তখন বুদ্ধিদক্ষ তাকে বলল– মা, তোমাকে আমাদের জন্য একটি কাজ করতে হবে। রাজকন্যা পদ্মাবতাঁকে গোপনে বলবে যে, রাজকুমারের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল সে তোমার বাড়িতে আছে।

বৃদ্ধ তাদের কাছে থেকে প্রচুর অর্থ পেয়েছে। তার উপর ‘মা’ ডাক শুনে আর ‘না’ বলতে পারে না। গোপনে সে রাজকন্যাকে সব কথা বলল। রাজকন্যা মুখে কিছু না বলে ইঙ্গিতে তার অন্তরের কথা জানিয়ে দিল। সে নিজের উরু থাবড়ে যেন চীৎকার করে উঠল–যা…যা তারপর নিজের আঙ্গুল কপালে ঠেকিয়ে প্রায় দূর করে দিল বুড়িকে।

রাজকন্যার হেঁয়ালি কিছুই বুঝতে পারল না মূর্খ বুড়ি। তারপর বাড়িতে এসে যা যা করল এবং বলল, অবিকল তেমনি জানিয়ে দিল মন্ত্রিপুত্রকে।

বুড়ির কথা শুনে রাজপুত্রের মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু মন্ত্রিপুত্র রাজকন্যার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে হেসে, বন্ধুকে বলল–আর তিনটি দিন অপেক্ষা করো বন্ধু। তোমার মনোবাসনা সিদ্ধ হবে।

তিন দিন কেটে যাবার পর চতুর্থ দিন বুড়িকে রাজপ্রাসাদে যেতে দেখে বুদ্ধিদক্ষ বলল–মা, গোপনে তুমি রাজকন্যাকে বলবে যে, তাকে দেখবার জন্য রাজকুমার একেবারে ব্যাকুল।

বুড়ি ফিরে এসে রাজকন্যার সংকেত জানিয়ে দিল। বজ্রমুকুটের সেই সংকেত বোঝার মত বুদ্ধি নেই। কিন্তু বুদ্ধিমান বুদ্ধিদক্ষ রাজকন্যার ইঙ্গিত বুঝতে পারল। তারপর রাজপুত্রের যা করণীয়, সব বুঝিয়ে বলে দিল।

গভীর রাতে রাজপুত্র রাজপ্রাসাদের পশ্চিম দিকে যেতেই এক দাসী এসে তাকে একেবারে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। রাজকন্যার সঙ্গে নিভৃতে মিলন ঘটল রাজকুমারের।

এক এক করে তিরিশ দিন, কেটে গেল। বজ্রমুকুট পদ্মাবতাঁকে বলল–আমার একবার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা দরকার। তার বুদ্ধির জন্যই আমি তোমাকে পেয়েছি। প্রথম দিন থেকে তোমার হেঁয়ালি আমি বুঝতে পারিনি। ওই বন্ধুই তোমার হেঁয়ালি বুঝে আমাকে এভাবে তোমার কাছে পাঠিয়েছে।

এই কথা শুনে পদ্মাবতী বলল–এতদিন আমাকে তোমার বুদ্ধিমান বন্ধুর কথা বলনি কেন? একজন উপকারী বন্ধুর সঙ্গে খালি হাতে দেখা করতে যাওয়া উচিত নয়। আমি নিজের হাতে তার জন্য কিছু মিষ্টি তৈরী করে দিচ্ছি। তুমি নিয়ে যাও।

বজ্রমুকুট খুব খুশি হয়ে পদ্মাবতীর দেওয়া মিষ্টি নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বুড়ির বাড়িতে এল। অনেক দিন পরে দুই বন্ধুর দেখা হল, কথা হল। রাজপুত্র বন্ধকে মিষ্টি খেতে দিল, কিন্তু বন্ধু মিষ্টি না খেয়ে ফেলে রাখল। তারপর রাজপুত্রের পীড়া পীড়িতে বুদ্ধিদক্ষ সেই মিষ্টি না খেয়ে রাস্তায় ফেলে দিল।

.

বুদ্ধিদক্ষের ব্যবহারে রাজপুত্র রেগে গিয়ে বলল–আমি রাজপুত্র, তোমার সম্মানীয়। আমি যাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে যাচ্ছি, সেও তোমার সন্মানীয়া। তার পাঠান মিষ্টি এভাবে তুমি ফেলে দিলে?

রাজপুত্র রাগে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে বুদ্ধিদক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই সময়েই দেখা গেল, একটি কুকুর এসে সেই মিষ্টিগুলি যেই খেয়েছে, অমনি সঙ্গে সঙ্গেই ছটফট করতে করতে কুকুরটি মারা গেল।

এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল রাজপুত্র। বন্ধুকে আর কিছু বলার থাকল না। রাজকন্যার চাতুরী সে বুঝতে পেরেছে।

তারপর বুদ্ধিদক্ষ বলল–বন্ধু, দেখলে তো, মিষ্টিতে বিষ দেওয়ার কারণ কি?

রাজপুত্র লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারছে না। বন্ধুর হাত ধরে বলল–আর নয় খুব হয়েছে, চল আমরা এখান থেকে চলে যাই। তা না হলে আমাদের দুজনকেই ঐ পিশাচীনির হাতে মরতে হবে।

বুদ্ধিদক্ষ বলল–না, আমরা চলে যাব না। দুষ্টের সাজা হওয়ার দরকার। তুমি আবার রাজকন্যার কাছে গিয়ে গোপনে তার একটি অলঙ্কার নিয়ে আসবে। যেন সে জানতে না পারে। একটি ছোট ত্রিশূলের দাগ তার জানুতে দিয়ে আসবে।

বুদ্ধিদক্ষের কথামতো রাজপুত্র সব কাজ করল। রাজকন্যার অলঙ্কার বন্ধুর হাতে দিল। তারপর দুজনেই ছদ্মবেশ ধরল। মন্ত্রীপুত্র যোগীর বেশ ধরে ত্রিশূল হাতে রুদ্রমণ্ডল শ্মশানে এসে যোগ সাধনায় বসল, রাজপুত্র হল তার চেলা। রাজকন্যার অলঙ্কারটি নিয়ে সে রাজারে বেচতে গেল। রাজবাড়ির গহনা চুরি হওয়ার কথা সর্বত্র জানাজানি হয়ে গেছে। বেচতে গিয়ে ছদ্মবেশী রাজপুত্র ধরা পড়ল। তাকে নিয়ে যাওয়া হল রাজার কাছে বিচারের জন্য।

রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করল যে, সে এই অলঙ্কার কোথায় পেয়েছে।

বজ্রমুকুট বলল যে, তার মহাযোগী গুরুদেব এটি তাকে দিয়েছে বিক্রি করার জন্য। তিনি এখন রুদ্রমণ্ডল শ্মশানে যোগসাধনায় রত আছেন।

ধরে আনা হল ছদ্মবেশী বুদ্ধিদক্ষকে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলল–গত রাত্রে এক পিশাচিনি তার কাছে এসেছিল। আমাকে সে এই অলঙ্কার দিয়ে বশ করতে চেয়েছিল। তার জানুতে আমার হাতের এই ত্রিশুল দিয়ে দাগ এঁকে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে পালিয়ে গেছে।

তার রাজ্যে পিশাচী। সর্বনাশ! মহা চিন্তায় পড়লেন দন্তবক্র। তাকে খুঁজে বার করার জন্য সারা রাজ্যে তল্লাসী চলল। কারুর জানুতে ত্রিশুলের চিহ্ন পাওয়া গেল না। শেষে রাজবাড়িতে খোঁজ নেওয়া হল। রাজকন্যার জানুতে ত্রিশূলের খোঁজ পাওয়া গেল। রাজা বুঝলেন পদ্মাবতী সেই পিশাচী বিচারে তিনি কঠোর। ক্ষমা করলেন না নিজের কন্যাকে। রাজ্য থেকে বের করে দিলেন পদ্মাবতাঁকে।

বিক্রমাদিত্যকে বেতাল এই কাহিনি শুনিয়ে বলল–মহারাজ, বলুন তো, এই কাহিনিতে ধর্মত সবচেয়ে বেশী পিপ কে করেছে?

বেতালের প্রশ্নের উত্তরে বিক্রমাদিত্য বললেন–ধর্মের বিচারে রাজা দন্তচক্র সবচেয়ে বেশি পাপ করেছে। রাজপুত্র বজ্রমুকুটের কোনো অপরাধ নেই। যথার্থই বন্ধুর কাজ করেছে মন্ত্রীপুত্র বুদ্ধিদক্ষ। কিন্তু রাজা দন্তচক্র! তার মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত, যথাসময়ে মেয়ের যে বিয়ে না দেয়, সে হয় মহাপাপী।

বিক্রমাদিত্যের উত্তর শুনে ব্রাহ্মণবেশী বেতাল খুশি হল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *