Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ব্যোমকেশ ও বরদা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 7

ব্যোমকেশ ও বরদা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

শশাঙ্কবাবু বোধহয় মনে মনে ব্যোমকেশ সম্বন্ধে হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন; তাই সেদিন কৈলাসবাবুর বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসার পর হইতে হত্যার প্রসঙ্গ আর ব্যোমকেশের সম্মুখে উত্থাপিত করেন নাই। তাছাড়া হঠাৎ তাঁহার অফিসে কাজের চাপ পড়িয়াছিল‌, পূজার ছুটির প্রাক্কালে অবকাশেরও অভাব ঘটিয়াছিল।

অতঃপর দুই তিনদিন আমরা শহরে ও শহরের বাহিরে যত্র তত্র পরিভ্রমণ করিয়া কাটাইয়া দিলাম। স্থানটি অতি প্রাচীন‌, জরাসন্ধের আমল হইতে ক্লাইভের সময় পর্যন্ত বহু কিম্বদন্তী ও ইতিবৃত্ত তাহাকে কেন্দ্ৰ করিয়া জমা হইয়াছে। পুরাবৃত্তের দিকে যাঁহাদের ঝোঁক আছে তাঁহাদের কাছে স্থানটি পরম লোভনীয়।

এই সব দেখিতে দেখিতে ব্যোমকেশ যেন হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলিয়াই গিয়াছিল। শুধু প্ৰত্যহ সন্ধ্যাকালে সে কৈলাসবাবুর বাসায় গিয়া জুটিত এবং নানাভাবে তাঁহাকে বাড়ি ছাড়িবার জন্য প্ররোচিত করিত। তাহার সুকৌশল বাক্য-বিন্যাসের ফলও ফলিয়ছিল‌, কৈলাসবাবু নিমরাজী হইয়া আসিয়াছিলেন।

শেষে সপ্তাহখানেক পরে তিনি সম্মত হইয়া গেলেন। কেল্লার বাহিরে একখানা ভাল বাড়ি পাওয়া গিয়াছিল‌, আগামী রবিবারে তিনি সেখানে উঠিয়া যাইবেন স্থির হইল।

।রবিবার প্রভাতে চা খাইতে খাইতে ব্যোমকেশ বলিল‌, শশাঙ্ক‌, এবার আমাদের তলপি তুলতে হবে। অনেকদিন হয়ে গেল।’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘এরি মধ্যে! আর দুদিন থেকে যাও না। কলকাতায় তোমার কোনো জরুরী কোজ নেই তো।’ তাঁহার কথাগুলি শিষ্টতাসম্মত হইলেও কণ্ঠস্বর নিরুৎসুক হইয়া রহিল।

ব্যোমকেশ উত্তরে বলিল‌, ‘তা হয়তো নেই। কিন্তু তবু কাজের প্রত্যাশায় দোকান সাজিয়ে বসে থাকতে হবে তো।’

‘তা বটে। কবে যাবে মনে করছি?’

‘আজই। তোমার এখানে ক’দিন ভারি। আনন্দে কাটল–অনেকদিন মনে থাকবে।’

‘আজই? তা–তোমাদের যাতে সুবিধা হয়—’ শশাঙ্করাবু কিয়ৎকাল বাহিরের দিকে তাকাইয়া রহিলেন‌, তারপর একটু বিরসস্বরে কহিলেন‌, ‘সে ব্যাপারটার কিছুই হল না। জটিল ব্যাপার তাতে সন্দেহ নেই; তবু ভেবেছিলুম‌, তোমার যে রকম নাম-ডাক হয়তো কিছু করতে পারবে।’

‘কোন ব্যাপারের কথা বলছ?’

‘বৈকুণ্ঠবাবর খুনের ব্যাপার। কথাটা ভুলেই গেলে নাকি?’

‘ও-না ভুলিনি। কিন্তু তাতে জানবার কিছু নেই।’

‘কিছু নেই! তার মানে? তুমি সব জেনে ফেলেছি নাকি?’

‘তা-একরকম জেনেছি বৈ কি।’

‘সে কি! তোমার কথা তো ঠিক বুঝতে পারছি না।’ শশাঙ্কবাবু ঘুরিয়া বসিলেন।

ব্যোমকেশ ঈষৎ বিস্ময়ের সহিত বলিল‌, ‘কোন-বৈকুণ্ঠবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে যা কিছু জানবার ছিল তা তো অনেকদিন আগেই জানতে পেরেছি–তা নিয়ে এখন মাথা ঘামাবার প্রয়োজন কি?’

শশাঙ্কবাবু স্তম্ভিতভাবে তাকাইয়া রহিলেন—‘কিন্তু–অনেকদিন আগেই জানতে পেরেছ—কি বলছ তুমি? বৈকুণ্ঠবাবুর হত্যাকারী কে তা জানতে পেরেছ?’

‘সে তো গত রবিবারই জানা গেছে।’

‘তবে-তাবে-এতদিন আমায় বলনি কেন?’

ব্যোমকেশ একটু হাসিল–’ভাই‌, তোমার ভাবগতিক দেখে আমার মনে হয়েছিল যে পুলিস আমার সাহায্য নিতে চায় না; বাংলাদেশে আমরা যে-প্রথায় কাজ করি সে-প্ৰথা তোমাদের কাছে একেবারে হাস্যকর‌, আঙুলের টিপ এবং ছেড়া কাগজের প্রতি তোমাদের অশ্রদ্ধার অন্ত নেই। তাই আর আমি উপযাচক হয়ে কিছু বলতে চাইনি। লোমহর্ষণ উপন্যাস মনে করে তোমরা সমস্ত পুলিস-সম্প্রদায় যদি একসঙ্গে অট্টহাস্য শুরু করে দাও—তাহলে আমার পক্ষে সেটা কি রকম সাংঘাতিক হয়ে উঠবে একবার ভেবে দ্যাখো।’

শশাঙ্কবাবু ঢোক গিলিলেন—‘কিন্তু–আমাকে তো ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারতে। আমি তো তোমার বন্ধু! সে যাক‌, এখন কি জানতে পেরেছ শুনি।’ বলিয়া তিনি ব্যোমকেশের সম্মুখে চেয়ার টানিয়া বসিলেন।

ব্যোমকেশ চুপ করিয়া রহিল।

‘কে খুন করেছে? তাকে আমরা চিনি?’

ব্যোমকেশ মৃদু হাসিল।

তাহার উরুর উপর হাত রাখিয়া প্ৰায় অনুনয়ের কণ্ঠে শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘সত্যি বল ব্যোমকেশ‌, কে করেছে?’

‘ভূত।’

শশাঙ্কবাবু বিমূঢ় হইয়া গেলেন‌, কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন‌, ‘ঠাট্টা করছ নাকি! ভুতে খুন করেছে?’

‘অর্থাৎ-হ্যাঁ‌, তাই বটে।’

অধীর স্বরে শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘যা বলতে চাও পরিষ্কার করে বল ব্যোমকেশ। যদি তোমার সত্যি সত্যি বিশ্বাস হয়ে থাকে যে ভুতে খুন করেছে—তাহলে—’ তিনি হতাশভাবে হাত উল্টাইলেন।

ব্যোমকেশ হাসিয়া ফেলিল। তারপর উঠিয়া বারান্দায় একবার পায়চারি করিয়া বলিল‌, ‘সব কথা তোমাকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে হলে আজ আমার যাওয়া হয় না।–রাত্রিটা থাকতে হয়। আসামীকে তোমার হাতে সমর্পণ না করে দিলে তুমি বুঝবে না। আজ কৈলাসবাবু বাড়ি বদল করবেন; সুতরাং আশা করা যায় আজ রাত্রেই আসামী ধরা পড়বে।’ একটু থামিয়া বলিল‌, ‘আর কিছু নয়‌, বৈকুণ্ঠবাবুর মেয়ের জন্যই দুঃখ হয়। —যাক‌, এখন কি করতে হবে বলি শোনো।’

আশ্বিন মাস‌, দিন ছোট হইতে আরম্ভ করিয়াছে। ছ’টার মধ্যে সন্ধ্যা হয় এবং নয়টা বাজিতে না বাজিতে কেল্লার অধিবাসিবৃন্দ নিদ্ৰালু হইয়া শয্যা আশ্রয় করে। গত কয়েকদিনেই তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলাম।

সে-রত্রে নটা বাজিবার কিছু পূর্বে আমরা তিনজনে বাহির হইলাম’। ব্যোমকেশ একটা টর্চ সঙ্গে লইল‌, শশাঙ্কবাবু একজোড়া হাতকড়া পকেটে পুরিয়া লইলেন।

পথ নির্জন; আকাশে মেঘের সঞ্চার হইয়া অর্ধচন্দ্রকে ঢাকিয়া দিয়াছে। রাস্তার ধারে বহুদূর ব্যবধানে যে নিষ্প্রভ কেরাসিন-বাতি ল্যাম্পপোস্টের মাথায় জ্বলিতেছিল তাহা রাত্রির ঘনকৃষ্ণ অন্ধকারকে ঘোলাটে করিয়া দিয়াছে মাত্র। পথে জনমানবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল না।

কৈলাসবাবুর পরিত্যক্ত বাসার সম্মুখে গিয়া যখন পৌঁছিলাম তখন সরকারী খাজনাখানা হইতে নয়টার ঘণ্টা বাজিতেছে। শশাঙ্কবাবু এদিক ওদিক তাকাইয়া মৃদু শিস দিলেন; অন্ধকারের ভিতর হইতে একটা লোক বাহির হইয়া আসিল-তাহাকে দেখিতে পাইলাম না‌, অস্পষ্ট পদশব্দে বুঝিলাম। ব্যোমকেশ তাহাকে চুপি চুপি কি বলিল‌, সে আবার অন্তৰ্হিত হইয়া গেল।

আমরা সন্তৰ্পণে বাড়িতে প্রবেশ করিলাম। শূন্য বাড়ি‌, দরজা জানোলা সব খোলা—কোথাও একটা আলো জ্বলিতেছে না। প্রাণহীন শবের মত বাড়িখানা যেন নিষ্পন্দ হইয়া আছে।

পা টিপিয়া টিপিয়া উপরে উঠিয়া গেলাম। কৈলাসবাবুর ঘরের সম্মুখে ব্যোমকেশ একবার দাঁড়াইল‌, তারপর ঘরে প্রবেশ করিয়া টর্চ জ্বলিয়া ঘরের চারিদিকে ফিরাইল। ঘর শূন্য-খাট বিছানা যাহা ছিল কৈলাসবাবুর সঙ্গে সমস্তই স্থানান্তরিত হইয়াছে। খোলা জানালা-পথে গঙ্গার ঠাণ্ডা বাতাস নিরাভরণ ঘরে প্রবেশ করিতেছে।

দরজা ভেজাইয়া ব্যোমকেশ টর্চ নিবাইয়া দিল। তারপর মেঝেয় উপবেশন করিয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল‌, ‘বোসো তোমরা। কতক্ষণ প্রতীক্ষা করতে হবে কিছু ঠিক নেই‌, হয়তো রাত্রি তিনটে পর্যন্ত এইভাবে বসে থাকতে হবে। —অজিত‌, আমি টর্চ জ্বললেই তুমি গিয়ে জানালা আগলে দাঁড়াবে; আর শশাঙ্ক‌, তুমি পুলিসের কর্তব্য করবে—অর্থাৎ প্রেত্যকে প্ৰাণপণে চেপে ধরবে।’

অতঃপর অন্ধকারে বসিয়া আমাদের পাহারা আরম্ভ হইল। চুপচাপ তিনজনে বসিয়া আছি‌, নড়ন-চড়ন নাই; নড়িলে বা একটু শব্দ করিলে ব্যোমকেশ বিরক্তি প্ৰকাশ করিতেছে। সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিয়া যে সময়ের অস্ত্যেষ্টি করিব তাহারও উপায় নাই‌, গন্ধ পাইলে শিকার ভড়কাইয়া যাইবে। বসিয়া বসিয়া আর এক রাত্রির দীর্ঘ প্রতীক্ষা মনে পড়িল‌, চোরাবালির ভাঙা কুঁড়ে ঘরে অজানার উদ্দেশ্যে সেই সংশয়পূর্ণ জাগরণ। আজকার রাত্রিও কি তেমনি অভাবনীয় পরিসমাপ্তির দিকে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে?

খাজনাখানার ঘড়ি দুইবার প্রহর জানাইল—এগারোটা বাজিয়া গেল। তিনি কখন আসিবেন তাহার স্থিরতা নাই; এদিকে চোখের পাতা ভারী হইয়া আসিতেছে।

এই তো কলির সন্ধ্যা-ভাবিতে ভাবিতে একটা অদম্য হাই তুলিবার জন্য হ্যাঁ করিয়াছি‌, হঠাৎ ব্যোমকেশ সাঁড়াশির মত আঙুল দিয়া আমার উরু চাপিয়া ধরিল। হাই অর্ধপথে হেঁচক লাগিয়া থামিয়া গেল।

জানালার কাছে শব্দ। চোখে কিছুই দেখিলাম না‌, কেবল একটা অস্পষ্ট অতি লঘু শব্দ শ্রবণেন্দ্ৰিয়াকে স্পর্শ করিয়া গেল। তারপর আর কোনো সাড়া নাই। নিশ্বাস রোধ করিয়া শুনিতে চেষ্টা করিলাম‌, বাহিরে কিছুই শুনিতে পাইলাম না-শুধু নিজের বুকের মধ্যে দুন্দুভির মত একটা আওয়াজ ক্রমে প্ৰবলতর হইয়া উঠিতে লাগিল।

সহসা আমাদের খুব কাছে‌, ঘরের মেঝের উপর পা ঘষিয়া চলার মত খসখস শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম। একজন ঘরে প্রবেশ করিয়াছে‌, আমাদের দুই হাত অন্তরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।–অথচ তাহাকে দেখিতে পাইতেছি না। সে কি আমাদের অস্তিত্ব জানিতে পারিয়াছে? কে সে? এবার কি করিবে? আমার মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়া একটা ঠাণ্ডা শিহরণ বহিয়া গেল।

প্ৰভাতের সূর্যরশ্মি যেমন ছিদ্রপথে বদ্ধদ্বার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে‌, তেমনি সূক্ষ্ম আলোর রেখা ঘরের মধ্যস্থলে জন্মলাভ করিয়া আমাদের সম্মুখের দেয়াল স্পর্শ করিল। অতি ক্ষীণ আলো কিন্তু তাহাতেই মনে হইল যেন ঘর উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। দেখিলাম একটা দীঘকূিতি কালো মূর্তি আমাদের দিকে পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং তাঁহারই হস্তস্থিত ক্ষুদ্র টর্চের আলো যেন দেয়ালের গায়ে কি অন্বেষণ করিতেছে।

কৃষ্ণ মূর্তিটা ক্ৰমে দেয়ালের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল; অত্যন্ত অভিনিবেশ সহকারে দেয়ালের সাদা চুনকাম পরীক্ষা করিতে লাগিল। তাহার গলা দিয়া একটা অব্যক্ত আওয়াজ বাহির হইল‌, যেন যাহা খুঁজিতেছিল। তাহা সে পাইয়াছে।

এই সময় ব্যোমকেশের হাতের টর্চ জুলিয়া উঠিল। তীব্র আলোকে ক্ষণকালের জন্য চক্ষু ধাঁধিয়া গেল। তারপর আমি ছুটিয়া গিয়া জানালার সম্মুখে দাঁড়াইলাম।

আগন্তুকও তড়িৎবেগে ফিরিয়া চোখের সম্মুখে হাত তুলিয়া ধরিয়াছিল‌, তাহার মুখখানা প্রথমে দেখিতে পাইলাম না। তারপর মুহুর্তমধ্যে অনেকগুলা ঘটনা প্ৰায় একসঙ্গে ঘটিয়া গেল। আগস্তুক বাঘের মত আমার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িল‌, শশাঙ্কবাবু তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনজনে জাপটা-জাপটি করিয়া ভূমিসাৎ হইলাম।

ঝুটোপুটি ধস্তাধস্তি কিন্তু থামিল না। শশাঙ্কবাবু্‌, আগন্তুককে কুস্তিগিরের মত মাটিতে চিৎ করিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলেন; আগন্তুক তাঁহার স্কন্ধে সজোরে কামড়াইয়া দিয়া এক লাফে উঠিয়া দাঁড়াইল। শশাঙ্কবাবু্‌, কিন্তু ছাড়িবার পাত্র নন‌, তিনি তাহার পা জড়াইয়া ধরিলেন। আগন্তুক তাঁহাকে ঝাড়িয়া ফেলিতে পারিল না; তদাবস্থায় টানিতে টানিতে জানালার দিকে অগ্রসর হইল। এই সময় টর্চের আলোয় তাহার বিকৃত বীভৎস রং-করা মুখখানা দেখিতে পাইলাম। প্ৰেতাত্মাই বটে।

ব্যোমকেশ শান্ত সহজ সুরে বলিল, ‘শৈলেনবাবু, জানালা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে কেবল দুঃখই পাবেন। আপনার রণ-পা ওখানে নেই‌, তার বদলে জমাদার ভানুপ্ৰতাপ সিং সদলবলে জানালার নীচে অপেক্ষা করছেন।’ তারপর গলা চড়াইয়া হাঁকিল‌, ‘জমাদারসাহেব‌, উপর আইয়ে।’

সেই বিকট মুখ আবার ঘরের দিকে ফিরিল। শৈলেনবাবু! আমাদের নিরীহ শৈলেনবাবু-এই! বিস্ময়ে মনটা যেন অসাড় হইয়া গেল।

শৈলেনবাবুর বিকৃত মুখের পৈশাচিক ক্ষুধিত চক্ষু দুটা ব্যোমকেশের দিকে ক্ষণেক বিস্ফারিত হইয়া রহিল‌, দাঁতগুলা একবার হিংস্ৰ শ্বাপদের মত বাহির করিলেন‌, যেন কি বলিবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু মুখ দিয়া একটা গোঙানির মত শব্দ বাহির হইল মাত্র। তারপর সহসা শিথিল দেহে তিনি সেইখানেই বসিয়া পড়িলেন।

শশাঙ্কবাবু তাঁহার পা ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলে ব্যোমকেশ বলিল‌, শশাঙ্ক‌, শৈলেনবাবুকে তুমি চেনো বটে কিন্তু ওঁর সব পরিচয় বোধহয় জান না। কাঁধ দিয়ে রক্ত পড়ছে দেখছি; ও কিছু নয়‌, টিনচার আয়োডিন লাগালেই সেরে যাবে। তাছাড়া‌, পুলিসের অধিকার যখন গ্ৰহণ করেছ তখন তার আনুষঙ্গিক ফলভোগ করতে হবে বই কি। সে যাক‌, শৈলেনবাবুর আসল পরিচয়টা দিই। উনি হচ্ছেন সার্কাসের একজন নামজাদা জিমনাস্টিক খেলোয়াড় এবং বৈকুণ্ঠবাবুর নিরুদ্দিষ্ট জামাতা। সুতরাং উনি যদি তোমার ঘাড়ে কামড়ে দিয়েই থাকেন তাহলে তুমি সেটাকে জামাইবাবুর রসিকতা বলে ধরে নিতে পার।’

শশাঙ্কবাবু কিন্তু রসিকতা বলিয়া মনে করিলেন না; গলার মধ্যে একটা নাতি-উচ্চ গর্জন করিয়া জামাইবাবুর প্রকোষ্ঠে হাতকড়া পরাইলেন এবং জমাদার ভানুপ্ৰতাপ সিং সেই সময়ে তাহার বিরাট গালপাট্টা ও চৌগোঁফা লইয়া ঘরের মধ্যে আসিয়া স্যালুট করিয়া দাঁড়াইল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress